৯০ তম জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
সুচিত্রা মিত্র: সু ধা কণ্ঠে সুধাগীত
আবদুল্লাহ আল আমিন
আজ থেকে তিয়াত্তর বছর আগে রবীন্দ্রনাথ তখন সদ্য প্রয়াত হয়েছেন, উত্তরায়ণ শূন্য। তবু তার অলৌকিক উপস্থিতিতে আচ্ছন্ন চারদিক। শান্তিনিকেতন তখন তরু ছায়াহীন প্রান্তরের এক ছোট্ট মরুদ্যান। বহুশাখায়িত একাডেমিক চর্চার পরিসরে বিশ্বভারতী একটি ছোট বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র তখনও। তারপরও অন্তরের ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ; নানা দেশের ধ্যানী-জ্ঞানী, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক,ভাবুক-রসিক,জ্ঞান সাধকের সরব উপস্থিতি প্রাণময়, আনন্দময়, সম্পর্কের নিবিড় বন্ধনে বাঁধা সমাজ। সেদিনের সেই শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন সঙ্গীতভবনের শিক্ষার্থী হয়ে সুচিত্রা মুখোপাধ্যায় নামে এক ছিপছিপে, সপ্রতিভ কিশোরী। রোগা মনে হলেও চোখেমুখে ছিল প্রাণের দীপ্তি ও বুদ্ধির প্রাখর্য। এই কিশোরীই এককালে হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী সুচিত্রা মিত্র। তার জন্ম ১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চলন্ত ট্রেনে। ট্রেন থামাতে হয়েছিল বিহারের শালবন ঘেরা অখ্যাত স্টেশন গুজুন্ডিতে। বাবা খ্যাতিমান সাহিত্যিক সৌরীন্দ্র মোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ঘনিষ্ঠজন। শৈশবেই গানের প্রতি আগ্রহ দেখে পিতৃবন্ধু পঙ্কজ মল্লিক তাকে গান শেখাতে শুরু করেন। সুচিত্রা পড়াশুনা করেন বেথুন স্কুল, স্কটিশ চার্চ কলেজ, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেথুন স্কুলে গান শেখেন অমিতা সেনের কাছে। সঙ্গীতশিক্ষায় স্কলারশিপ নিয়ে সুচিত্রা যখন শান্তিনিকেতনে এলেন , তার মাত্র বিশ দিন আগে রবীন্দ্রনাথ অমৃতলোকবাসী হয়েছেন। শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনে এসে সান্নিধ্য পেলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষের মত সঙ্গীতগুরু ও সাধকদের। এদের কাছেই রপ্ত করে নেন রবীন্দ্রনাথের গান ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। সুচিত্রা খুব অল্প সময়ের মধ্যে সর্বজন পরিচিত হয়ে ওঠেন। সে সময় শান্তিনিকেতনের চত্ত্বর জুড়েই চলছিল নক্ষত্র সমাবেশ। তার মধ্যে সবার উপরে ছিলেন সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দোপাধ্যায়; রবীন্দ্রনাথের ¯েœহধন্যা মোহর। আরও ছিলেন অরুন্ধতী গুহহঠাকুরতা, যিনি উত্তরকালে চলে যান চলচ্চিত্রে। আর সবার ওপরে ছিলেন চতুর্থ বর্ষের একঝাঁক ধ্যানী ও মেধাবী শিক্ষার্থী ,যাদের কেউ কেউ উত্তরকালে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিলেন। দিনকর কৌশিক, শিল্পী ও শিল্পরসজ্ঞ পৃথ্বিশ নিয়োগী, জয়া আপ্পাস্বামী, অস্কার জয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় প্রমুখের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে মুখর হয়ে থাকতো শিক্ষা, কলা, সঙ্গীতভবন। খাওয়াদাওয়া,গানবাজনা, আশ্রম পিকনিক, উৎসবে মেতে থাকতো সবাই। সবাইকে বৈতালিক গান গাইতে আসতে হত সঙ্গীতভবনে।‘ প্রাণের সঙ্গে প্রাণে/ সে যে মিলিয়েছে এক তানে/ভাইয়ের সঙ্গে ভাইকে সে যে করেছে এক মন’- আশ্রম সঙ্গীতের এই পঙক্তি তখন আক্ষরিক অর্থেই সত্য ছিল। তখন থেকেই সুচিত্রা মিত্র গান, আবৃত্তি, অভিনয় দিয়ে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন আশ্রমবাসীকে। তার সুরেলা কণ্ঠে অসামান্য,স্পষ্ট উচ্চারণ সহজেই মন কেড়ে নিত। তখন শান্তিনিকেতনের আশ্রমজীবনে কেবল সমবেত গান করার রেওয়াজ ছিল, তাই শোকে দুঃখে, আনন্দ উৎসবে কেবল সম্মেলক গানই পরিবেশিত হত। এর মধ্যেও সুচিত্রা নিজেকে আলাদা করে তুলে ধরতে সক্ষম হন, নানা মঞ্চের অনুষ্ঠানে। স্পষ্ট, শুদ্ধ উচ্চারণ; বলিষ্ঠ গায়ন ভঙ্গি সুচিত্রা মিত্রকে আলাদা করে চিনিয়ে দিতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। প্রথম জীবনে রবীন্দ্র সঙ্গীতে যে স্বকীয় ধারার ছাপ রাখেন সেই ধারাকেই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বহন করে নিয়ে গিয়েছেন তিনি সাধনা ও অনুশীলন দিয়ে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে যে ধারার শিল্পী হিসেবে সুচিত্রা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেই ধারার পথিকৃৎ ছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যার উত্তরসাধক শান্তিদেব ঘোষ এবং সফল উত্তরসূরি সুচিত্রা মিত্র। সুচিত্রা মনে করতেন, সুরের ঐশ্বর্য যতই থাক বাংলাগান মানে বাণী বা ভাবের ঐশবর্য-এ কথা মানতেই হবে। আর রবীন্দ্রনাথ সুরের সার্থকতা নয়, বাণীর কথা ভেবেই বলেছেন, সুখে দুখে বাঙালিকে তার গান গাইতেই হবে। রবীন্দ্রনাথের সেই মহার্ঘ উ্চ্চারণ সম্বন্ধে সুচিত্রা মিত্র ছিলেন গভীর সচেতন। তিনি যখন রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন তখন বাণীর মর্মভাবনা আত্মস্থ করে তা অনুভব ও উপলব্ধির ভিতরে এনে গাওয়ার চেষ্টা করতেন। তিনি গান গাইতেন বোধের জগৎ থেকে যেখানে শিল্প ও শিল্পী একাকার হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের গান যখন গাইতেন ,তখন মনে হত তিনি গান গাইছেন না,তিনি নিজের সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনার কথাই বলছেন। পূজার গানে যে আত্মনিবেদন তা অন্য কারো নয়, দুঃখের গানে যে মর্মবেদনা তা যেন তার নিজেরই। আর এখানেই তার স্বকীয়তা, অনন্যতা।
রবীন্দ্রনাথের বৈভবম-িত সৃষ্টিভুবনের সবচেয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ সৃষ্টি তার গান। সুচিত্রার গানে পাওয়া যায় তারই পারফেক্ট রূপ। তিনি রবীন্দ্রনাথের গান কেবল কণ্ঠ দিয়ে গাইতেন না, গাইতেন হৃদয় দিয়ে। তিনি উপলব্ধি,জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব দিয়ে তৈরি করতেন গানের বৃত্ত। চল্লিশের দশকে সুচিত্র মিত্র যোগ দেন গণনাট্য আন্দোলনে আইপিটিএ’র সক্রিয় সদস্য হিসেবে। এখানেই তার সখ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিনয় রায়, সলিল চৌধুরীর মতো খ্যাতিমানদের সাথে। আইপিটিএ’র সাথে প্রত্যক্ষ সুযোগের সূত্রে তিনি পেয়ে যান সাধারণ মানুষের মধ্যে গান ছড়িয়ে দেয়ার অপূর্ব সুযোগ। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক শিল্পী, তাই সবখানে ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ, তা সে ঘরোয়া আসর হোক কিংবা হাজার হাজার শ্রোতার গানের মজলিস হোক। রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে এমন এক অমৃতের খোঁজ পেয়েছিলেন তিনি, যা তার গায়ন পদ্ধতি ও ভঙ্গিকে সমৃদ্ধ করেনি, তার জীবনে এনে দিয়েছে বলিষ্ঠতা ও সমৃদ্ধি। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন, ‘ আমার তো মনে হয় বাঁচার যে আগ্রহ, এই যে বিপদকে ভয় না করার যে শিক্ষা, জীবনকে নৈরাশ্যেও সুরে ভারাক্রান্ত না করে তোলা, এই যে আলো বাতাস, আকাশ মাটি এ সবই যেন একান্ত াাপনার মনে হওয়া-এ শিক্ষা গুরুদেবের গানের মধ্য দিয়েই পেয়েছি। জীবনে এর চেয়ে বড় মন্ত্র, বড় আনন্দ আমার আর নেই। ১৯৪৬ সালে দ্বিজেন চৌধুরীর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেন রবিতীর্থ। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘকাল। রবিতীর্থ পাশ্চাত্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তুলতে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে।
আক্ষরিক অর্থে শিল্পী বলতে যা বোঝায়, সুচিত্রা মিত্র ছিলেন তা-ই। শিল্পের কত যে শাখায় তিনি কাজ করেছেন, যা এক কথায় বলে বোঝানো যাবে না। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে প্রবন্ধ রচনা, ছোটগল্প রচনা, ছড়া লেখা, ছড়ার সঙ্গে ছবি আঁকা ,পুতুল তৈরি আরও কত কী! রবীন্দ্রনাথের গানের ভিতর যে নাটকীয়তা রয়েছে, তার সংহত রূপটি তিনি কণ্ঠের পূর্ণ ব্যবহারে ছবি এঁকে দিতে পারতেন। সুচিত্রা মিত্রই আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের গান কেবল কণ্ঠের গান নয়, এ হৃদয়ের গান এবং একে হৃদয় দিয়েই গ্রহণ করতে হয়। এ গান জীবনের সাথি, নিত্যদিনের সখা, লড়্ইা-সংগ্রামের হাতিয়ার। এ গান বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের বর্ম, দুঃখের রাতের পরানসখা-গভীরতম বেদনায় সান্তৃনার ¯িœগ্ধ প্রলেপ। আসলে রবীন্দ্রসঙ্গীত কথাটি উচ্চারণ করলে যার মুখটি প্রথমে ভেসে ওঠে সেটি অবশ্যই সুচিত্র মিত্রের। অবশ্য পঙ্কজ মল্লিক, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে স্বীকার করে নিয়েই কথাগলো বলছি। কবে তিনি গান গেয়ে পথে বের হয়েছেন তা হয়তো তিনি নিজেই মনে করতে পারেন না, কিন্তু এটা তিনি মনে করেন যে, রবীন্দ্র গানই তার আশ্রয়। রবীন্দ্রনাথের গানের ঝরনাতলায় ¯œান করে জীবনের পূজা সম্পন্ন করতে চান তিনি। রবীন্দ্রনাথ যে ধ্রুবপদ বেঁধে দিয়েছেন তাকেই জীবনের গানে মেলাতে চেয়েছেন তিনি সুকঠিন সাধনা ও গভীর ভালবাসা দিয়ে সরাজীবন। দুঃখের আঁধার রাত্রি যখন তার দুয়ারে আঘাত হানে তখনও তিনি আশ্রয় খোঁজেন রবীন্দ্রনাথে। সুচিত্রা মিত্র নিছক কণ্ঠ শিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন ‘ নটীর পূজা’র নটীর মতো শিল্পকে আত্মনিবেদনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়া এক মগ্ন, নিবেদিত সাধিকা। সেই রবীন্দ্র সঙ্গীতের অন্যতম প্রধান ভাষ্যকার ও বিশ্লেষক। রবীন্দ্রনাথের গানের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, তিনিও গানের জন্য পেয়েছেন অনেক সম্মান ও সম্মাননা। ভারতের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৪৫ সালে লন্ডনের ট্যাগর হাইম সোসাইটি ‘ ট্যাগর হাইম অ্যাওয়ার্ড’। ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করে ১৯৭৩ সালে। বিশ্বভারতী বিশ্বদ্যিালয় তাকে দেশিকোত্তম প্রদান করে। সমাবর্তনে দাঁড়িয়ে চোখের জলে বলেছিলেন ‘ এ সম্মানের কি যোগ্য আমি।’পশিচমবঙ্গ সরকার তাকে দিয়েছে আলাউদ্দীর পুরস্কার। বহুমাত্রিক প্রতিভা ও প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই শিল্পী ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। দীর্ঘ রোগশয্যার পর ২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি কলকাতার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাষ ত্যাগ করেন।