somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শত্রু আমাকে নিরাপত্তা দিবে কেন?

০১ লা মার্চ, ২০১৭ দুপুর ২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



একজন ডাইভার কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ড্রাইভার হবে সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। গাড়ির ফিটনেস আছে কিনা, গাড়ি চালানোর গতিসীমা কী হবে এবং সেটি লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা সেটি দেখার দায়িত্বও রাষ্ট্রের।

নিরাপদ ভ্রমণ প্রত্যক্ষভাবে নিশ্চিত করবে ড্রাইভার, কিন্তু দায় কিন্তু সকলের, প্রধানত রাষ্ট্রের। একজন মালিক চব্বিশ ঘণ্টা তার গাড়িটি রোডে রাখতে চায়, কিন্তু ঐ গাড়িটির জন্য তার লাইসেন্সধারী ড্রাইভার আছে একজন। ঐ একজন যদি আঠারো ঘণ্টা গাড়ি চালাতে বাধ্য হয়, তাহলে কি সে সঠিকভাবে ড্রাইভ করতে পারবে? বাকি ছয় ঘণ্টা সার্ভিসটা দেবে হেলপার!

প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের ড্রাইভারেরা কেন গড়ে দশ থেকে ষোলো ঘণ্টা গাড়ি চালাতে বাধ্য হয়? খোঁজ নিয়ে জেনেছি উন্নত দেশে সপ্তাহে পাঁচদিন দিনে গড়ে দুই ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করা যায়, সেখানে প্রতিদিন দশ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়েও ড্রাইভারদের জীবিকা নির্বাহ হয় না!

অনেকে বলবেন, ড্রাইভার শিক্ষিত না, আচ্ছা অশিক্ষিত ড্রাইভার লাইসেন্স পায় কীভাবে? লাইসেন্স ছাড়া কেউ গাড়ি চালালে সে দায় কার? লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়াটাও কি স্বচ্ছ?

ড্রাইভিং-এর জন্য খুব বেশি শিক্ষা কি আসলে দরকার আছে? দরকার কারিগরী এবং মনস্তাত্ত্বিক ট্রেনিং। আছে কি সেই ব্যবস্থা আমাদের রাষ্ট্রে? পিটিয়ে ধমকিয়ে কি কাউকে দক্ষ করে তোলে যায়? মালিকদের কি এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দায় থেকে যায় না? ড্রাইভারদের সঠিকভাবে পরিচালনা করা এবং দক্ষ-যোগ্য করে তোলার জন্য তারা কী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে?

একটা পরিসংখ্যানে বোধহয় ভুল আছে, শুধু ‘অশিক্ষিত’ চালকেরাই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে, এই তথ্যটি বোধহয় সঠিক নয়। দুর্ঘটনা শুধু বাস-ট্রাক ঘটাচ্ছে সেটিও নয়। প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে প্রাইভেট কার, অনেকক্ষেত্রে সেগুলোর চালক মালিক নিজে। অনেক ঘটনা তো নিউজ হয় না, নিউজ হয়েছে এমন সংবাদও প্রচুর। গুগল করলেও অনেক খবর পাওয়া যাবে।

রাজধানীতে প্রাইভেট কারের ধাক্কায় স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু -এই ঘটনাটিতে ঐ বৃদ্ধ দম্পতির কোনো দায় ছিল না, গাড়িটি দ্রুত গতিতে এসে তাদের উপর উঠে পড়ে। গাড়ি থেকে মদের বোতল জব্দ করা হয়েছিল।

এটি এ বছরের ঘটনা- প্রাইভেট কারের ধাক্কায় ২ পথচারী নিহত, এক্ষেত্রেও প্রাইভেট কারটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পথচারি দুই নারীর উপর উঠিয়ে দেয়। - আমাদের সময়

এরকম ঘটনা অসংখ্য। আমার জানামতে প্রাইভেট গাড়ির চালকেরা লাইসেন্সধারী হয়, এবং চালকেরা মালিকের নির্দেশনা মেনে গাড়ি চালাতে বাধ্য থাকে? এক্ষেত্রে ড্রাইভারদের লাইসেন্স আছে, গাড়ির ফিটনেসও আছে, তাহলে এই দুর্ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা কী হবে?

সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটা বড় বিষয় মনে হয় এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে, কোনো পরিসংখ্যান কি আছে যে আমাদের মহাসড়কগুলোতে কী পরিমাণ গাড়ি চলাচল করে? সড়কের প্রশস্ততা অনুপাতে যে পরিমাণ গাড়ি চলাচল করার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি এবং বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চলাচল করলে দুর্ঘটনা অবশম্ভাবি হয়ে ওঠে না কি?

আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ- ড্রাইভারদের মানসিক অবস্থা। আমি নিজে মটর সাইকেল চালাতে গিয়ে দেখেছি, মনোসংযোগ রাখতে আমি ব্যর্থ হই। চালকের পক্ষে অন্য কোনো দিকে কোনো ইন্দ্রীয় খাটানোর সুযোগ নেই। বিষটি কি খুব স্বাভাবিক? ঘণ্টার পর ঘণ্টা মনোসংযোগ ধরে রাখা কি চাট্টিখানি কথা! এজন্য কোনো ব্যবস্থা আছে রাষ্ট্র বা মালিকদের পক্ষ থেকে।

যাত্রীদের কি এক্ষেত্রে অনেক দায়িত্ব রয়েছে না? ড্রাইভারকে ধন্যবাদ দেওয়া, গাড়ি থামলে তার সাথে হায় হ্যালো করা, নিজের নাস্তাটা একটু শেয়ার করতে চাওয়া, এ ধরনের মানবিক বিষয়গুলো নিশ্চয়ই ড্রাইভারকে আরো দয়িত্বশীল করে তোলে। কিন্তু আমরা কী করি? ড্রাইভারকে পুরো পথ ‘শত্রু’ বানিয়ে রাখি! শত্রু আমাকে নিরাপত্তা দিবে কেন?

ড্রাইভারকে যদি গাড়ি চালানোর সময় ভাবতে হয় পারিবারিক অশান্তির কথা, সন্তানদের পড়াশুনার খরচ কীভাবে চলবে সেসব কথা, তার অবসরের কথা, তাহলে সে মনোযোগ রেখে গাড়ি চালাতে পারবে?

কখনো কেউ খেয়াল করে দেখেছেন আমাদের ড্রাইভারদের স্বাস্থ্যের অবস্থা? প্রায় প্রত্যেকে ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী।বোঝাই যায় যে এদের কোনো নিয়মিত জীবনযাপন নেই। কী খাচ্ছে কোথায় থাকছে কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। তারা আমাদের নিরাপদ ভ্রমণ উপহার দিবে তাই কি আদৌ সম্ভব?

ড্রাইভারদের কারণেই সম্ভবত অনেক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, কিন্তু ড্রাইভার প্রত্যক্ষ ‘কারণ’ হলেও পরোক্ষভাবে দায়ী উপরিউক্ত বিষয়গুলো। আর এটা তো সমাজ বিজ্ঞানের সূত্র যে পরোক্ষ কারণ দূর না হলে কখনো প্রত্যক্ষ কারণ দূর হবে না।

তাছাড়া এভাবে গড় পড়তা কথা বলে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করাও যাবে না। একেবারে প্রতিটি দুর্ঘটনা ধরে ধরে বিশ্লেষণ করা উচিৎ। পুলিশের গাড়ির ধাক্কায় নিহত হওয়ার খবর খুব কম নয়, মাত্র এক বছর আগে ঢাকার বনানীতে রং সাইড দিয়ে চলা পুলিশের গাড়ির ধাক্কায় এক যুবক নিহত হয়েছিল। সেই ঘটনার কি বিচার হয়েছে?

বনানীতে উল্টোপথে চলা পুলিশের গাড়ির ধাক্কায় যুবক নিহত

বিচারের কোনো খবর শুনিনি। এরকম ঘটনা রয়েছে অনেক। যেগুলোর বিচার শুরুই হয়নি কোনোদিন? হয়ত মামলাই হয়নি। কিন্তু মামলা হতে হবে কেন? এসব ক্ষেত্রে মামলা করবে তো রাষ্ট্র স্বতপ্রণোদিত হয়ে। রং সাইড দিয়ে গাড়ি চালিয়ে কাউকে হত্যা করা হলে তার জন্য নিহতের স্বজনের মামলা করতে হবে কেন?

কিছুদিন আগে একটি দুর্ঘটনা শুনলাম, একজন লোক ফেরিতে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে, পিছন থেকে ট্রাক এসে ধাক্কা দিয়েছে। ফেরিতে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক ঢেউয়ের দুলুনিতে সামনে এগিয়ে এসেছে। ফেরিতে গাড়িগুলো কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এবং মানুষ কীভাবে তার ফাঁক দিয়ে গলে গলে যায় সেটি নিশ্চিয়ই অনেকেই খেয়াল করেছেন। যেকোনো সময় ফেরিটি উঁচু নিচু হওয়ার সাথে গাড়িটি একটু এগিয়ে আসলেই ঘটবে এ ধরনের দুর্ঘটনা। দায় কার? গাড়ির চাকার নিচে কিছু না দিয়ে রাখাটা এক্ষেত্রে সমস্যা, যে দায়িত্ব ফেরি কর্তৃপক্ষের বা গাড়ির লোকের। আবার এ ধরনের ফাঁক গলে যাওয়াটাও তো সমস্যা।

আমাদের এক ধরনের ঐশ্বরিক জীবনযাপন আছে, ব্যাপারটা এরকম, “ধুর, কিছু হবে না। কিছু তো হয় না।” কিন্তু দুর্ঘটনা তো রোজ ঘটার দরকার নেই, জীবনে একবার ঘটলেই হয়। তাই সতর্ক শুধু ড্রাইভার হলে তো হবে না, সতর্ক থাকার দায় রয়েছে যাত্রী-পথচারীদেরও।

সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, অনেক দুর্ঘটনার জন্য প্রত্যক্ষভাবে ড্রাইভার দায়ী, তাই বিচার হলে ড্রাইভার দোষী সাব্যস্ত হবে এবং তার সাজা হবে। আদালত কী সাজা দেবে তা আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে, তাই বলে ব্যতিক্রম ক্ষেত্র তৈরি করে বিচার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায় না, তাতে বরং সমস্যা বাড়ে।

তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের মত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মারা যাওয়াতে আমরা অনেক বেশি মর্মাহত হয়েছিলাম, যদিও প্রতিটি মৃত্যুই সমান কান্নার। তাই বলে এটিকে বিশেষ কোনো দুর্ঘটনা হিসেবে বিচার করার সুযোগ নেই যদি না এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে (আদালতে তেমন কিছু প্রমাণিত হয়নি)।

হঁ্যা, দুর্ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখা হোক এবং ড্রাইভারের বিচার হোক, কিন্তু পিছনের কারণগুলো দূর না করে শুধু ড্রাইভারদের সাজা দিয়ে যে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না সেটি সাদা চোখেও বোঝা যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১৭ রাত ৯:০০
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×