somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইয়োশিনোরি ওহশোমির আবিষ্কার এবং আমাদের ধর্মান্ধতা

১০ ই জুন, ২০১৭ সকাল ১০:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শরীরকে সবসময় খাবার দিলে হবে না, মাঝে মাঝে না খাইয়েও রাখতে হবে। এই “মাঝে মাঝে না খাইয়ে রাখা” বলতে কী বুঝতে হবে? সপ্তাহে একদিন, পনেরো দিনে একদিন? মাসে একদিন? “না খাওয়া” বলতে পানিও খাব না, কিছুই খাব না?


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক (একাউন্টিং বিভাগের) দেখলাম ধর্মের সাথে বিজ্ঞান মিলিয়ে অযৌক্তিক একটি বিশ্লেষণ তৈরি করে গোষ্ঠীগতভাবে তা প্রচার করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক প্রচার করায় মানুষ তা গ্রহণও করেছ কোনো বাচবিচার না করে।

একাউন্টিংয়ের ঐ শিক্ষকের বক্তব্য হচ্ছে, ২০১৬ সালে যেহেতু বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন অটোফেজি নিয়ে গবেষণা করে, অতএব, এটা ধর্মীয় সফলতা!

তার এ লেখা পড়ে আমার এক হিন্দু ধর্মীয় বন্ধু দাবী করলেন, এটা বেদান্তীয় সফলতা। কারণ, সনাতন ধর্মে উপবাস প্রথা আরো অনেক বেশি প্রাচীন এবং সে নিয়ম-কানুন নাকি আরো বেশি বৈজ্ঞানিক।

প্রাচীনকালে বিজ্ঞানটা সুস্পষ্ট ছিল না, অনেকটা দর্শন নির্ভর ছিল, এই কারণেই এরিস্টটল এত কিছুর আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃত।
তবে তখনও মানুষের পরীক্ষা নিরীক্ষা বা গবেষণা ছিল বলে জানা যায়। তাই প্রাচীন যে কোনো গ্রন্থের ঐতিহাসিক মূল্য আছে, সেগুলোর মধ্যে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানের উপাদান থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

আর সকল আবিষ্কারই একটি ধারাবাহিকতার ফসল। পূর্বসুরীদের অবদান সেখানে থাকে। তাই বলে কোনো আবিষ্কারকে ধর্মীয় বা ঐশী বলে প্রচার করা মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। আবিষ্কার মানে প্রকৃতি থেকে খুঁজে নেয়া, প্রকৃতিকে যুথবদ্ধ করা বা কতগুলো উপাদান টেনে এনে একসাথে করে নতুন কিছু সৃষ্টি করা। তাই চাইলে সবকিছুই ঐশ্বরিক ভাবা যায়, এবং এটাই ঈশ্বর বিশ্বাসের মূল কথা।

তাই বলে প্রকৃতিতে সবই আছে বলে চুপ করে বসে থাকলে কি কাজ হবে? এমন এমন হলে আকাশে বিমান চলবে, এটা তো প্রাকৃতিক নিয়ম, তাতে কি আকাশে আপনা আপনি বিমান চলবে?

যাইহোক, আরেকটু স্পষ্ট করে অটোফেজির কথা বলি, অনেক অনলাইন পত্রিকা দেখলাম, অটোফেজি অর্থ করছে রোজা বা উপবাস, আসলে অটোফেজি অর্থ রোজা বা উপবাস নয়। রোজা বা উপবাস অর্থ না খেয়ে থাকা, অটোফেজি অর্থ নিজেকে খাওয়া।

বিষয়টা সহজ ভাষায় এরকম, আপনি যখন কিছু খাবেন না, তখনও কোষগুলো পুষ্টি চাহিদা মেটাতে চাইবে এবং নিজেদের মাঝে খাবার খুঁজবে, এটা করতে গিয়ে শরীরের অনেক অনিষ্টকারী উপাদান খেয়ে ফেলবে (সেখান থেকে পুষ্টি উপদান বাছাই করবে) এবং বিপাকীয় ক্রিয়ায় শরীরের বর্জ্য বের করে দিবে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে আমাদের গ্রহণ করা প্রোটিনের একটা অংশ কাজে লাগে না, সেগুলো বিভিন্নভাবে কোষে জমা থাকে, সেগুলো মাঝে মাঝে বের করে দিতে পারলে ভালো।

বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান ডে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ১৯৭৪ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন লাইসোসোম আবিষ্কারের কারণে। এরও এক দশক আগে বিজ্ঞানীরা কোষের মধ্যে এক ধরনের ঝিল্লির কথা বলেছিলেন যা বর্জ্য পদার্থ বা বাড়তি উপাদান আটকে রাখে। তবে সুস্পষ্টভাবে সেখানে কীভাবে কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রিত হয় তা বিজ্ঞানীদের তখন জানা ছিল না। তিনি এবং আরো অনেক গবেষক দেখতে পান কোষ নিজের ভেতরে একটি আবরণ তৈরি করে তার মধ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় উপাদান আটকে রাখে। ক্রিস্টিয়ান ডে ঝিল্লি-আবৃত এ অংশটির নাম দেন লাইসোসম ।

জাপানের বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি ক্রিস্টিয়ান ডে-এর আবিষ্কারের সীমাবদ্ধতা বা তাত্ত্বিক দিকের প্রায়োগিক জায়গায় এসে কাজ করেছেন। এবং তিনি যে জিনটি এই অটোফেজি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সেটি শনাক্ত করেছেন।

অটোফেজির কারণে অনেক কোষ মরে যায়, স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল ও রোগাক্রান্ত কোষগুলোই মারা পড়ে, তাই ক্যান্সারসহ বার্ধক্যজনিত নানাবিধ রোগের গবেষণায় ইয়োশিনোরির অটোফেজি নিয়ে এ গবেষণার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অটোফেজির প্রয়োজনীয়তার সাথে এক মাস একটানা রোজা রাখা প্রাসঙ্গিক হয় কিনা। ধর্মীয়ভাবে কেউ রোজা রাখে বা উপবাস করে সেটি অালাদা বিষয়, কিন্তু ধর্মকে যখন কেউ বিজ্ঞান হিসেবে উপস্থাপন করতে চায় তখন মানব সভ্যতার অনেক ক্ষতি হয়ে যায়, ক্ষতি হয়ে যায় কারণ, তখন এই ভ্রান্ত বোধ তৈরি হয় যে সবই তো গ্রন্থে আছে তাহলে আমি শুধু সম্রাটই থাকি, কাজ করার দরকার নেই।

ধর্মগ্রন্থগুলোকে ধর্মীয় বলা হয়েছে বলেই তা শুধু ধর্মগ্রন্থ। পৃথিবীতে হাজার হাজার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রয়েছে যেগুলো থেকে মানব সভ্যতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা এসেছে। গ্রন্থগুলোকে নামহীন করে দিয়ে সেগুলোকে কি আমরা ধর্মগ্রন্থ বলব?

বিজ্ঞানের প্রথম দিকের অনেক নোবেল পুরস্কারই দর্শন নির্ভর। আইনস্টানের নোবেলটাই তো একদম তাত্ত্বিক। অপ্রমাণিত অনুকল্পের উপরও নোবেল দেয়ার ইতিহাস আছে। আচ্ছা, ধর্মগ্রন্থ ঐশী মানলে এটাও তো মানতে হবে বিজ্ঞানীরা আধুনিক যুগের ঈশ্বরের দূত, ঈশ্বর কানে কানে তাদের বলে দিয়ে যায় তারপর তারা আবিষ্কার করে, নাকি?

কয়েকটি প্রশ্ন রেখে এই লেখা শেষ করি-
১। অটোফেজি দরকার মাঝে মাঝে, তাহলে সেই “মাঝে মাঝে” বলতে আপনি কী বুঝবেন? একটানা একমাস? তিনদিনে একদিন? সাতদিনে একদিন? পনেরো দিনে একদিন? মাসে একদিন?

২। ইয়োশিনোরি ওহশোমির গবেষণার সারসংক্ষেপ যদি একটু বোঝার চেষ্টা করি তাহলে দেখব, এখানে বলা হচ্ছে-
কোষ নিজেদের মধ্যে খাওয়া খাওয়ি করবে কারণ শরীর সচল রাখতে হলে তার পুষ্টি লাগবেই, তার মানে বিপাক ক্রিয়া বন্ধ হচ্ছে না, বিপাক বন্ধ না হওয়ার মানে হচ্ছে পানি লাগবে।
অর্থাৎ, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে-
তাহলে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থেকে যদি আপনি রোজা রাখেন বা উপবাস থাকেন তাহলে কি একদমই না খেয়ে থাকবেন, নাকি অন্তত পানি খাবেন?

একজন মানব শিশুর (১বছর) শরীরের ৭৮% পানি, এরপর ক্রমান্বয়ে তা কমতে কমতে ৬০% এ এসে থিতু হয়। অর্থাৎ একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে ৬০ ভাগ পানি থাকে।
কোনো খাদ্য না খেয়ে তিন থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত একজন সুস্থ সবল লোক বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু পানি না খেয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব মাত্র ৩ থেকে ৭ দিন। এটা নির্ভর করে স্থানের তাপমাত্রা এবং বাতাসের আদ্রতার উপর। অর্থাৎ অানুপাতিকভাবে চিন্তা করলেও বোঝা যায় খুব বেশিক্ষণ পানি না খেয়ে থাকাটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

শরীরে পানি কী কাজ করে সেটি জানলে বুঝতে ‍সুবিধা হবে-
মোটা দাগে পানি কয়েকটি কাজ করে, যেমন, বিপাক ক্রিয়ার জন্য পানি অত্যাবশ্যকীয়, আমাদের হাড়ের সংযোগস্থলে যে লুব্রিকেন্ট রয়েছে তাতে পানি লাগে, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য পানি লাগে ইত্যাদি।

৩। একটানা কতক্ষণ না খেয়ে থাকা অটোফেজির জন্য বিজ্ঞান সম্মত, সে নির্দেশনা ইয়োশিনোরির গবেষণায় নেই, আসলে তিনি কোনো নির্দেশনাই দেননি, বিজ্ঞান সেটি কখনো করেও না। তিনি মূলত শুধু অটোফেজির জন্য দায়ী জিনটি সণাক্ত করেছেন। তাহলে তার গবেষণা কীভাবে উপবাস প্রথার সাথে প্রাসঙ্গিক হয়?
একটানা কতক্ষণ না খেয়ে থাকলে তবে তা সেক্ষেত্রে শরীরে ঘটা অটোফেজি অনিষ্টকর না হয়ে উপকারী হয়?
এই প্রশ্নের উত্তরটা দিতে দয়া করে একটা গবেষণা করুণ যেকোনো অপপ্রচারের আগে। প্রমাণ করুণ যে সেটি দৈনিক একটানা নির্জলা ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা এবং তা করতে হবে বছরে টানা এক মাস।
যদি ফলাফল ভিন্ন হয়, মানে দেখা গেল, অটোফেজির জন্য ৭ দিনে একদিন উপবাস থাকা ভালো বা সেটি কাকতালীয়ভাবে মিলে গেল বা কাছাকছি হল অন্য কোনো ধর্মের নিয়মের সাথে, তখন আপনি কী বলবেন?

ধর্মীয় প্রথাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন বা বিশ্বাস নির্ভর আচার-অনুষ্ঠান হিসেবেই দেখতে হবে। ধর্মের সাথে বিজ্ঞান জড়িয়ে ধর্মের গুরুত্ব বাড়াতে যাওয়া যেমন অযৌক্তিক, আবার বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মকে খারিজ করে দেয়াও অপ্রয়োজনীয়। ধর্ম ধর্মের মত থাক, তাতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু শিক্ষিত “ধার্মিকের” সমস্যা হচ্ছে সে উঁকি দিতে চায় সবার ঘরে এবং সেটি করে সে সাম্প্রদায়িকভাবে, এবং এভাবে সে একটি ডায়াস্পোরা নিজের পেছনে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়। অতএব, বলতে হবে শিক্ষিত ধার্মিক এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবেই করে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৭ দুপুর ১:১৫
৯টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×