তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। দাদুবাড়ি গিয়েছিলাম ঈদে। গ্রামের পাশ দিয়ে সুনীলের ভাষায় একটি ছিপছিপে তন্বী নদী চলে গিয়েছে- শঙ্খ নদী। দাদুবাড়ি যাব কিন্তু নদীতে যাবনা তা কখনো হত না। সেবারও গেলাম। আমরা চারজন। আমি, আমার জেঠাত বোন রুমানা, ফুপাত বোন নোভা আর জেঠাত ভাই হুমু ভাইয়া।
প্রস্থে সরু শঙ্খ নদীকে গ্রামের মানুষ বলে খাল। তখন শীতকাল; আক্ষরিক অর্থেই শঙ্খ নদীকে খালের মত লাগছিল। নদীর ঐপাড়টা বালিতে ভর্তী। আরেকটু দূরে নানারকম সব্জী ক্ষেত। মানুষজনও থাকেনা। আমরা তাই নৌকা করে ঐ পাড়েই চলে যাই। দৌড়-ঝাঁপ, ছুটাছুটি, যা যা করা যায় সব করে যখন পুরোপুরি ভিজা এবং ক্লান্ত, তখন হঠাৎ খেয়াল হল দুপুর হয়ে গেছে। ঐপাড়ে যে নৌকাগুলো বাধা থাকে, তার মাঝিগুলো একটারও নাই! তো এখন??? আমার ঐপাড়ে যাব কীভাবে?! বাড়ি ফিরবই বা কীভাবে?! গায়ের ভেজা কাপড় গায়েই শুকিয়ে যাচ্ছে, শুরু হয়েছে কাঁপুনি! হুমু ভাইয়া এতক্ষণ মোটেও আমাদের সাথে ছিলনা, একেবারে শুরুতেই কোথ্থেকে একটা নৌকার যোগাড় করে নিজেই লগি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল নদীতে। সুতরাং ওর কোন চিন্তা নাই বাড়ি ফিরা নিয়ে। নদী দৈর্ঘ্যে অনেক লম্বা, হুমু ভাইয়াকে দেখাও যাচ্ছেনা সে কোথায়..!
হঠাৎ আমাদের তিন মুরতীর কোন একজন যেন ঠিক মনে আসছে না, পরামর্শ দিল চল হেঁটেই নদী পার হয়ে যাই। আগেই বলেছি শীতকাল, নদী শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। চোখের আন্দাজে মনে হচ্ছিল মাঝনদীতে হাঁটুপানি। দোড়াদৌড়িতে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, ভীজা কাপড়ে কাঁপুনি ধরে এমনই বেগতিক অবস্থা তার উপর বাড়িতে কাউকে বলেই আসিনি যে আমরা নদীতে যাচ্ছি (প্রশ্নই আসেনা!!) এতই অসহায় ছিলাম যে পরামর্শটা অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী মনে হল.....!
অতএব এগুনো শুরু করলাম.. মাঝনদীর প্রায় কাছাকাছি এসেও যখন পায়ের নিচে ঠাঁই পাচ্ছিলাম তখন খুব কনফিডেন্স লাগছিল! নিজেদের বুদ্ধির উপর কী খুশী যে হচ্ছিলাম...!!
নোভা বলল, “ভাই আমার লাগতেসে(মানে মনে হচ্ছে) আমার এখনই পড়ে যাব”..................
কথাটা মুখ থেকে ফেলার দেরী ছিল কেবল.....অমনি তিনজন পিছলে পড়ে গেলাম............!
কে কাকে ধরেছিলাম কিছু মনে নাই। আমি কি হাত উঁচিয়ে ছিলাম? তাও মনে নাই। স্পষ্ট একটা অনুভূতি এখনও আমি মনে করতে পারি- পায়ের নীচের ঠাঁইয়ের শেষ প্রান্তে গিয়ে কীভাবে পা পিছলে গেল......! একদম স্পষ্ট!! এরপর মাথার তালুতে পানির স্পর্শ, পানি আমার নাকের উপরে উঠে গেছে, আমি দেখছি আকাশ....পরিষ্কার নীল................................
শেষ মুহূর্তে আমার হাত ধরেছিল রুমানা। না, আমরা ডুবে যাইনি। তিনজন “কীভাবে যেন” তলিয়ে যাইনি শেষপর্যন্ত। এই “কীভাবে যেন”র ব্যাখ্যা নাই আমার কাছে। ডুবে নাহয় গেলাম না, কিন্তু সেই নদী পার হই কোন উপায়! নদীর ঐপাড়ে ৩/৪জন মহিলা হাড়ি-কুড়ি মাজছিলেন। হরর মুভির উত্তেজনায় উনারাও আমাদের দেখছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনটি মাথা উঁচু দেখে বিজয়ের হাসিও দেখলাম উনারাই হাসছেন! কিন্তু এই তিন হতভাগীকে উদ্ধার করার মত মমতা দেখালেন না। আমি বলেই বসলাম, “আন্টি আমাদেরকে একটু পার করে দিবেন???” একটা গুড জোক শুনে দুই বান্ধবী দু’জনকে দেখে হাসলেন এবং পাতিল মাজায় মন দিলেন। অমন জটিল পরিস্থিতিতেও অভ্যাসবশত আম্মুর কথা মনে হল। মনে মনে বললাম- “আমার আম্মু হইলে... এতক্ষণ! কিছু বলতেই হতনা! আগেই নৌকার মাঝিদের কাউকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসত!! তারপর এক মিনিটের মধ্যেই....”
সবচেয়ে বড় বিপদ হল, দুপুর বেলা, জোয়ার শুরু হয়ে গেছে তখন!!! ঠিক মাঝ নদীতে আমরা , আশেপাশে অন্তত ধরে দাঁড়িয়ে থাকার কিছু নেই! তারউপর পায়ের নীচে ঠাঁইয়ের একবারে শেষ কিনারায়! জোয়ারের স্রোতের ধাক্কা এক একবার ঠেলে ফেলে দিতে চাচ্ছিল! পানির স্রোত বা পানির শক্তি যে আসলে কী সত্যি সেদিন বুঝতে পারলাম!
কোন উপায় না দেখে আবার আগের জায়গায় ফেরত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অমন শীতকালে ঠান্ডা পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা, জোয়ারের ধাক্কার মধ্যে পিচ্ছিল কাদার শেষ কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা দুইটাই অসম্ভব; একই রকম অসম্ভব ঠিক ঐসময় কোন নৌকা পাওয়া। সুতরাং ফেরত আসতে লাগলাম আগের পাড়ে। মুশকিল হল জোয়ারের পানির যে স্রোত, তা ঠিক ঐদিক থেকেই আসছিল। “পানির মত সোজা” কথাটা যে কী ফালতু! মনে হচ্ছিল আমরা পানি না, কোন শক্ত ভারী ফার্নিচার ঠেলে আগাচ্ছি! কিছুতেই আগাতে পারিনা...........................!
শেষ পর্যন্ত আমরা যেতে পেরেছিলাম ঐপাড়ে। আশ্চর্যের বিষয়, এতক্ষণ যা লিখলাম এতসব খুঁটিনাটি মনে আছে, কিন্তু শেষতক কীভাবে বাড়ি ফিরেছিলাম, তা আর মনে নাই!!! মনে হয় হুমু ভাইয়ার নৌকায়.. নাকী কীভাবে আমার একদম মেমরি জিরো!!!!
এই ঘটনার কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। নানা কারণে। অথবা এমনিই।
“স্রোতের বিপরীত” ব্যাপারটা কেমন আমি এক্সপেরিয়েন্স করেছি তবে আক্ষরিক অর্থে! কী অসম্ভব শক্তি স্রোতের! অথচ জিনিসটা ছিল সামান্য পানিই! স্রোতের বিপরীতে টিকে থাকা যেমন মুশকিল- পায়ের নীচে কখনো কারো শক্ত মাটি থাকে, কারো থাকে ঐরকম পিচ্ছিল কাদামাটির শেষ প্রান্ত!! আর হাঁটা তো আরও ভয়ংকর! শরীরের ব্যালেন্স রাখা, স্রোত ট্যাকেল করা এবং হাঁটা........ব্লাডী ইম্পসিবল! ইটস জাস্ট দ্যা ডিসটেন্স অফ এ গ্ল্যান্স ফ্রম ডেথ!!!! শরীর এবং মন দু’টোরই তেমন ব্লাডী ইম্পসিবল জোর লাগে!
কোন ব্লাডী ইম্পসিবল পরিস্থিতি নিয়ে এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। একসময় সে আমাকে তার “আশাবাদ” শুনাল। বলল, “একদিন আমাদেরও সময় আসবে, তখন আমরাও দেখে নিব!” আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, “তাহলে এর শেষটা করবে কে???! এরকম কি চলতেই থাকবে- আমার সময় আসলে আমি/তোমার সময় আসলে তুমি/যার সময় আসে সে?????!!” বন্ধু উত্তর দিল, “এটাই নিয়ম। এরকমই জোয়ার-ভাটা চলতে থাকে। কেন তুমি জোয়ার-ভাটা দেখনা, এটার কি কোন শেষ আছে??? এরকম চলতেই থাকবে।”
হতাশা নয়, বিতৃষ্ণা নয়, বিরক্তিও নয়, একটা তীব্র ব্যার্থতাবোধে উত্তর আটকে গিয়েছিল তখন! কোন একদিন ক্লাসের সব ফ্রেন্ডরা ফুল আন্সার করে খাতা জমা দিল আর আমি ১৪টার মধ্যে কেবল ২টা আন্সার করে জমা দিয়ে যেমন ব্যার্থ, বিপন্ন চোখে তাকিয়েছিলাম খাতার স্তুপের দিকে- ঠিক সেরকম লেগেছিল আমার!
আহারে জোয়ার..................................!
আহারে স্রোত........................................!