মন্ত্রিত্বের শক্তি, ত্যাগীদের অক্ষমতা
ফকির ইলিয়াস
=========================================
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের বর্তমান মন্ত্রিপরিষদে নতুন দু'জন মন্ত্রী যুক্ত হয়েছেন। তা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে জল্পনা ছিল। না, কোন মন্ত্রী বাদ পড়েননি। বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। নতুন যারা মন্ত্রী হয়েছেন, তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত পরিচিত ব্যক্তিত্ব। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং ওবায়দুল কাদের দু'জনই দেড় বছর ধরে নানা ইস্যুতে সরকারের 'মুখপাত্র' হিসেবে কথা বলে আসছিলেন। এরা দু'জনই সরকারের নানা অসঙ্গতির ব্যাপারে সমালোচকের ভূমিকায়ও ছিলেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজে একজন প্রখ্যাত আইনজীবী। ১৯৯৬ সালে যখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা। ঝানু এ পার্লামেন্টারিয়ান সবসময়ই শান্তি ও গ্রগতির পক্ষে ছিলেন সোচ্চার। 'র্যাটস' (রাজ্জাক-আমু-তোফায়েল-সুরঞ্জিত জঅঞঝ) বলে নানা মহলে যে গুঞ্জন ছিল ওয়ান/ইলেভেন-পরবর্তী সময় সুঞ্জিত সেনগুপ্তের ইমেজে কিছু মরচে ধরায়। তারপরও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে ইমেজ পুনরুদ্ধারে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন সুঞ্জিত সেনগুপ্ত। তাকে আইনবিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় এবং তা তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে কাজে লাগান। সংবিধান সংশোধন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া প্রভৃতিতে তিনি নিরলস শ্রম প্রদান করেন। সর্বোপরি সরকারের সব অশুভ ও অন্যায় কাজের সমালোচনা করে তিনি গত এক বছর মিডিয়ার লাইমলাইটে ছিলেন।
ঠিক একইভাবে আরেকটি সংসদীয় কমিটির প্রধান ওবায়দুল কাদেরও মিডিয়ায় ছিলেন সরব। গত টার্মের যুব উন্নয়ন ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের সুবক্তা এবং পরিমিতি ও প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের নতুন এই প্রেসিডিয়াম সদস্য ওয়ান/ইলেভেনের সময় নানা রকম হেনস্তার শিকার হন। হৃত জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারে তিনিও ছিলেন ঐকান্তিকভাবে সচেষ্ট। শেষ পর্যন্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং ওবায়দুল কাদেরকে মন্ত্রী করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক দাবাই খেলেছেন বলে মনে হয়। এ দুই রাজনীতিক এতদিন যে লম্বা লম্বা কথা বিভিন্ন সমাবেশে বলেছেন, আমার মতে তা-ও ছিল সরকারের নির্দেশিত। কারণ 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সে'র একটি ব্যাপার প্রতিটি সরকারেরই থাকে। এই দুই শীর্ষ রাজনীতিক সরকারের 'মাউথ স্পিকার' হিসেবে কাজ করেছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কথা হচ্ছে, পতাকাসমেত গাড়ি আর মন্ত্রিত্ব পেয়ে তারা কাজ কতটুকু করতে পারবেন_ কতটুকু করতে সচেষ্ট হবেন?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি প্রবচন খুব জোরেশোরে চালু আছে_ 'যে যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবণ'। ক্ষমতার বাইরে থাকলে অনেক কথাই মুখে বলা যায়। যেমনটি আজকে বলছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। মাত্র পাঁচ বছর আগে তিনি এবং তার দল রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। দেশকে জঙ্গিদের হাতে ইজারা দিয়েছিলেন এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ছিল দেশে হাওয়া ভবনের ছায়াশাসন। এখন তার মুখে বড় বড় কথা আমরা শুনছি।
বাংলাদেশের মানুষ কি তবে অতীতকে ভুলে যায়! এভাবে ভুলে যেতে পারে? উচিত কী ভুলে যাওয়া? না, ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ভুলে গেলে জাতি পিছিয়ে পড়ে। জাতিসত্তার উন্নয়ন স্তিমিত হয়ে পড়ে। প্রজন্ম এগিয়ে যাওয়ার সাহস হারায়।
আমরা এ সময় একটি বিষয় খুব প্রবলভাবে লক্ষ্য করছি। তা হচ্ছে দলীয়ভাবে ত্যাগী নেতাদের সঠিক মূল্যায়ন না করা। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক একটি ঘটনা এখানে বলতে চাই। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা, অন্যতম জাতীয় নেতা সাবেক মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এখন ব্রিটেনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন বর্তমান সরকার তার সুষ্ঠু খোঁজখবর নিচ্ছে না। তার যথাযথ মূল্যায়ন করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চিকিৎসা হচ্ছে না। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সম্প্রতি ফ্রান্স সফরে গেলে সেখানে প্রবাসী বাঙালি বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রীর গোচারে আনার চেষ্টা করেন। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেন, বিদেশে এসে এত টাকা খরচ করে যিনি চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন তিনি নিশ্চয়ই ধনী, বড় লোক। শিক্ষামন্ত্রীর এই তাচ্ছিল্যপূর্ণ বক্তব্য অপ্রত্যাশিত ছিল। তা লাখো মুক্তিকামী মানুষকে পীড়া দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আমি কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করতে চাই। আবদুর রাজ্জাক মহান মুক্তি সংগ্রামের 'নিউক্লিয়াস' শক্তির অন্যতম পুরোধা; তা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে একই ফোরামে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি' যুক্তরাষ্ট্র শাখার আমি ছিলাম প্রতিষ্ঠাতা সহকারী সদস্য সচিব। আবদুর রাজ্জাক ছিলেন এ কমিটির অন্যতম সমন্বয়কারী। তিনি সব সময় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে পাশাপাশি ছিলেন ছায়ার মতো। আওয়ামী লীগ দলটির পক্ষে আবদুর রাজ্জাক ছিলেন জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম প্রবক্তা ও প্রতিনিধি। এই সেই আবদুর রাজ্জাক যিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে প্রবাসীদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করেছিলেন। তার অমিত তেজ ও সাহসী বক্তব্য হাজারও তরুণকে সেদিন শাণিত এবং অনুপ্রাণিত করেছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের এই সংগঠক সেদিন অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত করার ডাক দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি_ তিনি কত সৎ, কত মহৎ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জিতে মন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সোচ্চার। জাতীয় সমন্বয় কমিটিতে তার কর্মপরিধির কোন ব্যত্যয় ছিল না মন্ত্রী হওয়ার পরও। এমন একজন জাতীয় নেতার প্রতি এভাবে কটাক্ষ করতে পারলেন বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী! জনাব নাহিদ কী জানেন না, আবদুর রাজ্জাক যখন নেতা তখন তিনি ভালো রাজনৈতিক কর্মীও হয়ে উঠতে পারেননি। এমন দীনহীন মানসিকতা আমাদের সম্মিলিত জাতীয় লজ্জা তো বটেই। খুবই দুঃখের কথা, বর্তমান সরকারের বেশ ক'জন মন্ত্রী লন্ডন সফরে গেলেও অসুস্থ আবদুর রাজ্জাককে দেখতে যাননি। তার খোঁজখবর নেননি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দেখতে গিয়েছিলেন। অবশ্য তা মন্ত্রী হওয়ার আগেই। মন্ত্রী হয়ে গেলে তিনিও দেখতে যেতে পারতেন কি-না, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
হ্যাঁ, মন্ত্রিত্বের শক্তি বাংলাদেশে বড় আজব জিনিস। মন্ত্রী বানানোর পরপরই অনেকের মুখে কুলুপ এঁটে দেয়া হয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কিংবা ওবায়দুল কাদের আগামী দুই বছর মন্ত্রী হিসেবে কী বলেন, কী করেন তা দেখার আগ্রহ এখন গোটা জাতির। কারণ তারা অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন।
দুঃখজনক কথা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের চরম ব্যর্থ মন্ত্রীদের কেউই বাদ পড়েননি। কেন বাদ পড়েননি তা শুধু প্রধানমন্ত্রীই বলতে পারবেন। তবে কথা হচ্ছে, ব্যর্থ হলে সরিয়ে দেয়ার যে ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন, তার কী হলো? তবে মন্ত্রিত্ব পাঁচ বছরের জন্যই স্থায়ী? নগ্নভাবে ব্যর্থ হওয়ার পরও?
বাংলাদেশে অনেক ত্যাগী নেতা আছেন, যারা নিজ নিজ দলে অক্ষম। তাদের অক্ষমতা গোটা জাতির জন্য পীড়াদায়ক। তারা তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার পরও নিজ নিজ দলের সাবেক আমলা রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, কালো টাকার মালিক রাজনীতিকদের কাছে চরমভাবে পরাজিত। তস্করবৃত্তি এবং কালো টাকার দাপটই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক। এর ফলেই বেশ কিছু দুর্নীতিবাজঘেরা শিক্ষা ভবনের মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কটাক্ষের লক্ষ্যবিন্দু হয়ে উঠছেন জননেতা আবদুর রাজ্জাক। বাংলাদেশে রাজনীতির অপমানজনক অধ্যায়গুলো এভাবেই পুনঃলিখিত হচ্ছে। পুনর্বাসিত হচ্ছে কালো শক্তি। ত্যাগী নেতাকর্মীরা মুখ লুকাচ্ছেন লজ্জায়।
কোন সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে মেধাবৃত্তিক রাজনীতির গলা টিপে ধরার নজির নেই। প্রতিবেশী ভারতের দিকে আমরা তাকাতে পারি। তাহলে বদলের মানসিকতায় বাংলাদেশ এগোচ্ছে না কেন, ভাবা দরকার। প্রজন্মকে দাঁড়ানো দরকার সত্যের অন্বেষণে।
নিউইয়র্ক
৩০ নভেম্বর ২০১১
--------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ / ঢাকা/ ২ ডিসেম্বর ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত
আলোচিত ব্লগ
ধর্ম ও বিজ্ঞান
করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন
তালগোল
তুমি যাও চলে
আমি যাই গলে
চলে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফুরালেই দিনের আলোয় ফর্সা
ঘুরেঘুরে ফিরেতো আসে, আসেতো ফিরে
তুমি চলে যাও, তুমি চলে যাও, আমাকে ঘিরে
জড়ায়ে মোহ বাতাসে মদির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন
মা
মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।
অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।
একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে
ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন