সমৃদ্ধ রাষ্ট্রভূমির স্বপ্ন কি তবে হারিয়ে যাবে
ফকির ইলিয়াস
=======================================
তীব্র উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে জামায়াত-বিএনপি আয়োজিত ১২ মার্চের মহাসমাবেশ শেষ হয়েছে। মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই দিনটি অতিবাহিত হওয়ায় দেশের মানুষ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। অনেকেই দিনটিকে 'সরকারি হরতাল' বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার কারণ সরকার অলিখিত ফরমান জারি করে রাজধানী ঢাকাকে গোটা দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ঢাকায় জনসমাগম ঠেকানো। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সরকারের শীর্ষ স্থানীয়রা বারবার এই '১২ মার্চ'কে তাদের ভাষণে গুরুত্ব দিয়ে প্রধান আলোচনার বিষয় করে তুলেছিলেন।
একটি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী যখন কোন জনসমাবেশকে ঘিরে নাশকতার আশঙ্কা করেন তখন আর কারোই কিছু বলার থাকে না। সরকারের অবশ্যই উচিত হয় সেই নাশকতার অপচেষ্টা ঠেকানো। বর্তমান সরকার ১২ মার্চকে ঘিরে সেই চেষ্টা করেছিল। বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার পুলিশ ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ঢাকার সঙ্গে সড়ক, নৌ-যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন কেন করা হয়েছিল? ঢাকার আবাসিক হোটেলগুলোতে অলিখিত খবরদারি কেন জারি করা হয়েছিল? গোটা ঢাকাকেই কেন 'হরতাল প্রায়' করে তোলা হয়েছিল?
হ্যাঁ, সরকারপক্ষ হয়তো এটাকে তাদের শান্তি রক্ষার একটি পদ্ধতি বলতে পারে। কিন্তু এ পদ্ধতির মাধ্যমে মূলত বিরোধীদলের আন্দোলনকেই গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়েছিল। প্রধান বিরোধীদল মনে করেছে, সরকার ভীত হয়েই এমন কাজ করছে।
খুব গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সরকারের সাম্রাজ্য থেকে একে একে পালক খসে পড়ার দৃশ্যগুলো। সাগর-রুনি হত্যাকা-ের এক মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এখনো দোষীদের কোন সন্ধান করা যায়নি। কেন সম্ভব হয়নি? বিষয়টি গোটা রাষ্ট্রের জন্য চরম পীড়ার কারণ হচ্ছে ক্রমেই। ঢাকার অভিজাত এলাকায় নৃশংসভাবে খুন হলেন সৌদি কূটনীতিক খালাফ বিন আলি। খালাফ হত্যার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপনে বলেছিল, খালাফ বিন আলি 'কূটনীতিক' নন। কূটনীতিকের প্রকৃত সংজ্ঞা কী? তিনি ঢাকার সৌদি দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি ছিলেন। বাংলাদেশে সৌদি নাগরিকদের সুবিধা সংরক্ষণ তার দায়িত্বের আওতাভুক্ত ছিল। 'কূটনীতিক' কি না, তা তো মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হচ্ছে একজন বিদেশি বাংলাদেশে নৃশংসভাবে খুন হলেন। এখন পর্যন্ত এর কোন সুরাহা সরকার করতে পারল না। এদিকে পত্র-পত্রিকায় খবর বেরোচ্ছে এ ঘটনার পর রিয়াদ, জেদ্দা, মক্কাসহ বিভিন্ন বড় বড় শহরে শ্রমজীবী বাংলাদেশের ওপর খড়গ নেমে এসেছে। কারণে-অকারণে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এসব প্রবাসী শ্রমিকের পরিবার-পরিজন শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান 'মেঘ' তার মা-বাবার হত্যার বিচার চেয়ে রাজপথে নেমে এসেছে। অবুঝ এ শিশুর আহাজারি মানবিক বিবেককে দংশন করছে প্রতিদিন। এই যে চরমভাবে সরকারি ব্যর্থতা, তা ক্রমেই গণমানুষকে হতাশ করে তুলছে। মানুষ তো একটা প্রত্যাশা নিয়েই মহাজোটকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল।
এটা খুবই দুঃখজনক, বর্তমান সরকার শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যার বিচার এখনো সম্পন্ন করতে পারল না। অথচ তিনি ছিলেন এ দলেরই সাবেক অর্থমন্ত্রী, যে দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বর্তমানে ক্ষমতায় আছে।
এসব দুঃখ বলার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না এদেশের মানুষ। চারদলীয় জোট সরকার অনেক অপশাসন এ দেশে করেছে। তা দেশের মানুষ ভুলে যায়নি। কিন্তু তাই বলেই তো মহাজোটকে এদেশের তরুণ প্রজন্ম ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিল।
আজ যখন মহাজোটের শরিকরাই প্রশ্ন তোলেন- 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা কার স্বার্থ রক্ষা করে কথা বলছেন?' কিংবা 'প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের কারও কারও মুখের ভাষায় মনে হয় তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন।' তখন বাংলাদেশের মানুষের চরমভাবে হতাশ না হয়ে কোন উপায় থাকে না। এমন তো কথা ছিল না। কোথায় যেন একটি সমন্বয়হীনতার অভাব। মন্ত্রীদের একে-অন্যের কথায় কোন সামঞ্জস্য নেই। রাষ্ট্র তো এভাবে চলতে পারে না।
প্রধান বিরোধীদল বিএনপি জোট সম্প্রসারণ করার ঘোষণা দিয়েছে। আরও কিছু নামসর্বস্ব দল এ জোটে যুক্ত হয়েছে। তা বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে খুব বড় ফ্যাক্টর বলে আমি মনে করি না। মূল কথা হচ্ছে, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতা ক্রমেই বেরিয়ে পড়ছে। মনে রাখা দরকার, ১২ মার্চের সমাবেশ স্তিমিত করে দেয়ার প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিরোধীদলের আন্দোলন দমানো যাবে না। বিএনপি নেত্রী মধ্য জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন। এরপর আরও বড় কর্মসূচির হুমকি দিয়েছেন। এসব ঘোষণা দেশকে অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে। এটা কে না জানে, খালেদা জিয়ার এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তার দল এবং জোট ক্ষমতায় আসতে না পারলে তার দুই ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। আর যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদেরও জেলহাজত থেকে বের করে আনা যাবে না। তাই যে কোন মূল্যে তার ক্ষমতা চাই। এ জন্য তিনি সব ধরনের কঠোর কর্মসূচি দিয়েই যাবেন।
এসব কর্মসূচি থেকে জনগণকে ফিরিয়ে রাখার একমাত্র পথ হচ্ছে রাষ্ট্রে সুশাসন, ন্যায়বিচার ও জানমালের নিরাপত্তা প্রদান। কিন্তু আমরা দেখছি সরকার তা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। সরকার পক্ষের কোন কোন নীতি-নির্ধারক হয়তো বলবেন- কোন তৃতীয় পক্ষ কালো শক্তি সুবিধা বুঝে এসব অঘটন ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাইছে। হ্যাঁ, তা চাইতেই পারে।
আমরা ১৯৭১ সালে দেখেছি পাকসেনা ও হানাদার বাহিনীর দোসররা পেট্রল ঢেলে বাংলার গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মানুষ জান বাঁচাতে দৌড়াচ্ছে। অথচ সে সময়ও আগুন লাগা ঘর থেকে টাকা-কড়ি, স্বর্ণালঙ্কারসহ দামি জিনিসপত্র লুট করে নিচ্ছে একটি লুটেরা মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী। বাংলাদেশে এ সময় কী তবে তেমন কোন লুটেরা ঘাতকবাহিনী ঢুকে পড়েছে? এরা কারা? এদের শায়েস্তা করা, বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দায়িত্ব তো সরকারেরই। সরকার তা করেছে না কেন?
চারদলীয় জোটের সময়ে শাহ কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারকে খুন করা হয়। এর কোন বিচার হয়নি ওই সময়ে। দেশজুড়ে বোমা হামলা হয়। একুশে আগস্টের নৃশংসতম গ্রেনেড হামলা হয়। সেসব দিনের কথা বাংলাদেশের মানুষ ভোলেনি।
বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের সেসব আর মনে নেই। তিনি ঢাকার মহাসমাবেশে বলেছেন, তরুণদের চাকরির ব্যবস্থা করবেন। বলেছেন, টেকনিক্যাল কারণে এখন সে প্রক্রিয়া বলবেন না। ক্ষমতায় গেলে বলবেন। এটা বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতা খুব ভালো করে জানেন, ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের মতো আলাদিনের চেরাগ কোন রাজনীতিকের হাতেই নেই। এমন রাতারাতি পরিবর্তন তারা চানও না। বিএনপি তো দীর্ঘ সময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। তারা তরুণদের জন্য কী করেছে অতীতে? দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান পলিটিশিয়ানদের জন্য পলিটিক্সকে ডিফিকাল্ট বানাতে গিয়ে ছাত্র-সমাজের হাতে কাড়ি কাড়ি টাকা, সুযোগ-সুবিধা তুলে দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার তনয় তারেক রহমান যে হাওয়া ভবন গড়েছিলেন, সেখানে একদল তরুণ ছিলেন দুর্নীতিবাজদের প্রধান রক্ষক এবং অংশীদার। খালেদা জিয়া কি তরুণদের আবারও আগের কায়দায় টোপ দিচ্ছেন?
মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ এখন স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। এখানে সরকারি এবং বিরোধীদলের যুদ্ধদেহী আচরণ দেখার জন্য এদেশের মানুষ মোটেই প্রস্তুত নয়। ৩০ লাখ শহীদ তাদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন এই উত্তর-প্রজন্মের শান্তির জন্য। সমৃদ্ধ রাষ্ট্রভূমির জন্য। আমরা দেখছি, প্রধান দু'দলের পারস্পরিক স্নায়ুযুদ্ধ প্রজন্মের সে স্বপ্নকে বারবার চুরমার করে দিচ্ছে। এ থেকে মুক্তির পথ কী? তা আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে।
সব সমস্যার সুরাহা করতে আলোচনার কোন বিকল্প নেই। জাতীয় সংসদ অবশ্যই হতে পারে সে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বাঙালিরা যে পাকহানাদারদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল, আজকের বাংলাদেশ সেই পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের ছায়াভূমি হতে পারে না। না, এমন বাংলাদেশ আমরা চাইনি। দেশকে ভালোবাসতে চাইলে ছাড় দিতেই হবে। খালেদা জিয়া তার ছেলেদের বাঁচাতে সেই ছাড় দিতে পারবেন কি?
বাকি যে দেড় বছরাধিকাল সময় বর্তমান সরকারের হাতে আছে, সে সময়টুকু জনগণের দুর্ভোগ বাঁচাতে যদি বর্তমান সরকার দায়বদ্ধ হয়, তবে কিছুটা হলেও অবস্থার উন্নতি হতে পারে। আপাতত সেটাই হোক প্রত্যাশা।
নিউইয়র্ক , ১৪ মার্চ ২০১২
------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ/ ঢাকা / ১৬ মার্চ ২০১২ শুক্রবার প্রকাশিত
সমৃদ্ধ রাষ্ট্রভূমির স্বপ্ন কি তবে হারিয়ে যাবে
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(
আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।
ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন
মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )
যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন
কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন
একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।
এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।
ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন