দীর্ঘ এক মাস বাড়িতে কাটিয়ে ঈদের পর ঢাকায় ফিরেছি। বাসায় এসে কান্তি চেয়ে গেল। হলে থাকতে সিগারেটের নেশা ছিল, এখনো মাঝে মাঝে একটু আধটু সিগারেটের নেশা হয়। ক্লান্তি কাটানোর জন্য সিগারেটের নেশার ভূত মাথায় চেপে বসলো। বাসা থেকে খানিকটা দূরে এসে টঙ্গয়ে বসে চা,আর একটা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে টানতে লাগলাম। সিগারেটের ধোয়ায় কুণ্ডলী আশপাশটা ভরে গেল। আর দুষিত বায়ুতে নিঃশ্বাস টানতে হচ্ছে দেখে খুব বিরক্ত লাগলো। আর আনমনে ভাবতে লাগলাম কেন যে আমার মত মানুষগুলো সিগারেট খায় ? অযথাই কেন যে আশপাশের পরিবেশটাকে দূষিত করে ? আমার মত বোকাগুলো এর মাঝে কি সুখ খুঁজে পায় আমারও বুঝে আসেনা। তবুও নেশা ছাড়ে না অপদার্থের মত খেয়ে যায়। বিল চুকিয়ে বাসার পথ ধরলাম। গড়ির কাঁটা একটা ছুঁইছুঁই, চারদিক তখন একেবারে নীরব নিস্তব্ধ; এমনিতে ঈদের ছুটিতে ফাকা ঢাকা শহর তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। দূরে একটি কুকুর অবিরাম চিৎকার করে চলছে। গভীর রাতে কুকুরের ডাকটাই যেন কেমন! শুনলে গা ছম ছম করে উঠে আমার! কেমন যেন একটা বিদঘুটে ভাব ডাকটার মধ্যে। সেই ডাক এই রাতের নিস্তব্ধতাকে বাড়িয়ে তুলেছে। গা ছমছম করছে হঠাৎ করেই; হাটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম! মনে হল, রাস্তার একটু দূরেই অন্ধকার গলির মুখে কে যেন ফুঁপিয়ে কাঁদছে! শুনেছি রাতের শহরে বোকা পথিকদের এমন ভাবে ঘায়েল করা হয়। দোয়া কুনুত পড়ে নিলাম। পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া রিকশা ওয়ালা বললো মামা ওরা ওরা পালান বলে জোরে প্যাডেল হাঁকিয়ে চলে গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম দেখবো কে কাঁদছে, যদি আমার কিছু খোয়াও যায় একটা পানিতে পড়া মোবাইল আর পকেটে আশ্রয় পাওয়া দুইশ বিশ টাকার বেশি কিছুতো নয়। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটের আলো ফেলতেই দেখি অসম্ভব একটা সুন্দরি তরুণী। দেখে মনে হল উচ্চ ঘরের নয়তো শিক্ষিতা। গায়ে নতুন জামা। আলো পড়তেই মুখ হাত দিয়ে ডেকে কাঁদছে। এই মেয়ে তুমি কে? এখানে, এত রাতে, কাঁদছ কেন? আরো জোরে কেঁদে চলছে। আসলে মানুষের যখন কান্না পায়, তখন কেউ সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে গেলে কান্নার বেগ বেড়ে যায়। মানুষ একা যত সাহসী হয়, কেউ পাশে থাকলে তার অর্ধেকও সাহসী হয়না। এই মেয়ে আমি কি মানুষ ডাকবো? উত্তর দিচ্ছেনা কেন? হঠাৎ করে দুই পা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। ভাইয়া, আপনার আল্লাহর দোয়াই মানুষ ডাকবেন না। আমাকে কি আজ রাতে আপনার বাসায় আশ্রয় দেওয়া আয়। মেয়ে বলে কি! গা চমকে উঠলো আমার! যুবক বয়স আর একটা যুবতি মেয়ে এত রাতে আমার সাথে থাকবে। নিজের প্রতি ভয় পেয়ে গেল, এই ভেবে যদি এই যুবক বয়সের ঘুমন্ত শয়তান জেগে উঠে! পাশ কাঁটিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যেতেই ভাইয়া ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালাম। আমাকে কি আশ্রয় দেওয়া যায় না? আমি খারাপ নয়। আমার কোন দোষ নাই। এবার আর ধমক দিলাম না! আমি বললাম, কোন চিন্তা করবেন না। ঠিক আছে আসুন। বাসায় নিয়ে আসলাম। তার সাথে আর কোন কথা বললাম না। যেহেতু আমি ব্যাচেলর আর এক রুমে থাকি তাই পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে পড়তে হল। সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি সে নাই। মনে হল আমি সত্যি একটা বোকা! আমার সব নিয়ে গেল। দৌড়ে মানিব্যাগ চেক করে দেখি টাকা আগের মত গুছালোই রয়েছে। ল্যাপটপ আর মোবাইলগুলো ও আগের মত পড়ে আছে। খেয়াল করলাম বালিশের উপর একটা চিঠি;
ভাইয়া,
আমি সারারাত ঘুমাইনি, এই ভয়ে কখন আমার সতীত্ব নষ্ট হয়। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন পতিতা বা রাতের নিশাচরের সতীত্বটা আবার কি? আমি একজন ছাত্রী। যদিও আপনার মত না। আপনাকে মিথ্যা বলবো না; আপনি যেখানে আমাকে দেখেছেন তার উল্টো পথে একটু এগোলেই আমার বাসা। আমার মা একজন খারাপ মহিলা যিনি বাবার অবর্তমানে বাসায় বিভিন্ন জনের সাথে অবৈধতায় লিপ্ত হচ্ছে। আমি প্রতিবাদ করায় আমাকে আপনি দেখার দশ মিনিট আগে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল। লোক লজ্জার ভয়ে কাউকে জানাতে পারিনি বলে ভয়ে অন্ধকার গলিতে কান্না করছিলাম। আপনি আমাকে রক্ষা করেছেন। আর সকালে আপনাকে মুখ দেখাতে পারবোনা এই ভয়ে চলে গেলাম। আর চাচার বাসায় যাওয়ার জন্য দুইশ টাকা নিয়ে গেলাম।
চিঠিটা পড়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম- নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হল, এমন কতজন বিপদে পড়েন। আর অথচ আমরা তাদের পতিতা মনে করি অথবা রাতের শিকারিনী। একজন বিপদগ্রস্ত হয়ে রাতে আশ্রয়ের অপেক্ষায় থাকলেও প্রতারক ভাবি।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৫৮