যেহেতু ঘুরতে বের হয়েছি এক দেশ আর কতদিন ভালো লাগে, তাই এবার চললাম সুইজারল্যান্ড। নেদারল্যান্ড এর আমাস্টারডাম বিমান বন্দর থেকে আমাদের ফ্লাইট। আমাস্টারডাম থেকে জার্মানির মিউনিখ বিমান বন্দরে এক ঘন্টার ট্রানজিট। মিউনিখ থেকে সুইজারল্যান্ড এর জেনেভার ফ্লাইট। আমাস্টারডাম বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশন শেষ করে সাথে থাকা বড় দুইটা লাগেজ ৬০ ডলারে বুকিং দিয়ে আমরা প্লেনে চড়লাম। ইউরোপের এই সিস্টেম আমার ভালো লাগেনি। এক দেশ থেকে আরেক দেশে গেলে লাগেজ বুকিং দিলে প্রতি লাগেজে ৩০ ডলার চার্জ দিতে হয়।
ট্রেন কিছুক্ষন চলার পর চারদিকেই সবুজের হাতছানি
নেদারল্যান্ড থেকে এক ঘন্টায় আমরা জার্মানির মিউনিখ বিমান বন্দরে চলে এলাম। সুইজারল্যান্ডের ফ্লাইট ধরতে দৌড়ানো ছাড়া উপায় নাই, কারন সুইজারল্যান্ড যাওয়ার প্লেন একদম বিমান বন্দরের শেষ দিকে। দৌড়ে এসে ফ্লাইট ধরলাম। প্লেনে বসে চিন্তা করছিলাম আমরা তো সময় মতই সুইজারল্যান্ড চলে যাবো কিন্তু আমাদের যে লাগেজ বুকিং দিয়েছি তা সময় মতো আসতে পারবেতো? কারন মাত্র এক ঘন্টায় এক প্লেন থেকে আরেক প্লেনে লাগেজ আসাটাও একটা কঠিনই।
আমরা এক ঘন্টায় চলে এলাম সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিমান বন্দরে। এসেই কত নাম্বার বেল্টে আমাদের লাগেজ দিবে সেখানে দাঁড়ালাম। পাশেই দেখি লাইন দিয়ে ট্রলি রাখা কিন্তু লক করা, ট্রলির এখানে এক ইউরো দিলেই ট্রলির লক খুলে যায়, এই এক ইউরো চ্যারিটির কাজে ব্যবহার করে তারা। এক ইউরো দিয়ে ট্রলি নিয়ে বেল্টের কাছে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু বেল্ট আর ঘুরেনা, কোন লাগেজও আসেনা। কিছুক্ষন অপেক্ষা করে বিমান বন্দরের ইনফরমেশন সেন্টারে গেলাম, তারা বললো যেখানে লাগেজের জন্য অভিযোগ করা হয় সেখানে গিয়ে জানাতে। অভিযোগ করার রুমে গিয়ে দেখি অনেকেই তাদের লাগেজ না আসার অভিযোগ একটা ফর্মে লিখছে। যখন আমাদের পালা এসেছে আমরাও ফর্ম নিয়ে সব লিখলাম। অভিযোগ কেন্দ্রে বসা মহিলা কম্পিটারে চেক করে বললো ট্রানজিট খুবই অল্প সময়ের হওয়াতে লাগেজ আসেনি, এখনো জার্মানিতেই আছে, লাগেজ আসবে বিকাল ৫টার পর। আমরা চাইলে ৫টার পর এসে লাগেজ বিমান বন্দর থেকে নিয়ে যেতে পারি অথবা আমরা যেখানেই থাকিনা কেন সেই ঠিকানা দিয়ে গেলে বিমান কর্তিপক্ষ তা আজ রাতের মধ্যে অথবা আগামিকাল সকালেই আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসবে। আমাদের যোগাযোগ করার জন্য ইমেইল এড্রেস দিয়ে দিয়েছে। ফর্মে আমাদের লাগেজের কালার লিখে দিয়ে আরো যা তথ্য চেয়েছে সব লিখে আমরা বললাম আমাদের ঠিকানায় লাগেজ পাঠিয়ে দিতে।
ইন্টারলেকেনের কাছাকাছি এসে ট্রেন থেকে দেখি বিশাল একটা লেক, পানি পুরাই নীল
এক সময় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো তখন ট্রেনের জানালার কাঁচও ঝাপসা হয়ে এলো
বিমান বন্দরে আমাদের একজন পারিবারিক বন্ধু অপেক্ষা করছিলো। উনার সাথে দেখা করে আমরা বিমান বন্দর থেকেই সুইজারল্যান্ডের সিম কিনে নিলাম। সুইজারল্যান্ড যাওয়ার আগেই একজন ট্রাভেলারের সাথে আমি সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ নিয়ে আলাপ করেছিলাম, সে আগে সুইজারল্যান্ড ঘুরে এসেছে। তাই আমরা কোথায় যাবো, কোথায় থাকবো, কি দেখবো সমস্ত কিছু আগেই আমি এই ট্রাভেলারের সাথে আলাপ করে ঠিক করে রেখেছিলাম।
হোটেলে উঠে বারান্দায় গিয়ে আমার চোখের সামনেই এই দৃশ্য
আমাদের গন্তব্য সুইজারল্যান্ডের ইন্টারলেকেন, যেখানে যেতে ট্রেনে জেনেভা থেকে প্রায় চার ঘন্টা লাগে। আমরা যেহেতু জানিনা কিভাবে কি করতে হবে, কোথায় স্টেশন তাই আমাদের পারিবারিক যে বন্ধু তাকেই বললাম সব বুঝিয়ে দিতে। জেনেভা বিমান বন্দরের নিচেই স্টেশন। আমরা ট্রেনের টিকেট কাটতে গেলাম, ১৫ মিনিট পর পর ট্রেন ছেড়ে যায়, টিকেট কাটার সময় বললাম আমার ছেলে আছে যার বয়স সাড়ে বারো তার জন্য কোন ছাড় আছে কিনা। যে মহিলা ট্রেনের টিকেট দিবে সে ছেলের পাসপোর্ট দেখে ছেলের জন্য দুইটা সুইস পাস দিয়ে দিয়েছে, বললো এই সুইস পাস দেখালে এক বছর পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের ট্রেনে, বাসে, ট্রামে এমনকি যেসব ট্যুরিষ্ট স্পট দেখতে টিকেট কাটতে হয় ছেলের জন্য সব ফ্রি। ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডে সবার জন্যই এসব ফ্রি। মনে মনে বিরাট খুশি হয়েছি সুইস পাস পেয়ে, কারন ট্রেনের টিকেট, ট্যুরিষ্ট স্পটের টিকেট সুইজারল্যান্ডে খুবই এক্সপেন্সিভ।
ট্রেন আসতে আরো কিছু সময় বাকি আছে তাই এই ফাঁকে আমরা স্টেশনের রেষ্টোরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। খাওয়ার পর আমাদের পারিবারিক বন্ধু আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো, উনার সাথে আমরা পরে আবার দেখা করবো যখন ঘুরে ফিরে জেনেভা আসবো। ট্রেন আসার পর উঠে পরলাম ট্রেনে, দোতলা ট্রেন কিন্তু পুরা ট্রেনই ফাঁকা। ট্রেন আসার সময়ের এক সেকেন্ডও এদিক সেদিক নাই। একদম ঠিক সময়ে ট্রেন আসে।
ট্রেন যখন চলতে শুরু করেছে তখন মনে হচ্ছিল ঢাকার মতই আশপাশ। কিছুটা হতাশ হলাম, মনে মনে যে সুইজারল্যান্ডের ছবি এঁকে রেখেছি তা কই? আধা ঘন্টা পরই ট্রেনের জানালা দিয়ে যখন দুইপাশে অবারিত সবুজ আর সবুজ দেখছিলাম আর দূরে সুইস আল্পসের উপর সাদা বরফে ঢাকা তখন শুধু মনে হচ্ছিল ওয়াও এত্ত সুন্দর, এইতো সেই সুইজারল্যান্ড যার ছবি আমার মনে আঁকা। চারদিকে এত সুন্দর ছবির মত যে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে হচ্ছিলনা। এসব দেখতে দেখতে আরেক স্টেশনে আমাদের ট্রেন বদল করতে হয়েছিলো কিন্তু টিকেট আর নতুন করে কাটতে হইনি, তারপর এক সময় চলে এলাম ইন্টারলেকেন স্টেশন।
হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়েই একটু ঘুরতে বের হয়েছিলাম আশেপাশে
হোটেল বুকিং দেওয়ার সময় দেখাচ্ছিলো স্টেশন থেকে আমাদের হোটেল ১০ মিনিট হাটার দূরত্বে। কিন্তু যেহেতু চিনিনা আর হাল্কা বৃষ্টিও হচ্ছিল তাই আমরা ট্যাক্সি নিলাম। বসার সাথে সাথেই ট্যাক্সি আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিয়েছে। হোটেলে সব ফর্মালিটি শেষ করার পর হোটেল থেকে তারা আমাদের ইন্টারলেকেন পাস এর দুইটা টিকেট দিয়েছে, আমরা যতদিন ইন্টারলেকেন থাকবো ততদিন এখানকার সব বাসে এই টিকেট দেখালে ফ্রি চলা যাবে। হোটেলের এক সাইডে ফ্যামিলি রুম, আরেক সাইডে ব্যাচেলরদের রুম। অনেকেই ঘুরতে আসে যারা কম খরচে থাকতে চায়, তারা যাতে একই রুমে তিনজন, চারজন, ছয়জন থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা করা। এটা ব্যালেচর, ছাত্রদের জন্য খুবই ভালো ব্যবস্থা, একই হোটেলে হোটেল আর হোস্টেল দুইটাই আছে। আবার কিছু কিছু আছে শুধুই হোস্টেল।
এটা আমাদের হোটেল
শীতের কারনেই হয়তো ওখানে কাঠের ব্যবহার বেশি হোটেল আর বাড়ি বানাতে।
চাবি নিয়ে তিনতলায় গেলাম আমাদের রুমে। আমাদের তিনজনের তিন বেডের বিশাল এক রুম, সাথে বারান্দা। রুমে গিয়ে বারান্দায় গিয়ে পুরাই অবাক, আবারো মুখ দিয়ে নিজেই বের হয়ে এলো ওয়াও এত্ত সুন্দর। আমার সামনে সুইস আল্পস, সুইস আল্পসের উপরে বরফে ঢাকা আর পাহাড়ের গায়ে পাইন গাছ, এ যেন এক স্বর্গিয় পরিবেশ। এটাই আমার জীবনের প্রথম এত কাছে থেকে বরফের পাহাড় দেখা।
লাগেজ তো আসেনি তাই একটু ফ্রেশ হয়ে কফি খেয়ে এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে হোটেলের সামনের রাস্তায় গেলাম, সব কিছু এত সুন্দর এত গুছানো যে মনে হচ্ছিল সারা জীবন এখানে কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হতোনা। হেঁটে আশেপাশের রাস্তায় আরো ঘুরতে চাইলাম কিন্তু বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়াতে তা আর হইনি, একে বৃষ্টি আর প্রচুর ঠান্ডা তাই হোটেলে চলে এসে বারান্দায় বসে সুইস আল্পসের সৌন্দর্যই দেখছিলাম। ইন্টারলেকেন খুবই নিরিবিলি, চোখে কোন মানুষই পরেনা, রাস্তাঘাট একদমই ফাঁকা, ট্যুরিষ্ট ছাড়া স্থানীয় লোকজন দুই পারসেন্ট আছে কিনা সন্দেহ। আর এই এলাকাতে ট্যুরিষ্ট আসে বছরে কয়েকমাস বাকি কয়েকমাস বরফে ঢাকা থাকে বলে হোটেল, রেষ্টরেন্ট সবই নাকি বন্ধ থাকে।
হোটেল থেকে ফোন দিয়ে বললো রাত ৮টার পর পরই সব খাবারর দোকান এখানে বন্ধ হয়ে যায়, হোটেলের রেষ্টোরেন্ট তারা ৯টার মধ্যে বন্ধ করে দেয়, আমরা রাতের খাবার যেন শেষ করে ফেলি। এত ঠান্ডা আর অচেনা পরিবেশ বলে বাইরে আর যেতে চাইনি, হোটেলের রেষ্টোরেন্টেই খাবার অর্ডার দিলাম। থ্রি স্টার মানের হোটেল হলেও খাবার হয় রেষ্টোরেন্টে বসে খেতে হবে অথবা নিজে গিয়ে খাবার রুমে নিয়ে আসতে হবে। খাবার আনতে নিচে গেলাম আর তখনই রিসিপশনে দুইজন লোক এসে আমাদের খোঁজ করছিলো, তারা জেনেভা থেকে আমাদের লাগেজ নিয়ে এসেছে এবং এক পয়সাও চার্জ করেনি। এত সুন্দর এদের সার্ভিজ আর সব কিছুই এত নিয়ম মাফিক বলেই হয়তো সুইজারল্যান্ড অনেকের পছন্দের তালিকায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ৭:৫২