এক
ব্যাপারটা বিব্রতকর।
পুরোটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তানিম ভাইয়ের সাথে সর্বসাকুল্যে দেখাই হয়েছে বড়জোর দশ কী বিশ, মেরেকেটে খুব বেশি হলে ত্রিশবার। ক’টা মাপা হাসির সালাম আর “কী অবস্থা? কেমন চলছে?” এইতো! এর বাইরে কোনো বাক্যের আদানপ্রদান হয়েছে বলে স্মৃতি সাক্ষ্য দেয় না নিয়াজের।
সেই তানিম ভাই এখন পোষা মুরগির জন্য ভাত ছড়ানোর মতো করে চাকরি ছড়িয়ে দিচ্ছেন-
বন্ধুদের মাঝে; পরিচিত, অল্প পরিচিত। জুনিয়রদের মাঝে; পরিচিত, অল্প পরিচিত।
এমনকি সিনিয়রদের মাঝেও; পরিচিত, অল্প পরিচিত।
ঢাকা, রংপুর, রাঙ্গামাটি। বিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ।
কোন সে স্বর্ণালী যোগাযোগ, তা জানে না নিয়াজ, তবে পিলপিল করে বিপুল তানিমবাডি জনতার চাকরি হচ্ছে - চাকরির বাজারের সাথে কুশলবিনিময়সময়ে বাজার তাকে এই তথ্যটা দেয়। এখন অতি অল্প পরিচিতির সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরির জন্য তানিম ভাইয়ের কাছে হাত পাততে হবে কাল।
ব্যাপারটা বিব্রতকর।
কিন্তু উপায় নেই। এদিকে লোকটা কেমন তাও ঠিকমত জানে না নিয়াজ। দু চারজন নিয়াজের বন্ধু যারা তানিম ভাইকে চেনে তারা বলেছে-খুব ভালো।
হলেও বা কতোটুকুই বা আর খারাপ হবেন? কতোটুকুই বা আর বলবেন? খুব বেশি হলে ক’টা কড়া কথা আর অনেকটা অপমান, এইতো! তা এই অসহায় দারিদ্রকালে অতোটুকু রিস্ক নেয়াই যায়। নিয়াজ জানে- “আমি আপনার গুণমুগ্ধ বেকার একটা জুনিয়র ভাই” সুনিপুণ ভদ্র ভাষায় ভিক্ষা ছাড়া কিছুই না। এবং এই সত্য যে তানিম ভাইও জানেন, তা নিয়াজ বোঝে বলেই একটা লাগামহীন লজ্জা নিয়াজকে গ্রাস করে।
নিয়াজ অভিভাবক মুডে দর্শন চর্চা করে-ভিখারী্ এতো লজ্জা পেলে লজ্জা নামক আবেগটারই অপব্যবহার।
কিছু বিকট বাস্তবতা আর এইসব স্বীয়স্বান্তনার পাশে আজগুবি আত্নসম্মানে টইটুম্বুর মননে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বেকার গোঁয়ার যুবকটাকে দাঁড় করালে তানিম ভাইয়ের সাথে দেখা করাটার দিকে দাঁড়িপাল্লা ভারি হয়ে আসে নিয়াজের।
তাছাড়া হয়তো রুহির সাথে দেখা হবে, কথাও হতে পারে প্রথমবারের মতো।রুহির স্বামীর কাছে চাকরির চাহিদা নিয়ে চামচিকার মতো করে লেগে থাকা অবস্থায় চাকচিক্যহীন নিয়াজ তেলতেলে একটা নাজুক মুহূর্তে থাকবে ঠিক। কিন্তু তাও!! রুহি তো রুহিই। তার সময়ে ব্যাচের তো বটেই, পুরোটা ক্যাম্পাসেরও সম্ভবত ডাকসাইটেতম সুন্দরী ছিলো, এখনো সবাই এক নামে চেনে; এমনকি যারা রুহিকে এলাকায় পায়নি তারাও। স্বাভাবিকভাবেই রুহি সবাইকে চেনে না। সেই না চেনা নিয়াজ জনতাদল এতোটাই রুহি সৌন্দর্যে বিমোহিত এবং রুহিবিষয়ে বিশেষজ্ঞ যে রুহি যাদেরকে বন্ধু বলে গণ্য করে তাদেরকেও তারা চেনে এবং সেই রুহিবন্ধুদেরও অনেকেই অনেকগুলো নিয়াজকে চেনে না। ভাগ্যে ভাগ্যে তানিম ভাইয়ের সাথে হাই হ্যালো হলেও তো একটা চেনাজানা আছে। সেই চিকন সূতাটা ধরে চাকরি একটা হোক বা না হোক, সুন্দরীতমার সাথে দু’একটা বাকবিনিময় তো হতে পারে। খুব অসম্ভব আজগুবি চাওয়া তো কিছু না।
অথচ রুহি যখন শত সহস্র রাজপুত্রশ্রী যুবকের, মেধামল্লারমাঝী যুবকের ক’সাগর কান্নার দিকে হতাশ চাহনি চেয়ে অনেক গুজব গুঁজে দিয়ে সত্যি সত্যি তানিম ভাইয়ের বধূ হয়ে ওঠে, তখন নিয়াজদের আড্ডায় আরো ক’টা নিয়াজের সাথে নিয়াজও একমত হয়- চোখের দেখার আড়ালে, জানার আড়ালে অন্য কোনো রূপ, অন্য কোনো গুণ তানিম ভাইয়ের কিছু একটা আছে যা সম্পর্কে তারা অবহিত নয়। এর মাঝে ঠাট্টাবাজতম নিয়াজটা যখন নিঃশ্বাসের নিচে একনাগারে “লম্বা ধোন, লম্বা ধোন” জপতে থাকে, তখন নিয়াজরা না হেসে পারে না।
তা নিয়াজ জানে সে তানিম ভাই সম্পর্কে কী ভাবে, কী জানে সেটা ব্যাপার না; দেখানোটাই ব্যাপার।
দুই
নিপাট ভালো ছেলে বেশ নিয়ে রিকশা থেকে নামার পর নিয়াজের মাথায় আসে- কিছু একটা নিয়ে যাওয়া উচিত। মানিব্যাগে ঋণাত্নক কিছু টাকা থাকার কথা, মিষ্টি রঙের দু’টো হাজার টাকার নোট আছে নিশ্চিত-রাসেলের কাছ থেকে মোটামুটি জোর করে নেয়া। দিনে দিনে মাসে মাসে ফুলে ফেপে বেড়ে ওঠা সেই ঋণাত্নক অর্থপাহাড় ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর নিমিত্তে যদি পাহাড়টাকে আগে একটু বাড়ানোই লাগে, লাগুক। বাচ্চাকালে গ্রামে দেখেছে- মেশিন দিয়ে জমিতে পানি দেওয়ার জন্য মেশিনেই আগে পানি ঢালতে হয়, তারপর পানি আসে। নিয়াজও নাহয় টাকা আসার আগে টাকা ঢাললো কিছু।
আরো কিছুক্ষণ পর সুন্দরী ও তার স্বামীর জন্য এক কেজি শাদা সন্দেশ আর এক হাড়ি খয়েরী হালিম হাতে নিয়ে কলিংবেলের সামনে দাঁড়িয়ে আত্নবিশ্বাসবর্ধনে ক’টা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিয়াজ।
বাসায় ঢোকার মিনিট পাঁচেকের মাঝে একটা তথ্য নিয়াজকে কিঞ্চিত বিমর্ষ এবং একটা অনুধাবন অনেকটা পুলকিত করে তোলে।
তথ্য- রুহি বাসায় নেই। কিছু একটা কেনাকাটা করতে কোনো একটা বাজার, কিংবা মার্কেট কিংবা মল কোথাও গেছে। কী কিনতে কোথায় গেছে এবং কখন আসবে এই জাতীয় প্রশ্ন মনে উঁকিঝুকি মারলেও তানিম ভাইকে তা জিজ্ঞেস করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন থেকে নিজেকে বিরত রাখার বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নেয় নিয়াজ।
অনুধাবন- তানিম ভাই চমৎকার একটা লোক। চাকরির লোভে না, এম্নিতেই কেনো এহেন ভালোমানুষ টাইপ মানুষটার সাথে এক জীবনে জম্পেশ খাতির জমাতে পারলো না তা নিয়ে মনে মনে নিজেকে কিছুটা নিন্দা করে নিয়াজ আর রুহির প্রশংসা করে অঢেল। সুন্দরীর বুদ্ধি আছে বটে! বাজার বুঝে বেছে বেছে সর্বাধিক বন্ধুবাতসল্যপূর্ণ বিপশ্চিৎ যুবাটিকে বাছাই করেছে।
তানিম ভাই বহুজনের গল্প বলেন। তাদের মাঝে কাউকে কাউকে নিয়াজ চেনে। কাউকে আবার চেনে না। কাউকে আবার না চেনা সত্ত্বেও নিজের ইগনোরেন্স ঢাকার নিমিত্তে চেনার ভান করে। যেটার স্বতস্ফূর্ততা সম্পর্কে নিয়াজ সন্দীহান ছিলো দরজার ওপাশে দাঁড়িয়েও, এপাশে এখন আর নেই; সেই হাসিটা ঝুলিয়ে নিয়াজ চাকরির বাজারের সাথে তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত কুশলবিনিময়ের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করে।
তারপর নিয়াজের বিপুলায়তন লজ্জা আর বিব্রত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তানিম ভাই যখন নিয়াজের জন্য চা বানানোর জন্য নিজেই উঠে পরিক্রমায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন তখন নিয়াজ; যদিও সে খুব ভালোই জানে উত্তর, তাও “ওয়াশরুম?” বলে একটি ভদ্রশব্দের প্রশ্ন করে। তারপর তানিম ভাইয়ের অঙ্গুলির নিশানা অভিমুখে লাগোয়া স্নানঘরটাতে নিভৃত একাকীত্বের মাঝে ঢুকে পড়ে। যত্নের সাথে ছিটকিনি লাগানোর পর দু’পলক দৃষ্টি ফেলতে না ফেলতেই আরো ক’দান দীর্ঘশ্বাস ঠোঁটের মাঝে জমে যায় নিয়াজের। এতো সুন্দর, ঝকঝকে তকতকে একটা বাথরুম, প্রার্থনালয়ও তো এতোটা পরিষ্কার থাকে না। নিয়াজ ভাবে সে গোটা মানুষটাই তো এই শুভ্রতার মাঝে পুরোদস্তুর আবর্জনা একটা, সেখানে তার শরীরের আবর্জনা ফেলাটা কি আদৌ সমীচীন হয়!! সুড়সুড় করে নাকে কিছু সুঘ্রাণ আসে, বিস্তারিত দেখার জন্য ঘাড় ঘুরাতেই কাপড় রাখার স্ট্যান্ডে নিয়াজের চোখ যায়। ভালোমতো পড়া যাচ্ছে না, অর্কিড সম্ভবত, এয়ার ফ্রেশনারের নাম, ঝুলানো। তার পাশেই কী এটা? নিয়াজ অবাক হয়। অবশ্য অবাক হওয়ার মতো কিছু না, না জানারও কোনো কারণ নেই। এক জোড়া অন্তর্বাস। রুহির। ব্রা এবং পেন্টি। দুটোই টকটকে লাল রঙের। স্বাভাবিকতার দাগটুকু পার করে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নিয়াজ। অন্তর্জালে দেখেছিলো কোথাও- অন্তর্বাসের রঙ ম্যাচ করার মাঝে নিহিত তথ্য এই যেঃ মেয়েটিই সংগমের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এবং সেই অনুযায়ী নিজেই তার গোপনতম অঙ্গকে সাজিয়ে এনেছিলো। রুহি আর তানিম ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সময় নিয়ে ভাবে নিয়াজ, ভাবতে ভাবতে আবার কেমন জানি অস্বস্তিও লাগে; রুহি বা তানিম ভাই কেউ বোধহয় বুঝে ফেলছে সে কী ভাবছে তা ভেবে।
এইসব ভাবাভাবি, সুগন্ধ সেবন, ওলোট পালোট ক’টা দীর্ঘশ্বাস আর স্বীয় কর্ম সম্পাদনের একফাঁকে সে দরোজায় বেল শুনতে পায় একটা। তারপর ধারণাকৃত কন্ঠটি শুনতে পায়, রুহির।
নিয়াজ বোঝে না এখনই বের হয়ে যাওয়া ঠিক কিনা। বিশেষত রুহি কেবল এলো, এরই মাঝে তার স্নানঘর থেকে বের হয়ে আসা অজানা অচেনা নিয়াজের মুখোমুখি হওয়ার মতো প্রস্তুতি রুহির থাকাটা কি যুক্তিসঙ্গত? নিয়াজ আরো কিছুক্ষণ বিলাসী কারাবাসের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মাঝে রুহিকে তার উপস্থিতি এবং স্নানঘরের বর্তমান পরিস্থিতি জানানোর জন্য তানিম ভাই কিছুটা সময় পাক, সেই ভালো।
বেশ খানিকটা পর যত্নের সাথে দরজা খুলে এবং লাগিয়ে বেরোতেই নিয়াজ দেখে- বেশ ক’টা নাস্তার বহর নিয়ে তানিম ভাই বসে আছেন একা। রুহি এঘরে নেই। নিয়াজ তার কিংকর্তব্যবিমুঢ় চেহারাটা নিয়ে পুনর্বার তানিম ভাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতেই তানিম ভাই উল্লাস করে ওঠেন- আরে, নিয়াজ!! গেইজ হোয়াট!! রুহিকে বললাম তোমার কথা। ও তো চেনে তোমাকে। তোমার তোলা কোন একটা ছবি দেখে ওর নাকি গ্যুজবাম্পস হয়েছিলো-এই ছেলেটা তো ভালো ফটোগ্রাফার!! তারপর তোমার চাকরির কথা বলতেই ও একটা সন্ধান দিয়ে দিলো। চমৎকার চাকরি। আশা করি তোমার বেকারত্বের অবসান এখানেই। বসো তুমি, চা-নাস্তা খাও। আমি রুহিকে ডেকে নিয়ে আসি। ও-ই বিস্তারিত বলবে।
একাকী ঘরে দাঁড়িয়ে কেমন জানি ধাঁধাঁ লাগে। নিয়াজ বিহবল নয়নে দেয়ালের দিকে তাকায়- হাস্যরত নব দম্পতির বাঁধাই করা ছবিটার পেছন দিক থেকে একটা টিকটিকি বের হয়ে আসে।
আচ্ছা, রুহি কি টিকটিকি ভয় পায়?
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:০৮