২৬শে মার্চ ২০০৪, বৃহস্পতিবার শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী জাদুঘর খুলতেই কর্মচারীদের চক্ষু চড়কগাছ!!
চুরি হয়ে গেছে বিশ্ব কবির নোবেল।শুরু হয় হৈচৈ। গোটা রবীন্দ্র ভবন ঘিরে ফেলে পুলিশ। মঙ্গলবার বিশ্বভারতী বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই চোরেরা ভেতরে ঢুকে অবস্থান নেয়। সারা রাত ধরে মালপত্র সরাতে থাকে। রবীন্দ্র ভবনের পেছনের জানালা ভেঙে ফেলে এই জানালা দিয়ে মালপত্র সরিয়ে নেয় চোর দল।তাতক্ষনিক অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে ২৮ জোড়া পায়ের ছাপ। তার মধ্যে আবার দু জনের পায়ে চটি ছিল। তাই দেখে সিআইডি আইজি ভুপেন্দর সিং বলেন চোর একজন না একাধিক, আর চটি প্রমান করে এরা স্থানীয়।
মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে খবর পৌছানোর সাথে সাথে তদন্তের নির্দশ দেন সিআইডিকে। হতাশা প্রকাশ করেন বিশ্বভারতীর আচার্য ও প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। ফোনে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাথে, আশ্বাস দেন সর্ব্বোচ্চ সহযোগিতার।
চুরির ঘটনায় রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম আজাদ গভির উদ্বেগ প্রকাশ করেন।সাথে যথাযথ কতৃপক্ষকে তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন।
নোবেল চুরির খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সারা ভারত জুড়ে উঠে ক্ষোভ। বিশ্বভারতীর আচার্য ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবী করে। তৃনমূল কর্মীরা বৃহস্পতিবার অনশনে বসে। SFI মিছিল বের করে। প্রধান বিচারপতির আদালতে তিনটি আলাদা মামলা হয়। অমর্ত্য সেন, মহাশ্বতা দেবী, শঙ্খঘোষ সবাই ক্ষোভ আর অবিলম্বে নোবেল উদ্ধারের দাবী জানান।
তৃনমুল নেত্রী মমতা ব্যানার্জী এই চুরির দায়িত্ব বামফ্রন্টের উপর চাপিয়ে দেন আর ওদিকে কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ মন্ত্রী ডঃ মুরালী বলেন তৃনমূল আর কমিউনিষ্টদের অশ্রদ্ধাই এই চুরির জন্য দায়ী। মুরালীর এই বক্তব্যর আবার তীব্র সমালোচনা করে সি পি আই (এম) এর রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস।
নোবেল চুরির ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সুইডেনের নোবেল কমিটি ।নোবেল কমিটির মুখপাত্র মাইকেল শ্যোলম্যান বলেন আমরা তো আর আসল নোবেল দিতে পারব না বড় জোর একটা ব্রোঞ্জ প্রতিরূপ দিতে পারি আর মানপত্রের তো প্রতিরূপ দেয়ার বিধান নেই।
নোবেল যাতে গলিয়ে ফেলতে না পারে সেজন্য রাজ্য জুড়ে সকল স্বর্নকারদের অনুরোধ জানানো হয়। বিশ্বভারতীর উপাচার্য সুজিত কুমার বসু চোরদের কাছে আবেদন জানান ‘’ওরা ওই সব মূল্যাবান বস্তু আমাদের কাছি ফিরিয়ে দিক ওদের ক্ষমা করে দেয়া হবে। ওদের পরিচয় গোপন রাখা হবে, এটা জাতীয় লজ্জা।‘’
এই চুরির আলামতের সাথে জীবন বাগদি নামে এক বিক্ষাত চোরের হাতের ছাপের মিল খুজে পায় সিআইডি।তাকে গ্রেফতার করা হয়। কিছুদিন পর জামিনে বেরিয়ে আসেন জীবন বাগদি।জামিনের কয়েকদিন পরেই রহস্যজনক ভাবে খুন হয় জীবন। অন্যদিকে কোলকাতার বরাহ নগর বারই পাড়া লেনের একটি বাড়িতে হানা দিয়ে উদ্ধার হয় ‘রবীন্দ্র ১৯৩৮’ লেখা ছবিসহ বেশ কিছু মুল্যবান সামগ্রী। পরে প্রমানিত হয় ওগুলো রবীন্দ্র ভারতী থেকে চুরি যাওয়া পন্য নয়, এসব অনেক আগে শান্তিপুর রাজবাড়ী থেকে চুরি যাওয়া মাল।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই তদন্ত শুরু করে ১ লা এপ্রিল ওই দিন রাতেই তদন্ত কারী দল উদ্ধার করে চুরি যাওয়া একটি হাতির দাতের শিল্পকর্ম যা মিউজিয়ামের এক কোনে একটি কাপড়ের পুটুলিতে রাখা ছিল। এই উদ্ধারের পর সি বি আই নিশ্চিত এর সাথে রবীন্দ্র ভারতীর কেউ জড়িত।
কিন্তু কে জড়িত তা সনাক্ত করতে তারা ব্যর্থ হয়।
এর প্রায় ১২ বছর পর এই নোবেল চুরির বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কথা জানিয়েছিল সিবিআই, সিআইডি এবং রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের গঠিত সমন্বিত সেল।
২০১৬ সালের ১১ই আগস্ট রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরির বিষয়ে সমন্বিত সেলের তথ্যের বরাত দিয়ে এ সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশ করে টাইমস অব ইন্ডিয়া। এরপর সংবাদ প্রতিদিন নামে কলকাতার একটি ওয়েবসাইটেও এই মামলার অগ্রগতির বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। পত্রিকাটি সিআইডি সূত্রের বরাতে জানায়, নোবেল পাচারের ‘নাটের গুরু’ ছিলেন বাংলাদেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মুহাম্মদ হোসেন শিপলু এবং ভারতীয় ব্যবসায়ী জীবন সিং। এ ছাড়া ওই দুজনের সঙ্গে এক ইউরোপীয় পাচারকারীরও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল বলে জানান ওই সিআইডি কর্মকর্তা।
এ ছাড়া টেলিফোন রেকর্ড এবং অন্যান্য সূত্রে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছে শান্তিনিকেতনে বসে চুরির ছক কষে ওই ‘নাটের গুরু’ চোরাচালান চক্রের অন্যদের জানায়। বাংলাদেশ ও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গার বাসিন্দা ওই চোরাচালান চক্রের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করেই ওই ব্যক্তি নোবেল চুরির ছক কষে। এ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক বিদেশি ব্যক্তির সম্পৃক্ততাও জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। প্রাথমিকভাবে ওই ব্যক্তি জার্মানি বা ইউরোপের অন্য কোনো দেশের নাগরিক বলে সন্দেহ গোয়েন্দাদের।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, ওই আন্তর্জাতিক পাচারকারী দলের লক্ষ্য ছিল, চোরাপথে নোবেল এবং অন্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো পাচার করে প্রথমে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া। সেখান থেকে নোবেল চোরাপথে ইতালি বা জার্মানির মতো ইউরোপের কোনো দেশে পাচার হয়েছে, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না ভারতের গোয়েন্দারা।
২০১৬ সালের নভেম্বরে কলকাতার পত্রিকাগুলোয় ‘অবশেষে রবীন্দ্রনাথের ‘নোবেল চোর’ গ্রেপ্তার’ শিরোনামে একটি খবর বেরোয়।
খবরে প্রকাশ- ২০০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার চুরির ঘটনায় অভিযুক্ত প্রদীপ বাউরি নামে এক বাউল শিল্পীকে অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে ভারতের পুলিশ। গতকাল শুক্রবার তাকে শিয়ালদহের ব্যাঙ্কশাল আদালতে তুলে নিজেদের হেফাজতে রেখেছে সিআইডি।
সূত্রের খবর, প্রায় ১০ দিন আগে রূপপুর পঞ্চায়েতের মোলডাঙা গ্রাম থেকে ভোর তিনটের সময়ে বাড়ি থেকে ওই বাউল শিল্পীকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি-এর ৬ সদস্যের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম।
বিশেষ তদন্তকারী শাখার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা প্রায় নিশ্চিত যে ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ নোবেল-চুরির ঘটনার সঙ্গে প্রদীপ বাউল ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। শুধু তাই নয়, ওই ঘটনায় বাকি অভিযুক্তদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন প্রদীপ। চোরেদের পালানোর সুযোগও তিনিই করে দিয়েছিলেন।
সূত্রের খবর, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদক চুরির মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তার কথা থেকে জানা গেছে যে, মহম্মদ হোসেন শিপুল নামে এক বাংলাদেশের নাগরিক এই চুরির মাস্টারমাইন্ড। দুই ইউরোপীয় ব্যক্তিও এই ঘটনায় জড়িত বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত শান্তিনিকেতন থানার রূপপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলেন প্রদীপ বাউরি। সিআইডি অফিসারের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, নার্কো অ্যানালিসিস টেস্টের জন্য গুজরাটে নিয়ে যাওয়া হবে প্রদীপকে।
নোবেল পদকের সাথে আরো যে সব পন্য চুরি হয় সেগুলি হচ্ছে- ১। রৌপ্য পদক ২। ওঁ লেখা সোনার আংটি ৩। জামার সোনার বোতাম ৪। কাফ লিঙ্ক ৫। মৃনালিনীদেবীর শাড়ি ৬। সোনা-বাধানো নোয়া ৭। রূপোর রেকাবী ৮। রূপোর কফি কাপ ৯। সামুরাই তরবারী ১০। কফি কাপ রাখার তেপায়া ১১।চৈনিক চামুচ ১২। কোবে শহর থেকে পাওয়া হাতির দাতের ঝাপিসহ আরো ৩৭টি জিনিস।
গত ২৩শে অক্টোবর ২০১৭ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পদক চুরির তদন্তে ভারতের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই কেন আজও কিছু করতে পারল না, তার লিখিত জবাব চেয়েছেন কলকাতা হাইকোর্ট।নোবেল চুরি কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে অগ্নিশর্মা কলকাতা হাইকোর্ট। কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা সিবিআই-কে তুলোধনা করে কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাকেশ কুমার তিওয়ারি ও বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডনের ডিভিশন বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, না পারলে বলে দিন আপনারা অকর্মণ্য।
রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরির তদন্তভার সিআইডি-কে দেওয়ার আর্জিতে হাইকোর্টে দায়ের হওয়া একটি জনস্বার্থ মামলায় এদিন সিবিআইকে রীতিমতো ভর্ত্সনা করে হাইকোর্ট। প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার অবস্থার সম্মুখীন হন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার আইনজীবী। আদালত এদিন জানতে চায় দু'বার ফাইনাল রিপোর্ট জমা দেওয়ার পরও কেন অভিযুক্তের হদিশ নেই? তদন্তের রিপোর্ট দিতে এত গড়িমসির কারণ কী? এমনকি, আদলত এদিন এও প্রশ্ন করে, সিআইডি তদন্ত করলে সিবিআই-এর আপত্তি কোথায়?
এরপরই আদালত বলে, আপনারা ব্যর্থ বলেই সিআইডি তদন্তভার নিতে চাইছে। এদিন এক সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয় আদালতের পক্ষে।
একই সঙ্গে জানতে চেয়েছেন ১৩ বছর ধরে যে তদন্তের কিনারা করতে পারেনি, সেই তদন্তভার পশ্চিমবঙ্গের সিআইডির হাতে তুলে দিতে বাধা কোথায়?
কর্মজীবনের শেষ দিনে কলকাতা হাইকোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি রাকেশ তেওয়ারি বলেছেন, সিবিআই না পারলে ছেড়ে দিক। পাশাপাশি, এই দীর্ঘসূত্রতাকে এক কথায় ব্যর্থতা বলেই তিনি মন্তব্য করেন। ভর্ত্সনা করেন সিবিআইকে। ডিভিশন বেঞ্চের অপর বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন বলেন, সিবিআই ইতোমধ্যে দু’বার চুরির তদন্তে কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না বলে তদন্ত বন্ধের আবেদন জানিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে আদালতে জানানো হয়, রাজ্য পুলিশের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্যসূত্র আছে, যা দিয়ে এ তদন্তের কিনারা করা যাবে।
সম্প্রতি রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, তদন্তের দায়িত্ব সিআইডিকে দেয়া হোক। তারা নোবেল উদ্ধার করে দেখিয়ে দেবে।
আশ্চর্য হলেও এটা ঠিক যে,, সিবিআই, সিআইডি এবং রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সহ ভারত সরকারের প্রায় সব গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে নেমে তদন্ত করলেও গত ১৩ বছরেও এই চুরির কোন কিনারা করতে পারেনি তারা।
উদ্ধার করতে পারেনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চুরি যাওয়া নোবেল।
তথ্যসুত্র-
http://www.ntvbd.com/world
http://www.somewhereinblog.net/blog/shovan13/29828350
http://www.bd-pratidin.com/various/2013/06/21/2034
http://enews71.com/news
http://www.ittefaq.com.bd/world-news/2017/10/25/132883.html
http://zeenews.india.com
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৩৩