শৈশবে দেখেছি মার্বেল খেলাটাকে মুরুব্বিরা কেন জানি কুনজরে দেখতেন,একটা ছেলের ভবিষ্যৎ যে বরবাদ হয়ে যাচ্ছে এ খেলার খেলোয়াড়দের দেখে তারা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যেতেন।‘বরবাদ হয়ে যাচ্ছে’’ নয়, আরেকটা খেলা খেললে মুরুব্বীকুল নিশ্চিত হয়ে যেতেন এই ‘ছেলে বরবাদ হয়ে গেছে’।ওই খেলাটাও মার্বেল খেলার মত তবে খেলা হত পয়সা দিয়ে।আমাদের স্থানীয় ভাষায় একে বলা হত ‘পয়সা মীর’।
এই পয়সা মীর বাদে ইচিং বিচিং, ওপেন টি বাইস্কোপ , কড়ি খেলা , কানামাছি , কাবাডি , কুতকুত , গোল্লাছুট , বউচি , টোপাভাতি , ডাংগুলি , দাড়িয়াবান্ধা, পুতুল খেলা , ফুল টোকা , বাঘ ছাগল খেলা , মার্বেল খেলা , মোরগ লড়াই , লাটিম , লুডু , ষোল গুটি , এক্কাদোক্কা , ইত্যাকার কত রকমের খেলা যে ছোটবেলায় খেলেছি তার ইয়ত্তা নাই।
সে সকল খেলা থেকে কয়েকটি খেলা নিয়ে এই পোস্ট।আমার ধারনা এই পোস্ট আপনাকে কিছুক্ষনের জন্য হলেও আপনার সোনালী শৈশবে নিয়ে যাবে। উল্যেখ্য যে, পোস্টের ছড়া গুলি লিখেছেন, সামুর সুকুমার রায় ‘কি করি আজ ভেবে না পাই।‘
১/পুতুল খেলা - বাড়িতে মাটি, কাঠ কিম্বা কাপড় দিয়ে মানুষের আদলে পুতুল বানানো হত।পুতুল খেলা খেলেনি এমন মেয়ে এতদ অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এটা মুলত মেয়েদের খেলা, তবে ফূটফরমাস খাটা বা বাজার সদাই করার জন্য ছেলেদের ভুমিকাও থাকতো ।
মাটি,কাঠ,মোম কিবা
কাপড় আর সুতোলে;
গড়ে তা খেলেনি কে হে
কুট্টিকালে পুতুলে?
ও বাবারে মর্দ সবে
ছেঁকে ধরে মোরে;
কি সাহস!মগো নাম!!
দেখে নেবো তোরে।
বুকে হাত দিয়ে কও
খেলোনি কি কভু?
পুতুলি বিয়েতে সেজে
শশুর হয়ে হবু?
হা হা হা হা পারবেনা
মোটে যে তা জানি;
কুট্টিকালের আহা
মধু স্মৃতিখানি।
যত কও মে'গো খেলা
পুলারাও সাক্ষী;
ছড়ায় পড়লো কিগো
শৈশবি ঝাক্কি?
২/গুটি খেলা (আমাদের স্থানিয় ভাষায় 'কুত্তা কুত্তা)- মেয়েদের আরেকটি প্রিয় খেলার নাম গুটি খেলা। সাধারণত দশ-বারো বছরের মেয়েরা এই খেলাটি খেলে। ইট বা পাথড়ের পাঁচটি গোল টুকরা নিয়ে খেলতে হয় এটি।শুরুতে গুটিগুলোকে মাটিতে ছড়িয়ে ফেলতে হয়। তারপর মাটিতে ছড়ানো গুটিগুলো থেকে একটি হাতে নিয়ে তা উপরে ছুড়ে দেয়। ছুড়ে দেয়া গুটিটি মাটিতে পড়ার আগেই ওই গুটি সহ মাটিতে ছড়ানো এক বা একাধিক গুটি হাতে তুলতে হয়।
এটি বাপু জেনুইন
মেয়েগোই খেলা;
খেলেনি তা,দেখি তবে
মে'গো হাতে মেলা।
ক্লাশ ফাঁকে রুমি-সুমি
এরে-ওরে ঠেলে;
কি আজব চামে চামে
ক্লাশেই তা খেলে!!
উপড়ে ছুড়ে সে গুটি
ছুঁঃ মেরে তা ওমা'রে;
চারখানা গুটি তুলে
মুঠিতে কি চুমারে!!
সে কালেই গুটিতরে
হতো ভারি হিংসে;
গুটি হয়ে জন্মিনি
ভেবে যাই চিমসে।
৩/ কুত কুত (এক্কাদোক্কা) - আমাদের দেশের মেয়েদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় একটি খেলা। ভাঙ্গা মাটির হাড়ি বা কলসির টুকরা দিয়ে চাড়া বা ঘুটি বানিয়ে বাড়ির উঠানে কিম্বা খোলা জায়গায় আয়তাকার দাগ কেটে খেলা হয় এক্কাদোক্কা/চাড়া। ঘরের মধ্যে আড়াআড়ি দাগ টেনে তৈরি করা হয় আরো ছয়টি খোপ।বেশ সরল নিয়মের এই খেলাটি একা একাই খেলা যায়। আবার বন্ধুরা মিলে এক্কাদোক্কার প্রতিযোগিতাও করা যায়। এক এক করে প্রতিটি ঘরে চাড়া ছুড়ে এবং এক পায়ে লাফ দিয়ে দাগ পার হয়ে ওই চাড়া পায়ের আঙ্গুলের টোকায় ঘরের বাইরে আনতে হয়। আঙ্গুলের টোকায় চাড়াটি কোন দাগের উপর পড়লে কিম্বা দুই পাশের রেখা পার হয়ে গেলে খেলোয়াড় দান হারায়। তখন দান পায় দ্বিতীয় জন। এভাবে যে সব ঘর পার হয়ে আসতে পারে সে-ই এক্কাদোক্কায় জিতে যায়।
যে মেয়ে ক'বে জীবনে সে
খেলেনিকো কুতকুত;
আদৌ সে মেয়ে নাকি
আছে মোর খুতখুত।
পুলারাও পারবেনা
বুকে মেরে টুক্কা;
অস্বীকারে খেলেনি হে
এক্কা ও দোক্কা।
কিতকিত,হাপ,অপ
কত দম বাপরে;
শ্বাসে ছেদ হলে ছিটে
নেই তার মাফরে।
যত হও দমরাজ
বোলে মহা দক্ষ;
আদতে এ খেলাতে যে
চারাটাই মুখ্য।
চারা পেতে কত কত
পাতিলের শ্রাদ্ধ;
ভালো চারা পেতেইতো
ভাঙ্গতে তা বাধ্য।
নির্বোধ মা-দাদীরা
ব্যপারটা না বুঝে;
ভাঙ্গতে পিঠের দাঁড়া
মিছেই লাঠি খুঁজে!!
সপাং সপাং বেতে
মেরেছেগো ছিঃ কি?
ওরাও কি ছোটকালে
খেলেনি তা ঠিকি?
খেয়ে মার,শতবার
কভু কেউ দমেনি;
খেলেছে তা সারাবেলা
খেল নেশা কমেনি।
৪/ জোলাভাতি- পুতুল খেলার মতোই মেয়েদের আরেকটি প্রিয় খেলা হলো জুলাবাতি বা রান্না করার খেলা।কঞ্চি বা লাঠি হয় ঘরের খুঁটি, পাতার ছাউনি দিয়ে বানানো হয় খেলাঘর। ঘর লেপা, চুলা তৈরি, খুদ দিয়ে ভাত রান্না, ধুলোকে চিনি বা লবণ আর গাছের বড় পাতাকে ব্যাবহার করা হয় বাসন হিসেবে। কেউ কেউ আশেপাশের ঝোপঝাড়ে যায় বাজার করতে। রকমারি কাল্পনিক কেনাকাটা করে নিয়ে আসে। সেখানে থাকে মাছ-মাংস থেকে সব রকমের তরকারি।তিনটে ইটের টুকরো দিয়ে বানানো হয় চুলা। সেই চুলায় ফু দিয়ে-দিয়ে আগুন জ্বলানো হয়। আগুনের ধোঁয়ার চোখ হয়ে যায় লাল। সবটাই অভিনয়। কিন্তু দেখলে মনে হবে বাস্তব সংসারেই ঘটে চলছে এসব। মুখ দিয়ে শব্দ করে পাতার থালায় চলে খাওয়ার পর্ব। এ সময় এক অনাবিল আনন্দে ভরে থাকে বাচ্চাদের মুখ।
এই খেলা যে খেলেনি
বৃথা তার শৈশব;
এ খেলা খেলেই শিখি
কুট্টিকালে ঐ সব।
কে হবে কর্তা তায়
কত প্রতিযোগীতা;
পরপর সিরিয়ালে
কার টার্ন টুকি তা।
মোর টার্ন এলে ব্যস
আহা মজা ওমারে;
রুমিটারে বেছে বিবি
খাই চামে চুমারে।
সে কালেই পেয়ে গেছি
হাতেখড়ি সংসার;
রুমিটা না ভারি ইয়ে
রেগে কয় ঢঙ ছাড়।
মিছিমিছি সংসারে
রুমি করে রান্না;
আহা স্মৃতি,কাঁদে মন
আজ থাক,আর না।
৫/ কানামাছি- কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যারে পাবি তারে ছোঁ! ভীষণ সহজ আর খুব মজার একটি খেলা কানামাছি।
খেলাতে টস করে একজনকে কানামাছি বানানো হয়। একটি কাপড় দিয়ে তার চোখ বেঁধে দেওয়া হয়। চোখ বাঁধা অবস্থায় সে বন্ধুদের ছুঁয়ে দিতে চেষ্টা করে। বন্ধুরা মাছির মতো কানামাছির চারপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকে আর তার গায়ে আলতো টোকা দিতে থাকে। এইসঙ্গে তারা কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যারে পাবি তারে ছোঁ আওড়াতে থাকে। চোখ বাঁধা অবস্থায় কানামাছি যদি আশেপাশের কাউকে ধরে ফেলে, তাহলে যাকে ধরে তাকেই হতে হয় কানামাছি। নতুন কানামাছিকে ঘিরে শুরু হয় আবার খেলা।
এও এক মিঠে খেলা
ছেলে মেয়ে সকলে;
চোখেতে পট্টি বেঁধে
কানামাছি নকলে।
যে হয়েছে কানামাছি
তার কাম সাড়া;
বাকীগোর কাম হলো
তারে ধরে মারা।
মাইয়ারা নরম বলে
দেয় স্রেফ ছোঁয়াটা;
পুলা সব হাড়ে বদ
মারে ঘুষা-ঠুঁয়াটা।
মোর যথা বদগুলা
মারে কিল-লাথিও;
তাই বাজে এ খেলাতে
প্রায় হাতাহাতিও।
যদি থাকে কিসমতে
মেয়ে কানামাছি;
এথা-ওথা ছুঁতে তার
থাকি কাছাকাছি।
স্রেফ এটুকুন দোষে
মোরে নাহি ডাকতো;
কিংবা দেখলে মোরে
খেলা ছেড়ে ভাগতো!!
৬/ দড়ি খেলা/লাফা খেলা/ স্কিপিং - এ খেলা এখনো কিছুটা প্রচলিত আছে। উপকরন একটা রশি। এটাকে মাথার উপর আর পায়ের নিচ দিয়ে সমানে ঘুরানো। পায়ে বা মাথায় রশি আটকে গেলে খেলা শেষ ।
এ খেলা খেলতে বাপু
লাগে মহা স্কিল;
তাল থোরা পিছলালে
দড়ি বেঁধে মুশকিল।
থাকলে মুন্সিয়ানা
দু'জনায়ও দেয় লাফ;
অত সুজা ভেবনাকো
আদতে তা ভেরি টাফ।
তালেতে মিলিয়ে তাল
দু'জন এক দড়িয়ে;
কত যে দিয়েছি লাফ
মুন্নীরে জড়িয়ে।
৭/ মোরগ লড়াই - বিভিন্ন বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় এই খেলা আয়োজন করা হত। এটি সাধারনত ছেলেদের খেলা। গ্রামাঞ্চলের ছেলেদের কাছে এটি অতন্ত্য জনপ্রিয় একটি খেলা।
"নিয়মকানুন" মোরগ লড়াই খেলায় একদল ছেলে গোল হয়ে একপায়ে দাড়িয়ে থাকে। দুই হাত দিয়ে অপর পা পিছনে ভাজ করে রাখতে হয়। রেফারি যখন বাশিঁতে ফুঁ দেন তখনই খেলোয়াড়রা একে অপরকে ভাজ করা পা দিয়ে মারতে থাকে। কেউ পরে গেলে সে বাতিল বলে গণ্য হয়। এভাবে শেষ পর্যন্ত তিনজন থাকে। তাদের মধ্য থেকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় নির্ধারন করা হয়।
এ খেলার ঠেলা আছে
লোক চাই পাক্কা;
গা বাঁচিয়ে কৌশলে
মারা চাই ধাক্কা।
কেউ মারে কাঁধে আর
কেউ মারে বুকে;
জমিনে পড়লে পা'টা
খেলা গেলো চুকে।
ভয় যদি হাঁটু করে
ও জা'গায় হিট;
দেখেছি কত যে বীর
স্পটেই ফিট!!
৮/ কপাল টোকা/ মাছ মাছ/ ফুল টোকা -গ্রামীন শিশু কিশোরদের অন্যতম খেলা। বাড়ির আঙ্গিনাতে কিংবা স্কুলের মাঠে মেয়েরা ফুল টোকা খেলে থাকে। শিশু বয়স থেকে কৈশোর পর্যন্ত এই খেলায় অংশ নেয় গ্রামের মেয়েরা। এই খেলায় কোনো উপকরণ লাগে না। দলপতি সহ দুই দলে ভাগ হয়ে কিছুটা দূরত্বে মুখোমুখি বসে এই খেলা শুরু করতে হয়। দুই দল নিজেদের খেলোয়াড়দের নাম ফুল,মাছ অথবা ফলের নামে রেখে থাকে। দলপতি অপর পক্ষের যে কোনো খেলোয়াড়ের চোখ দুইহাতে চেপে ধরে সাংকেতিক নামে তার যে কোনো একজন খেলোয়াড়কে ডাকে। সে খেলোয়াড় এসে চোখ ধরে রাখা খেলোয়াড়টির কপালে আলতো করে টোকা দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে। চোখ খোলার পর ঐ খেলোয়াড়কে যে টোকা দিয়েছে তাকে সনাক্ত করতে হয়। সফল হলে সে সামনের দিকে লাফ দেবার সুযোগ পায়। এইভাবে যে দলের খেলোয়াড় লাফ দিয়ে প্রথমে সীমানা অতিক্রম করে সেই দলই জয়ী হয়।
'মাছ মাছ' নাম শুনে
হই থোড়া বোকা;
মোরা খেলি এ খেলারে
নাম 'ফুল টোকা'।
খেলার আছে টেকনিক
সিক্রেট কোডে;
ইশারায় সব কথা
হয়ে যেতো মুডে।
কৌশলে মাইয়াগোরে
কত দিনু ধোঁকা;
চোখ বুজে কয়ে দিয়ে
কে দিয়েছে টোকা।
কোথাও যে ফাঁকি আছে
বুঝে তারা ঠিকি;
ধরতে না পেরে ট্রিক্স
কাঁদে নাঁকি ছিঃ কি!!
পরিশিষ্টঃ
মিঠে সব খেলে মোরা কাটিয়েছি শৈশব;
ডিজিটাল জমানাতে মধু স্মৃতি কই সব?
এভাবে বেড়েছি মোরা মাঠে-ঘাটে-বিলে;
আজকাল বাড়ে ওরা ক্যাপসুল পিলে!
পুলাপান বাড়ে আজ ভার্চুয়াল ভূবনে;
মাটিই দেখেনি তারা ডেইরি ফার্ম জীবনে।
তখনো সুঠাম ছিনু আজো পুরো চাঙ্গা;
পুলাপান এ বয়সে আধা মাজা-ভাঙ্গা!
বানালো কি জমানা হে ডিজিটাল বর্গিরা;
চারপাশে কিলবিল ফার্মের মুর্গিরা!
আর যে যায়না সয়া প্রজন্ম যে ক্ষতিতে;
চলো চলো ফিরে মগো সোনালী সে অতীতে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৩৫