somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একাত্তরের স্মরণীয় ভিন দেশী সুহৃদগন -৩ ।

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পাশে পেয়েছিলাম ভিন দেশী কিছু স্মরণীয় সুহৃদকে যারা নিজের জীবন বাজী রেখে , দেশ কালের সীমা অতিক্রম করে আমাদের সেই মহাক্রান্তিকালে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহায্যের হাত ।
১৯৭১ সনে যাদের গর্জে ওঠেছিল হাতিয়ার, কারো কলম,কারো কণ্ঠ, আবার কখনো বা নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জীবন বিপন্ন করে।
বিজয়ের এই দিনে সশ্রদ্ধ চিত্তে তাঁদের স্মরণ করছি।
(সিরিজটির প্রথম পর্ব দিয়েছিলাম ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে, দ্বিতীয় পর্ব ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে)


২১/ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ডাকতেন ‘বিজয়া’ নামে। কিন্তু বিজয়া তাঁর আসল নাম ছিল না। নাম ছিল তাঁর ভিক্টোরিয়া1 । ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। আর্জেন্টিনার এক নারীবাদী লেখিকা এবং বিগত ত্রিশের দশক থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করা সুর (Sur) নামের এক প্রগতিশীল পত্রিকার সম্পাদিকা। ধারণা করা হয়, রবীন্দ্রনাথের সাথে এক ‘রহস্যময়’ প্লেটোনিক ধরণের রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল তাঁর। রবিঠাকুরের একেবারে শেষ বয়সের প্রেম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন ৬৩। আর ওকাম্পোর ৩৪। সেটা ভিন্ন বিষয়। আমরা পোস্টের মুল প্রতিপাদ্যে আসি-

একাত্তরে লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের সংহতি আন্দোলনের সামনের সাড়িতেই ছিলেন এই সাহসী লেখিকা। একাত্তরের ১১ জুন তাঁদের একটি প্রতিনিধিদল আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের জন্য সাহায্য পাঠানোর দাবি জানিয়েছিলেন। এই দাবিনামায় যাঁরা স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই ছিলেন আশি-ঊর্ধ্ব ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নাম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেসসহ আর্জেন্টিনার সেরা লেখক ও শিল্পীদের অনেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বিজয়া'- ভিক্টোরিয়ার নামের এই বাংলা প্রতি শব্দ করেছিলেন কবি নিজে।

বাংলাদেশের সমর্থনে রাজধানী বুয়েন্স আইরেসের একটি মিছিলে পুরোভাগে ছিলেন তিনি। সেদিন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন- ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে প্রতি আমার সমর্থন অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারন বাংলাদেশের মানুষের ভাষা বাংলা। বাংলা রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ও ভাষা। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু সময় কাটিয়েছেন বাংলার ওই অংশে। সে জন্য এই অঞ্চলের মানুষের সংগ্রামের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ আমার কর্তব্য বলে মনে করেছি।‘


২২/ বাঙালি মায়ের সন্তান মার্ক টালি




মার্ক টালির জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৫ অক্টোবর ধনাঢ্য ইংরেজ পরিবারে হলেও জন্মস্থান কিন্তু কলকাতায়। মার্ক টালির কেন এই বাংলাদেশের প্রতি নাড়ির বাঁধন অনেকেই হয়তো জানেন না। মার্ক টালির মা ছিলেন বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার মেয়ে।
বাবা ব্রিটিশ রাজত্বে ব্যবসার সুবাদে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে পাট কিনতে আসতেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থায়িত্ব বেড়ে যায় তার মা বাঙালি বলে। তার পিতা ব্রিটিশ রাজের নিয়ন্ত্রণাধীন শীর্ষস্থানীয় অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ছিলেন। শৈশবের প্রথম দশকে ভারতে অবস্থান করেন। কিন্তু ভারতীয়দের সঙ্গে সামাজিকভাবে মেলামেশার সুযোগ পাননি তিনি।
ইংল্যান্ডের বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন।

টাইফোর্ড স্কুলে পড়ার পর ভর্তি হন মার্লবোরো কলেজে। এরপর ট্রিনিটি হলে ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে বেশ কিছু দিন পড়াশোনা করেছেন তিনি।
এরপর তিনি ক্যামব্রিজের চার্চ অব ইংল্যান্ডে পাদ্রি হতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু লিঙ্কন থিওলজিক্যাল কলেজে দুই মেয়াদে পড়াশোনার পর এ চিন্তাধারা স্থগিত করেন। এখানে ভর্তি হয়ে খ্রিস্টান পাদ্রিদের আচরণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন। ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন বা বিবিসির নয়া দিল্লি ব্যুরোর সাবেক প্রধান।

একাত্তরের বিবিসি বলতে তৎকালীন সবাই মার্ক টালিকেই জানত। মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোতে তিনি ছিলেন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আশার আলো। যুদ্ধ চলাকালীন হারিকেন বা কুপির মিটি মিটি আলো জ্বালিয়ে রেডিওর এরিয়াল তুলে সকাল-সন্ধ্যা বিবিসিতে মার্ক টালির কথা শোনার জন্য উৎকণ্ঠিত থাকত পুরো দেশ। তিনি যখন কথা বলতেন পিনপতন নীরবতা সবদিকে। কী বলছেন তিনি! মুক্তিযোদ্ধারা নাকি একে একে নাজেহাল করে চলেছে পাকবাহিনীকে। তার কণ্ঠের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ত প্রতিটি বাঙালির বুকে। ১৯৭১-এ মার্ক টালির বয়স ছিল ৩৫ বছর।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিবিসি টিমে যারা কাজ করতেন তাদের অগ্রনায়কের আসনে ছিলেন এই মার্ক টালি। প্রতি মুহূর্তে বাঙালিদের চাঙ্গা করতে তার কণ্ঠের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রতি মুহূর্তে নিয়ে আসতেন তাত্ক্ষণিক উত্তেজনা ভরপুর খবরাখবর।
১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে প্রধান পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। এর আগে বিবিসিতে প্রায় ৩০ বছর কর্মরত ছিলেন। দিল্লি ব্যুরোর প্রধান পদে ২০ বছর দায়িত্ব পালন করেন মার্ক টালি।বাংলাদেশের দুসসময়ের বন্ধু মার্ক টালিকে ২০১২ সালে ‘বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্মাননা’ দেয়।

২৩/ আন্দ্রেই আন্দ্রেভিচ গ্রোমিকো



১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে বিশ্বের দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন দুই শিবিরে বিভক্ত, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে অকুন্ঠ সমর্থন নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। রাশিয়ান কূটনীতিবিদ আন্দ্রেই আন্দ্রেভিচ গ্রোমিকো ১৯৬৫ সালের তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের মধ্যে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আন্দ্রেই আন্দ্রেভিচ গ্রোমিকো বাংলাদেশ সংকট সমাধানের জন্য ভারত-পাকিস্তান দুদেশের সাথে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন।

আন্দ্রেই আন্দ্রেভিচ গ্রোমিকো যিনি ছিলেন একজন পেশাদার কূটনৈতিক, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো সমর্থন আদায়ে জোর তৎপর ছিলেন। তাঁর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক উত্থাপিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন 'ভেটো' প্রদান করে। এর ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আরও সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌছে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় কূটনীতিকদের পরামর্শে আন্দ্রেই আন্দ্রেভিচ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পাকিস্তানের বিপক্ষে জনমত গঠনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সবধরনের কূটনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করেন। বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু আন্দ্রেই আন্দ্রেভিচকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

২৪/ আঁদ্রে মালরো



মহান মুক্তিযুদ্ধে যে বিশিষ্ট বিদেশিরা নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব আঁদ্রে মালরো। মহান এই ফরাসি লেখক-রাজনীতিক-সৈনিক যুদ্ধবিমান ও ট্যাংক চালিয়েছেন, স্পেনের বিপ্লবীদের সহায়তায় চাঁদা তুলতে গেছেন আটলান্টিক পেরিয়ে মার্কিন দেশে। ইন্দোচীনে নিজ দেশের ঔপনিবেশিক আচরণের প্রতিবাদে প্রকাশ করেছেন শৃঙ্খলিত ইন্দোচায়নার মতো নামের সংবাদপত্র!

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী যে বর্বর গণহত্যা চালিয়েছিল, সে ব্যাপারে বিশ্ববাসীকে অবহিত করতে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন মালরো। শুধু মৌখিক প্রতিবাদ নয়, প্রস্তাব দিয়েছিলেন বাঙালিদের পাশে দাঁড়িয়ে অস্ত্র হাতে লড়বেন। ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মালরো প্যারিসে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে লড়াই করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাঁর এ ঘোষণা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তায় প্রবাসী বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিলকে চিঠিও দিয়েছিলেন মালরো। দেড় শ ফরাসি যোদ্ধার একটি দল গড়েও শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারত মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হওয়ায় ভরসা পেয়ে বাংলাদেশে আসার পরিকল্পনা ত্যাগ করেন তিনি।বাংলাদেশের পক্ষে অস্ত্র ধারণ করা সম্ভব হয়নি আঁদ্রে মালরোর; কিন্তু তিনি যতটুকু করেছিলেন, তা-ই পরবর্তী সময়ে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ছিল যথেষ্ট।

১৯৭৩ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের আমন্ত্রণে তিন দিনের সফরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন সত্তরোর্ধ্ব এই ফরাসি যোদ্ধা, বিমান থেকে বাংলাদেশে নেমেই পুষ্পসিক্ত অভিনন্দনের জবাবে আর্দ্র হলো আঁদ্রে মালরোর কণ্ঠ, ‘সবাইকে তো বুকে টেনে নেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। পুরো বাংলাদেশকে আমি আমার বুকে জড়িয়ে ধরছি।’

২৫/ নিকোলাই পদগর্নি




সম্মানিত প্রেসিডেন্ট,
সোভিয়েত ইউনিয়নে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এই কারণে যে, ঢাকায় শান্তি আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর সামরিক বাহিনী কর্তৃক চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহন ও শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে। ওখানে যে ঘটনাগুলো ঘটছে এবং যার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের অগনিত সংখ্যক মানুষের মৃত্যু, ধ্বংশ আর দুর্গতির স্বীকার হওয়ার খবরে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণও শঙ্কিত না হয়ে পারে না। অল্প কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য রাজনীতিবিদ যারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন তাদের গ্রেফতার ও নির্যাতনের খবরে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগন চিন্তিত হয়ে পড়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগন সবসময়ই পাকিস্তানের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং তাদের উন্নয়নের প্রত্যাশী, দেশের যে কোন বড় সমস্যা হোকনা কেন গনতান্ত্রিক সমাধানে সোভিয়েত জনগন সমভাবে আনন্দিত হয়েছে।আমরা মনে করি এই সময়ে পাকিস্তান যে জটিল সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে কোন শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান করা সম্ভব এবং সেটাই হওয়া উচিৎ। পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের উপর দমন-পীড়ন, অত্যাচার আর মৃত্যু সমাধানের পথকে রুদ্ধ করে দিবে আর তা মানুষের মৌলিক স্বার্থহানি ঘটাবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সোভিয়েত প্রেসিডিয়ামের পক্ষ থেকে আপনাকে জানানো আমাদের কর্তব্য যে যত দ্রুত সম্ভব মৃত্যু-হানাহানি বন্ধ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর অত্যাচার-জুলুম কমিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বের করুন। আমরা বিশ্বাস করি, একমাত্র এই পথেই জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা এবং আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখা সম্ভবপর হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ যে কোন শান্তিপূর্ণ সমাধানে আনন্দের সাথে গ্রহণ করবে। বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণার মানবিক মূলনীতি অনুসারে আমরা এই অনুরোধ জানাচ্ছি, আমরা পাকিস্তানের বন্ধুপ্রতিম জনগণের সম্মতিতেই তাদের সবার জন্য এই অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট সাহেব, আমরা আশা করব, এ চিঠির প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবনে আপনি সক্ষম হবেন। যত দ্রুত সম্ভব পূর্ব পাকিস্থানে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক এই আমাদের প্রত্যাশা।
এন. পদগর্নি
মস্কো, ক্রেমলিন ২ এপ্রিল, ১৯৭১


পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে চিঠিটি লিখেছিলেন সয়ং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি । উল্যেখ্য যে, ৭১ সালে তৎকালীন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট আন্তরিক ভাবে বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন।

২৬/এডওয়ার্ড কেনেডি



১৯৭১-এ বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার জন্য লড়ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় রিপাবলিকান পার্টি। রিপাবলিকানদের সমর্থন ছিল পাকিস্তানের দিকে। এর মধ্যেই বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন সিনেটর এডওয়ার্ড।

বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছিলেন। তাদেরই একজন মহান ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশিদের অকৃত্রিম বন্ধু আমেরিকার সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি।

অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। পাকিস্তান বাহিনীর পাশবিকতা থেকে বাঁচার জন্য মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এক কোটি শরণার্থীর দুর্দশা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে ফিরে এসে কেনেডি সিনেট জুডিশিয়ালি কমিটির কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট করেছিলেন ‘ক্রাইসিস ইন সাউথ এশিয়া’। ইতিহাসে এই রিপোর্টটির গুরুত্ব অনেক। এ রিপোর্টে কেনেডি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার কথা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন মার্কিন প্রশাসনের সামনে।

আমেরিকা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন দেশে গিয়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সাহায্য চেয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে আসেন। এখানে তিনি একটি শোভাযাত্রায় অংশ নেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কাজ করে গেছেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে এনেছিলেন এডওয়ার্ড কেনেডি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুর্দশা নিজের চোখে দেখে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে মর্মস্পর্শী একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিলেন তিনি।


২৭/জোসেফ ও’কনেল



মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বন্ধু জোসেফ ও’কনেল টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম গবেষণা বিভাগের প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের সম্মানিত অধ্যাপক ছিলেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের বশে তিনি ও তার সহধর্মিণী ক্যাথলিন ও’কনেল দীর্ঘদিন ধরে বাংলা চর্চা করেছেন।

জোসেফ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। বিদেশে যে কয়জন বন্ধু বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ভাষার প্রতি সত্যিকারে দরদ দেখিয়েছিলেন তাদের একজন তিনি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় জনমত তৈরি করেন।


২৮/ অ্যালেন গিন্সবার্গ



কবি এবং কাব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আলোড়ন তুলেছিল। সেই কবির নাম অ্যালেন গিন্সবার্গ। তিনি একজন মার্কিন কবি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ওপর তিনি লিখেছিলেন একটি দীর্ঘ কবিতা।

কবিতাটির নাম ছিল- ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। তার কবিতাটি ছুঁয়ে যায় হাজারও মানুষের হৃদয়। নিপীড়িত মানুষের হাহাকার মেশানো, যুদ্ধের বাস্তবচিত্র কবিতার অক্ষরে অক্ষরে জানান দিয়ে যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য। তার কবিতা শুনে ও পড়ে অশ্রুসজল হয়ে পড়েন হাজারও মানুষ। বাংলাদেশের পক্ষে একাত্ম হয়ে ওঠেন বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অগণিত সাহিত্যপ্রেমিক।

তার কবিতাটির কয়েকটি লাইন এখনো অনেকের মুখে মুখে চলে আসে। ‘মিলিয়নস অব সোলস নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান, হোমলেস অন যশোর রোড আন্ডার গ্রেসান, আ মিলিয়ন আর ডেড, দ্য মিলিয়নস হু ক্যান, ওয়াক টুওয়ার্ড ক্যালকাটা ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান’। কবিতার ইস্ট পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানই হলো বর্তমান বাংলাদেশ।

তার এ কবিতার সূত্র ধরেই বিখ্যাত বাঙালি গায়িকা মৌসুমী ভৌমিক কবিতাটির কিছু অংশ বাংলায় অনুবাদ করে তৈরি করেছেন তার ‘যশোর রোড’ গানটি।


২৯/পল কনেট দম্পতি



লন্ডনে বাংলাদেশের নিরীহ জনমানুষের ওপর অস্ত্র ব্যবহারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিল পল কনেট দম্পতি। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে এ খবরে তারা আর চুপ করে বসে থাকতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন, বাংলাদেশের খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধপথ্য পাঠানোর জন্য তিনি ‘অপারেশন ওমেগা’ নামে একটি সংস্থা করেন।

লন্ডনের ক্যামডেন এলাকায় তারা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে একটি কার্যালয় খোলেন। পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জনমত গঠন করতে ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে বিশাল জনসভার আয়োজন করেন তারা।

এ ছাড়া বাংলাদেশে ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে পল নিজেই চলে আসেন। পলের সঙ্গে তার স্ত্রী এলেন কনেটও বাংলাদেশে এসেছিলেন। ট্রাফালগার স্কয়ারে বিশাল জমায়েত শেষে একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ভারতে আসেন। সেখান থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢোকেন বাংলাদেশে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। পরে পাকিস্তানের সামরিক আদালত তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি মুক্তি পান।

৩০/সিডনি শ্যানবার্গ



সিডনি শ্যানবার্গ ছিলেন দি নিউইয়র্ক টাইমস-এর একজন সাংবাদিক। তিনি ১৯৩৪ সালের ১৭ই জানুয়ারি আমেরিকার ক্লিনটন মাসাচুয়েটস -এ জন্মগ্রহন করেন । ১৯৫৯ সালে তিনি দি নিউইয়র্ক টাইমস এ যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ-এর হত্যাকাণ্ড তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন। সেসময় তিনি ছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। হোটেলের জানালা দিয়ে তিনি দেখেন ইতিহাসের এক ভয়ানক হত্যাকাণ্ড।

তিনি পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ওপর অসংখ্য খণ্ড খণ্ড প্রতিবেদন পাঠান যার অধিকাংশ ছিল শরণার্থী বিষয়ক। তার প্রতিবেদনে পুরো বিশ্ব জানতে পারে পাক বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের অবস্থা। তার অসংখ্য প্রতিবেদনের একটি নির্বাচিত সংকলন প্রকাশ করেছে ঢাকার সাহিত্য প্রকাশ। সংকলনটির নাম ডেটলাইন বাংলাদেশ-নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান। যা অনুবাদ ও সংকলন করেছেন মফিদুল হক।

সুত্র ও কৃতজ্ঞতা-
http://nivrito-swopnocharee.blogspot.com/2015/09/blog-post_14.html?m=0
http://www.somewhereinblog.net/blog/nameless/29495367
http://egiye-cholo.com/w-a-s-ouderland/
https://footprint.press/?p=17874



সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৪৫
৩৩টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×