রাষ্ট্র গঠিত হয় একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সাধারণ অভিপ্রায়ের তথা জেনারেল উইলের ভিত্তিতে। আর এটাই স্বাভাবিক, একটি রাষ্ট্রের সব নাগরিক সব বিষয়ে একমত না-ও হতে পারে। এ স্বতঃসিদ্ধ কথাটিকে মেনে নিয়েই বহু পরীক্ষ-নিরীক্ষার পর বিশ্বে দীর্ঘকাল ধরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র পরিচালনার একটি উত্তম পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শূল কথা হচ্ছে : নাগরিকদের বেশির ভাগের সম্মতির ভিত্তিতে তাদের ভোটে নির্বচিত প্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনার তথা সরকারের দায়িত্ব নেবেন। এরা এক দিকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্ব লাভ করবেন এবং তাদের নির্দিষ্ট সময়ের পরপর ভোটারদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সরকারের আরো দায়িত্ব হলো- তার সমালোচকদের বক্তব্য মনোযোগ ও মর্যাদা দিয়ে শুনতে হবে। কারণ সমালোচনাকারী ও সরকার বিরোধীরাও একই দেশের অধিবাসী এবং তাদেরও সমান অধিকার রয়েছ। আবার এটাও সঠিক, জনগণের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত পার্লামেন্টে গৃহীত আইন সবাই মেনে চলতে বাধ্য। কেউ আইন অমান্য করলে তাকে আদালতের মুখোমুখি হতে হবে। যেখানে তিনি ন্যায় বিচার পাবেন। আর আদালত সরকারের মাধ্যমে প্রভাবিত না হয়ে ন্যায়বিচার পরিচালনা করবেন।
এটা নিশ্চিত করতে রক্ষাকবচ হিসেবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা আজ সর্বজনবিদিত সত্য বলে গৃহীত একটি দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিচার বিভাগ দেশের সংবিধানের রক্ষক হিসেবেও কাজ করে। যে সরকার বিরোধীদের সমালোচনা সহ্য করতে চায় না অথবা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে না, তাকে গণতান্ত্রিক সরকার বলা যায় না। এরুপ সরকার নিজেকে নির্বচিত বলে দাবি করলেও তা সঠিক নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় থাকতে হয়। নয়তো সেটি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে। আর জবাবদিহিতার উপযুক্ত স্থান হচ্ছে পার্লামেন্ট এবং চূড়ান্তভাবে ভোটার তথা নাগরিকদের ম্যান্ডেট লাভের জন্য তাদের মুখোমুখি হওয়া। সে জন্যই নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এত গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্যে গণতান্ত্রিক দেশগুলো বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ একটা স্থিতিশীল পর্যায় পৌঁছেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের রাজনৈতিক শিক্ষা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির দীক্ষা দিয়ে থাকে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো বেশির ভাগই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারেনি। এর প্রধান কারণ কিছু রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রের সামরিক শাখা জনগণের সম্মতি ছাড়াই ক্ষমতায় যেতে চায় বা টিকে থাকতে চায়। এই সুযোগ নিয়ে বিশ্বের উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার দেশগুলো অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়। এর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখে ফায়দা হাসিল করে। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের খনিজ সম্পদ ও বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে তারা ছলেবলে কূটকৌশলে ওইসব দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে রাখে। একদল বিশ্বাসঘাতক নাগরিক তাদের দালাল হিসেবে কাজ করে এবং তাতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে।
ঠিক তারই প্রতিচ্ছবি আমাদের 5ই জানুয়ারীর নির্বাচন। যেখানে 5-10শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। আবার 200-এর মতো কেন্দ্রে ভোটাররা ভোট দিতে যায় নি। 153টি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্ধী ছিলোনা। 50টি আসনের প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থীরা তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে আবেদন করলেও নির্বাচন কমিশন তা গ্রহণ করেনি। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো প্রহসনের নির্বাচন হবে আশঙ্কা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। একই ধারণায় দেশী-বিদেশী নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরাও আসেনি পর্যবেক্ষণ করতে। এরই ধারাবাহিতকায় প্রতিদিন খবরের কাগজে চলমান ঘটনার ছিটেফোঁটা বিবরণ প্রকাশ পাচ্ছে। এর আংশিক চিত্র কখনো অনাকাঙ্খিত, কখনো অসম্ভব আবার কখনো অবিশ্বাস্য বলেও মনে হতে থাকে। এর চেয়ে কঠিনতম ও কঠোরতম ঘটনা ঘটছে বলে দাবি মানুষের মুখে মুখে, যা হয়তো প্রকাশ পাচ্ছে না। কিন্তু এরপর কী হবে!? স্বগতোক্তিতে অনেকেই হয়তো এর জবাব উচ্চারণ করছেন। বেশির ভাগই হতাশাব্যঞ্জক, কিছু কিচু উচ্চারণযোগ্য নয়। এক কথায় মানুষ যন্ত্রণাক্লিষ্ট, হতাশ। চিত্রটি সাধারণও বটে।
অপর চিত্রটি অসাধারণ। সে চিত্রের ধারক-বাহক ও পরিচালকেরা ক্ষমতাবান। এরা দাবি করছেন, সব ঠিক আছে। যৎসামান্য বিশৃঙ্খলা যা আছে, এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। অবশ্য এর মাঝে কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। আর চিত্রটি ক্রমান্বয়ে অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য হয়ে উঠেছে। তাই ক্ষমতাবানেরা সুরুও পাল্টাতে শুরু করেছেন। এদু’টি চিত্র বাংলাদেশের্ জন্য নতুন নয়। এ দেশের ঊষালগ্ন থেকেই ঘটে চলেছে এমন রবাহুত ঘটনাবলি। আর একই ভাবে এর বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। একটি বহুল ব্যবহৃত বাক্য দিয়ে এমন ঘটনাবলির বর্ণনা দেয়া হয়-‘দেশ এখন ক্রান্তকালের মাঝ দিয়ে চলছে’। এ ক্রান্তিকালের শেষ নেই। সাড়ে চার দশক ধরে চলছেঠ। দেশের জম্মের প্রথম তিন বছরে এমনই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। হত্যা-খুন-গুম নিত্যদিনের বিষয় হয়ে পড়লে মানুষ নীরবে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য চাইত। মজলুমের আর্তি আকাশ-বাতাস যেন ছেয়ে যাচ্ছিল। কেই ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করত না। উল্লেখ্য, আজকের ক্ষমতাবানদের একাংশ তখন সেই বিরোধিতার নেতৃত্ব দিয়েছিল। বর্তমানের অবস্থা বর্ণনা করে ইন্টারনেটে হাজার মন্তব্যের মাঝে রোকেয়া বেগমের মন্তব্যটি উদ্ধৃত করা যায়। তিনি লিখেছেন- ‘বাংলাদেশের অভিধান থেকে গণতন্ত্র, সততা, বিশ্বাসম, মতবিনিময়, অনুভব, সহানুভূতি, আস্থা, সম্মানবোধ, স্বাধীনতা, সহনীয়তা, ক্ষমা, দয়া, নৈতিকতা, ধৈর্য্য, বোধশক্তিসহ মানবিক ও সামাজিক শব্দগুলো হারিয়ে গেছে। লেখিকা এই একবাক্যে চমৎকারভাবে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেনই বটে।
প্রশ্ন হলো, এমনটি কেন হয়? এক কথায় এর জাবাব- ক্ষমতার লড়াই। ঠিক একই ঘটনা ফ্রান্সের ইতিহাসে বিধৃত। রাজার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে তিনি গুম-খুন-অপহরণ ইত্যাদি ফরাসি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত শতবর্ষব্যাপী চলমান রাখেন। সৃষ্টি করেন গোপন বিচারকক্ষ, যার না ছিল ‘চেম্বার আরদঁত’। প্যারিসের বাস্তিলের (যেখানে বিপ্লবের শেষ যুদ্ধ হয়) কাছে অবস্থিত ছিল এই বিচার কক্ষ। বিশেষ করে সেই সময় ক্যালভিনিস্টদের সহ্যই করতে পারতেন না নিষ্ঠুর রাজা। কারণ তারা ছিলো রাজার অপকর্মের সমালোচক। তখন রাজা এই ক্যালভিনিস্টদের নানা বদনাম দিয়ে শত শত লোককে কারাগারে নিক্ষেপ প্রেরণের নির্দেশ দিতেন। কখনো বা তাদের পুড়িয়ে মারতেন। আবার কখনো তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতেন। ক্যালভিনিস্টদের যে অপবাদটা সেই সময় দেয়া হতো, তা আজকের যুগের বহুল প্রচলিত শব্দগুলোর সাথে হুবহু মিলে যায়। যেমন-মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ইত্যাদি। এরকম চলতে থাকলে 1559 সালের সেই দিনের প্লেস দ্যা ভোসাজের বর্শা খেলার একফাঁকে মন্টগোমারি তার বর্শা দিয়ে রাজা হেনরিকে বিদ্ধ করলে প্যান্সের নিষ্টুর একটি সময়ের অবসান ঘটে। এরপর ‘আরদঁত’ কক্ষটি বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু 115 বছর পর সেই কক্ষটি আবার খুলে দেয়া হয় রাজা লুই-4 এর রাজত্বকালে। পরবর্তীকালে রাজা লুই 210টি গোপন বিচারের মাধ্যমে কয়েক হাজার নিরিহ প্রতিপক্ষকে হত্যা করেন। এরপর শুরু হয় নিরুদ্দেশ এবং পানি খাওয়ানো। এখন যাকে বলা হয় ‘ওয়াটার বর্ডিং। এভাবে পৃথিবীর সভ্য সমাজে সময়ে সময়ে ঘটে এসেছে স্বৈরাচারী শাসকদের নিষ্ঠুর শাসন এবং তার অবসানও ঘটেছে খুব দ্রুত। যার বলি হন সাধারণ জনতা।
আপনি কখন বুঝতে পারবেন যে, আপনি কোনো ফ্যাসিস্ট কিংবা স্বৈরাশাসকের অধীনে রয়েছেন। যখন দেখবেন, আপনার প্রতিবাদ কিংবা সমালোচনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। তাই পুলিশ ও ক্ষমতাবানেরা যেকোনো সময় আপনার প্রতিবাদকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে একত্রে মুনাফার কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনৈতিক আইন তৈরি হয় এবং প্রয়োজন অনুসারে বিচারক নির্বাচিত করা হয়-যেন এই মুনাফার কর্মকান্ডে ব্যতয় না ঘটে। এককথায়, ফ্যাসিবাধী কর্মকান্ডগুলো প্রবল হয়ে ওঠে। তবে রাষ্ট্রটি ফ্যাসিবাদীতে নিমজ্জিত হয়েছে কি না তার অন্তত 14টি চিহৃ আপনি দেখতে পাবেন। অধ্যাপক লরেন্স- ব্রিট হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কো ইত্যাদির শাসন অনুসন্ধান করে এই চিহৃগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার- 01. সব সময় দেশপ্রেম এবং এ সম্পর্কে গান, প্রচারণা, স্লোগানে মত্ত থাকে এবং জনগণকে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য করে। 02. মানবাধিকার নিয়ে মাথা ঘামায় না। বৈদেশিক ও ভেতরের শত্রুর দোহাই দিয়ে জনগণের অধিকার হরণ করে। 03. দুর্বল গোষ্ঠীকে অন্যের দোষের বোঝা বইতে বাধ্য করে। 04. সামরিক বাহিনীসহ সব রাষ্ট্রীয় অস্ত্রধারীকে সবার ওপরে স্থান দেয়া হয়। 05. সংবাদমাধ্যমকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। 06. জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে বাড়াবাড়ির মাঝ দিয়ে জনগণকে এক ভীতির মধ্যে রাখা হয়। 07. ধর্মকে ব্যবহার করা হয় নানাভাবে। 08. করপোরেট শক্তি ও রাষ্ট্রীয় শক্তি এক হয়ে পড়ে। 09. চিন্তাবিদ ও তাদের কর্মকান্ডকে নিন্দা করা হয়। 10. পুলিশকে সীমাহীন ক্ষমতা দেয়া হয় এবং অপরাধ দমনের নামে প্রচন্ড অনাচারের রাজত্ব কায়েম করা হয়। 11. নির্বাচন নামমাত্র হয় এবং এমন ব্যবস্থার সৃষ্টি করা হয় যেন সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না আসে। 12. নিজের দল ও আত্মীয়রা সর্বপ্রকার রাষ্ট্রীয় সহায়তা পায়। 13. কোনো গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রবিরোধী আখ্যা দিয়ে তার ওপর প্রচন্ড অত্যাচার করা হয় এবং 14. হত্যা ও গুম সাধারণ দৈনন্দিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়
আপনার চারিদিকে আপনার দুচোখ দিয়ে একটু খেয়াল করুন এবং একটু চিন্তা করুন আমি, আপনি কি অবস্থানে অবস্থান করছি। যদি লেখার সাথে বর্তমান পরিস্থিতির মিল খুঁজে পান তবেই বুঝতে পারবেন যে, আমরা মানে জনগন তার যন্ত্রণার বিনিময়ে কারো কারো আনন্দ দিতে সক্ষম হয়েছে।