আজকের সমাজ ব্যবস্থায় সততার বড়ই অভাব, যেখানে টিকে থাকতে হলে নীতি-নৈতিকতার বিসর্জন দিতে হয়। তাই এই মুহুর্তে ‘সৎ থাকার কোনো যুক্তিই আমি দেখিনা’...?! অথচ সৎ থাকার কতই না অহেতুক চেষ্টা করছি প্রতিনিয়তই...
কথায় তো বলে গোড়ায় গলদ। সেই গোড়ায় গলদের কারণে আমরা প্রতিনিয়তই দুর্ণীতির ফাঁক-ফোকরে আটকা পড়ে যাচ্ছি। এর মূল কারণ হচ্ছে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আজ পর্যন্তু যত জন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি তৈরি করেছে তার সিকিভাগও সৎ লোকের সৃষ্টি করতে পারেনি! কারণ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নীতি-নৈতিকতা ও দেশ প্রেমের শিক্ষা দেওয়া হয় না। আমার সামান্য শিক্ষা জীবনে ও খুব কম শিক্ষককে পেয়েছি যিনি আমাদেরকে দেশ প্রেম এবং নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন।
স্যারেরা ক্লাসে এসে তাদের নির্ধারিত একটা টপিকের উপর আলোচনা করেই দায়িত্ব শেষ করতেন। অথচ আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ স্যার নাকি ঢাকা কলেজে বেশিরভাগ সময় ছাত্রদের নীতি-নৈতিকতা বিষয়ক জ্ঞানের আলোই বিতরণ করেছেন। এমন শিক্ষকের ছাত্র হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।
চাকরি জীবনে এমনকি সাংগঠনিক দায়িত্বে থেকে যে কয়জন ট্রেনার বা শিক্ষক দেখেছি তাদের অনেকেই সৎ এবং এবং খুব দক্ষ ছিলেন। তারা নিয়মিত দায়িত্বে ঠিকতে পারতেন না। কারণ আশ-পাশে অসৎ লোকের খবরদারিই ছিলো চোখে পড়ার মতো! আর এদেরকে সরাসরি সেইসব লোকেরাই পরিচালনা করেন কিংবা এরাই তাদেরকে পরিচালিত করেন, ক্ষেত্রেবিশেষে! তাই দেশের মানুষ সৎ এবং ন্যায়পরায়ণ মানুষ চোখে দেখে না। সৎ সরকারি চাকুরীজীবী মানুষদের দেখে না। আমি একজন ম্যাজিস্ট্রেট এর নাম জানি যিনি একটা এয়ারপোর্ট এর চিত্রটাই পালটে দিয়েছেন নিজের সততার বলে (যতটা সম্ভব)।
বেশ কিছুদিন আগে মসজিদের হুজুর ওয়াজ করলেন দেশের আইন না মানা, মানেই দেশের সাথে ওয়াদা ভঙ্গের শামিল। তিনি যে ফতোয়া দিলেন তার সারমর্ম হল এই, আপনি যদি রাস্তার উল্টো পথে চলেন তাহলেও আপনি আল্লাহর নিকট ওয়াদা ভঙ্গকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। আপনি যতই ঈমানদার হোন না কেন আল্লাহ আপনাকে ওয়াদা ভঙ্গকারী হিসেবেই বিবেচনা করবেন। এবার চিন্তা করেন ওয়াদা ভঙ্গকারী কি কখনো জান্নাতে যেতে পারবে? অথচ ভেবে দেখুন আমরা কদমে কদমে ওয়াদা ভঙ্গকারী!
এই দেশে যারাই দুর্নীতি করে তারা কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে ভালো ছাত্রদের একজন। কারণ ভাল ছাত্র ছাড়া ভাল চাকরী করা সম্ভব নয়। যারা একটু পিছিয়ে তারা বাস্তব জীবনে বড় কোনো চাকরী পায় না। আর যদি পায় ও তবে বুঝতে হবে সেখানেও ন্যায়ের কোনো ছাপ নেই আছে মামা-খালুর তদবির!
বড় চাকরি বেশিরভাগ পায় মেধাবীরা। আমার দেশের কৃষকেরা দুর্নীতি করে না। কুলিকামার দুর্নীতি করে না। এরা দুর্নীতির শিকার হয়। দুর্নীতির কারণে এদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। তবু তারা জমির খাজনা দিয়ে দেশে শিক্ষিত সমাজ সৃষ্টি করে। দেশের সব থেকে মেধাবীরা ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হয়। তার পরের স্থরের মেধাবীরা হয় সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। রাজনীতিবিদগনও মেধাবী উচ্চশিক্ষিত। যদিও আজ-কালকের সময়ে এই রাজনীতিবিদদের মাঝেও নিম্ন শ্রেণীর প্রবেশ অবাধ করা হয়েছে! যেখান থেকেও আপনি ন্যায় আশা করতে পারেন না। কারণ এখানেও এক ধরণের অসৎ লোকের বাজার খোলা হয়েছে।
যদিও এই রাজনৈতিকদের বিরাট একটা অংশ মহান মুক্তিযোদ্ধে আত্মত্যাগকারী, জীবন উৎসর্গকারী বীরদের সন্তানও আছেন। তবুও দেশে অনিয়ম কমে না। দুর্নীতি কমে না। তার কারণ কি? তাহলে কি ধরেই নিবো যতবড় মেধাবী ততবড় দুর্ণীতি?! আমার মধ্যে যতটুকুই (অতি সামান্য) সততা এবং নৈতিকতা আছে তার বেশিরভাগ আমি আমার পরিবার থেকে পেয়েছি কিংবা শিখেছি। আমি দেখেছি আমার বাবা সর্বোচ্চ সুযোগটুকু পেয়েও অসৎ উপায় অবলম্বন করেন নি। নিজের সম্পত্তি নষ্ট করেছেন কিন্তু সততা নষ্ট করেন নি। ইলিশ মাছ নিয়ে কারো বিচার-সালিশে অংশ নেননি।
আমি আজ যতটুকু অসৎ কিংবা চরিত্রহীন হয়েছি তা আমি রাষ্ট্র এবং তার সিস্টেমে পরিচালিত পরিবেশ থেকে শিখেছি। আমি দেখেছি এই দেশে শত অনিয়ম করার পরেও সবাই তাকেই সম্মান করে। আমি দেখেছি অদক্ষ, অযোগ্য, অশিক্ষিত হয়েও যাদের টাকা আছে এবং সেই টাকাই ক্ষমতা কিনে নিয়ে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করছে, তারাই সমাজের কাছে সম্মানিত বনেছেন! যেকোনো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন সেই অখ্যাত ব্যক্তিই অলংকৃত করেন! যে কোনো কাজে সমাজ তাকেই বেশি প্রাদান্য দেয়!
তাহলে আমি বা সে যারাই চাকরিতে আসেন তারা সৎ থাকবেন কেন?! সৎ থাকার কোনো যুক্তিই আমি এখন পর্যন্ত এই সমাজ থেকে দেখতে পাইনি। আমি ভালো থাকতে চেয়ে হয়তো আমার পরিবারের সদস্যদের কোনোদিন ভাল কাপড়ও দিতে পারবো না কিংবা তাদের ভাল কোনো স্কুলে পড়াতে পারবো না। অথচ চোখের সামনেই অফিসের সব থেকে কম বেতন পাওয়া কর্মচারিও হয়তো তার পরিবারের সদস্যদের বাজারের সব থেকে ভালো জামা-কাপড় কিনে দিবে কিংবা শহরের দামি স্কুলে পড়াবে!
হয়তো আমি কোনো রকম একটি বাসা বাড়া নিয়ে থাকতে পারবো! অথচ একই প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে অফিসের একজন পিয়নেরও হয়তো একটা বড় সড় বাড়ি থাকবে! আমি ঠিকমত ডাল ভাত খেতে পারবো না অথচ আমার সামনেই এমএলএসএস বাজারের সব থেকে বড় মাছটা কিনে নিবে! এই সৎ থাকার কি যুক্তি আছে...?!
আমি মনে করি, আজকে যারা সমাজে অশান্তি তৈরি করছেন কিংবা অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করছেন তার জন্য রাষ্ট্র ততটা দায়ী যতটা দায়ী হচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ আমরা আমাদের নীতিগত শিক্ষায় কোনো আদর্শ ধারণ করিনি কিংবা শিখিনি। এর বড় প্রাপ্তি হচ্ছে একটি আদর্শিক পরিবার, যেখানে কখনোই দুর্ণীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হয়না বরং দুর্ণীতি রোধে ভূমিকা রাখতে শিখানো হয়। আর যে যতটুকু সৎ তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব কেবল তার এবং তার নিজের পরিবারের। কৃতিত্ব আরেক জন সৎ লোকের।
আমার এই লেখাটা সেই সব বীরদের জন্য যারা চোখের সামনে টাকা উড়তে দেখেও চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়। আমার লেখায় কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে দুঃখিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১৮ সকাল ১১:৫২