কনসার্টের কাজ আজকের মত মুলতবি করে বাসায় ফিরছিলাম রাত ১১ টার দিকে। বাসার পাশেই একটা ছেলে কান্নাকাটি করছিল তার মা তারে চড়-থাপ্পড় দিচ্ছিল বাংলা সিনেমার মায়েদের স্টাইলে। " এত খাই খাই কেন তোর"। প্রতিবার একবার কথাটা উনার মুখ থেকে অনুদিত হচ্ছিল আর একটা করে চড় বাচ্চা ছেলেটার গালে কষে দিচ্ছিল । কাছে এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি হইছে? প্রতিউত্তর :উনি আর উনার স্বামী নদী ভাংগা এলাকার মানুষ। সর্বগ্রাসী নদী তাদের কিছুই আস্ত রাখে নাই। স্বামী খাবার আনতে গেছে। ছেলেটা অপেক্ষা করতে করতে ক্ষিদায় চেচামেচী করছিল। তাই এই চড় ! আমি তাকে বাচ্চাদের মার না দেয়ার জন্য একদফা বিনামুল্যে জ্ঞান দান করে বাসায় চলে আসলাম। গোসল করে খেতে গেলাম কিন্তু গরম আর সারা দিনের পরিশ্রমে কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না। শুধু ঠান্ডা কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু আমাদের ভাই-বোন সবার টন্সেল নামক একটা ছোট বিচির অহেতুক প্রবেনতার দরুন , ফ্রিজে ঠান্ডা পানি রাখার উপর সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই ভরসা, দোকানের জুস অথবা কোল্ড ড্রিংক্স। নিচে নেমে দেখি বাচ্চা কাদছে এখন ও, এবার বাবার পালা, ইচ্ছে মতন মারছে ছেলেকে। মেজাজ গেল বিগড়ায়া। জিগাইলাম, ঐ মিয়া তোমার প্রোব্লেম কি? এত ছোট বাচ্চারে মারতেছ কেন? ব্যাটা মনে হয় আমার গলার উচ্চ তরংগে কিঞ্চিত ভীত হয়ে গেল।
জানা গেল, উনার খাবার কিনতে যাওয়াটা আসলে একটা ভান ছিল পকেট এ টাকা যা ছিল, সব শেষ। ভেবেছিলেন খাবার কিনতে গিয়ে দেরী করলে বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়বে। কথা শেষ করার আগেই বাবা সন্তানকে বুকে নিয়ে কাদতে শুরু করলেন। একজন বিপর্যস্ত বাবার অপত্য পিতৃ স্নেহ দারিদ্র ও রুখতে পারল না !
আমি ৩ জনকেই পাশের হোটেল এ নিয়ে গেলাম। কিছুতেই যেতে চাচ্ছিলেন না, আমি হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম। হোটেল এ গিয়ে আমি ও উনাদের সাথে খেলাম, গরুর মাংস আর রুটি। সারা দিনের ক্ষিধা যেন হঠাট করে চাঙ্গা হয়ে উঠল। খেতে খেতে বেশ গল্প হচ্ছিল । উনি ছিলেন বেশ অবস্থাসমপন্ন গহস্থ। জায়গা-জমি সব বছর দুয়েক আগেই চলে গিয়েছিল, কিছুদিন আগে প্রমত্তা নদী তাদের শেষ সমবল জমিটা ও কেড়ে নিল। নদী ভাঙ্গনের পর থেকে উনি অন্যের জমিতে ভাড়া খাটতেন, কিন্তু শেষ সমবল ভিটে-মাটি যাওয়ার পর থেকে চোখে মুখে সর্ষেফুল দেখা শুরু করলেন। মাথা গোজার কোন জায়গা না পেয়ে একটু নিরাপদ আশ্রয় আর ভালো একটা কাজের জন্য শহরে আসা। আচার আচরনে ও অনেক ভদ্র মনে হচ্ছিল, খাচ্ছিলেন ঠিকি কিন্তু কি একটা হীনতা যেন তাকে খুব ক্ষুদ্র করে রাখছিলেন। আমি খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই জিজ্ঞেস করলাম , কোন কাজ পেয়েছেন কিনা। উত্তর দিলেন কোন কাজ পান নাই। এক জায়গায় রিকশা চালানোর জন্য গিয়েছিলেন কিন্তু অপরিচিত বিধায় রিকশা পান নাই। প্রথম ৪ দিন ঊঠেছিলেন তার পরিচিত গ্রামের এক লোকের মাধ্যমে তেজগাও রেল লাইনের পাশের বস্তিতে। কিন্তু তার অল্প বয়সী স্ত্রীর উপর কু নজর পড়ে রেল লাইনের পাশে মাদক ব্যাবসায়ী কিছু ছেলের। তারা তাকে দিনের বেলা মাদক বিক্রি ও ট্রেনের বগিতে রাতে দেহ ব্যাবসার প্রস্তাব দেয়, রাজী না হলে তাকে নানা ধরনের হুমকি-ধামকি দেয়া হয়। ভয়ে ঐখান থেকে পালিয়ে রাতে রাস্তার পাশে থেকেছেন শেষ কটা দিন। ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে তার হাতের টাকা। আজ সকালে এক বুড়ি তাকে প্রস্তাব দেয় , তার সন্তান কে ভিক্ষা বৃত্তিতে নিয়োজিত করার জন্য। প্রতিদিন ৬০ টাকা করে দেবে। কিন্তু উনারা স্বামী-স্ত্রী দৃঢ়তার সাথে সে প্রস্তাব প্রত্যাক্ষান করেন। উত্তরটা ঊনাদের ভাষাতেই দেই,
" ভাই ! খারাপ সময় আর কয়দিন, একটা কাজ় পায়া নেই, পোলাটারে একটা ভাল স্কুলে ভর্তি করামু, আমরা দুইজন মিলে কাম করুম। পোলারে শিক্ষিত বানামু, আপনেগো মতন।"
আমি মাথা হেট করে উত্তর দেই, " ভাই আমি শিক্ষিত না"।
আমি তো জানি আমার দৌড় কতটুকু !