somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

৭১ এর কয়েকটি চিঠি সমগ্র : ( মুক্তিযুদ্ধকে জানুন এবং অন্যকে জানান)

২১ শে মে, ২০১৫ রাত ১০:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৭১ সাল সময়টি তখন মুক্তির সংগ্রাম।  আর এই সংগ্রামে রয়েছে লক্ষ প্রাণ আর স্মৃতি।  সংগ্রহ  করা চিঠি গুলোর  মধ্যে রয়েছে  মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামের  কথা।

★চিঠি নং ১ :

 
চিঠি লেখকঃ শহীদ কাজী নুরুন্নবী।

 
২৯ এ মার্চ / রাজশাহী ১৯৭১
চিঠি লেখকঃ শহীদ কাজী নুরুন্নবী। ১৯৭১ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র এবং কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিব বাহিনীর রাজশাহী বিভাগের প্রধান ছিলেন। ১ অক্টোবর ১৯৭১ নুরুন্নবীকে পাকিস্তানি বাহিনী আটক করে শহীদ জোহা হলে নিয়ে যায়। তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের একটি হোস্টেল তাঁর নামে রয়েছে।

চিঠি প্রাপকঃ মা নুরুস সাবাহ রোকেয়া। শহীদের বাবার নাম, কাজী সাখাওয়াত হোসেন। ঠিকানাঃ লতা বিতান কাজীপাড়া, নওগাঁ।

চিঠিটি পাঠিয়েছেনঃ ডা. কিউ এস ইসলাম, ১৮ শান্তিনগর, ঢাকা।
২৯ শে মার্চ/রাজশাহী'৭১

আম্মা,
সালাম নেবেন।

আমি ভালো আছি এবং নিরাপদেই আছি। দুশ্চিন্তা করবেন না। আব্বাকেও বলবেন। দুশ্চিন্তা মনঃকষ্টের কারণ ছাড়া আর কোন কাজে আসে না। এখানে গতকাল ও পরশু Police বনাম Army-র মধ্যে সাংঘাতিক সংঘর্ষ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আমরা জিততে পারিনি।

রাজশাহী শহর ছেড়ে লোকজন সব পালাচ্ছে। শহর একদম খালি। Military কামান ব্যাবহার করছে। ২৫০ মত Police মারা গিয়েছে। ৪ জন আর্মি মারা গিয়েছে। মাত্র। রাজশাহীর পরিস্থিতি এখন Army-আয়ত্তাধীনে রয়েছে। হাদী দুলাভাই ভালো আছেন। চিন্তার কারন নেই। দুলি আপার খবর বোধহয় ভালোই। অন্য কোথায় যেন আছেন। আমি যাইনি সেখানে।

পুষ্প আপা সমানে কাঁদাকাটি করে চলেছেন। ধাকার ভাবনায়। ক'দিন আগে গিয়েছিলাম। ধামকুড়িতে বোধহয় উনার মা আছেন। সম্ভব হলে খবর পৌঁছে দেবেন। আমার জন্য ব্যাস্ত হবেন না। যেভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, সেখানে আমাদের বেচেঁ থাকাটাই লজ্জার। আপনাদের দোয়ার জোরে হয়তো মরব না। কিন্তু মরলে গৌরবের মৃত্যুই হতো। ঘরে শুয়ে শুয়ে মড়ার মানে হয় কি?

এবার জিতলে যেমন করে হোক একবার নঁওগা যেতাম। কিন্তু জিততেই পারলাম না। হেরে বাড়ি যাওয়া তো পালিয়ে যাওয়া। পালাতে বড্ড অপমান বোধহয়। হয়ত তবু পালাতেই হবে। আব্বাকে ছালাম। দুলুরা যেন অকারণ কোনোরকম risk না নেয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বললাম কথাটা। তাতে শুধু শক্তি ক্ষয়ই হবে।

দোয়া করবেন
ইতি
বাবুল, ২৯/



★চিঠি নং ২ :

 
চিঠি লেখকঃ নৌ কমান্ডো শহীদ জিন্নাত আলী খান।


চিঠি লেখকঃ নৌ কমান্ডো শহীদ জিন্নাত আলী খান। পিতা শামসুল হক খান, গ্রামঃ ননীক্ষির, ডাকঃ ননীক্ষির, উপজেলাঃ মকসুদপুর, জেলাঃ গোপালগঞ্জ
চিঠি প্রাপকঃ মা শুকুরুননেছা।
চিঠিটি পাঠিয়েছেনঃ ইয়াসির আরাফাত খান
৫.৪.১৯৭১

মা, আমার সালাম গ্রহন করবেন। পর সংবাদ আমি আপনাদের দোয়ায় এখনো পর্যন্ত ভাল আছি। কিন্তু কতদিন থাকতে পারব বলা যায় না। বাংলা মাকে বাঁচাতে যে ভূমিতে আপনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, যে ভাষায় কথা বলা শিখিয়েছেন, সেই ভাষাকে, সেই জন্মভুমি কে রক্ষা করতে হলে আমার মত অনেক জিন্নার প্রান দিতে হবে। দুঃখ করবেন না, মা। আপনার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে যদি আপনার এই নগন্য ছেলের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়, সে রক্ত ইতিহাসের পাতায় সাক্ষ্য দেবে যে বাঙ্গালি এখনো মাতৃভূমি রক্ষা করতে নিজের জীবন পর্যন্ত বুলেটের সামনে পেতে দিতে দ্বিধা বোধ করে না।
সময় নেই। হয়তো আবার কখন দৌড় দিতে হয় জানি না। তাই এই সামান্য পত্রটা দিলাম। শুধু দোয়া করবেন। সবার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। মা, যদি সত্যি আমরা এই পবিত্র জন্মভুমি থেকে ইংরেজ বেনিয়াদের মতো পাঞ্জাবি গুণ্ডাদের তাড়িয়ে দিয়ে এ দেশকে মুক্ত করতে পারি, তবে হয়তো আবার আপনার সাথে দেখা হতে পারে। বিদায় নিচ্ছি মা। ক্ষুদিরামের মতো বিদায় দাও। যাবার বেলায় ছালাম। মা...মা...মা...যাচ্ছি।
ইতি
জিন্না



★চিঠি নং ৩ :


 
চিঠি লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা বিপ্লব।


পথের ধারের বাড়ী
১৫ জুলাই, ‘৭১
মা,
পথ চলতে গিয়ে ক্ষনিকের বিশ্রামস্থল রাস্তার ধারের এ বাড়ি তোমায় চিঠি লিখতে সাহায্য করছে। বাড়ি থেকে আসার পর এই প্রথম তোমায় লিখার সুযোগ পেলাম। এর পূর্বে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কাগজ, কলম, মন ও সময় একীভুত করতে পারিনি। টিনের চালাঘরে বসে আছি। বাইরে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার সর্বত্র। প্রকৃতির একটা চাপা আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে টিনের ওপর বৃষ্টি পড়ার শব্দে। মাগো, আজ মনে পড়ছে বিদায় বেলায় তোমার হাসিমুখ। সাদা ধবধবে শাড়িটায় বেশ মানিয়েছিল তোমায়। বর্ষার সকাল। আকাশে খন্ড খন্ড মেঘের ভেলা ভাসছিল। মেঘের ফাঁকে সেদিনকার পূর্ব দিগন্তের সূর্যটা বেশ লাল মনে হয়েছিল। সেদিন কি মনে হয়েছিল জানো মা, অসংখ্য রক্তবীজের লাল উত্তপ্ত রক্তে ছেয়ে গেছে সূর্যটা। ওর এক কিরণচ্ছটা পৃথিবীতে জন্ম দিয়েছে এক একটি বাঙালি। অগ্নিশপথে বলীয়ান, স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত।

মাগো, তোমার কোলে জন্মে আমি গর্বিত। শহীদের রক্ত রাঙা পথে তোমার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেকে তুমি এগিয়ে দিয়েছ। ক্ষণিকের জন্যও তোমার বুক কাঁপেনি, স্নেহের বন্ধন দেশমাতৃকার ডাককে উপেক্ষা করতে পারেনি। বরং তুমিই আমাকে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের প্রেরনা দিয়েছ। দেশকে ভালবাসতে শিখিয়েছ। মা, তুমি শুনে খুশি হবে তোমারই মত অসংখ্য জননী তাঁদের স্নেহ ও ভালোবাসার সম্পদ পুত্র-সন্তান, স্বামী, আত্মীয়, ঘরবাড়ি সর্বস্ব হারিয়ে শোকে মূহ্যমান হয়নি; বরং ইস্পাতকঠিন মনোবল নিয়ে আজ অগ্নিশপথে বলীয়ান। মাগো, বাংলার প্রতিটি জননী কি তাঁদের ছেলেকে দেশের তরে দান করতে পারে না? পারে না এ দেশের মা-বোনেরা ছেলে ও ভাইদের পাশে এসে দাঁড়াতে? মা তুমি তো একদিন বলেছিলে, ‘সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যেদিন এ দেশের মায়ের কোলের শিশুরা মা-বাবার কাছে বিস্কুট-চকলেট চাইবে না জেনো, চাইবে রিভলবার পিস্তল।’ সেদিনের আশায় পথ চেয়ে আছে দেশের প্রতিটি সন্তান। যেদিন বাংলার স্বাধীনতা সূর্যে প্রতিফলিত হবে অধিকারবঞ্চিত, শোষিত, নিপীড়িত বুভুক্ষু সাড়ে সাত কোটি জাগ্রত বাঙালির আশা, আকাঙ্খা। যে মনোবল নিয়ে প্রথম তোমা থেকে বিদায় নিয়েছিলাম তা আজ শতগুনে বেড়ে গেছে, মা। রক্তের প্রবাহে আজ খুনের নেশা টগবগিয়ে ফুটছে।

এ শুধু আমার নয়,প্রতিটি বাঙালি পাঞ্জাবি হানাদার লাল কুত্তাদের দেখলে খুনের নেশায় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। তাই তো বাংলার প্রতিটি আনাচে-কানাচে এক মহাশক্তি ও দুর্জয় শপ্তহে বলীয়ান মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা অনেক বেড়ে গেছে। তোমাদের এ অবুঝ শিশুগুলিই আজ হানাদার বাহিনীকে চরম আঘাত হানছে। পান করছে হানাদার পশুশক্তির রক্ত। ওরা মানুষকে হত্যা করে। আমরা পশু(ওদের) হত্যা করছি। এই তো সেদিন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার সদর দক্ষিণ মহকুমার কোন এক মুক্ত এলাকাইয় ভালুকাতে(থানা) প্রবেশ করতে গিয়ে হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের হাতে চরমভাবে মার খেয়েছে। মা, তোমার ছোট্ট ছেলে বিপ্লবের হাতেই লেগে আছে বেশ কয়েকটা পশুর রক্ত। এমনি করে বাংলার প্রতিটি আনাচে-কানাচে মার খাচ্ছে ওরা। মাত্র শুরু। যুদ্ধনীতি ওদের নেই, তাই বাংলার নিরীহ অস্ত্রহীন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, বৃদ্ধ, শিশু ও নারীর ওপর হত্যাকাণ্ডের মই চালাচ্ছে। এ হত্যাকাণ্ড ভিয়েতনামের একাধিক ‘মাইলাইয়ের’ হত্যাকাণ্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। ওরা পশু। পশুত্বের কাহিনী শুনবে, মা? তবে শোনো।

শত্রুকবলিত কোনো এক এলাকায় আমার একটি ধর্ষিত বোনকে দেখেছিলাম নিজের চোখে। ডেকেছিলাম বোনকে। সাড়া দেয়নি। সে মৃত। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র দেহে পাশবিক অত্যাচারের চিহ্ন শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে। বাংলার শিশু ছিল তার গর্ভে। কিন্তু তবু পাঞ্জাবি পশুর হায়না কাম দৃষ্টি থেকে সে রেহাই পায়নি। সে মরেছে কিন্তু একটা পশুকেও হত্যা করেছে। গর্বিত,স্তব্ধ, মূঢ় ও কঠিন হয়েছিলাম। আজ অসংখ্য ভাই ও বোনের তাজা রক্তকে সামনে রেখে পথ চলছি আমরা। মাগো, বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর এমন অত্যাচারের কাহিনী শুনে ও দেখে কি কোনো জননী তা ছেলেকে প্রতিশোধের দীক্ষা না দিয়ে পারে? পারে না। প্রতিটি জননীই আজ তাঁর ছেলেকে দেবে মুক্তিবাহিনীতে, যাতে রক্তের প্রতিশোধ, নারী নির্যাতনের প্রতিশোধ শুধু রক্তেই নেওয়া যায়। মা, আমার ছোট্ট ভাই তীতু ও বোন প্রীতিকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। পারবে না আমাদের তিন ভাই-বোনকে ছেড়ে একা থাকতে? মা, মাগো। দুটি পায়ে পড়ি, মা। তোমার ছেলে ও মেয়েকে দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে ঘরে আটকে রেখো না। ছেড়ে দাও স্বাধীনতার উত্তপ্ত রক্তপথে। শহীদ্দ হবে, অমর হবে, গাজী হয়ে তোমারই কোলে ফিরে আসবে, মা। মাগো জয়ী আমরা হবই। দোয়া রেখো।
জয় বাংলা ।।
ইতি
তোমারই বিপ্লব


চিঠি লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা বিপ্লব। চিঠি লেখকের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধকালে এই চিঠি ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে প্রকাশিত জাগ্রত বাংলায় প্রকাশিত হয়।
চিঠি প্রাপকঃ মা। তাঁর পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
চিঠিটি পাঠিয়েছেনঃ ডাঃ মোঃ শফিকুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, চক্ষুবিজ্ঞান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ।


★চিঠি নং ৪ :


 
চিঠি লেখকঃ শহীদ মুক্তিযুদ্ধা আমানউল্লাহ চৌধুরী ফারুক।


তাং: ২৩-০৫-১৯৭১
জনাব আব্বাজান,
আজ আমি চলে যাচ্ছি। জানি না কোথায় যাচ্ছি। শুধু এইটুকু জানি, বাংলাদেশের একজন তেজোদৃপ্ত বীর স্বাধীনতাকামী সন্তান হিসেবে যেখানে যাওয়া দরকের আমি সেখানেই যাচ্ছি। বাংলার বুকে বর্গী নেমেছে। বাংলার নিরীহ জনতার উপর নরপিশাচ রক্তপিপাসু পাক-সৈন্যরা যে অকথ্য বর্বর অত্যাচার আর পৈশাচিক হত্যালীলা চালাচ্ছে, তা জানা সত্ত্বেয় আমি বিগত এক মাস পচিঁশ দিন যাবৎ ঘরের মধ্যে বিলাস-ব্যসনে মত্ত থেকে যে ক্ষমাহীন অপরাধ করেছি, আজ সেই অপরাধের পায়শ্চিত্ত করার জন্য যাত্রা শুরু করলাম। সমগ্র বাঙ্গালী যেন আমাকে ক্ষমা করতে পারেন। আপনি হয়ত দুঃখ পাবেন। দুঃখ পাওয়ারই কথা। যে সন্তানকে দীর্ঘ ষোল বছর ধরে তিল তিল করে হাতে কলমে মানুষ করেছেন, যে ছেলে আপনার বুকে বারবার শনি কৃপাণের আঘাত হেনেছে, যে ছেলে আপনাকে এতটুকু শান্তি দিতে পারেনি, অথচ আপনি আপনার সেই অবাধ্য দামাল ছেলেকে বরংবার ক্ষমাসুন্দুর দৃষ্টিতে দেখেছেন, যার সমস্ত অপরাধ আপনি সীমাহীন মহানুভবতার সঙ্গে ক্ষমা করেছেন। আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন সম্ভবত একটি মাত্র্য কারণে যে, আপনার বুকে পুত্রবাৎসল্যের রয়েছে প্রবল আকর্ষণ।

আজ যদি আপনার সেই জেষ্ঠ্য ফারুক স্বেচ্ছায় যুদ্ধের ময়দানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধে মৃত্যকে আলিঙ্গন করে, তাহলে আপনি কি দুঃখ পাবেন, বাবা? আপনার দুঃখিত হওয়া সাজে না, কারণ হানাদেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যদি নিহত হই, আপনি হবেন শহীদের পিতা। আর যদি গাজী হিসেবে আপনাদের স্নেহছায়াতলে আবার ফিরে আসতে পারি, তাহলে আপনি হবেন গাজীর পিতা। গাজী হলে আপনার গর্বের ধন হব আমি। শহীদ হলেও আপনার অগৌরবের কিছু হবে না। আপনি হবেন বীর শহীদের বীর জনক। কোনটার চেয়ে কোনটা কম নয়। ছেলে হিসেবে আমার আবদার রয়েছে আপনার উপর। আজ সেই আবদার রয়েছে আপনার উপর। আজ সেই আবদারের উপর ভিত্তি করে আমি জানিয়ে যাচ্ছি বাবা, আমি তো প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী। আমার মনে কত আশা, কত স্বপ্ন। আমি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে কলেজে যাব। আবার কলেজ দিঙিইয়ে যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে। মানুষের মতো মানুষ হব আমি।

আশা শুধু আমি করিনি, আশা আপনিও করেছিলেন। স্বপ্ন আপনিও দেখেছেন। কিন্তু সব আশা, সব স্বপ্ন আজ এক ফুৎকারে নিভে গেল। বলতে পারেন এর জন্য দায়ী কে? দায়ী যারা সেই নরঘাতকের কথা আপনিও জানেন। বাংলাদেশের প্রটিটি মানুষ ওদের কথা জানে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে--Mother and Motherland are superior to heaven. স্বর্গের চেয়েও উত্তম মা এবং মাতৃভূমি। আমি তো যাচ্ছি আমার স্বর্গাদপী গরীয়সী সেই মাতৃভূমিকে শুত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করতে।আমি যাচ্ছি শত্রুকে নির্মূল করে আমাদর দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে, বাবা, শেষবারের মতো আপনাকে একটা অনুরোধ করব। সর্ব শক্তিমান আল্লাহর নিকট সবসময় দোয়া করবেন, আমি যেন গাজী হয়ে ফিরতে পারি। আপনি যদি বদদোয়া বা অভিশাপ দেন, তাহলে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

জীবনে বহু অপধ করেছি। কিন্তু আপনি আমায় ক্ষমা করেছেন। এবারও আপনি আমায় ক্ষমা করবেন, এই আশাই আমি করি। আপনি আমার শতকোটি সালাম নেবেন। আম্মাজাঙ্কে আমার কদমঅবুসি দেবেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলবেন। ফুফু আম্মাকেও দোয়া করতে বলবেন। ফয়সাল, আফতাব, আরজু, এ্যানি ছটদের আমার স্নেহাশিস দেবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন আর সবসময় হুঁশিয়ার থাকবেন।

ইতি
আপনার স্নেহের ফারুক

চিঠি লেখকঃ ফারুক। শহীদ মুক্তিযুদ্ধা আমানউল্লাহ চৌধুরী ফারুক। চট্টগ্রাম সিটি কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। নোয়াখালীর কম্পানীগঞ্জ থানার বামনী বাজারের দক্ষিণে বেড়িবাঁধের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। এই যুদ্ধে আরও চার মুক্তি যোদ্ধা শহীদ হন।
চিঠি প্রাপকঃ বাবা হাসিমউল্লাহ চৌধুরী। চিঠিটি মৃত্যুর কদিন আগে লেখা। ঠিকানাঃ অম্বরনগর মিয়াবাড়ি, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী।
চিঠিটি পাঠিয়েছেনঃ মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম ভুঁইয়া


★চিঠি নং ৫ :


 
চিঠি লেখকঃ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমী।


আগরতলা - ১৬ জুন, '৭১
প্রিয় পাশা মামা,
অবাক হয়ো না! এটা লেখা হয়েছে আর তোমার কাছে পৌছেছে। আর পড়ার পর চিঠিটা নষ্ট করে ফেলো। এ নিয়ে আম্মাকেও কিছু লিখোনা। তাহলে তাদের বিপদে পড়তে হবে। তারাহুড়া করে লিখলাম। আমার হাতে সময় খুব কম। বেস ক্যাম্পের উদ্দেশে কাল এখান থেকে চলে যেতে হবে।

আমরা একটা ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ লড়ছি। আমরা জয়ী হব। আমাদের সবার জন্য দোয়া কোরো। কী লিখব বুঝতে পাড়ছি না--কত কী নিয়ে যে লেখার আছে! নৃশংসতার যত কাহিনী তুমি শুনছ, ভয়াবহ ধ্বংসের যত ছবি তুমি দেখছ, জানবে তার সবই সত্য। ওরা আমাদের নৃশংসতার সঙ্গে ক্ষতবিক্ষত করেছে, মানব ইতিহাসে যার তুলনা নেই। আর নিউটন আসলেই যথার্থ বলেছেন, একইধরনের হিংস্রতা নিয়ে আমরাও তাদের উপর আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেব।
জানি না আবার কখন লিখতে পারব। আমাকে লিখ না। সোনার বাংলার জন্য যা পারো কর।
এখনকার মত বিদায়
ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাসহ
রুমী
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×