শত শত মাঝিমাল্লা নৌকা-জাল নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। ডিম সংগ্রহকারীদেরও নিজস্ব কুয়া কিংবা হ্যাচারিতে ডিম থেকে দ্রুত পোনায় পরিণত করার প্রস্তুতি শেষ। সারাদেশের মাছচাষিরা বসে আছেন পুকুর-জলাশয় নিয়ে। এসব আয়োজন-প্রস্তুতি শুধু একটি নদীতে মাত্র কয়েক ঘণ্টার দুর্লভ ও অনন্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। আর তা হলো 'হালদা নদীতে মাছ ডিম ছাড়বে'। সারা বছর সাধারণত মাত্র একটি এ ধরনের ঘটনা ঘটে। বিশেষ এক প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে হালদা নদীতে কার্প জাতীয় মা মাছরা ডিম ছাড়ে। আর হাজার হাজার জেলে-ডিম সংগ্রহকারী নদী থেকেই বিশেষ উপায়ে ডিম সংগ্রহ করে। এশিয়া মহাদেশে একমাত্র একটি নদীতেই বিরল এ ঘটনা ঘটে প্রতি বছর। আর তা এই হালদা নদীতেই ঘটে। যে কারণে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের এ নদীকে বলা হয় এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র। একই সঙ্গে এটি বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। হালদা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন নদী-শাখানদী, খাল-বিল থেকে কার্প জাতীয় মা মাছরা ইতিমধ্যে তাদের প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে এসে বিচরণ শুরু করেছে। অপেক্ষা শুধু প্রকৃতির সেই বিশেষ মুহূর্তটির জন্য অর্থাৎ মুষলধারে তুমুল বৃষ্টি, মেঘের গর্জন, সঙ্গে পাহাড়ি ঢল। এই তিনের সংমিশ্রণ ঘটলেই সামনের যে কোনো অমাবস্যাই ডিম নিঃসরণ ও সংগ্রহের অনন্য এ ঘটনা ঘটতে পারে। সম্প্রতি মা মাছরা নমুনা ডিম ছাড়ায় অন্তত এ আভাস পাওয়া যায়। গত কয়েক মাস ধরে নদীর দু'পাড়ের মানুষ অনেকটা নির্ঘুম রাতযাপন করছে_ যদি সামান্য ঘুমে সারা বছরের জীবিকা চলে যায়।
এশিয়া মহাদেশ তথা সারাবিশ্বের অন্যতম বৈশি্বক উত্তরাধিকার এ হালদা নদী নানা সংকটের কারণে বিপদাপন্ন আজ। রুই জাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) পোনার জন্য এ নদীর আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকলেও যথাযথ উদ্যোগের অভাব এবং পরিবেশ দূষণসহ অপরিকল্পিত পানি ও মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনার কারণে প্রাকৃতিক এ মৎস্যভাণ্ডার ধ্বংসপ্রায়। শুধু মৎস্যসম্পদই নয়, চট্টগ্রাম মহানগরীর বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের অন্যতম প্রধান উৎস এ হালদা নদী। ক্রমেই নাব্যতা হ্রাস, অবাধে বালু উত্তোলন, পানির দূষণ বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম ওয়াসা তার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হালদা নদী থেকে পানি উত্তোলন করতে পারে না। শুকনো মৌসুমে তো পানি শোধন করেও লবণাক্ততা ও দূষণের গন্ধ দূর করা যায় না। এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকার তুরাগ, বালু, বুড়িগঙ্গার মতো হালদা নদীর পানিও শোধন করা সম্ভব হবে না।
এছাড়া হালদার সঙ্গে সংযুক্ত ১৯টি প্রধান খাল ও ছড়া যেগুলো হালদার পানিপ্রবাহের অন্যতম প্রধান উৎস_ স্লুইসগেট কিংবা অন্যান্য স্থাপনার মাধ্যমে গলাটিপে ধরা হয়েছে। ফলে উজান থেকে যেমন_ পিঠা পানির প্রবাহ কমছে, অন্যদিকে জোয়ারের সময় সাগরের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে। এতে ক্রমেই বিলুপ্ত হচ্ছে হালদার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বিপন্ন হয়ে পড়েছে মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটি। বিশ্বের অনন্য এ প্রজনন ক্ষেত্রটি সংরক্ষণে যেন কারও কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির মুখে বিগত জোট সরকারের আমলে 'হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র পুনরুদ্ধার প্রকল্প' নামে একটি পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প অনুমোদন করলেও তা এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রাম মৎস্য অধিদফতরের সাবেক কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের ভবিষ্যতে রুটি-রুজিকে সামনে রেখেই এ প্রকল্পের বিভিন্ন দিক চূড়ান্ত করা হয় বলে কথিত রয়েছে, যা বাস্তবতা বিবর্জিত, অপরিকল্পিত এবং অনেকাংশে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিনির্ভর না হওয়ায় ২০০৭ সালের শুরু থেকেই এ প্রকল্প প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। হালদা রক্ষা কমিটির নামে গড়ে ওঠে বিশাল আন্দোলন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন এক শিক্ষকের নেতৃত্বে এ আন্দোলন ক্রমেই বেগবান হয়। হালদার দু'পাড়ের সাধারণ মানুষের একটি অংশও সোচ্চার হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রশাসনের ইঙ্গিতে এবং কতিপয় জনপ্রতিনিধির স্বার্থান্বেষী মনোভাবের কারণে হালদা এখন এক লাভজনক বাণিজ্যের উৎসে পরিণত হয়েছে। হালদার পোনার নামে গড়ে উঠেছে ভেজাল রেণু পোনার বিশাল এক সিন্ডিকেট। তার ওপর হালদা পুনরুদ্ধার প্রকল্পের ১৪ কোটি টাকা নিয়ে হরিলুটের খবর তো এখন হালদা পাড়ের সবার মুখে মুখে।
অনন্য এ প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রকে রক্ষার জন্য যেন কেউ নেই। সুযোগ পেয়ে একটি চক্র মা মাছ হত্যায় ব্যস্ত। কখনও কখনও এলাকার সচেতন মানুষ মা মাছ হত্যাকারীদের পাকড়াও করলেও রাজনৈতিক পরিচয়ে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে প্রশাসন কিংবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাত থেকে। পরবর্তী সময়ে সচেতন মানুষকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে বলেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় অর্থাৎ মা মাছের প্রবেশ, ডিম নিঃসরণ, অবাধ বিচরণ এবং মা নিরাপদ প্রস্থানের সময় পর্যন্ত অভয়ারণ্য থাকলেও অবাধে চলছে মা মাছ হত্যা। ২০০৭ সালে হালদার নাজিরহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত এলাকায় প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী হাটহাজারী উপজেলার সাত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী এলাকাকে মাছের অভয়াশ্রম ঘোষিত হয়েছে। অথচ এ নদীর ওপর নির্ভরশীল জেলেরা এ লম্বা সময় কীভাবে অন্ন সংস্থান করবে সে বিষয়ে প্রশাসনের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। প্রকল্পে বিকল্প কর্মসংস্থানের নামে কিছু টাকা বরাদ্দ থাকলেও প্রকৃত জেলেদের কাছে তা পেঁৗছানোর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। যে কারণে অনন্যোপায় হয়ে জেলেদের একটি অংশ রাতের আঁধারে মাছ ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে।
হালদা নদীর প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক গুরুত্ব কোনো অংশ খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চট্টগ্রামের কোনো বিষয় নিয়ে যদি মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়_ তার মধ্যে হালদা রক্ষা, হালদার প্রকল্পের আলোচনা-সমালোচনা সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মৎস্য উপদেষ্টা, বর্তমান সরকারের মৎস্যমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের সচিব, জনপ্রতিনিধি সবাই হালদা নদী ঘুরে দেখেছেন। এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, হালদা নদী রক্ষার এমন কোনো আশ্বাস নেই, যা তারা দেননি কিংবা বাস্তবে এসব আশ্বাসের যেন প্রতিফলন দেখা যায়নি। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদল হয়েছে কিছু উপকারভোগী, তাও রাজনৈতিক বিচারে। হালদার বালু উত্তোলনকারীরা বদলান দলীয় ব্যানার।
পরিশেষে বলতে চাই, হালদা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। নয় কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়। এটি বাংলাদেশ, এশিয়ার তথা বিশ্বের এক অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। বিশেষ করে সরকার ও জনপ্রতিনিধির তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা কিংবা বুড়িগঙ্গার পরিণতি হওয়ার আগেই হালদা নদীকে রক্ষা করতে হবে। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক এ মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রে যাতে নিরীহ মা মাছরা ডিম নিঃসরণ করে নিজ গন্তব্যে নিরাপদে ফিরে যেতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। ভেজাল রেণু ও পোনা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে সারাদেশের মৎস্যচাষিদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। হালদাপাড়ের সন্তান হিসেবে সবিনয় মিনতি সংশ্লিষ্ট সবার কাছে।
তৌহিদ ইবনে ফরিদ : নাগরিক অধিকার কর্মী