somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার একটা শ্রেণিসংঘাতের গল্প । গঠনমূলক সমালোচনা প্রত্যাশা করছি।

২৯ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বৈষম্যের আর্তনাদ
রেসেকা হেঁটে যাচ্ছিল বিষুবরেখা বরাবর। আচমকা আলোর প্রস্থানে পৃথিবীতে জ্বলে উঠল অন্ধকার। অন্ধকারে অন্তর্দৃষ্টি গলিয়ে সে দেখতে পেল সর্পিল একটা পথ চলে গেছে অরণ্যের গহিনে। পথে নেমে সে ভাবল, অরণ্য আধুনিক মানুষের গন্তব্য হতে পারে না। থমকে দাঁড়াল রেসেকা। তার হৃদয়কেন্দ্রে অনুভূত হলো বৃক্ষদের শিকড়ের পিপাসা জলের গভীরে বিস্তৃত। দৌড়ের ভঙ্গিতে দ্রুতপায়ে সে ধাবিত হতে লাগল বিল কিংবা সমুদ্রের দিকে। জলে নেমে জোঁক বা কুমির দেখতে পেয়েছিল কিনা তা স্মরণ করতে পারছে না রেসেকা।
শৈত্যপ্রবাহের দমকে রেসেকার শরীরে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়। অন্যমনস্ক থেকে পূর্ণমনস্ক হতে চেষ্টা করে সে। কিছুণ আগে যে সে চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলেছিল এটা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি তার। কিন্তু একটা বিষয় একেবারেই মিলছে না। নিজেকে সে গরম কাপড়হীন অবস্থায় আবিষ্কার করেছে রমনা পার্কের ভেতর একটা জলাশয়ের পাশে।
স্যার! আচমকা উচ্চারিত শব্দটির উৎসের দিকে ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকায় রেসেকা। পেছনে ড্রাইভার সজল খাম্বার মতো দাঁড়ানো। টুপিঅলা জ্যাকেটের পকেট থেকে হাত দুটি বের করে বলল, ব্লেজারটা নিয়ে আসি স্যার?
না, আমি শৈত্যস্নান করছি।
শৈত্যস্নানের অর্থটা অনুধাবন করতে সামান্য সময় লাগে স্বল্পশিক্ষিত সজলের। আর কতক্ষণ যে মনিবের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তা ভাবতে ভাবতে হাই তোলে সে। তার মুখ থেকে বের হয়ে আসা ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে রেসেকা বলে, তুমি বরং চলেই যাও।
আপনাকে একলা রেখে যাব না। দরকার হলে সারা রাত থাকব এখানে। তবে আপনাকে ব্লেজার পরতে হবে। তা না করলে আমার জেকেট খুলে ফেলবো।
সজলের সরল কথাগুলো আলোড়িত করে রেসেকার আবেগকে। অনিচ্ছায় সে পার্কের গেট পেরিয়ে গাড়িতে বসে।
সাদা গাড়িটি বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে ধীরে ধীরে গতি বাড়ায়। কুয়াশাঢাকা পথটা পাড়ি দিতে দিতে রেসেকার ভাসমান ভাবনাগুলো জমাট বাঁধতে থাকে।
উঁচু প্রাচীরের বিশাল এক ফটকের সামনে গাড়ি এসে থামে। ফটকের দু’দিকের দুটি সিংহমূর্তির প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ করে রেসেকা। মূর্তিগুলোকে জীবন্ত মনে হচ্ছে তার।
লম্বা হর্ন শুনে তন্দ্রাচ্ছন্ন হেকমত আলী টুল থেকে লাফিয়ে দাঁড়ায়। রেসেকাকে সালাম ঠুকে গেট খোলে। গাড়ি থেকে নেমে হাজার দশেক টাকা সজলের দিকে বাড়িয়ে রেসেকা বলে, যাও, মৌজ করে এসো ইচ্ছেমতো। ওই চাচা মিয়াকেও কিছু দাও, ফূর্তি করে আসুক।
সজল ও হেকমতের অভিব্যক্তি অবলোকন না করেই করিডোরের দিকে হাঁটতে থাকে রেসেকা। তার পিছু পিছু পা মিলায় সপ্তম তলায় সাবলেটে থাকা সিনথিয়া। রেসেকার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু সে। ওদের মধ্যে তুই তুকারি সম্পর্ক। এমন আরও কিছু মেয়েবন্ধু রেসেকার ছিল। তারা বন্ধুত্বের পবিত্রতা বজায় রেখে বিদায় নিয়েছে। একমাত্র সিনথিয়াই রয়ে গেছে।
সিনথিয়ার জুতোর শব্দে রেসেকা এক মুহূর্ত থামে। তার দিকে না ফিরেই বলে, এতরাতে কোত্থেকে এলি?
তোর মতো তো বিত্তবেসাত নিয়ে ব্যস্ত থাকি না। এলাম পত্রিকা অফিসে আড্ডা মেরে। এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট, মিল-ফ্যাক্টরি কেমন চলছে রে?
জিগ্যেস করার আর কিছু পেলি না! এসব দেখার জন্য যথেষ্ট লোকজন আছে আমার। কর্মব্যস্ত আমাকেও থাকতে হয়, তাই বলে আমি এত কাজপাগল না।
এর নমুনা তো দেখেই আসছি তিন বছর ধরে। হিসেব রাখলে, ক’বার খোঁজ নিয়েছিস, সংখ্যাটা বলে দেয়া যেত।
কথা বলতে বলতে ওরা লিফটে উঠে দাঁড়ায়। সিনথিয়া সাত নম্বর বোতাম টিপে। সেদিকে খেয়াল নেই রেসেকার। সে ডুবে আছে অবান্তর ভাবনায়। এই লিফটা যদি অনন্তকাল চলতে থাকত কিংবা চলতে চলতে স্বর্গে উঠে যেত।
রেসেকার নীরবতা ও উদাসিতা ভালো লাগছে না সিনথিয়ার। আলাপচারিতা চালিয়ে যেতে সিনথিয়া বলে, তুই নাকি আড়াই লাখ ডলারে মহাকাশ ভ্রমণের টিকিট কিনেছিস?
চাঁদে হানিমুনের টিকিটও কিনে রাখলাম।
এ আর তেমন কী? আমি যে মঙ্গলে চলে যাবার দরখাস্ত জমা দিলাম।
সিনথিয়ার তেরচা কথা রেসেকাকে বিদ্ধ করতে পারেনি। সে লিফট নিয়েই বিভোর। একটা লোডশেডিং হলেও তো আটকা থাকা যেত অনেকক্ষণ।
রেসেকার অবান্তর মগ্নতা ভেঙে আবারো সংলাপের সূচনা করে সিনথিয়া।
বিয়ে-থা কবে করছিস?
তুই কি চিরকুমারী থাকবি?
জবাব আসার আগেই লিফটা সপ্তম তলায় পৌছুঁয়। সিনথিয়া নামে। রেসেকাও অনুসরণ করে তাকে। জিন্সের পকেটে হাত রেখে সিনথিয়া বলে, আমার ঘরে চল্।
আজ থাক। রাত অনেক হলো।
রেসেকার লাল লাল চোখের দিকে তাকিয়ে ব্যাগ খোলে সিনথিয়া। ‘দ্রোহকলি’ নামে একটা ত্রৈমাসিক বের করে। শীতল কণ্ঠে বলে, আমি সম্পাদনা করি, পড়বি তুই?
হাত বাড়িয়ে ম্যাগাজিনটা নিয়ে ধন্যবাদ ও শুভরাত্রি জানায় রেসেকা। সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে থমকে দাঁড়ায় সে। ভাবতে থাকে সিনথিয়াকে নিয়ে।
প্রগতিশীল ছাত্র-রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিল সিনথিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে সাব-এডিটর পদে চাকরি নিয়েছে একটা বামপন্থী পত্রিকায়। রেসেকা তার প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বহাল করতে চেয়েছিল সিনথিয়াকে। এতে সম্মতিসূচক সাড়া মিলেনি অদ্যাবধি। তাই সে কিছুটা ুব্ধ সিনথিয়ার প্রতি।
কীসের এত অহংকার তোর! বিড়বিড়িয়ে কথাটা বলে রিমোট টিপে ঘরের দরজা খোলে রেসেকা।
ওয়াশরুমে ঢুকে গরম জলের কল খুলে মুখে দেয় খানিকটা। বেশ আরাম বোধ হচ্ছে। কাপড় পাল্টে রেসেকা কিচেনে যায়। ভাত-তরকারি গরম করে নেয় মাইক্রোওয়েভ ওভেনে। খেয়েদেয়ে তার আইটি টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সিনথিয়ার দেওয়া ম্যাগাজিনটা টেবিলে রাখে। ম্যাগাজিনের ওপর কনুই চেপে হাতের তালুতে থুতনি ঠেকিয়ে মুখ চেপে ধরে বসে থাকে মিনিট তিনেক। মাথাটা ভারী হয়ে আছে। কাজ করছে না ঠিকমতো।
লেপটপ না খুলে রেসেকা দ্রোহকলির পাতা ওল্টায়। প্রথমেই চোখ পড়ে সম্পাদকীয়তে। শেষের অনুচ্ছেদটা সরবে পড়তে থাকে সে।
আসুন সবাই মিলে একটা সীমান্তবিহীন, পাসপোটর্-ভিসাবিহীন বিশ্ব গড়ে তুলি। ভাষার ভিত্তিতে বিশ্ব বিভক্ত হতে পারে প্রদেশ কিংবা পরগনায়। বিষুবরেখার মতো অদৃশ্য সীমারেখাবেষ্টিত হবে সেসব স্থান। যেখানে বদলে যাবে রাষ্ট্র, সরকার, স্বাধীনতার রূপরেখা। শুধু শিল্পীসাহিত্যিকগণ রচনা করবেন বিশ্বসংবিধান। সকল তন্ত্রমন্ত্র রহিত হয়ে জাগ্রত হোক মানবতন্ত্রের জয়গান।
সিনথিয়া কি সমাজতন্ত্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে নাকি সমাজতন্ত্রের আরো গভীরে প্রবেশ করছে তা লেখাটা পড়ে বুঝতে পারেনি রেসেকা। সিনথিয়া একবার রেসেকার রাফ খাতায় লিখেছিল― আগাছা পরগাছার মতো যতই জন্ম নিক তন্ত্রমন্ত্র/ শ্রমিকের শ্রমে ঘামে রক্তে একদিন জয়ী হবেই সমাজতন্ত্র। এই কথাগুলো তার উদ্দেশ্যে লিখার কার্যকারণ কোনোদিন অনুসন্ধান করেনি রেসেকা। কেননা তার ধারণা, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন মানুষের কল্পনাবিলাস ছাড়া আর কিছুই না। শুধুমাত্র সিনথিয়ার কারণেই সে মাঝেমধ্যে মনে করে সমাজের প্রয়োজনেই হয়তো এ দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হতে পারে কোনো একদিন।
সিনথিয়ার প্রভাব-বলয় থেকে মুক্ত হতে রেসেকা ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসে। ফেসবুকে ঢুকেই সে আহত হয় সিনথিয়ার শব্দাস্ত্রে। সে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে― স্বচ্ছ জীবনে স্বচ্ছন্দবোধ করে না অতিস্বচ্ছল ব্যক্তিরা। সিনথিয়ার প্রোফাইল পিকচার কাস্তে-হাতুড়ি খচিত লাল পতাকার দিকে তাকিয়ে রেসেকা ভাবতে থাকে আপত্তি জানিয়ে কী কমেন্ট করা যায়। ভাবনাকে ভাষায় প্রকাশ করতে না পেরে সে সিনথিয়ার ইনবক্সে লিখে, আমার জীবনযাপনও কি তোর কাছে অস্বচ্ছ মনে হয়?
সিনথিয়ার জবাব আসছে না। অপেক্ষার কষ্ট কাটাতে রেসেকা ব্রাণ্ডির বোতল বের করে বিছানায় রাখে। ক্রমে সেখানে জমা হতে থাকে সিগারেট বক্স, লাইটার, অ্যাশট্রে, টিভির রিমোট।
টিভিতে সিমেন্টের বিজ্ঞাপন চলছে। একটা বস্তার গায়ে লেখা― জন্ম সৃষ্টির লক্ষে। ছোট্ট কথাটি রেসেকাকে আন্দোলিত করে প্রবলভাবে। কীবোর্ড টিপে টিপে সে লিখতে শুরু করে।
কেউ বাঁচে মরতে মরতে। কেউ মরে বাঁচতে বাঁচতে। কেউ বাঁচে জীবন নিয়ে। কেউ বাঁচে প্রাণ নিয়ে। কেউ মরে চলে যায় চিরবিস্মৃতিতে। কেউ মরে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে সৃষ্টিতে।
প্রতিটি বাক্যের শুরুতে কেউ শব্দটি পছন্দ হয়নি রেসেকার। তাই পোস্ট করে না। বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে সে টেবিল বসে। দ্রোহকলির পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা বাক্যে তার দৃষ্টি আটকা পড়ে।
হাত দুটিকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হবে, উত্তোলন করতে হবে যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
আয়েশা আকতারের শৃঙ্খলমুক্তির গান নামে পুরো নিবন্ধটা পড়ে ফেলে রেসেকা। ছবিসহ লেখক পরিচিতির পাতায় চোখ বুলিয়ে চমকে ওঠে। দারোয়ানের যে মেয়েটি তার রান্নাবান্না করে দেয় তারও তো একই নাম, একই চেহারা।
কৌতুহলজনিত অস্থিরতা পেয়ে বসে রেসেকাকে। সে ছুটে যায় গেটের কাছে। হেকমত আলীর সঙ্গে কথা বলে সে নিশ্চিত হয় যে তার মেয়ে আয়েশা লেখালেখি শুরু করেছে। এতে অবাক হয়নি রেসেকা। এমন তথ্য তার জানা আছে, স্বল্পশিক্ষিত আইরিশ নাট্যকার বার্নার্ড শ সামান্য কেরানি থেকে নোবেল বিজয়ী লেখক হয়েছিলেন।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠার সময় রেসেকার মনোভূমিতে দৃপ্তপায়ে বিচরণ করতে থাকে কতিপয় বাম মনীষী। মুচির সন্তান স্তালিন যিনি রাশিয়ার শ্রমজীবি মানুষকে দীতি করেছিলেন বিপ্লবের মন্ত্রে; নয়া চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং যিনি ছিলেন গরিব মুদি দোকানির সন্তান; ভিয়েতনামের নেতা হো চো মিন একসময় যিনি কাজ করতেন বাসন মাজার।
আবেগ আপ্লুত মনে ঘরে ফিরে রেসেকা আয়েশা আকতারকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। সঙ্গে একটা ম্যাসেজ― দ্রোহকলিতে তোমার লেখা পড়লাম।
সিনথিয়া ও আয়েশাকে নিয়ে এলোপাথারি ভাবতে ভাবতে কিছুণ পায়চারি করে রেসেকা। দারুণ অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
অপ্রত্যাশিত একটা ফোনে সকাল ন’টার দিকে ঘুম ভাঙে রেসেকার। টাকার বাণ্ডিলটা ফেরত দেওয়ার জন্য ছটফট করছে সজল। এটা জেনে আশ্চর্যান্বিত ও বিরক্ত হয় সে।
দ্বিতীয় দফায় ঘুমানোর জন্য বিছানায় শোয় রেসেকা। ঘুম জোড়া লাগছে না। উঠে বসে ফেসবুক লগ ইন করে সে। দুটি ম্যাসেজ জমা হয়ে আছে। প্রথমটি সিনথিয়ার। সে লিখেছে- প্রাত্যহিক জীবনযাপনের মধ্যে তোর সত্তার যে প্রকাশ-বিকাশ তাতে সৃষ্টিশীলতার কিছুই নেই; সম্ভব হলে সৃজনধর্মী কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগাতে পারিস তুই।
পরের লম্বা ম্যাসেজটি আয়েশার। ইংরেজি অরে লেখা বাংলা ভাষা পড়তে অসুবিধা লাগে রেসেকার। তবু সে পাঠোদ্ধার করে ধৈর্যসহকারে।
আমার লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ... আপনার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে আমি গর্বিত... কিন্তু মুশকিল হলো আপনি তো শ্রেণিশত্রুদের দলে... তাই রিয়েল কিংবা ভার্চুয়াল যাই হোক আপনাকে বন্ধু হিসেবে মানতে আমি দ্বিধাগ্রস্ত... পারলে উদ্বৃত্ত অর্থবিত্ত বিলিয়ে দিন বিত্তহীনদের মাঝে... কথাটা আপনার ভেতর লুকানো মানবিক মানুষটাকে বললাম...
এতটুকু পড়ে রেসেকা থামে। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কষ্টটা বুদবুদ হয়ে অনুভবে ভেসে উঠছে। সত্যিকার অর্থে অর্থের অহমিকা ছাড়া গর্ব করার কিছুই নেই আমার, ভাবে সে।
ফোনে সিনথিয়াকে আসতে বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রেসেকা। ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢোকে। বাথফোমে শরীরটা ডুবিয়ে দিতেই রাত জাগার কান্তি ঝরতে থাকে সুগন্ধি জলে।
আচমকা ডোরবেল বেজে ওঠে। গোসল অসমাপ্ত রেখে শরীর মুছে কাপড় পরে রেসেকা। দরজা খুলে দেখে উদাসীন চাহনিতে আয়েশা দাঁড়িয়ে। কম্পিত কণ্ঠে রেসেকা বলে, ভেতরে এসো।
থ্যাংক ইউ স্যার। আমি এসেছি সরি বলতে।
সরি তো বলব আমি। তোমাকে দিয়ে রান্না করিয়ে খাচ্ছি কতদিন ধরে।
এভাবে বলবেন না প্লিজ। আপনার কাছে আমরা ঋণী। আমাকে রাঁধুনীর কাজ ও নিরাপদ আশ্রয় দিলেন। পঙ্গু শ্রমিক বাবাকে বাড়ির দারোয়ান বানালেন। আসলে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই চালানো যায় না। তাই ডিসাইড করেছি আপনার এই প্রাসাদ ছেড়ে বস্তিতে চলে যাবো।
চুপ কর আয়েশা। বিয়ের আগ পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকবে আর যা কিছু প্রয়োজন হয় আমাকে বলবে।
আয়েশার নীরবতা থেকে সম্মতি অসম্মতি কোনোটাই আঁচ করতে পারেনি রেসেকা। টবে ফোটা ডালিয়া ফুলের কলির দিকে তাকিয়ে বলে, মানুষের কোনো উপকারে লাগতে পারলে খুব খুশি হই।
আসি স্যার, বলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় আয়েশা।
আমাকে তুমি স্যার স্যার বল কেন? ভাই কিংবা ভাইয়া বলে ডাকা যায় না?
ঠোঁট কামড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে আয়েশা। মেয়েটির অস্বস্তি তাড়াতে রেসেকা বলে, ঠিক আছে, এসো এবার।
আয়েশার প্রস্থানের পর সিনথিয়ার আগমনের প্রতীক্ষায় থাকে রেসেকা।
আধঘন্টার মধ্যে সিনথিয়া আসে। ঘরে প্রবেশ করে এলোমেলো বিছানার দিকে তাকিয়ে বলে, এই তো ব্যাচেলর জীবন।
টিভিতে বিয়ের বিজ্ঞাপন দেবো ভাবছি।
বড়লোকের সুন্দরী ললনারা ছুটে এসে লুটিয়ে পড়বে তোর পায়ের কাছে, চেয়ার ঘুরিয়ে বসে সিনথিয়া বলে।
খোঁচা মারিস না। আমি বিয়ে করব মধ্যবিত্তের কাউকে।
একসময় মধ্যবিত্তরা তোর দুচোখের বিষ ছিল। তাদেরকে সমাজের সবচাইতে সুবিধাবাদী মনে করতি তুই।
এর কারণ অবশ্যই আছে। মধ্যবিত্তরা উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে না কিন্তু ভোগ করে। উৎপাদিত দ্রব্য বিতরণ ও ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত থেকে এরা সহায়তা করে শ্রমশোষণে। আন্দোলনে সংগ্রামে সরাসরি অংশগ্রহণের চাইতে এরা নেতৃত্ব প্রদানে তৎপর এবং অর্জিত ও অর্জিতব্য সুফল সবটুকু ভোগপ্রয়াসী। এই শ্রেণি থেকেই বুর্জোয়া ভাবাদর্শ গড়ে ওঠে।
আরে, তোর কথায় কার্ল মার্কসের গন্ধ পাচ্ছি। পড়েছিস তুই?
মার্কস পড়তে আমার বারণ আছে নাকি?
তা নেই। কিন্তু পুঁজিবাদ যদি সমাজতন্ত্রের বন্ধু হতে চায় তাহলেই যে মহাবিপত্তি বাঁধে। সেকথা থাক। তোর আকষ্মিক মধ্যবিত্তপ্রীতির হেতুটা জানতে পারি?
চামচ নেড়ে চিনি মিশিয়ে কফির পেয়ালা সিনথিয়ার দিকে বাড়িয়ে দেয় রেসেকা। তাই জবাব মিলে একটু দেরিতে।
শিল্প-সাহিত্য ও বিজ্ঞান-দর্শন চর্চায় মধ্যবিত্তরাই অগ্রগামী। বুদ্ধিজীবি শ্রেণিও এ শ্রেণিতে কেন্দ্রীভূত। মুক্তবুদ্ধির বিকাশও মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে ঘটে।
রেসেকার নিকট থেকে গুরুগম্ভীর কথা শুনতে ভালো লাগছে না সিনথিয়ার। সে শুরু করে চটুল আলাপ।
আজ পর্যন্ত ক’টা মেয়ের সাথে ভাব জমিয়েছিস?
মেয়েদের মন রেখে কথা বলতে জানি না বলে এটা হয়নি।
তোর অফিসগুলোতে সুন্দরী আছে না?
তা আছে বৈকি!
ওদের কাউকে গেঁথে ফেল।
যাকে বিয়ে করব তাকে হতে হবে তোর মতো মেধাবী ও প্রতিভাবান।
স্পর্শকাতর কোনো কিছু শোনার জন্য তৈরি ছিল না সিনথিয়া। আবেগহীনতায় তাকায় রেসেকার দিকে। রেসেকার দৃষ্টি বদলে গেছে। চাহনী চপল হয়ে উঠেছে। চোখের পাতায় কাঁপছে অপ্রকাশের যন্ত্রণা।
গুমোট পরিবেশটাকে সহজ করতে সিনথিয়া বলে, কী রে ঘুমাসনি রাতে? নাকি স্বপ্ন দেখছিস বসে বসে?
স্বপ্ন দেখার ভরসা পাই না আমি।
কাচভাঙা শব্দ তুলে সিনথিয়া হাসে। হাসতে হাসতে তাকে জরুরি ডেকে আনার কারণ জানতে চায়। জবাবে রেসেকা বলে, কিছু কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
সেগুলো বাদ দিয়েই বল্।
তোর সম্পাদকীয়গুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে চাই।
তা হতে পারে। তবে আলোচনাসাপেক্ষে।
ঠিক আছে। আর একটি কথা। আমাকে কিছু বইয়ের লিস্ট দিবি। সময় করে পড়ে নেবো।
সত্যি বলছিস তুই!
মানুষ তো নিজের কাছেও সবসময় সত্যবাদী নয়।
আর কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না সিনথিয়ার। তবুও সে জিগ্যেস করে, কোনো কারণে তুই কি আমাকে ইমপ্রেস করতে চাচ্ছিস?
জবাবের আশা না করে সিনথিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। পা বাড়ায় দরজার দিকে। মৃদুস্বরে অনুযোগ প্রকাশ করে রেসেকা, বিদায় না নিয়েই চলে যাচ্ছিস?
আচ্ছা আসি, ম্লান হেসে নিচু স্বরে উত্তর দেয় সিনথিয়া।
সিনথিয়া চলে যাওয়ার পর রেসেকা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে চেয়ারের দিকে। সিনথিয়ার শূন্যতা বসে আছে চেয়ারে। হৃদয়ের অনুচ্চারিত কথাগুলো বলতে থাকে শূন্যতার কাছে।
ঘোর কেটে গেলে রেসেকা ব্যালকনিতে আসে। টবে ফোটা ডালিয়ার কলিটা নেই। এটা কে ছিঁড়েছে, আয়েশা না সিনথিয়া, বুঝতে পারছে না সে।
আয়েশা ও সিনথিয়ার উদ্দেশ্যে রেসেকা উচ্চারণ করে একটি শব্দ― শিট!
ওদের প্রতি বিষিয়ে ওঠা মন নিয়ে রেসেকা গাড়িতে গিয়ে বসে। তাকে দেখে হেকমত আলীর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সজল। টাকাগুলো ফেরত দিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলে, আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু লোভী নই।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে রেসেকা হাত ইশারায় কাছে ডাকে হেকমত আলীকে। বুক চিতিয়ে আসে সে। সালাম ঠোকে না। অনমনীয় ভঙ্গিতে দৃঢ়স্বরে বলে, আমি আর দারোয়ানগিরি করব না, হকারি করব সিনথিয়াদের পত্রিকার।
হেকমত আলীর স্বভাববিরুদ্ধ আচরণে একটুও বিস্মিত হয় না রেসেকা। বরং কিছুটা বিচলিত হয়। তাহলে কি আয়েশা ওর বাবাকে নিয়ে সত্যি সত্যিই চলে যাবে?
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেসেকা হাত রাখে সজলের কাঁধে। শীতল গলায় বলে, ইচ্ছে হলে তুমিও চলে যেতে পারো আমার ড্রাইভারি ছেড়ে।
মাথা নিচু করে বাগানের ঘাসের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সজল।
স্টিয়ারিং ধরে রেখে রেসেকা সজলকে গাড়িতে ওঠার নির্দেশ দেয়। ইতস্তত করে সজল তার মালিকের পাশে বসে।
এলোমেলো গতিতে গাড়ি চালাতে শুরু করে রেসেকা। সজলের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আশংকা-বাণী।
একটু সাবধানে চালান স্যার। এক্সিডেন্ট হতে পারে।
হলে হোক। কোনো ঘটনাই তো ঘটছে না, একটা দুর্ঘটনাই না হয় ঘটুক।
তাহলে প্রাণও চলে যেতে পারে স্যার।
প্রাণের আর মায়া নেই আমার।
আমার আছে। মরতে চাইলে একা মরুন। নামিয়ে দিন আমাকে।
অতর্কিতে ব্রেক কষে রেসেকা। সজল নেমে একটুও দাঁড়ায় না। সোজা হাঁটতে থাকে ফুটপাথ ধরে। যতদূর তাকে দেখা যায় ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকে রেসেকা।
ফুটপাথ ঘেঁষে গাড়িটা সাইড করে রেসেকা রাস্তায় নামে। ড্রাইভিং সীটে চাবিটা রেখে মিশে যেতে চায় জনস্রোতে। তার সামনের দিক থেকে স্লোগানে স্লোগানে এগিয়ে আসছে লাল পতাকার মিছিল।
দুনিয়ার মজদুর... এক হও, এক হও...
এক হও, এক হও... দুনিয়ার মজদুর...
মিছিলটা রেসেকাকে অতিক্রম করে যাওয়ার সময় তার মধ্যে একটা বিপ্লবী স্পন্দন জাগে। স্লোগানে কণ্ঠ মিলাতে গিয়ে তার খেয়াল হলো শোষিত শ্রমিকরা যাদের শোষণের বিরুদ্ধে মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলন করছে শিল্পপতি রেসেকা তাদেরই একজন।
মিছিলটা চলে যাবার পরও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে রেসেকা। তার ইচ্ছে হয় এগিয়ে গিয়ে শ্রমিক নেতাদের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে আসার। পরণেই এই কাজটিকে নিরর্থক মনে হতে থাকে। সে ভাবে, প্রলোভনে অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করে না এমন কোনো শ্রমিকনেতা এ দেশে নেই; আর থাকলেই বা আমার কী?
কর্তব্যবিমূঢ়তায় দাঁড়িয়ে থাকার কষ্ট থেকে মুক্ত হতে রেসেকা হাঁটতে শুরু করে। এলামেলো পায়ে পৌঁছে যায় রমনা পার্কের ভেতর। ুৎপিপাসায় কাতর রেসেকা ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। চোখ বুঁজে ভাবতে চেষ্টা করে নিজেকে নিয়ে। অথচ কী আশ্চর্য, তার মনোজগতে প্রবেশ করে মার্কিন ধনকুবের অ্যান্ড্রু কার্নেগি যিনি শেষজীবনে সব সম্পদ দান করে যান জনহিতকর কাজে। খানিক পরে অ্যান্ড্রু কার্নেগিকে সরিয়ে দেন মণি সিংহ। বিড়বিড়িয়ে রেসেকা বলে, কমরেড গরিবদের মাঝে তুমি তোমার সবকিছু বিলিয়ে দিলে; আমি পারছি না...।
ধীরে ধীরে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রেসেকা।
কাস্তে হাতুড়ি হাতে তাকে তেড়ে আসছে একদল জীবন্ত কঙ্কাল।
অর্থহীন ধ্বনিতে সে আর্তনাদ করে ওঠে।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×