somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিরিয়ার যুদ্ধ মানবতার পরাজয় ২

১৪ ই মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সিরিয়া পশ্চিম এশিয়ার দেশ। স্বাধীন দেশ। সিরিরা আরব রিপাবলিক নামে পরিচিত। আয়াতন মাত্র ১৮৫১৮০ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ২০১৭ সালের হিসাবে মতে ১৮.০১ মিলিয়ন। কিন্তু বর্তমানে দেশের জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ উদ্বাস্তু। দেশের ভেতর কিংবা দেশের বাইরে। কিন্তু বর্তমানে দেশটি নানা ভাবে বিভক্ত। কোন একক শক্তির হাতে এই দেশটির শাসনভার হাতে নেই। সার্বভৌম ক্ষমতা বলতে যা বুঝায় তার চরম লঙ্ঘন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শক্তি ইচ্ছেমত তাদের এজেন্ডা কায়েম করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই রকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের শাসকরা দেশের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখার কারণেই সংকটের তীব্রতা বেড়েছে। মানুষ যখন তাদের মৌলিক অধিকার হারায়।
সিরিয়ার ইতিহাস সবসময়ই অরাজকতা পূর্ণ। এর কারণ নানামূখী। অংশত কেন্দ্রীয় শাসনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। সিরিয়া একক পরিচিতির অভাব ছিল এখনও আছে। এখানে আত্মপরিচয়ের সংঘাত আছে। আত্মপরিচয়ের জন্য প্রতিযোগীতা আছে। আরব জাতীয়তাবাদ, সিরীয় জাতীয়তাবাদ, ইসলামিক ঐক্যবাদ। এই রকম নানা মূখী সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ে সিরিয়ার যাত্রা। অন্যদিকে পারিবারিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বংশ কিংবা ধর্মীয় মতবাদের কর্তৃত্ববাদ এই সংঘাতকে আরো তীর্বতর করেছে। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে আলাবাইত পন্থি শিয়ারা; অন্যদিকে সুন্নি আরবদের অতিক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠী অর্থনীতির হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল। কিন্তু গ্রামীন জনপদে সকল মানুষের আর্থিক অবস্থা ছিল নাজুক। যুদ্ধে এই পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তোলে। আধা –সামন্ততান্ত্রিক আর্থিক কাঠামো উপর ভর করে দাঁড়ানো ছিল সিরিয়ার অর্থনীতি। সংকীর্ণ বিভাজিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সিরিয়ার অন্যতম মূল সমস্যা। ধর্মের দিক থেকে সিরিয়া চরমভাবে বিভক্ত। শিয়া, সুন্নি, আলাবাইত ( শিয়াদের একটি শাখা), দ্রোজ (খ্রীষ্টানদের একটি শাখা), এই সাথে প্রান্তিক অর্থনীতিতে বসবাস মানুষের মাঝে বঞ্চনা ছিলা আগে থেকেই। এই পরিস্থিতি যখন ২০১১ সালে প্রথম দিকে বিপ্লবের সূচনা হচ্ছিল। সামাজিক, আর্থিক, ধর্মীয় বিরোধ গৃহবিবাদ কে গৃহযুদ্ধে রূপান্তর করার জন্য ভূমিকা রাখে। বর্তমানে জনসংখ্যার ৯০.৩০% আরব। কুর্দিস,আর্মেনিয়ান এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ৯.৭০ শতাংশ। এখানে উল্লেখ্য যে সিরিয়ার গোলান মালভূমিতে বসবাস করে ২০০০০.০০ হাজার ইহুদি। ইসরাইল এই মালভূমি দখল করে আছে। ধর্মের দিক থেকে সিরিয়ায় বাস করে ৮৭% মুসলিম, ১০% খ্রীস্টান, ৩% ইহুদি। মুসলিমদের ৭৪ সুন্নি, ১৩% আলাবাইত, ইসমাইলি শিয়া। মজার ব্যাপার হল এই সকল জাতিতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় বিভক্তি সিরিয়াতে অত্যন্ত প্রবল। ভাষার দিক দিয়েও সিরিয়াতে নানা ভাষার প্রচলন আছে। সরকারি ভাষা আরবি। তবে সেখানে কুর্দি, আর্মেনিয়ান, আরামাইক, সিরকাসিয়ান, ফ্রান্স ও ইংরেজি ভাষা চলে।
সিরিয়ার প্রায় ৫৮% মানুষ শহরে বাস করত।নগরায়নের হার ছিল ৩.৫৯% শতাংশ। জনসংখ্যার আধিক্যের দিকে থেকে আলেপ্পো ছিল প্রথম। আলেপ্পোতে বাস করত প্রায় ৩.৫৬২ মিলিয়ন, দামাস্কাসে ( রাজধানী) ২.৫৬৬ মিলিয়ন, হোমসে ১.৬৪ মিলিয়ন, হামাতে ১.২৩৭ মিলিয়ন, লাতাকিয়া ০.৭৮১ মিলিয়ন( ২০১৫ সালের হিসাব)। মোট জনসংখ্যার ৫১.১৬ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বছরের নীচে। অধিকন্তু ৩১.৬২ শতাংশের বয়স ১৪ বছরের নীচে। যুদ্ধের এই বিশাল সম্ভাবনাময় মানুষের স্বপ্ন আশা সব ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের বিশাল অংশ দেশ থেকে বিতাড়িত। যেখানে তাদের বাড়ি ছিল। ঘর ছিল। ব্যসসা বানিজ্য, সংসার ছিল। সবকিছু বদলে গেছে। যুদ্ধ, ধ্বংসলীলা, মৃত মানুষ, পুড়ামাটি, কংক্রিটের ভগ্নস্তুপ, গোলা বারুদ, বোমার আঘাতের চিহ্ন; দখল আর পাল্টা দখলের কাড়াকাড়ি। দেশের ভেতরের নানা বিভক্ত শ্রেণি আর বাইরের নানা বাহিনীর আনাগোনা ইত্যাদি প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ সিরিয়ার বাস্তবতা। বর্তমানে আলেপ্পো, লাতাকিয়া, হোমস, হামা প্রভৃতি শহরে আর বাসযোগ্য নয়। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেণ্টকে পূর্ব ঘৌতা শহরে হামলার বিষয়ে সাংবাধিকরা জিজ্ঞেস করলে, তিনি উত্তর দেন আলেপ্পোতে যান। সেখানে ধ্বংসস্তুপের নীচে পড়ে থাকা লাশের দাফন করে আসুন। সেখানে এখনও অনেক মৃতদেহ পড়ে আছে। যেমনটা ইরাকের মসূলে ধ্বংসস্তুপের নীচ পড়ে আছে।
আকাশের দিকে তাকালে দেখা যাবে মার্কিন, রাশিয়া, তুর্কি, সিরিয়া সরকার পন্থি, কিংবা ইসরাইলের বিমানের আনাগোনা, হামলা। উদ্দেশ্য ভিন্ন কিন্তু টার্গেট একটা সিরিয়ার মানুষ যতবেশি মারা যায়। কার লাভ কার লোকসান তা বিচার যাবে না। লাভ যারই হোকসান জনগণের। সম্পদ আর ইতিহাসে দিক বিবেচনা করলে সিরিয়ার শহরগুলোর সম্বৃদ্ধি অনেক সুপ্রাচিন। এই সুপ্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস আজ বিপন্ন। যুদ্ধে মানুষ মারা গেলেও এখানেও বানিজ্যের জয়। অস্ত্র বিক্রি বেড়ে গেছে। পুরানো অস্ত্র গোলা, ট্যাংক বহর, বিমান, কামান, ক্ষেপানাস্ত্রবিরোধী ব্যাটারি, যুদ্ধ বিমান সহ অন্যান্য অস্ত্র বিক্রি বেড়ে গেছে। সিরিয়ার পাশের দেশ সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, এবং সিরিয়া এই সবদেশ তাদের অস্ত্রের ভান্ডার বড় করছে। আর রাশিয়া, ইউরপীয় ইউনিয়ন( ফ্রান্স, জার্মানি), যুক্তরাজ্য সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর অস্ত্র বিক্রি করছে। সস্তা তেল কিনে দামি অস্ত্র বিক্রি চলছে। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়া তাদের নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সরাসরি যুদ্ধ করছে। একদিকে আইএসআইএলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে আবার অন্যদিকে এদের হোতাদের কে কিভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে কাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে তুরস্কের মিত্র আবার অন্যদিকে তুরস্ক বিরোধীদের কে অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ দিয়ে সরাসরি সাহায্য করছে। তুর্কিদের সাথে কুর্দিদের সংঘাত পুরানো। এই সংঘাত কে উস্কে দিতে কুর্দিদের অস্ত্র দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখানে তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে আগামীতে আসপাশের দেশ গুলো সাথে একটা স্থায়ী সংঘাত কে টিকিয়ে রাখা যাবে। তাদের স্বার্থ এখানেই।
আর কুর্দিদের দমনে ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক আর ইরান একট্টা। কুর্দি জাতিগোষ্ঠীকে দমন করা, তাদের স্বাধীনতার দাবিকে নিরুৎসাহিত করার জন্য এই সকল দেশে কখনও একা, কখনও যৌথ উদ্যোগে দমন অভিযান চালায়। কুর্দিরা ইরাকে সাদ্দামের পতনের পর থেকে তাদের দাবিকে জোরেশোরে করে আসছিল। সেখানে ইরাকের অখন্ডতা রক্ষা করার জন্য কুর্দিদেরকে দমনের ব্যবস্থা করা হয়। আজ সিরিয়ার আফরিনে কুর্দিদের অবস্থানে তুরস্ক আকাশ থেকে বোমা বর্ষন করছে। অন্যদিকে স্থল অভিযান করছে। এখানে আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিদের কে রসদ দিচ্ছে। তার মানে হল ইরাকে বর্তমান অবস্থায় যুদ্ধ শেষ হলে কুর্দি সমস্যা তরতাজা থাকবে।আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করছে সব পক্ষ। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। যুদ্ধে প্রবৃত্ত দলগুলোর কাছে মানুষের জীবনের কোন মূল্যনেই। সহসা যুদ্ধ শেষ হবে তার কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। সিরিয়া বিভক্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। সিরিয়া বিভক্তি আগামী দিনেও এখানে যুদ্ধের বীজ বপন করবে। সিরিয়া আর কোনদিনে গোলান মালভূমি ফেরৎ পাবে না। ইসরাইল ১৯৬৭ সালে যুদ্ধে এই এলাকা দখল করে। কৌশলগত অঞ্চল হিসাবে ইসরাইল এই এলাকাকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে তার দখল অব্যাহত রেখেছে। ইসরাইল মনে করে গোলান তাদের দরকার। জোর করেই দখলে রাখতে পারবে। ১৯৮১ সালে ইসরাইলের সংসদ নেসেট আইন করে গোলান কে নিজেদের দেশের এলাকা হিসাবে ঘোষণা করে। সিরিয়াকে বিভক্ত করতে পারলে ইসরাইল লাভবান। আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে ইসরালের অবস্থান এমনিতেই অতুলীয়। সেখানে সিরিয়াকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা উপরই তাদের স্বার্থকতা নির্ভর করছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০৬
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×