somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টোকিও সফর – কিছু আইতল্যামি

১৩ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

Hibiya City Park and Dr. Jose Rizal’s Bronze Statue
--------------------------
টোকিও ভ্রমনের শেষদিন। সকাল বেলা হোটেলের কাছাকাছি একটা পার্কে হাটাহাটি করার জন্য গিয়েছিলাম। পার্কটি উন্মুক্ত এলাকা। বেশ কয়েকটি গেইট দিয়ে সেখানে প্রবেশ করা যায়। প্রধান সড়কের পাশ দিয়ে প্রবেশ পথের কাছেই আছে আন্ডার গ্রাইন্ড গাড়ি পার্কিং স্থান। তাছাড়া পার্কের ভেতর হাঁটার জন্য প্রসস্ত লেইন আছে। বাকি খোলা জায়গায় বাগান। নানান ফুলের বাগান। বাগানের সাজসজ্জায় যে কেউ মোহিত হবে। নিজের অজান্তেই এক ঐতিহাসিক পার্কের ভেতর চলে আসি। আমার হোটেল থেকে বেশী দূরে না। সোজা হাটলে হিবিয়া সিটি সেন্টার। রাজপ্রাসাদের অনতিদূর। সাজানো এক বাগান। বল হয়ে থাকে হিবিয়া পার্ক পশ্চিমা ধাঁচের প্রথম পাবলিক পার্ক। ইতিহাসের পাতায় লিখা আছে হিবিয়া পার্কের নাম। একশ বছরের চেয়ে প্রাচীন এই বাগান। আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকেই ইন্টার নেটে খোঁজাখুঁজি। ইতিহাস এখানে মিশে আছে মাটি আর প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে। ইতিহাস লুকিয়ে গাছের ছায়ায়। কেননা এখানে একটি প্রাচিন গাছ আছে যার বয়স প্রায় ৪০০ শত বছর। এই গাছে ছায়া দিয়েছে মানুষ, পাখি আর ভ্রমণ বিলাসি দূরদেশি কে। এর ছায়ায় লুকিয়ে আছে কতই না অজানা প্রেমের কাহিনি। ফুল আছে, লতানো নানা পাতা বাহার আছে। প্রাচিন পাথর আর মাটির মিশেলে বানানো এই পার্ক। আকারে হাইড পার্কের চেয়ে ছোট। তবে নান্দনিকতার কমতি নেই। এই পার্কে বর্তমানে জমির পরিমাণ হচ্ছে ৪০ একর। রাজকীয় প্রাসাদের দক্ষিন পরিখা ঘেঁষে এই বাগান।
হিবিয়া পার্কের জায়গা মূলত ছিল সামন্ত প্রভুদের মাঠ। সুগোনাত (Shogunate – উত্তরাধিকার ভিত্তিক শাসন কাঠামো) এর আমলে এই মাঠ তারা ব্যবহার করত। উনবিংশ শতাব্দিতে জাপানের প্রারম্ভিক আধুনিকায়নের সময় এখানে সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হত।১৯০৩ সালে এই পার্ক জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এই পার্কেই ১৯০৫ সালে টোকিও এর সেই ঐতিহাসিক দাঙ্গা ঘটে। সেই দাঙ্গায় মারা যায় ১৭জন। ৩০,০০০ হাজার প্রতিবাদি জনতা এখানে সম্মিলিত হয়। উদ্দেশ্য জাপান সরকারের সাথে রাশিয়া শান্তি চুক্তির নানা শর্তের প্রতিবাদ জানাতে। মার্কিন যুক্তরাষ্টের মধ্যস্থায় সংগঠিত হয় এই চুক্তি। এই চুক্তির নাম ছিল পোর্টসমাউথ চুক্তি(Portsmouth ) । যুদ্ধে বিজয়ী পক্ষছিল জাপান। জাতীয়তাবাদি জাপানীরা মনে করত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জাপানের মান সন্মান ক্ষুন্ন হয়েছে। ফলে এখানে সাধারণ মানুষ জড়ো হয়। প্রতিবাদ করে। এক দশক ধরে চলে নানা প্রতিবাদ। জাপানে এই প্রতিবাদ কে সমাজবাদি প্রতিবাদ নামে খ্যাত। এই পার্কে সমবেত হয়ে প্রথম আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।

আগেই বলেছি হিবিয়া পার্ক পশ্চিমা ধাঁচের ফুলের বাগান। এখানে অনেক টিউলিপ আছে। বড় একটা ঝর্ণা আছে। নানা বাহারের গোলাপ ফোটে আছে বাগানে। গানের আসরের জন্য দুইটি মিউসিক ডোম আছে। যেখানে গান চলছে। কোন না কোন মেলা চলছেই। পার্কের ভেতর একটা পার্ক মিউজিয়াম আছে, লাইব্রেরি আছে, পাবলিক হল, পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট আছে। আর আছে আন্ডার গ্রাউন্ড গাড়ি পার্কিং। টেনিস কোর্ট আছে একদিকে।
বাগানের ভেতর খোলা জায়গায় অনেক খাবারের দোকান। ভেতরে প্রবেশ করে দেখি খাদ্যমেলার মত মনে হলেও আসলে এই সব দোকান পার্কের অন্তর্ভুক্ত। নানা প্রকার খাবারের দোকান সাজানো। একেক দোকানে খাবারের বাহারি পোস্টার লটকানো আছে। তাছাড়া প্লেটে করে খাবার সাজিয়ে দেখানো হচ্ছে। ভেতরে লাইন করে অনেক চেয়ার টেবল সাজানো। আমার কাছে অন্য একটা বিষয় নজরে আসে। অনেকের এখানে এসেছে পরিবারের অনেক বৃদ্ধ পিতা মাতা কিংবা দাদা দাদি, নিদেন পক্ষে আত্মীয় পরিজন নিয়ে। কাজের জন্য যাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ কম হয়। তাদের জন্য হয়ত এই দিন একটা মিলন মেলা। সেদিন ছিল রবিবার। কাজ নেই। অফিস আদালত ছুটি। সকাল থেকেই মেলায় ভীড় ছিল। অনেকই এসেছে হুইল চেয়ারে করে। হুইল চেয়ার ঠেলে ঠেলে মাঠে মেলার জায়গায় প্রবেশ করছে। মুখে হাসি। একটা খুশির ঝিলিক আছে। অশিতিপর বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা আসছে পরিবারের তরুণ কারও হাত ধরে। তাদের মনে যে আনন্দ আছে তা চেহারায় বেশে উঠে। কম বেশী গরম ছিল না। হালকা বাতাস। শীতের প্রকোপ নেই। আরাম দায়ক তাপমাত্রা। বাগানের অনেক বাহারি ফুল আছে। সেই ফুলের মাঝে এই মেলায় যেন ফুলের সুভাস কে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।পারিবারিক বন্ধন জাপানে একেবারে হারিয়ে যায়নি। উন্নত, আধুনিক, প্রযুক্তি আর শিল্প বিকাশের অনন্য মাত্রায় পৌছেছে জাপান। তাদের মাঝে পারিবারিক বন্ধন শিতিল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু হারিয়ে যায়নি। তাদের আনন্দউচ্ছ্বাসের মাঝে কিছুক্ষণ পার করে চলে এলাম।
অধিকন্তু বাগানের দেখার মত আছে নানান জাতের গাছপালা। উল্লেখ করার যে বৃক্ষ আছে তার নাম জিঙ্কো বিলোবা। সাধারণত জিঙ্কো নামেই পরিচিত এই বৃক্ষ। এর আরেকটি নাম আছে যাকে মেইডেনহেয়ার গাছ নামে ডাকা হয়। বাগানের মধ্যভাগে এই জিঙ্কো গাছের সারি ছায়াবীথি প্রসস্ত হাঁটার রাস্তা তৈরি করেছে। এখানে একটি জিঙ্কো বিলোবা আছে যার উচ্চতা প্রায় ৮০ ফুট। কুবিকাকে ইচু নামে পরিচিত এই জিঙ্কো গাছ। এর বয়স প্রায় ৪০০ শত বছর। বাগানের একদিকে ছোট্ট একটা বাঁধানো পুকুর আছে। দুইদিকে পাথরের উপর ব্রোঞ্জের বক বসানো। এই পার্কে জীবন্ত বকের আনাগোনা আছে। নম্বা পা আর দীর্ঘ গলাওয়ালা বক। এখানে রাখা আছে অনেক পাথর। এই পাথর গুলো আনা হয়েছে ইয়াপ দ্বীপ থেকে। এন্টার্টিকা থেকে একখন্ড পাথর এনে এখানে রাখা আছে। মজার ব্যাপার হল বাগানের এককোণে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান ভাইকারদের সমাধি স্তম্ভলিপি (Epitaph)। অনেক স্ট্যাচু আছে এই পার্কের ভেতর । উল্লেখযোগ্য স্ট্যাচু হচ্ছে রেমুস এবং রেমুলাসের স্ট্যাচু। ১৯৩০ সালে ইতালী সরকার এই স্ট্যাচু দান করেন। ১৯৫২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া লিবার্টি ঘন্টা বসানো আছে পার্কের ভেতর। সব মিলিয়ে জাপানের জনগণের কাছে এই পার্ক অনেক স্মৃতিবহন করে।

আগেই উল্লেখ করেছি সকালে যেহেতু কাজ নেই তাই বাগানে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। বাগানের এককোণে একটা আবক্ষ স্ট্যাচু চোখে পড়ে। নীচে লেখা একটা নাম। ফিলিপাইনের জাতীয় নেতার নাম। ডক্টর জোসে রিজাল। কে এই রিজাল? কেন তাঁর একটা আবক্ষ স্ট্যাচু এখানে? নানা প্রশ্ন আমার মনে আসে। আমার জানা ছিল না । তাঁর নামের সাথে ফিলিপাইনের ইতিহাস জড়িত। ফিলিপাইনের ইতিহাস আমার জানা নেই। বড়জোর বর্তমান সময়ের কয়েকজন নেতার নাম মনে আসে। আর যে নামটা বার বার মনে আসে। স্বৈরশাসক মার্কুসের নাম। আর সেই সাথে তাঁর স্ত্রী ইমেলদা মার্কুসের নাম। যাদের নাম বার বার পত্রপত্রিকার আসত। স্বৈরশাসকের নামের সাথে আমাদের দেশের স্বৈরশাসকদের নানা কাহিনী পড়াহত। যাক এখানের ফিলিপাইনের সেই বীরের কথা লিখছি যিনি তাঁর আজীবন সংগ্রাম করে ফিলিপাইনি জনগণের মুক্তির কথা বলে গিয়েছেন। যার নাম আমাদের কাছে জানা নেই। কিন্তু ফিলিপাইনের এই জাতীয় বীরের কথা জাপানবাসি পর্যন্ত ভুলে নাই। যেখানে তাঁর আবক্ষ মুর্তি লাগানো আছে, সেখানে একটা আবাসিক হোটেল ছিল। নাম ছিল টোকিও হোটেল। এই হোটেলে তিনি কিছুদিন ছিলেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জাপান বাসির এই আয়োজন।
ডক্টর জোশে রিজাল (Dr. Jose Rizal ) জন্ম ১৮৬১ সালে। জন্মস্থান কালাম্বা, লেগুনা প্রদেশ, ফিলিপাইন। তাঁর জন্মের সময় ফিলিপাইন শাসিত হত স্পেনের দ্বারা। স্পেনের কলোনিয়াল শাসনের যাতাকলে পিষ্ট ছিল ফিলিপাইন। দীর্ঘদিনের শাসন। বলতে গেলে স্পেন ১৫২১ সাল থেকে ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত ছিল স্পেনের অধীন। অতঃপর ফিলিপাইন শাসিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা ১৮৯৮-১৯৪৬। ১৯৪৬ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে আমেরিকা ফিলিপাইনের স্বাধীনতা মেনে নেয়। ডক্টর রিজাল জন্মে ছিলেন এক বনেদি পরিবারে। যার পূর্বপুরুষ ছিলেন চীনের অধিবাসি। স্পেনের শাসনের নির্মমতা থেকে বাঁচার জন্য অনেকেই খ্রীস্টধর্ম গ্রহন করে। স্পেনিশ নাম গ্রহন অনেকটা বাধ্যতামূলক ছিল। রিজালের পরিবারও তাই করে। সেই হিসাবে রিজাল নামটি স্পেনিশ সারনেম। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি একজন ডাক্তার। চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি মনের চোখেও দেখতে পেতেন। ফলে তিনি লেখালেখিতে হাত দেন। তাঁর জ্ঞান চর্চার কারণে তাঁকে বলা হত একজন পলিম্যাথ(Polymath) মানে হলে জ্ঞানবিজ্ঞানের অনেক শাখায় যার দখল আছে। লেখক, ডাক্তার, বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিক, আইনজ্ঞ, ভাষাবিজ্ঞানি, একাধারে তিনি নৃ-ভাষাবিদ। যারা দখল ছিল অনেক ভাষায়।তিনি স্পেনিশ, ইংলিশ, জার্মান ছাড়াও আরো অনেক ভাষা জানতেন। টেগালগ ভাষার, বর্তমানে যার নাম ফিলিপিনো ভাষা ( জাতীয় ভাষা) পরিভাষা আর কাঠামো নিয়ে কাজ করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। যার বিশুদ্ধ দখল ছিল বিজ্ঞানের নানা শাখায়। একই সাথে তিনি জ্ঞানের অন্য শাখা স্থাপত্যকলা, চিত্রকলা, নকশা অংকন, দর্শন শাস্ত্র নিয়ে পড়শোনাই করেন নাই।এই সব বিষয়ে অনেক জ্ঞানগর্ভ কাজ আছে। জটিল বিষয়ের গাণিতিক সমাধান দিতে পারতেন বলে জানা যায়। তিনি দশভাষায় পড়তে ও লিখতে পারতেন।
ডক্টর রিজাল ইউরোপে তার উচ্চতর পড়াশোনা করার জন্য যান। তিনি প্রথমে মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা করেন। পরে হেইডেল বার্গ, জার্মানিতে গিয়ে চক্ষুচিকিৎসার সর্বশেষ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন। তিনি একজন ইউরোপীয় নৃবিজ্ঞানিদের একজন সদস্য ছিলেন। সেখানে মাদ্রিদে স্বদেশীয় বিদেশিদের সংগঠন প্রপাগান্ডা মুভমেন্ট (Propaganda Movement) এর সাথে জড়িত হন। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল ফিলিপাইনের সংস্কার। বিশেষ করে যাজকদের ক্ষমতা আর রাজার শাসনের সংস্কার। ফিলিপাইনের জাতীয় মুক্তির জন্য আন্দোলন। এইসব কাজের জন্য একসময় তিনি বিপ্লবিদের কাতারে যোগদেন। তাছাড়া তার প্রতিষ্ঠিত দুইটি সংগঠন ছিল। তিনি ১৮৮৮ সালে লাঁ সলিডারেট (The Solidarity). এই সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্যে ছিল প্রবাসিদে কে একত্র করা। স্প্যানের সরকারের কাছে নানা বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো। ইউরোপে বসবাসকারি ফিলিপিনো নাগরিক, ছাত্রসমাজকে উজ্জ্বিবিত করা, সচেতন করা আর ফিলিপিনো স্বার্থরক্ষা করা ছিল এর কাজ। এই সংগঠনের একটি পত্রিকা ছিল। এই পত্রিকার মাধ্যমেই তারা জনমত গড়ে তোলে। যার উদ্দেশ্য হল দি প্রপাগান্ডা মুভমেন্ট কে আরো শক্তিশালি করা।
তিনি ১৮৯২ সালে গঠন করেন La Liga Filipina. এই সংগঠনের চরিত্র ছিল। অনেকটা গান্ধীর অহিংসা মতবাদের মত। স্প্যানিস শাসনের যাতাকলের ভেতর কিভাবে নিজের উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করত এই সংগঠন। দেশপ্রেমিক মন্ত্রে উজ্জিবিত হয়ে শিল্প –বানিজ্য, কৃষি, শিক্ষার উন্নয়ন কে প্রাধান্য দেয়া ছিল এই সংঠন।
ভারতে আমরা দেখেছি কিভাবে বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে কত মানুষ তাদের জীবন দিয়েছে। কারাবরণ করেছে। ঠিক তেমনি ফিলিপাইনের ইতিহাসে স্পেনিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে সেখানে হাজারো মানুষ মারা যায়। দেশান্তরি হয়। কারাবরণ করে। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়। রিজাল ফিলিপাইনের জাতীয় বীরদের একজন। যিনি মানুষের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জন্ম দিতে পেরেছিল। তাঁর এই অপরাধের কারণে স্পেনিশ সরকার প্রতারণা করে গ্রেপ্তার করে। সংক্ষিপ্ত বিচারে মৃর্ত্যুদন্ড দেয়া হয়। ফায়ারিং স্কোয়ার্ডে তার এই দন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। তার অপরাধ সে বিপ্লবী। তাঁর অপরাধ সে একজন স্বাধীনতাকামী। যে মানুষ স্বজাতির স্বাধীনতা চায় সে কিনা বিনদেশি শাসকদের কাছে অপরাধী।
ফিলিপাইনের মানুষ তাঁকে স্বরণ রাখবে। আমি যতটুকু জেনেছি। তার বিখ্যাত উপন্যাস Noli Me Tangere" (Touch Me Not) লিখেন স্প্যানিশ ভাষায়। এই উপন্যাস বিশ্ব সাহিত্যের এক অনন্য নজির। তাঁর এই উপন্যাসে তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে স্প্যানিশ ক্যাথলিক ধর্ম গুরু আর শাসকদের নির্মমতা, ফিলিপিনো সমাজের অবক্ষয়, তার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদি এই উপন্যাস। বর্তমানে এই উপন্যাস তেগালগ ভাষার ( ফিলিপিনো ভাষা)এক অমর ক্লাসিক। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবশ্যক পাঠ হিসাবে পড়ানো হয়। ফিলিপিনোর পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গার মন্ত্র পেয়েছেন এই লেখা থেকে। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৮৮৭ সালে।অন্যদিকে ১৯০০ সালে তা ইংরেজিতে অনুবাদ হয় An Eagle Flight name (1900)। পরে ১৯১২ সালে আবার তা The Social Cancer (1912) প্রকাশিত হয়। তার আরেক উপন্যাস El Filibusterismo (The Rebel) তিনি লিখেন বেলজিয়ামের গেন্টে ১৯৯১। এখানেও তিনি স্প্যানিস ধর্ম ভিক্ষুদের নির্মমতা তোলে ধরেন।
১৮৯২ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পোর্ট সান্টিয়াগোর কারাগারে রাখা হয়। বিচারে তাঁর শান্তি হয় চার বছরের দেশান্তর। তাঁকে পাঠানো হয় দাপিটান, উত্তর মিন্দানাও দ্বীপে। সেখানে তিনি চার বছর তাঁর চিকিৎসা শাস্ত্রের অভিজ্ঞতাকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করে। শিশুদের জন্য স্কুল করেন। নানা সামাজিক সংগঠন করে তোলেন। তাঁর ইঞ্জিনিয়ারিং মেধা কাজে লাগিয়ে নগরবাসির বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ করেন। ১৮৯৬ সালে আবার ফেরৎ আসেন। কিন্তু ভাগ্য তাঁর সাথে প্রথারিত করা হয়। তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কাতিপুনাং নামে একটি বিপ্লবী জাতীয়তাবাদি সংগঠনের সাথে জড়িত। প্রকৃতপক্ষে সে তাঁর সদস্য ছিল না। গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় ফোর্ট সান্তিয়াগো, ম্যানিলা। সে তৎকালীন গভর্ণরের কাছে আবেদন করেছিল, কিউবায় প্রেরণের জন্য। কিন্তু তাঁর অনুরোধ রক্ষা করা হয়নি। তার বিরুদ্ধে সরকারে উৎকাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। ২৬শে ডিসেম্বর ১৮৯৬ সালে তাঁর মৃর্ত্যুদন্ড ঘোষণা করা হয়। মাত্র চারদিনের মাথায় তার মৃর্ত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ফায়ারিং স্কোয়ার্ডে নেয়ার আগে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করা সুযোগ দেয়া হয়। তাঁর মা, স্ত্রী আর কয়েকবোন, ভাগ্নের সাথে তাঁর দেখা হয়। সেই শেষ দেখায় সময় তার বোনের মাধ্যমে সাদা কাগজে কিছু লেখা দিয়ে যায় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। সেই লেখাই পড়ে প্রকাশিত হয়, Mi Ultimo Adios ( The last farewell). এক অনবদ্য বিপ্লবীর লেখা, তার একটি লাইন, I die just when I see the dawn break.
সত্যি সত্যি ১৮৯৬ সালে ৩০শে ডিসেম্বরের সে হারিয়ে যায়। এক প্রহসনমূলক বিচারে তাঁর মৃর্ত্যুদন্ড হয়। উপমহাদেশে ইংরেজ শাসকরা অনুরূপ হাজারো মানুষের জীবন চিনিয়ে নিয়েছে। আমাদের দেশের কর্ণেল তাহেরের ফাঁসি ছিল এমনি এক প্রহসন।
ডক্টর রিজাল ছিল, কবি, সাহিত্যিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, দার্শনিক, পেইন্টার, স্থাপত্যবিদ, সংস্কারক, বিজ্ঞানি, ভাষাবিদ। আরো নানা পরিচিতি আছে। সব পরিচয় বাদদিয়ে তিনি একজন মানুষ। তাঁর অহংকার ছিল আমি মানুষের মুক্তি চাই। স্বাধীনতা চাই। এই যদি অপরাধ হয় তাহলে আমি অপরাধি। ফিলিপিনো মানুষ তাকে মনে রেখে রেখেছে। তাঁর মনুমেন্ট তৈরি করেছে। জাতীয় বীরের সন্মানার্থে সেখানে ২৪ ঘন্টা ৭ দিন পালা করে, বছরের পর বছর পাহাড়া দেয়া হয়। যেখানে তাঁকে হত্যা করা হয় সেই লুনেতা পার্কে তৈরি হয়েছে এই মনুমেন্ট। ফিলিপিনোরা তাঁকে সালাম জানিয়ে জাতীয় দিবস পালন করে। ডক্টর রিজাল ১৮৮৪ সালে শিল্পি জুয়ান লুনা আর ফিডেলগো
(ফিলিপাইনের অমর চিত্রশিল্পি, ভাস্কর) প্রতি সন্মান জানাতে লিখেন,
“Genius has no country. It blossoms everywhere. Genius is like the light, the air. It is the heritage of all.”
প্রকৃতপক্ষে রিজাল একজন খাঁটি জিনিয়াস, মৃর্ত্যুর আগে লিখে যান সেই বিখ্যাত কবিতা,
Farewell to thee, too, sweet friend that lightened my way,
Beloved creatures all, farewell! In death there is rest!
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×