somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডায়েরিঃ বৃদ্ধাশ্রম ও অতঃপর

৩১ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমার বেতন ২২০০০ টাকা, কিন্তু আমি যে বাসায় থাকি ওটা বাড়িধারাতে( ওল্ড ডি ও এস এইচ) ।এয়ারপোর্ট এর পূর্ব দিকে একটা বিশাল ফ্লাট। লোকে শুনে হাসে, পিছে লোক ঘুসখোর বলে।
আমি হাসি, গ্রাম থেকে এসেছিলাম একটা কাজ জুটাবো বলে। কিন্তু আমাকে খুঁজে নিয়েছে। বিশাল কোম্পানি। বছর খানেক পর আমার কাজের উপর খুশি হয়ে এই বাড়িধারাতে ট্রান্সফার করে দেয়। সাথে এই অফিসিয়াল ফ্লাট। পুরো ঘটনা অনেক কে বলা হয়, যারা শুনে তাড়া ভ্রু কুঁচকায়। বাকিরা ঘুস খোর বলে।
যেদিন এই বাসায় এসেছিলাম সেদিন শায়লা কে কোলে তুলে ঘুড়িয়েছিলাম, চুমু খেয়েছিলাম, মাঝরাতে দুজনে একসাথে নেচেছি খিক খিক।
--------
রিহানের জন্ম হয়েছিল বাড়িধারা ‪#‎লেক_ভিউ‬ ক্লিনিকে। সবচেয়ে উন্নত সেবার এই ক্লিনিকে রিহান সোনার চামুচ মুখে জন্মেছিল।
মধ্যবিত্তের কাছে সোনার চামুচ অধরা, বড্ড আদিক্ষেতা। আমার কাছে তা ছিল না। পুরো ১২ আনা সোনা দিয়ে বানিয়ে নিয়েছি সোনার চামুচ। জন্মের পর সেই চামুচে সামান্য মধু নিয়ে রিহানের মুখে দিয়েছিলাম। আমার সন্তান, সোনার চামুচ না হলে চলবেই না। হুম
রিহানের মা কখনো ওর ছবি তুলতে দিত না।কারন অজুহাতের সমান। কিন্তু আমি নাছোরবান্দা, জন্মের প্রথম দিন থেকে রিহানের প্রথম বসা, হামাগুড়ি দেওয়া, প্রথম দাঁত নিয়ে হাসি, নিজের পায়ে দাড়ানো, প্রথম মুখে ভাত, প্রথম স্কুল, কলেজ সব সব আমার ক্যামেরায় বন্দি করেছি।
অহহ হ্যাঁ শায়লা একদিন নিজেই একটা ছবি তুলেছিল রিহানের। যেদিন রিহান আমার পিঠে বসেছিল আর আমি গরুর মত হয়ে হাম্বা হাম্বা করে ওকে নিয়ে ঘুরছিলাম। উফফফ আমার দেখা সেরা ছবি ওটা।
শায়লা বলতো ধুর ছাই, আমাকে খুশি করতে মিথ্যা বলছো।
-----
রিহান যখন ২৬ শে পা দিল তখন আমার ৫২ বছর। এটা নিয়ে বেশ একটা হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল। বাবা ছেলে বয়সে দ্বিগুন। সেই ক্লাস ফোরের অঙ্কের মত।
শায়লা সে বছর বেশ ক্ষেপিয়েছিল আমায়, তবে বেশি দিন পারে নি।
রিহান হঠাৎ একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এলো।শায়লা প্রচন্ড রেগে গিয়েছিল সেদিন। পারলে রিহান কে জ্যান্ত পুতে ফেলবে।
মনে খুব আপসেট হয়ে গেল শায়লা, কিছুদিন তো খাওয়া, ঘুম ছেড়েই দিল। আমি বোঝালাম, ছেলে মানুষ, পছন্দ হয়েছে, বিয়ে করেছে।
কেন আমরাও তো এই ভাবেই বিয়ে করেছি তাই না??
কিন্তু শায়লা বুঝলো না। তার উপর রিহানের বউয়ের অবাধ্য আচরন বাসার ভিতর বেশ খিটমিট পরিবেশের সৃষ্টি করলো।
রিহান একদিন প্রচন্ড রেগে তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল, সে এ বাসায় থাকবে না। অহহ হ্যাঁ একটু বলেই দেই পরে আমি কিস্তিতে অফিস থেকে বাসাটা ৮ বছরে কিনে নিয়েছিলাম।
সেই স্বপ্নের বাসায় রিহান থাকবে না, যার স্মৃতি ঘিড়ে এ বাসা সেই থাকবে না।
আমি ওর পিঠ চেপে দিয়ে বললাম, রাগ করিস না। তোরা এবাসায় থাক, আমাদের বরং বৃদ্ধাশ্রম এ দিয়ে আয়।
এটাই তো চাচ্ছিস তাই না??
রিহান আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলো।
আমি হেসে বললাম, কোথাকার বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে??
ও বলল, গুলশানে। অনেক ভাল একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে। তোমরা ওখানে অনেক ভাল থাকবে।
আমি হেসে আমার রুমে আসলাম,শায়লা আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ঠিক একই কান্না কেঁদেছিল রিহান যখন জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছিল। কি কান্না টাই করেছে, ""আমার রিহান কে ফিরিয়ে দাও বলে "
-----
বসুন্ধরার এই বৃদ্ধাশ্রমে মোট ৬৩ জন আশ্রিতা। যার মধ্যে আমরা দুজন কমবয়েসি। এই ব্যাপার টা খুব মজা লাগতো, শায়লা কে বলতাম দেখ কি কপাল এত জোয়ান বয়সে আমরা ঘড় ছাড়া।
শায়লা মুখ কালো করে নিত। কিন্তু একটা মেয়ে হাসতো। ওর নাম সাবিত্রি।এখানে থাকে। সবার দেখাশুনা করে।কার কি লাগবে সেই দেখাশুনা করে। যখন থেকে আমরা এসেছি এই মেয়েটাই আমাদের পরম কাছের হয়ে গেছে।
প্রায় দেখি সাবিত্রি শায়লার মাথায় তেল দিয়ে দেয়।
আমি ওর মাথায় গুতা দিয়ে বলি কিরে ""মা টাকে আবার কাছ থেকে কেড়ে নিবি না তো?? বুঝিস এই একটাই আমার সম্পদ""।
ও আমার পেটে গুতা দিয়ে বলতো, ইহহহ আমার কি সেই সাধ্য আছে??
বলে হা হা হা করে হাসতো।
----------
গুনে গুনে ফের ২৮ বছর পেড়িয়েছি। ৮০ এর বুড়া আমি , বৃদ্ধাশ্রমের গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছি। বসুন্ধরার সেই বৃদ্ধাশ্রম থেকে ৫ মাস পড়েই পালিয়েছি। তারপর এখানে এসেছি, এখন যেখানে আছি সেখানে নাম বলবো না।পালিয়েছি কারন রিহান মাঝে মাঝে ন্যাকামি দেখাতো, হারামীর ন্যাকামো আমার পছন্দ হতো না। ওর মায়ের সাথে কথা বলে চলে যেত।
পালিয়ে আসার পর ওরা আমাকে খুজেঁছিল কিনা জানি না, তবে খুজেঁ নি এটা সিওর।
এই ২৮ বছরে আমার কাছে কিছু বাকী নেই। ৯ বছর আগে হঠাৎ শায়লা ঘুমিয়ে গেল, এতো ডাকলাম শুনলোই না, ঘুমোনোর আগে শুধু রিহান কে ডাকলো।
আমার বুক টা কেঁপে উঠলো,চোখে ঝাপসা দেখলাম, সাবিত্রি রোজ আসতো আমাদের দেখতে। রোদ বৃষ্টি, ঝড়, এমন কোন দিন নেই যে সে আসেনি। একদিন খুব জ্বর নিয়েও এসেছিল, শায়লা খুব বকেছিল সেদিন।
নিজের সন্তান যেখানে এত বড় বেঈমান সেখানে পর সন্তানের মায়ায় শায়লা কেঁদে দিত।
যেদিন শায়লা ঘুমিয়ে গেল, সাবিত্রি ২ বার সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল।চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছিলো, মাটিতে বসে পা দাপিয়ে আম্মা আম্মা বলে চেঁচাচ্ছিলো। সব কিছু ছেড়ে কবরে শুইয়ে দিলাম শায়লা কে।
এরপর মাঝে মাঝে আসতো সাবিত্রি, গম্ভীর ভাবে কথা বলতো, শায়লার সব কাপর ও নিয়ে গিয়েছিল, আমার কাছে ছিল শুধু রিহানের ফটো এলবাম।
বছর দুয়েক পরে টানা ১ মাস আসলো না সাবিত্রি, খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। একদিন এক ছোকড়া গোছের ছেলে এসে একটা চিঠি দিল। আর বলল, সাবিত্রি দি দিয়েছে।
আমি বললাম ও কই? আসে না যে?
ছেলেটা মাথা নিচু করে বলল, দিদি ২৫ দিন আগে রোড এক্সিডেন্ট মারা গেছে। ওর জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার সময় এই চিঠি পাওয়া গেছে, আর এই ঠিকানা।
বলেই ছেলেটা চলে গেল, আমি বুকে হাত দিয়ে ঠোট চেপে ধরলাম..... বাহ সাবিত্রি বাহ শায়লা। বাহ!!
হঠাৎ একটা গাড়ির হর্নে সেদিকে তাকালাম। মার্সিডিজ বেঞ্জ। এই গাড়িটা আমার সবচেয়ে পছন্দ, কখনো কেনার সামর্থ্য হয় নি, তবে একে দুর থেকেই দেখলেই চিনে ফেলি।
গাড়ির সামনের সিট থেকে একটা ২৫/২৬ এর ছোকড়া নামলো। চোখে সিওর গুচ্ছি এর সানগ্লাস,বড় বিরক্তিকর আমার কাছে, তাই দেখলেই বুঝতে পারি।
ছেলেটা গাড়ির দরজা খুলে দিল।একটা মাঝ বয়েসি লোক,পাঞ্জাবি পড়া আর মহিলা বের হলো। একটু কাছে আসতেই খুব চিনলাম লোকটা কে...
গ্রিলে ছেড়ে হাটা দিলাম তার দিকে, সামনে গিয়ে পাঞ্জাবির কলার চিপে ধরে দুটো থাপ্পর দিব, যেটা আমাকে আরো ২৮ বছর আগে দেওয়া উচিত ছিল।
আর প্রশ্ন করবো "" আজ কেমন লাগছে রে রিহান"""।
আমি জানি ও আমার থাপ্পর খেয়ে কান্না করবে না, ও কাঁদবে আমার প্রশ্ন শুনে।
কিন্তু আমি ওকে মাফ করবো না.........
৮টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×