বিশ্বের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র, মানবতা ও মানবাধিকারের শক্রু, বিশ্বের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সামরিক আগ্রাসনে বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। মানবতা ও মানবাধিকার আজ ধুকরে ধুকরে কেঁদে মরছে। মানবতা ধ্বংস ও দস্যু গিরির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্বের সুপার পাওয়ার এ পরিনত হয়েছে। এ সুপার পাওয়ার হওয়ার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে এক রক্তাক্ত ইতিহাস। বিগত ৩০ বছরে ৫ জন মার্কিন প্রেসিডেন্টে তাদের শাসনকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সমস্ত আগ্রাসন চালিয়েছে এবং সেটার পিছনে আন্তর্জাতিক সমর্থন কতটুকু ছিল তা নিয়ে সংবাদ সং¯হা এপি একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে উঠে এসেছে সামরিক আগ্রাসন ও মানবতা ধ্বংসের বিভিন্ন দিক । নিম্নে রোনাল্ড থেকে বারাক ওবামা পর্যন্ত সামরিক আগ্রাসনের যৎকিঞ্চিত বিবরণ দেওয়া হলো।
রোনাল্ড রিগ্যান
রোনাল্ড রিগ্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান (১৯৮১-১৯৮৯) ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম সামরিক আগ্রাসন পরিচালনা করেন লেবাননে। তিন জাতির শান্তিরক্ষা মিশনের অংশ হিসেবে লেবাননে মার্কিন সেনা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। ১৯৮৩ সালে লেবাননে সামরিক ব্যারাকে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে এতে ২৯৯ জন মার্কিন ও ফরাসি সেনা নিহত হয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে সেখানে সীমিত পরিসরে বিমান হামলা চালানোর জন্য নির্দেশ দেন রোনাল্ড রিগ্যান। ১৯৮৩ সালেই রিগ্যান আবারও সামরিক হামলা চালানোর নির্দেশ দেন গ্রানাডায়। সেখানে সামরিক অভূত্থানে ক্ষমতাসীন সরকারের পতন হলে জাতিসংঘ এবং ব্রিটেনের আপত্তি সত্বেও ক্যারিবীয় দ্বীপের ৬টি দেশের সমর্থন নিয়ে রোনাল্ড রিগ্যান সামরিক হামলা চালান।এরপরে আসে লিবিয়ার পালা। ১৯৮৬ সালে বার্লিনে একটি ডিস্কোবারে বোমা হামলা চালানো হয় এতে ৭৯ আমেরিকান নাগরিক আহত এবং ২ জন নিহত হয়। এই হামলার জন্য লিবিয়ার তৎকালিন প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে দায়ী করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সেখানে সামরিক হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। (যদিও হামলায় গাদ্দাফির সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিতে পারেনি।) এই হামলায় মার্কিন মিত্রদেশ যুক্তরাজ্যের পুর্ণ সমর্থন ছিল। তবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ তাদের এই সামরিক আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানায়।
জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ
রিগ্যানের পরে (১৯৮৯–১৯৯৩)যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করেন ৪১ তম প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ। ক্ষমতা গ্রহন করেই তিনি পূর্বসূরীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে একের পর এক দেশে সামরিক আগ্রাসন চালাতে থাকেন। ক্ষমতা গ্রহনের প্রথম বছরেই(১৯৮৯)তিনি সামরিক আগ্রাসন চালান পানামায়। একনায়ক ম্যানুয়েল নোরিয়েগার সরকার মাদকদ্রব্য পাচারে জড়িত এই অজুহাতে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে বুশ সেখানে ২৬ হাজার মার্কিন সৈন্য প্রেরণ করেন। আক্রমন শুরু হওয়ার পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পানামা যুদ্ধ ঘোষণা করলে এক মার্কিন সৈন্য নিহত হয়। ১৯৯১ সালে জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ আবারও সামরিক আগ্রাসন চালান ইরাকে। সাদ্দাম সরকার কুয়েত দখল করে নিলে কুয়েত থেকে তাদের হটিয়ে দিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও ৩৩ টি মিত্র দেশের সমর্থন নিয়ে ইরাকে হামলা চালানোর নির্দেশ দেন বুশ। যে আগ্রাসনের প্রভাব আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ইরাক।এরপর আসে সোমালিয়া। ১৯৯২ সালে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবিক সাহায্য প্রদানের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমতি সাপেক্ষে সোমালিয়ায় সৈন্য প্রেরণ করেন জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ।
বিল ক্লিনটন
জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের পরে ৪২ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করেন উইলিয়াম জেফারসন বিল ক্লিনটন( ১৯৯৩-২০০১)। আগের দুই প্রেসিডেন্টের তুলনায় কম আগ্রাসী ছিলেন তিনি। তবুও তার সময়েও থেমে থাকেনি সামরিক আগ্রাসন।১৯৯৩ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশকে হত্যার চক্রান্তে জড়িত থাকার অজুহাতে ইরাকের গোয়েন্দা সদর দপ্তরে ক্রুজ মিশাইল হামলা চালান তিনি। এতে বাগদাদে অব¯িহত সং¯হাটির কার্যালয় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৯৩ সালে আবারও সোমালিয়ায় অভিযান পরিচালনা করার নির্দেশ দেন ক্লিনটন। সোমালিয়ার নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সেখানে ¯িহতিশীলতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও অন্য ৩৫ দেশের সমর্থন নিয়ে সোমালিয়ায় সৈন্য প্রেরণ করেন তিনি।এরপরে ১৯৯৪ সালে হাইতিতে সৈন্য প্রেরণ করে ক্লিনটন। হাইতির নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সেখানে ¯িহতিশীলতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন নিয়ে সেখানে সৈন্য প্রেরণ করেন তিনি। এরপরে আসে বসনিয়ার পালা। (১৯৯৪-১৯৯৬)ন্যাটো বাহিনীর সমর্থন নিয়ে বসনিয়াতে ১৮ মাস ধরে বিমান হামলা পরিচালনা করেন ক্লিনটন। তার নির্দেশেই জাতিসংঘের অনুরোধে সেখানকার সার্বদের বিরুদ্ধে কামান, সাজোয়া যান, বোমা হামলা ও ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালায় মার্কিন সেনা বাহিনী।১৯৯৬ সালে আবারও ইরাকে সামরিক হামলা চালান ক্লিনটন। ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসরত সংখ্যালঘু কুর্দীদের রক্ষা ও তাদের উপরে সাদ্দাম হোসেনের রাসায়নিক হামলার অজুহাতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনক্রমে ইরাকের নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যবস্তুতে ক্রুজ মিশাইল হামলা চালান এবং জাতিসংঘের সহায়তায় ইরাকের দক্ষিনাঞ্চলে নো-ফ্লাইজোন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।১৯৯৮ সালে সুদান ও আফগানিস্তানে হামলা চালান ক্লিনটন। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি ও তাঞ্জানিয়ায় মার্কিন দুতাবাসে বোমা হামলা করে ২২০ জন মানুষ হত্যার (যাদের মধ্যে ৯ জন মার্কিন নাগরিক)সাথে জড়িত থাকার অজুহাতে আফগানিস্তান ও সুদানে এই হামলা চালান হয়।১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকদের বেধে দেওয়া নিয়ম মেনে চলতে সাদ্দাম হোসেনকে বাধ্য করতে আবারও ইরাকে মিসাইল ও বিমান হামলা পরিচালনার নির্দেশ দেন ক্লিনটন।
১৯৯৯ সালে আসে কসোভোর পালা। এবার যুগো¯¬াভিয়ার সৈন্য বাহিনীকে লক্ষ্য করে মিসাইল ও বিমান হামলার নির্দেশ দেন ক্লিনটন। এই হামলায় ন্যাটো বাহিনীও অংশ নেয়।
জর্জ ডব্লিউ বুশ
ক্লিনটনের পরে ৪৩ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসেন জর্জ ডব্লিউ বুশ(২০০১-২০০৯)। মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে আগ্রাসী ও যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনে কর হয় তাকে। ২০০১ সালে সন্ত্রাসী আক্রমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের প্রতীক টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে এই ঘটনায় আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের জড়িত থাকার অভিযোগ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবী জানায় আফগান কর্তৃপক্ষের কাছে। তবে আফগান কর্তৃপক্ষ তাকে আমেরিকার হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানালে জাতিসংঘের অনুমোদন নিয়ে ন্যাটো বাহিনী এবং অন্য ৪৮ টি দেশের সহায়তায় আফগানিস্তানে হামলা চালায় আমেরিকা। আজও শেষ হয়নি সেই যুদ্ধ।২০০৩ সালে আবারও ইরাকে হামলা চালানোর নির্দেশ দেন জর্জ ডব্লিউ বুশ। ইরাক পারমানবিক অস্ত্র তৈরী করছে এমন অমুলক অজুহাতে জাতিসংঘ ও অন্য ৪৮টি দেশের সমর্থন নিয়ে ইরাকে হামলা চালান তিনি। যদিও এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে সরানো।
বারাক ওবামা
জর্জ ডব্লিউ বুশের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন বারাক ওবামা। তার সময়ে সামরিক আগ্রাসন তুলনা মূলক কম হলেও একে বারে থেমে থাকেনি। পূর্বসূরি বুশের শুরু করা ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ তিনি সফলতার সাথে তার দুই মেয়াদে চালিয়ে নিয়েছেন। এছাড়াও তিনি নতুন করে বেশ কিছু দেশে আগ্রাসন পরিচালনাও করেছেন। ২০১১ সালে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ থামানোর জন্য জাতিসংঘের অনুমোদন ক্রমে লিবিয়ায় মিসাইল ও বিমান হামলার অনুমোদন দেন বারাক ওবামা। এমনকি সেখানে নো-ফ্লাইজোনও প্রতিষ্ঠা করে মার্কিন বাহিনী। ২০১১ সালে লাদেনকে হত্যা করার জন্য পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে কমান্ডো অভিযান পরিচালনার নির্দেশ প্রদান করেন বারাক ওবামা। ওই অভিযানে কমান্ডো হামলায় লাদেন নিহত হন। এবার বারাক ওবামার নতুন মিশন সিরিয়া। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থামানো এবং আসাদ সরকার বিদ্রোহীদের উপরে রাসায়নিক হামলা করেছে এই অজুহাতে সিরিয়ায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা চুড়ান্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘ ও মিত্রদেশগুলোর সমর্থন পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তাদের অনুমোদন না পেলেও একাই সিরিয়ায় হামলা চালাতে বদ্ধপরিকর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
সময়ের বিবর্তনে বিশ্বের সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ পতনের পথে। কারণ জুলুম নির্যাতন কখনো চিরস্থায়ী হয় না। আজকের বিশ্ব প্রেক্ষাপটে দস্যু ভিত্তির রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ এতটাই দূর্বল হয়ে পড়েছে যে, কারো সহযোগীতা ছাড়া এখন আর একা আগ্রাসন পরিচালনা করতে পারছে না। সিরিয়া আগ্রাসনের ঘোষনা দিয়েও পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । আর মার্কিন সমাজের মধ্যে যে পচন ধরেছে তা মার্কিন সামরিক বাহিনীতেও সংক্রমিত হয়েছে। ব্যাপক বেকারত্ব আর অর্থনীতি ধশের ব্যাপকতায় বিপর্যস্ত মার্কিন সমাজ। ধিরে ধিরে শক্তি হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে বর্তমান সময়ে আলোচিত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ,যেমন নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। তাইতো বিশ্ববাসী আজ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে মার্কিন দস্যুদের পতনের দিকে।