somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-৩

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাম্রাজ্যবাদ কি?
সাম্রাজ্যবাদ হলো পররাজ্যের উপর অধিকার বিস্তারের নীতি। এটিকে প্রায় নঞর্থকভাবে বিবেচনা করা হয়, যেহেতু এতে স্থানীয় জনগণকে শোষণের মাধ্যমে অল্প আয়াসে ধনী হবার উদ্দেশ্য থাকে। আধুনিককালে এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয় যে উপনিবেশবাদ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের বহিঃপ্রকাশ এবং পরেরটি ছাড়া তার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। বিদ্যমান বৈধ উপনিবেশ ছাড়া "অনানুষ্ঠানিক" সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয়।(সূত্র-বাংলাউইকিপিডিয়া)
তাত্ত্বিকভাবে পুঁজিবাদ তার একচেটিয়া অবস্থায় পৌছানোর আগেই এই অবস্থায় পৌছানোর কথা। সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক সমরবাদ। গত একশত বছর ধরে ব্রিটিশ নৌবাহিনী আর মার্কিন সেনাদের যত্রতত্র ঢুকে পড়া, সারা পৃথিবীকে নিজের মনে করার আগ্রাসী মনোভাবে সাম্রাজ্যবাদ না হোক সমরবাদ কি জিনিস টের পাওয়া যায়।
সহজ কথায় সাম্রাজ্যবাদ
সাম্রাজ্যবাদের বিষাক্ত থাবা বিভিন্ন দেশ ও জাতির বুকে রক্ত ঝরিয়ে চলেছে। অথচ সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে একটা ন্যূনতম সঠিক ধারণা ব্যাপক জনগণের মাঝে এখনও ছড়িয়ে দেয়া যায়নি। ইরাক, আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলছে। মার্কিন নেতৃত্বে তার মিত্র দেশগুলো এই যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। এটা সবাই জানে যে, “সন্ত্রাসবাদ দমন” একটা অজুহাত মাত্র। আসল উদ্দেশ্য তেল সম্পদ দখল করা।
বিশ্বের দিকে তাকান। দেখবেন দুনিয়া দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে অতিবৃহৎ এবং বৃহৎ শক্তিগুলো। অন্যদিকে তাদের দ্বারা নিপীড়িত-শোষিত-লুণ্ঠিত জাতিগুলো। ঐ শক্তিশালী দেশগুলোকে বলা হয় সাম্রাজ্যবাদী দেশ।
উন্নত পুঁজিবাদী দেশে কিছু কিছু পুঁজি হয়ে উঠেছিল বিরাটাকার। এই পুঁজি শিল্প, ব্যবসায়, ব্যাংক পুঁজিকে একাট্টা করে সর্বেসর্বা হয়ে উঠে। এটা মূলতঃ লভ্যাংশজীবী বা পরজীবী পুঁজিতে পরিণত হয়। একে বলা হয় লগ্নিপুঁজি। প্রথমে নিজ দেশের পুরো অর্থনীতিকে এই পুঁজি অধীনস্ত করে। তারপর হাত বাড়ায় দুনিয়ার দিকে। পণ্য নয়, অতি উদ্বৃত্ত পুঁজি রপ্তানি করা হয়ে উঠে এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই লগ্নিপুঁজির অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সমগ্র ব্যবস্থাটাকে আমরা বলি সাম্রাজ্যবাদ।
ইউরোপীয় কিছু দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপানসহ কতগুলো দেশে এ ধরনের পুঁজি বিকশিত হয়। তারা গোটা দুনিয়াকে নিজেদের মধ্যে বিভক্ত এবং অধীনস্ত করে।
পুঁজিবাদের নিয়ম হলো অর্থনীতিতে তেজীভাবের পরে মন্দাভাব আসে। অর্থনৈতিক সংকট তৈরী হয়। সাম্রাজ্যবাদী পর্যায়ে এই সংকট হয়ে উঠে সর্বব্যাপী এবং চরম। তাই এটা হলো বুড়ো পুঁজিবাদ। ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ এবং শেষ পর্যায়। অন্যদিকে, কোন পুঁজি দ্রুত বিকশিত হয়, কোনটি ধীরে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং নৈরাজ্য থেকে তার মুক্তি নেই। এসব কারনে লগ্নিপুঁজির মুনাফা নিশ্চিত করার স্বার্থে নিজের অধীনস্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল বাড়নোর জন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে তীব্র সংগ্রাম চলে। এজন্য তারা দেশে দেশে পেছনে থেকে গৃহসংঘাত, গৃহযুদ্ধে মদদ দেয়। তাই সাম্রাজ্যবাদকে বলা হয় “যুদ্ধ পুঁজিবাদ”। আগ্রাসী যুদ্ধ চালায়। এসব সংগ্রাম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়।
সাম্রাজ্যবাদের এই আগ্রাসন-নিপীড়ন বিশ্বের নিপীড়িত জাতিগুলি ও তার জনগণকে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিরোধে পরিচালিত করে। তাদের সামনে সাম্রাজ্যবাদ হলো জাতীয় বিকাশ ও জনগণের মুক্তির পথে বাধার পাহাড়। দুনিয়ার জন্য বাতিলযোগ্য এক আপদ। তাই তারা সাম্রাজ্যবাদের অবসানের জন্য সংগ্রামে সামিল হয়। সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশের নিপীড়িত জনগণও এ সংগ্রামে যুক্ত হয়। এভাবে জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম প্রতিরোধ সংগ্রাম, প্রতিরোধ যুদ্ধ, বিপ্লবী যুদ্ধ, গণযুদ্ধ রূপে বিকশিত হয়। আজ তা আরো দুর্নিবার হয়ে উঠেছে।সাম্রাজ্যবাদ হলো বুড়ো পুঁজিবাদ। মুমূর্ষু পুঁজিবাদ। এটা পুরনো হয়ে গেছে, নতুন দুনিয়াকে তার জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে। নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে তা নানা ধরনের যুদ্ধের জন্ম দেয়।
মাকি©ন সাম্রাজ্যবাদ
মাকি©ন সাম্রাজ্যবাদ হলো বিশ্বব্যাপী মাকি©ন আধিপত্য, ভূরাজনৈতিক উচ্চকাঙ্খার বাস্তবায়ন, রাজ্য বিস্তারের লক্ষে দেশে দেশে সামরিক আগ্রাসন, প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন, মানবতাধ্বংস, মানবাধিকার লংঘন ইত্যাদী সামগ্রিক তৎপরতাকে চালানোকে বুঝায়। আমেরিকান আদি অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের নিমূ©লের মাধ্যমে মাকি©নীরা নিজের দেশে সাম্রাজ্যবাদ শুরু করেছিল বত©মানে সারা পৃথিবীতে দেশে দেশে সামরিক আগ্রাসন, গণহত্যা আর মানবতাধ্বংসের মাধ্যমে তার বিশ্বজনীন চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছেন মাত্র। শুধু একটি নমুনা পেশ করলে বিষয়টি আরো পরিস্কার হবে। তা হলো মার্কিন সামরিক ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ব্লামের গবেষণার একটি উদাহারণ এতে বুঝা যাবে মাকি©ন সাম্রাজ্যবাদের আসল চেহারা। তিনি তার গবেষনায় বলেন যে , ভূমিদখলের জন্য বিংশ শতাব্দীতে কেবল লাতিন আমেরিকাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় শতাধিক ছোটো-বড়ো ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক যুদ্ধ পরিচালিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র

নানা দিক দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র এক অতি ব্যতিক্রমী ধরনের দেশ। এটাই হয়ত বিশ্বের একমাত্র দেশ যা একটা সাম্রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জর্জ ওয়াশিংটনের ভাষায় ওটা ছিল শিশু সাম্রাজ্য এবং সেই সাম্রাজ্যের জনকদের বিশাল বিশাল আশা-আকাঙ্ৰা ছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে উদারপন্থী টমাস জেফারসন ভেবেছিলেন যে, এই শিশু সাম্রাজ্যের ছড়িয়ে পড়ে এমন এক 'নীড়ে' পরিণত হওয়া উচিত যেখান থেকে গোটা মহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করা যাবে। এতে লালদের অর্থাৎ ইন্ডিয়ানদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে কারণ তাদের তাড়িয়ে দেয়া বা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। কৃষ্ণাঙ্গদের যখন আর কোন প্রয়োজন শ্বেতাঙ্গদের হবে না তখন তাদের আফ্রিকায় ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হবে এবং লাতিনরা উন্নততর জাতের কাছে পরাজিত হবে।(নোয়াম চমস্কি)

মাকি©ন সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্নরুপ
মাকি©ন সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন রুপ রয়েছে।যা তার ঘৃনিত বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তোলে।প্রখ্যাত লেখক আজফার হোসেন তার ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামপ্রতিক ব্যাকরণ’ প্রবন্ধে এ সম্পকে© বিস্তারিত বণ©না করেছেন। ২০০৩ সালে এক বিশাল যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে ফিলিস্তিনি তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক সংগঠক জুবায়ের বিন তালেব সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন বিশেষণের একটা ফর্দ পেশ করেন এভাবে : ‘নতুন সাম্রাজ্যবাদ,’ ‘নয়া সাম্রাজ্যবাদ,’ ‘নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ,’ ‘সামরিক সাম্রাজ্যবাদ,’ ‘কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ,’ ‘অগ্রসর সাম্রাজ্যবাদ’ এবং এমনকি ‘অতিপ্রাকৃত সাম্রাজ্যবাদ।’
এও বলা দরকার যে, ১১ই সেপ্টেম্বরের আগে একদল ‘উত্তর-বাদী’ (পোস্ট-অল্) তাত্ত্বিক, অর্থাৎ উত্তর-কাঠামোবাদী ও উত্তর-আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিক, সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী চেহারাকে প্রচ্ছন্ন করার উদ্দেশ্যেই ‘উত্তর-সাম্রাজ্যবাদ’ বা ইংরেজিতে ‘পোস্ট-ইম্পিরিয়ালিজম’ বর্গটি চালু রেখেছিলেন। কিন্তু, না, শেষ পর্যন্ত ওই বর্গটি ধোপে টেকে নি, কেননা সামপ্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নিজেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে দ্বিধাবোধ করছে না মোটেই। মার্কিন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক জন্ বেলামি ফস্টারের মতে ‘নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ’-এর ধারণাটিই এখন সবচাইতে যুৎসই ধারণা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে অনেকের কাছে। এ-বিষয়টি তলিয়ে দেখা বর্তমান রচনার একটি উদ্দেশ্য, যদিও একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু তার আগে জুবায়ের বিন তালেবের ওই ফর্দের তাৎপর্য নিয়ে কিছু বলা দরকার।
সাম্রাজ্যবাদকে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষিত করার ব্যাপারটি একাধিক ইঙ্গিতকেই সামনে আনে। প্রথমত, সাম্রাজ্যবাদের যুগ শেষ হয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, বরঞ্চ সাম্রাজ্যবাদ আরো আগ্রাসী হয়ে তার উপস্থিতি সরবে ঘোষণা করছে এমনভাবে যে, খোদ মার্কিনীদের মধ্যেই যারা একসময় সাম্রাজ্যবাদকে সেকেলে রেটোরিক বলে উড়িয়ে দিত, এমনকি তারাও সাম্রাজ্যবাদকে ওই সাম্রাজ্যবাদ নামেই ডাকতে বাধ্য হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ওই ফর্দ আরো নির্দেশ করে যে, সাম্রাজ্যবাদের চেহারা একটি নয়, একাধিক। অথবা বলা যায়, সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন বেশে বিভিন্নভাবেই উপস্থিত হওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে। বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন কায়দায় বিভিন্ন ধরনের অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক তৈরী করে তাকে বিভিন্ন পরিসরে বিকীরিত করে চলেছে আজকের সাম্রাজ্যবাদ। এই সাম্রাজ্যবাদ একই সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক, মতাদর্শিক এবং পরিবেশগতও। সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন কিন্তু পরষ্পর-সম্পর্কিত চেহারা ও চরিত্র নিয়ে আলোচনা করাও বর্তমান রচনার একটি উদ্দেশ্য।
সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন বেশে ও চেহারায় বিভিন্ন পরিসরে বা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় উপস্থিত, প্রভাবশালী ও আগ্রাসী হওয়ার অভূতপূর্ব মতা অর্জন করলেও সাম্রাজ্যবাদ নির্দিষ্ট নামে এবং নির্দিষ্ট জাতীয় পতাকা নিয়েই উপস্থিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, ইরাকে ও আফগানিস্তানে তো বটেই। এই সাম্রাজ্যবাদের নাম মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই, কেননা কোথাও নিজের পতাকা লুকিয়ে ফেলার এখন কোনো ইচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই। শুধু নিজের দেশের সুপারমার্কেটগুলোতে বিভিন্ন পণ্যের গায়েগায়েই যে মার্কিন পতাকা লেপ্টে থাকে তা নয়, এখন সারাপৃথিবীতেই তৈরী-করা তার প্রায় ৭০০টি সামরিক ঘাঁটিতে পতপত করে উড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা। ইউরোপসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় তৈরী-করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রায় ৭০০টি সামরিক ঘাঁটি কোনো অদৃশ্য, বায়বীয়, ভূতুড়ে জায়গা নয় মোটেই। সারা পৃথিবীকে একলা শাসন করবে বলেই এই ঘাঁটিগুলো তৈরী করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে বিষয়টি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক অভূতপূর্ব সামরিকায়নকেই নির্দেশ করে বটে। এ-অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদ এমনকি ঈশ্বরের মতো সব©ময় ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইলেও চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে সে বিভিন্ন ক্ষেত্রেরই দৃশ্যমান। শুধু দৃশ্যমানই নয়, সে কেন্দ্রীয় অবস্থানেই দৃশ্যমান বটে।
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণের চলমান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনগুলো থেকে উঠে-আসা যুক্তি ও তত্ত্বগুলো সরাসরিই বলে দেয় যে, আমরা এখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামপ্রতিকতম স্তরেই বাস করছি। বছর কয়েক আগে ক্যারিবীয় অঞ্চলে-বিশেষ করে গ্রানাডায়-একাধিক যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে গ্রানাডার বিপ্লবী মরিস বিশপের ওই কথাটা নিঃশ্বাসের মতো অনিবার্য হয়ে বারবারই উচ্চারিত হয়েছে : ‘আমাদের সময়ের প্রধান ও প্রাথমিক সমস্যা হলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।’ দুটো বিকল্প বৈশ্বিক মিডিয়া-‘ইন্ডি-মিডিয়া’ ও ‘জি-নেট’-গত কয়েক বছরে ইরাকের প্রায় শতাধিক ছোটো-বড়ো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন ও তৎপরতার খবর আমাদেরকে দিয়েছে। ওইসব তৎপরতা বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চিনে নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদকে-যে-সাম্রাজ্যবাদের নাম মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।
সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘থিংক-ট্যাংকে’র আলোচনা এবং এমনকি কিছু সরকারি পলিসি-সংক্রান্ত আলোচনা সাম্রাজ্যবাদ কথাটাকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেরই ব্যবহার করেছে নির্দ্বিধায়। অর্থাৎ ৱায়ুযুদ্ধ চলাকালীন পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ছদ্মবেশে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবেই হাজির থেকেছে, সেখানে আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পরিত্যাগ করেছে তার সকল ছদ্মবেশ, এমনকি খুলে ফেলেছে তার সমস্ত বসন। জন বেলামি ফস্টার একেই বলেছেন ‘নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ।’ তিনি তাঁর সমপ্রতি প্রকাশিত গ্রন্থ নেকেড ইম্পিরিয়ালিজম-এ অসংখ্য প্রমাণ হাজির করেছেন ওই নগ্ন সাম্রাজ্যবাদের ধারণাকে পরিষ্কার করার জন্যই।
জন বেলামি ফস্টারের নেকেড ইম্পিরিয়ালিজম প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক মহলে তা বেশ সাড়া জাগায়। শুধু তাই নয়, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে বইটি। বইটির মূল বক্তব্য সংক্ষেপে এভাবে পেশ করা যায় : যদিও ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক তৎপরতা অনেকের কাছে ‘নতুন সামরিকবাদ’ ও ‘নতুন সাম্রাজ্যবাদ’-এর আকারে হাজির হয়েছে, আসলে সামরিকবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মোটেই নতুন কোনো বিষয় নয়, কেননা তার জন্মলগ্ন থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেই তার আধিপত্য বৈশ্বিক পরিসরে বিস্তৃত করতে চেয়েছে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সাম্রাজ্যবাদী আকাঙা ঊনিশ শতকে সাংস্কৃতিক বৈধতাও লাভ করে এমনি এক মাত্রায় যে, গণতান্ত্রিক, মহৎ, মানবতাবাদী কবি ব’লে বিশ্বখ্যাত ওয়ল্ট্ হুইটম্যানও তাঁর কিছু কিছু কবিতায় সে আকাঙা সরাসরি প্রকাশ করেন।) কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সামরিকবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ নতুন কোনো বিষয় না হলেও তাদের ইতিহাস কি কেবল স্থিরই থেকেছে? উত্তরে ফস্টার ‘না’ বলেছেন অবশ্যই। তবে, ফস্টারের মতে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চেহারায় যে পরিবর্তন লক্ষণীয়, তা হচ্ছে তার নগ্ন বর্বরতা বা বর্বর নগ্নতার অভূতপূর্ব প্রকাশ, যে-নগ্নতার প্রমাণ বাস্তব পৃথিবীতে তো বটেই, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘অফিসিয়াল রেটোরিক’-এ পাওয়া যায়। এখানে কয়েকটি প্রমাণ হাজির করা যাক।
২০০০ সাল। তখন রিচার্ড হাস্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের একজন প্রভাবশালী সদস্য। শুধু তাই নয়, প্রথম বুশের একজন বিশেষ সহকারীও সে, যাকে পরবর্তী সময়ে নব্য-নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রতি জর্জ ডাব্লিউ বুশের স্বরাষ্ট্র বিভাগের নীতি প্রণয়ন ও পরিকল্পনার পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই রিচার্ড হাস্ ২০০০ সালের ১১ই নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘পলিসি-পেপার’ পেশ করেন, যার শিরোনাম ‘ইম্পিরিয়াল আমেরিকা’। শিরোনাম নিজেই তাৎপর্যপূর্ণ বটে। নীতিমালা প্রণয়ন-সংক্রান্ত ওই রচনায় পরিষ্কারভাবে বলা হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ‘সনাতন জাতি-রাষ্ট্রের ভূমিকা পালনের পরিবর্তে সরাসরি সাম্রাজ্যের শক্তির চেহারা নিয়ে উপস্থিত হতে হবে, (নেকেড ইমপিরিয়ালিজম, পৃ ১৭)। ফস্টার নিজেই ওই রচনাকে এভাবে উদ্ধৃত করেন :
সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্র নীতির জন্য প্রয়োজন এমন এক নীতি যা কতোগুলো বিশেষ কৌশলে পৃথিবীর পুনর্বিন্যাসে সহায়তা করবে...এক্ষেত্রের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর গ্রেট ব্রিটেনের মতোই। (পৃ ১৭) ঊনবিংশ শতাব্দীর গ্রেট ব্রিটেনের মতো? হ্যাঁ, জোরেশোরেই সেই তুলনাটাকে সামনে এনেছেন রিচার্ড হাস্। দরকার হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিরে যাবে ধ্রুপদী উপনিবেশবাদের যুগেই; দরকার হলে সে জোর করেই দখল ও শাসন করবে অন্যের ভূমি। না, এখানে ছদ্মবেশ ধারণ করার কোনো অবকাশ নেই। হাসের বক্তব্য অনুসারে সাম্রাজ্যের কৌশল প্রয়োগই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখন অনিবার্য মিশন। আমরা তো জানিই যে, ১১টি ভার্জিন আইল্যান্ডসহ পুর্তোরিকো এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি উপনিবেশ। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক ও আফগানিস্তান দখল এবং সে-সব অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি শারীরিক উপস্থিতি হার্ট-ও-নেগ্রি-কথিত অবয়বহীন ভূতুড়ে সাম্রাজ্যের উত্তর-আধুনিকতাবাদী ধারণাকে নিমেষেই অকেজো প্রমাণ করে এবং এমনকি যাকে মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ও ভূগোলবিদ ডেভিড হারভি তাঁর সমপ্রতি প্রকাশিত দ্য নিউ ইম্পিরিয়ালিজম গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদের ‘টেরিটোরিয়াল লজিক’ বলেছেন, তারই প্রাসঙ্গিকতাকে প্রমাণ করে।
ডেভিড হারভি’র দ্য নিউ ইম্পিরিয়ালিজম দু’টো পরস্পর-সম্পর্কিত সাম্রাজ্যবাদী ‘লজিক’-এর ধারণাকে সামনে আনে : একটি হচ্ছে ক্ষমতার পুঁজিবাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ‘লজিক’ এবং অপরটি মতার ‘টেরিটোরিয়াল’ বা ভূগোল-ও-ভূমি-সংক্রান্ত লজিক। পরের লজিকের মোদ্দা কথাটা হচ্ছে এই : আজকের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কেবল অনানুষ্ঠানিক ও পুরো অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শাসনকে বা আধিপত্যকেই নির্দেশ করে না; পুঁজিবাদের বিকাশের ও পুঁজির সংবর্ধনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তাগিদেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে সরাসরি ভূমিদখল, ভূমিদস্যুতা বা ভূমিলুণ্ঠন, যে-কাজটি করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এসেছে নিদেনপ সেই ঊনিশ শতক থেকেই। আজ সেই ভূমিদখল বা ভূমিলুণ্ঠন পেয়েছে আরো তীব্রতা। আসলে শুধু ধ্রুপদী উপনিবেশবাদের ক্ষেত্রেরই নয়, আজকের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চেহারা ও চরিত্র বোঝার জন্যই ভূমি-প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে হাজির হয়।
‘ভূমিতেই সাম্রাজ্যবাদ সবচাইতে দৃশ্যমান ও নগ্ন হয়’-কথাটা একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো। ভূমি যে সাম্রাজ্যবাদের জন্য-বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য-ঐতিহাসিকভাবে কতটা জরুরী হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে ক্যাস্ত্রোর একটি চমৎকার আলোচনা আছে তার সামপ্রতিক গ্রন্থ ওয়ার, রেইসিজম্ এ্যান্ড একোনমিক ইনজাস্টিস-এ। সেখানে ক্যাস্ত্রো আমাদের জানাচ্ছেন যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস এবং তার ভূমিদখলের ও ভূমিদস্যুতার ইতিহাস কেবল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালেই সীমাবদ্ধ নয়। ক্যাস্ত্রোর মতে সেই ইতিহাসের জন্য আমাদেরকে যেতে হবে ঊনিশ শতকেই। তিনি তিনটি গরুত্বপূর্ণ সনের ওপর জোর দেন। এগুলো হচ্ছে ১৮২৩, ১৮৪৮ এবং ১৮৯৮। হ্যাঁ, ১৮২৩ সালে সরবে ঘোষিত হয় ‘মনরো ডকট্রিন।’ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতির নামাঙ্কিত এই মতবাদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূমিদস্যুতার একটি মতাদর্শিক ভিত্তি তৈরি করার তাগিদেই প্রচার করে যে, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই লাতিন আমেরিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেফাজতে রাখা জরুরী। রাষ্ট্রপতি মনরো নিজেই একটি রূপক চালু করেন : ‘লাতিন আমেরিকা হচ্ছে আমাদের বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগের উঠোন।’ কিন্তু মতবাদ ও রূপকের চেয়ে আরো সত্য ও বাস্তব হয়ে থাকে ইতিহাসে মূর্ত-হয়ে-ওঠা ঘটনা। ১৮৪৮ সালে মেঙিকোর অর্ধেকেরও বেশি ভূমি ছিনিয়ে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভৌগোলিক সীমানা সমপ্রসারিত করে। এভাবে নিজের দেশেই পরবাসী হয়ে ওঠেন অসংখ্য মেঙিকান। এরপর ১৮৯৮ সালে উঠতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূমিদখলের ও ভূমিদস্যুতার চেহারা আরো নগ্ন হয় : কিউবা, পুর্তো-রিকো, গুয়াম, হাওয়াই এবং ফিলিপাইনস্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি উপনিবেশে রূপান্তরিত হয়। মার্কিন সামরিক ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ব্লামের গবেষণা-মোতাবেক ভূমিদখলের জন্য বিংশ শতাব্দীতে কেবল লাতিন আমেরিকাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় শতাধিক ছোটো-বড়ো ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক যুদ্ধ পরিচালিত হয়।
এই ইতিহাস থেকে আজকের নগ্ন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অপতৎপরতাকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না মোটেই। এমনকি মার্কিন সরকারের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীসহ সরকার-প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত পত্রিকাগুলো ওই ইতিহাসকেই স্মরণে রেখে আজকের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সরাসরি মতাদর্শিক বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছে ইতিমধ্যেই। ফস্টার নিজেই নগ্ন সাম্রাজ্যবাদের ধারণাকে পরিষ্কার করার জন্য উদাহরণ জড়ো করেছেন একের পর এক। যেমন ধরা যাক, ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশানস’-এর কথা এবং তার সিনিয়র ফেলো ম্যাকস্ বুটের একটি রচনার কথা। ২০০৩ সালে ৬ই মে ইউ.এস.এ টুডে নামের একটি প্রধান পত্রিকায় ম্যাকস্ বুট-এর যে প্রবন্ধটি ছাপা হয়, তার শিরোনামই চট করে বলে দেয় ওই প্রবন্ধের মূল কথাটাই। শিরোনামটি হচ্ছে ‘আমেরিক্যান ইম্পিরিয়ালিজম? : নো নীড টু রান ফ্রম দি লেবেল।’ ম্যাকস্ বুটের মতে সাম্রাজ্যবাদকে গালি হিসেবে বিবেচনা না ক’রে বরঞ্চ ঐতিহাসিকভাবে কার্যকর তাবৎ সাম্রাজ্যবাদী কলাকৌশল ও অনুশীলনকে যথাযথভাবে ব্যবহার করাই হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাজ। ওই ২০০৩ সালেই এ্যান্ড্রু বেইস্ভিচের সম্পাদনায় বের হয় একটি প্রবন্ধ-সংকলন, যার শিরোনাম দ্যা ইম্পিরিয়াল টেনস্। সেখানে দীপক লাল নামের আরেক ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীর একটি প্রবন্ধ আছে। ওই প্রবন্ধটির শিরোনামই বলে দেয় লালের বক্তব্যটা কি। শিরোনামটি হচ্ছে ‘ইন ডিফেন্স অব এম্পায়ারস্।’ সেখানে লাল বলছেন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ হবে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন ব্যবস্থা তৈরী করা। অনেকেই দোষারোপ করে বলেন যে, স্থিতাবস্থার এ-ধরনের পুনর্বিন্যাস সাম্রাজ্যবাদের কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে, যা মধ্যপ্রাচ্যের তেল নিয়ন্ত্রণের আকাঙাকেই নির্দেশ করবে। কিন্তু আপত্তিকর হওয়া তো দূরের কথা, সাম্রাজ্যবাদই এখন জরুরী, ওই মধ্যপ্রাচ্যে একটি ব্যবস্থা নির্মাণের স্বার্থেই (নেকেড ইম্পিরিয়ালিজম-এ উদ্ধৃত, পৃ ৭) লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই যেখানে উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা বড়ো জোর আভাসে-ইঙ্গিতে ইনিয়ে-বিনিয়ে সাম্রাজ্যবাদের কথা বলেন, বা যেখানে তাঁরা সাম্রাজ্যবাদ শব্দটিই উচ্চারণ করতে নারাজ, সেখানে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের আলোচনায় বা সরকারী আলোচনায় ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বর্গটি কেবল স্পষ্টোচ্চারণেরই বিষয় থাকছে না, বরঞ্চ তা লাভ করেছে এক অভূতপূর্ব মতাদর্শিক বৈধতা। আবারও ওই ২০০৩ সালের ৫ জানুয়ারী নিউ ইয়র্ক টাইমস্ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেই মুদ্রিত হয়েছে এই পঙ্ক্তিটি-‘আমেরিকান এম্পায়ার : গেট ইউজড্ টু ইট।’ অর্থাৎ পত্রিকাটি ডাক দিচ্ছে আমাদেরকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য। আমাদের প্রাত্যহিক অনুশীলনে বা আমাদের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায়, অনুষঙ্গে, অনুপুঙে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ লাভ করুক প্রশ্নাতীত স্বাভাবিকতা, এই লক্ষেও তো কাজ করে চলেছে মার্কিন রাষ্ট্রসহ তার মতাদর্শিক ও দমনমূলক সব ‘এ্যাপারেটাস্’, বিশেষ ক’রে তার সামরিক বাহিনী, মিডিয়া ও ভাড়াটে বা তাঁবেদার বুদ্ধিজীবীদের দল, যাদের আবার জাতীয় সংস্করণ পাওয়া যাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায়। বাংলাদেশেও আছে ওইসব বুদ্ধিজীবী যাদের কিছুদিন আগেই দেখা গিয়েছে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিসের বিদায়ী সম্বর্ধনায়। এটা বলাই যথেষ্ট নয়। আসলে গত ছত্রিশ বছরে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেই সংস্কৃতিই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সত্যিকার অর্থে শুধু প্রশ্নাতীত করেই রাখে নি, বরঞ্চ তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লেনদেনের প্রায়-নিরবচ্ছিন্ন ইতিহাস তৈরী করে রেখেছে।

নতুনধারার বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা
মাকি©ন সাম্রাজ্যবাদের প্রধান লক্ষ্য তাদের নেতৃত্বে একটি নতুনধারার বিশ্ব প্রতিষ্ঠা। যেখানে তাদের নিরংকুশ আধিপত্য বজায় থাকবে। সাবেক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মাকি©ন যুক্তরাষ্ট্র এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার রুপ রেখা তৈরি করেছে। ১৯৯১ সালে মাকি©ন সরকার সব©প্রথম ‘নিউ ওয়াল্ড© ওয়াডার©’ নামে এর পরিকল্পনা পেশ করে, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ‘গ্লোবালাইজেশন’ পরিভাষা সবত্র© প্রসার লাভ করে। যার একমাত্র উদ্দেশ্য তৃতীয় বিশ্বকে মাকি©নী রঙে রঙিন করা। মূলত কমিউনিজমের পতনের পর বত©মানে মাকি©ন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ হচ্ছে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ। তাই পাশ্চাত্য শক্তি নতুন বিশ্বব্যবস্থার পরিকল্পনায় ইসলামকে নিমূ©লের উদ্যোগই গ্রহন করেছে। এ নতুন বিশ্বব্যবস্থার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, যে কোন মূল্যে মাকি©ন যুক্তরাষ্ট্রকে একুশ শতকের একক পরাশক্তি হিসাবে টিকিয়ে রাখা এবং তার বিকল্প যে কোন শক্তির উত্থান প্রতিহত করা। সে উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে এ নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার চারটি মূল স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো-
১. বিশ্বায়ন ঃ বিশ্বায়নের অথ©ই হলো, গোটা বিশ্বে এমন একটি অথ©ব্যবস্থা প্রবত©ন করা, যেখানে স্বাধীন বাণিজ্য, পুঁজির অবাধ প্রবাহ এবংবহুজাতিক কোম্পানী গুলোর মাধ্যমে আন্ত©জাতিক অথ©নীতির ওপর পশ্চিমা জাতিসমূহের বিশেষ করে মাকি©ন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে স্থায়ীভাবে রুপ দেওয়া। এ ব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য বিভিন্নভাবে পুরো বিশ্বের সকল বিষয়ের ওপর পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা, যার প্রথম ভাগে থাকবে আমেরিকা।
২. ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার সংরক্ষণ, ও ধমীয় উদারতার বিকাশ ঃ-
ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার সংরক্ষণ ও ধমী©য় উদারতার বিকাশ ইত্যাদী মুখরোচক এবং আপাত মধুর স্লোগানের অন্তরালে বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে পশ্চিমা জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং বিভিন্ন দেশের ওপর রাজনীতি, অথ©নীতি, মিডিয়া এবং প্রযুক্তির সরু পথ ধরে সহজেই বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও সভ্যতার প্রধান্য বিস্তার করা সম্ভব করে তোলা।
৩. টেকনোলজি ঃ-টেকনোলজি তথা তথ্য প্রযুক্তির ওপর বিশেষ করে নিউক্লিয়ার ও হাইটেক টেকনোলজির ওপর পশ্চিমা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। মাকি©ন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ হলো, চ্যালেঞ্জের উধ্বে© আমেরিকার ভবিষ্যত সামরিক শক্তিকে সুদৃঢ় সুসংহত করা এবং তার বিরুদ্ধে যে কোন বিপদ বিপয©য় নিমূ©ল করা, চাই তা লৌহ প্রাচীরের মতোই হোক না কেন।
৪. নুতন নতুন রাজনৈতিক গাঁটছড়া ঃ-
মাকি©ন যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সচেতনতার সাথে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন নতুন রাজনৈতিক খেল খেলছে।যেমন-ন্যাটোর সম্প্রসারণ, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাঈলের সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পর তা এখন অথ©নৈতিক বিজয়ের জন্য আরব বিশ্বের সাথে সমঝোতা করার প্রচেষ্ঠা, মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে পাশ্ব©বতী রুশ ও পশ্চিমাপন্থী দেশগুলোকে উসকে দেয়া এবং ভারতকে এশিয়ার সুপার পাওয়ার হিসাবে সামনে অগ্রসর করার প্রচেষ্ঠা, যাতে এশিয়ার ইসলামী দেশগুলো এবং সেখানকার সক্রিয় ইসলামী সংগঠনগুলোকে নিমূ©ল করার পরিকল্পনা সহজেই বাস্তবায়ন করা যায়।

পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ
পুঁজিবাদ তার বিকাশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদের রূপ পরিগ্রহ করে। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পৌঁছেছে তার বয়স এক শতাব্দকাল পেরিয়ে গেছে। একই সাথে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার যুগে পুঁজিবাদের সকল প্রগতিশীল ভূমিকাও তিরোহিত হয়েছে। সামন্তবাদ উচ্ছেদের পর্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিকতার ধারণা এনে পুঁজিবাদ অগ্রগতির যে পথ দেখিয়েছিল মানব সমাজকে বলাই বাহুল্য পুঁজিবাদের সেই ভূমিকা আর নেই। তা শুধু যে ভূমিদাসত্ব থেকে মানুষকে মুক্ত করে শ্রমদাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধেছে তা-ই নয়; এখন গোটা মানব সমাজ, বিশ্ব-প্রকৃতি-জলবায়ু সহ প্রাণের অস্তিত্বের প্রতিই তা ভয়াবহ হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ, তথা সাম্রাজ্যবাদের প্রধান লক্ষ্য হলো পুঁজির বিকাশের অপ্রতিহত চাহিদাকে পরিপুষ্ট রাখা - এক কথায় পুঁজির স্বার্থের দেখভাল করা। একই সাথে গোয়েন্দা সংস্থা, আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান, সামরিক বাহিনী, এনজিও, সুশীল সমাজ - এ সমস্ত কিছুই সৃষ্টি করা হয়েছে পুঁজিবাদের এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে। পুঁজির প্রবাহ যতোক্ষণ অবাধ থাকে, তার বিকাশের পথে কোনো প্রতিবন্ধক এসে দাঁড়ায় না, ততোক্ষণ সাম্রাজ্যবাদ ভদ্রতার মুখোশ পরিধান করে থাকে। কিন্তু যখনই তার গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয় কোনো কারণে তখনই সে তার প্রকৃত চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়। আর এই আবির্ভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা দেয় দেশে দেশে যুদ্ধ, সামরিক আগ্রাসন, হত্যা, নিপীড়ন সহ আরো বহু কদর্য বিষয়।
সাম্রাজ্যবাদ তার উদ্দেশ্যকে সফল রাখার জন্য কাজ করে কয়েকটা স্তরে। প্রথম পর্যায়ে তারা তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ তথা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রভৃতি সংস্থা, তাদের বশংবদ এনজিও, সুশীল সমাজ, মিডিয়া প্রভৃতির দ্বারা অনুন্নত দেশসমূহের দালাল শাসক গোষ্ঠীকে নিজেদের শৃঙ্খলে বেঁধে রেখে স্বার্থ হাসিল করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অস্ত্র চুক্তি, ঋণ চুক্তি, পারস্পরিক সহযোগিতামূলক কিংবা অবকাঠামো উন্নয়ন চুক্তি, যৌথ সামরিক মহড়া প্রভৃতি এই স্তরে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতার উল্লেখযোগ্য স্মারক। এ পর্যায়ে ব্যর্থ হলে প্ল্যান-বি বাস্তবায়নে বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে তাদের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন, যারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় চালায় বিভিন্ন ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা। এই তৎপরতার বহিঃপ্রকাশ রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে হত্যা, গুম এমনকি অপহরণের পর্যায়ে পর্যন্ত পৌঁছায়। বিশ্বে এর উদাহরণ বিরল নয়, বিশেষত গত শতকের দক্ষিণ আমেরিকায়।
তৃতীয়, অর্থাৎ সর্বশেষ পর্যায়ে তারা আশ্রয় নেয় দেশে দেশে সামরিক আগ্রাসনের। এসবই তারা করে গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদির নামে। এ কাজে বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র হিসেবে নেতৃত্বে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিগত শতাব্দে এ ধরনের কার্যকলাপ আমরা দেখেছি ইন্দোচীন অঞ্চলের দেশগুলোতে, বর্তমান জমানায় যা সম্প্রসারিত হয়েছে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে; আফগানিস্তানকে দিয়ে যার সূচনা। এরপর একে একে এসেছে ইরাক, লিবিয়া, পাকিস্তান এই রাষ্ট্রগুলো। আর অনির্দিষ্টকালীন যুদ্ধ পরিস্থিতির দেশ হিসেবে ফিলিস্তিন ও লেবানন তো রয়েছেই। এছাড়া ইরান বহুদিন ধরেই সাম্রাজ্যবাদীদের টার্গেটের মধ্যে রয়েছে। এবার তাদের আগ্রাসী পরিকল্পনার তালিকায় এসেছে সিরিয়া।
অনেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদও বলেছেন। এ সম্পকে© প্রখ্যাত লেখক আজফার হোসেন তার ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামপ্রতিক ব্যাকরণ’ প্রবন্ধে এ সম্পকে© বিস্তরিত বণ©না করেছেন।এখানে স্পষ্ট ক’রেই বলা দরকার যে, লেনিন-যিনি নিঃসন্দেহে সাম্রাজ্যবাদের একজন প্রধান ও প্রাসঙ্গিক তাত্ত্বিক-কাউটস্কির সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে বিতর্ক করতে গিয়ে কাউটস্কির যুক্তিকে খণ্ডন করেছেন এই বলে যে, সাম্রাজ্যবাদ কোনো পলিসির বিষয় নয়; সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদী বিকাশের যৌক্তিক পরিণতি। অর্থাৎ, লেনিনের মতে, আমরা সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ উদঘাটনে ব্যর্থ হবো যদি তার সঙ্গে পুঁজিবাদের সম্পর্ককে না-বুঝি। লেনিন তাঁর ইম্পিরিয়ালিজম : দ্য হাইয়েস্ট স্টেইজ অব ক্যাপিটালিজম পুস্তিকায় ওই সম্পর্কের তত্ত্বকে হাজির করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদকে সংজ্ঞায়িত করেন এভাবে : ‘সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদের একচেটিয়া স্তর’ (পৃ ৮৮)। লেনিন এও বলেন, ‘পুঁজিবাদের বিকাশের একটি নির্দিষ্ট, খুবই উঁচু স্তরে পুঁজিবাদ রূপান্তরিত হয় পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদে।’ (পৃ ৮৮)
সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে লেনিনীয় তত্ত্বের বিচার-বিশ্লেষণ ও সেই তত্ত্ব ঘিরে বিভিন্ন ধরনের তর্ক-বিতর্ক এখনও চলছে, যেমন চলেছে আগেও। তবে এখানে লেনিনকে আনার কারণ হচ্ছে মূলত এটাই বোঝানো যে, পুঁজিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া বর্তমান সময়ের নগ্ন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে পুরোটা বোঝা মোটেই সম্ভব নয়।
এখানে এটাও বলা দরকার যে, সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজির বিচিত্রমাত্রিক বহিরঙ্গ এবং আগ্রাসনের মুখে পুঁজিবাদকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়েছে : ‘বহুজাতিক ফিন্যান্স পুঁজিবাদ,’ ‘নব্য-পুঁজিবাদ,’ ‘অগ্রসর বা ‘লেইট’ পুজিবাদ,’ ‘উত্তরফোর্ডবাদী পুঁজিবাদ,’ ‘উত্তরআধুনিকতাবাদী পুঁজিবাদ,’ ‘ইলেক্ট্রো পুঁজিবাদ,’ এমনকি ‘হাইড্রোকার্বন পুঁজিবাদ’ ইত্যাদি। নামের এই ছড়াছড়ি মাঝে মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলেও লেনিনের ওই কথাটা ফিরে আসে : ‘পুঁজি তার শক্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশ করে।’ (দ্য স্টেট এ্যান্ড রেভ্যুলিউশন, পৃ ২২০)। লেনিনের আগে মার্কস নিজেই তাঁর গ্রুনড্রিস-এ বলেছেন ‘বহুরূপী পুঁজি’-এর কথা। এছাড়া পুঁজির ‘নমনীয়তা’ বা ‘ফেকসিবিলিটি’ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন বিশ শতকের একঝাঁক রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ- বেলজিয়ান তাত্ত্বিক আর্নেস্ট ম্যান্ডেল (যিনি তাঁর গ্রন্থ লেট ক্যাপিটালিজম-এর জন্য বিখ্যাত), ইতালীয়-মার্কিন তাত্ত্বিক জিয়োভানি আরিঘি, মিশরীয় তাত্ত্বিক সমির আমিন এবং ইংরেজ তাত্ত্বিক ডেভিড হারভি (যিনি তাঁর ‘পুঁজির নমনীয় সংবর্ধন’-এর তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত)।
বিষয়গত, শৈলীগত ও পদ্ধতিগত ভিন্নতা সত্ত্বেও এঁদের কাজ এক সঙ্গে জড়ো করলে কতোগুলো সাধারণ বিষয় চোখে পড়ে। প্রথমত, পুঁজির ইতিহাসে পুঁজি নিজেই বিভিন্ন চেহারা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। অর্থাৎ পুঁজির নিজস্ব ইতিহাস থেমে থাকে নি মোটেই। দ্বিতীয়ত, পুঁজির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার নমনীয়তা (কেউ কেউ পুঁজির ‘অসীম নমনীয়তা’র কথাও বলেছেন)। তৃতীয়ত, তবে ‘নমনীয়তা’ মোটেই শেষ কথা নয়; পুঁজি নমনীয় হয় একচেটিয়া হয়ে ওঠার লক্ষেই। হ্যাঁ, চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে পুঁজি সবসময়ই একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারে আগ্রহী। আমাদের সময়ে পুঁজিকে যে-নামেই ডাকা হোক না কেন, তার একচেটিয়া হয়ে-ওঠার প্রবণতাকে অস্বীকার করা যাবে না মোটেই। বরঞ্চ জোর দিয়েই এ-কথা বলা দরকার যে, আমরা একচেটিয়া পুঁজিবাদের সাম্প্রতিকতম স্তরে বাস করছি। আর ওই একচেটিয়া পুঁজিবাদের সাম্প্রতিকতম স্তরের নাম নগ্ন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। হ্যাঁ, লেনিন বলেছিলেন ‘পুঁজিবাদের একচেটিয়া স্তর’-এর কথা; আর আমরা লেনিনকে খানিকটা সমপ্রসারিত করেই বলতে পারি ‘একচেটিয়া পুঁজিবাদের সাম্প্রতিকতম স্তর’-এর কথা। এর আরেক নাম আজকের ‘গোলকায়ন’ (যদিও গোলকায়নের ইতিহাস পুঁজিবাদের ইতিহাসের মতোই দীর্ঘ)। এ-বিষয়গুলোকে উদাহরণ সহযোগে তলিয়ে দেখা যাক।
পুঁজির একচেটিয়া চরিত্র ও আচরণ কোন্ জায়গায় আছে-যে-চরিত্র যুগপৎ উৎপাদন ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে-তা বোঝার জন্য আজকের বহুজাতিক কোম্পানীগুলো কীভাবে এবং কি বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করছে তা বোঝা দরকার, যদিও কোম্পানীগুলো বর্তমান সময়ের পুঁজিবাদের তাবৎ অনুশীলনের একমাত্র ক্ষেত্র বা প্রতিনিধি নয়। বিভিন্ন পরিসরেই পুঁজি কাজ করে বা সঞ্চালিত হয় বা সংবর্ধনের পথ খুঁজে পায়। ব্যাংক, ফান্ডস্, বন্ড, সিকিউরিটি এবং জাতি-রাষ্ট্র নিজেই পুঁজির বিনিয়োগের সুযোগ বিভিন্নভাবে খোলা রাখে বা সেই বিনিয়োগের সুযোগকে সহায়তা ও ত্বরান্বিত করে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রের সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানীর সম্পর্ক যে সবসময় সহজ ও খোলামেলা থাকে তাও নয়। মাঝে মাঝে বহুজাতিক পুঁজির সঙ্গে একটি জাতি-রাষ্ট্র সংঘর্ষেও জড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু এরপরেও যদি আমরা বর্তমান সময়ে বহুজাতিক কোম্পানী বা কর্পোরেশনগুলোর কেবল বিক্রির পরিমাণ লক্ষ্য করি, তাহলে চট করেই বোঝা সম্ভব কিভাবে ওই কোম্পানী বা কর্পোরেশনগুলো তার শক্তি ও প্রভাব বজায় রেখেছে। তাহলে একটা ছোটো কিন্তু ইঙ্গিতবহ পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। বর্তমান পৃথিবীর সবচাইতে প্রভাবশালী ও ধনবান পাঁচটি বৃহত্তম কর্পোরেশনের নাম হচ্ছে জেনারেল মটরস, ওয়ালমার্ট, এঙন-মবিল, ফোর্ড এবং ডাইমলার-ক্রাইসলার। এই পাঁচটি কর্পোরেশনের সামগ্রিক বিক্রি পৃথিবীর ১৮২টি দেশের জি.ডি.পি’র চেয়েও বেশি। মার্কিন রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ রিচার্ড জে বার্নেট-এর মতে, এসব কর্পোরেশন সারা পৃথিবী চষে বেড়ায়, সস্তা শ্রম খুঁজে ফিরে, লন্ডন থেকে হংকং পর্যন্ত তাদের স্টক বিক্রি করতে থাকে এবং গজিয়ে-ওঠা বাজারগুলোর মক্কেলকে বশ করা শুরু করে। (পৃ ৩৬) বার্নেট আরো জানাচ্ছেন যে, ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর ১১ পর্যন্ত সময়ে পৃথিবীর ২০০টি কর্পোরেশনের মুনাফা শতকরা ৩৬২.৪ বৃদ্ধি পেয়েছে। আরো উল্লেখযোগ্য হলো এই যে, ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তাদের মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে আরো ব্যাপক। কেবল বিক্রি আর মুনাফার অংক কষে বর্তমান সময়ের পুঁজিবাদের মতো একটি জটিল ও অগ্রসর উৎপাদন-প্রণালীর সাম্প্রতিক একচেটিয়া চেহারা ও চরিত্রের সমগ্রকে যে ধরা সম্ভব হবে, সেটা আমরা মোটেই বোঝাচ্ছি না। তবে বিক্রি ও মুনাফা সাধারণভাবে কোম্পানী বা কর্পোরেশনগুলোর অর্থনৈতিক শক্তির গুরুত্বপূর্ণ সূচক। আসলে বড়ো আকারের মুনাফা ছাড়া কোনোভাবেই কর্পোরেশন-যাকে মার্কিন রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ পল সুইজি ও পল ব্যারান বলেছেন ‘পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানের প্রকৃষ্ট নমুনা’-তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারে না। সুতরাং মুনাফা একমাত্র বিবেচ্য বিষয় না, হলেও গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই। কিন্তু কর্পোরেশনগুলোর মুনাফাভিত্তিক অর্থনৈতিক শক্তি নির্দেশ করার পাশাপাশি আরেকটি সংলগ্ন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে শনাক্ত করা জরুরী। সেটি হলো কর্পোরেশনগুলোর হাতে বৈশ্বিক অর্থনীতির অভূতপূর্ব কেন্দ্রীভবন। বেশ আগেই ওয়ার্ল্ড ব্যাংক নিজেই তো আমাদের জানিয়ে দিয়েছে যে, পৃথিবীর ৩ থেকে ৬টি সবচাইতে বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানী বৈশ্বিক পরিসরে খাদ্য ও পানীয়, কাঁচামাল এবং খনিজ ও ধাতব পদার্থের শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ রপ্তানী নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
কিন্তু এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থানটা কোথায়? আগেই আমরা বর্তমান পৃথিবীর সবচাইতে বৃহৎ পাঁচটি কর্পোরেশনের নাম উল্লেখ করেছি। এদের মধ্যে প্রথম চারটিই হচ্ছে মার্কিন কর্পোরেশন : জেনারেল মটরস্, ওয়ালমার্ট, এঙন-মবিল এবং ফোর্ড। এছাড়া রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরো কয়েকটি কর্পোরেশন, যেগুলো শক্তিতে ও বিস্তারে নিঃসন্দেহে বিশ্বখ্যাত : মাইক্রোসফ্ট্, কোকা-কোলা এবং আই.বি.এম.। এদের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের সম্মিলিত জি.ডি.পি’র অঙ্ককেও ছাড়িয়ে যায়। এ-কারণেই কোকা-কোলার প্রাক্তন সভাপতি ডনাল্ড আর. কিয়ৌ এক সাংবাদিককে যথার্থই বলেছিলেন যে, আজকের পৃথিবীতে বহুজাতিক কোম্পানীর কথা বলা মানেই আমেরিকার একচেটিয়া আধিপত্যের কথা বলা। কথাটি তিনি অবশ্য বর্তমান সময়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে চিহ্নিত করার জন্য বলেন নি; বলেছেন তিনি তাঁর মার্কিন জাতীয়তাবাদী অহংকার ও গৌরবকে উৎসাহে ও উল্লাসে প্রকাশ করার জন্যই।
মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানীর সঙ্গে, বা বৈশ্বিক পুঁজির সাম্প্রতিক মার্কিনায়নের সঙ্গে, বর্তমান সময়ের পুঁজিবাদের একচেটিয়া স্তরের যোগাযোগকে দাতা সহকারে প্রত্যক্ষান করেছেন ফরাসী তাত্ত্বিক মিশেল বড্। ২০০০ সালে বড্ একটি সাড়া-জাগানো গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এর শিরোনাম এ হিস্ট্রি অব ক্যাপিটালিজম। গ্রন্থটিতে তিনি ১৫০০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পুঁজিবাদের ঘটনাবহুল, পর্বভিত্তিক, সম্ভাবনাময় ও সংকটাপন্ন ইতিহাসকে তত্ত্ব ও উপাত্ত সহযোগে ধরার চেষ্টা করেছেন। সেই গ্রন্থটির শেষের দিকে মিশেল বড্ বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র [বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে] প্রধান আধিপত্যবাদী চালক। কার্যত প্রতিটি ক্ষেত্রেরই সে প্রধান, কাউকেই সে কোনো কিছুর জন্য জবাব দেয় না, বা তোয়াক্কা করেনা; বরঞ্চ সবার ওপরে সে তার আইন-কানুন চাপানোর চেষ্টা করে। (পৃ ২৮৫)
বড্ আরো বলেন, ইতিহাসে আমরা প্রথমবারের জন্য লক্ষ্য করছি যে, কর্পোরেশনগুলো এখন একেবারে সেই সব মৌলিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম, যেগুলো গোটা মানবজাতিসহ জীবন ও পৃথিবীকে আক্রান্ত করে। এসব কর্পোরেশন এখন অভূতপূর্ব আর্থিক, প্রযুক্তিগত, বৈজ্ঞানিক ও শিল্পোপণ্যোৎবাদী শক্তির অধিকারী। অবশ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে বিবেচনায় রেখেই এসব কর্পোরেশন তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। (পৃ ৩১০) কিন্তু কর্পোরেশনের বা মার্কিন কর্পোরেশনের অভূতপূর্ব ক্ষমতার অর্থ এই নয় যে, পৃথিবী থেকে জাতি-রাষ্ট্রগুলো উবে যাচ্ছে। না, যাকে কর্পোরেট পুঁজিবাদ বলা হচ্ছে-যা আসলে একচেটিয়া পুঁজিবাদের আরেক নাম-তা মোটেই জাতি-রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘোষণা করে নি, যদিও একদল উত্তর-আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিকসহ কিছু অর্থনীতিবিদ ও সংস্কৃতি-তাত্ত্বিক এর মধ্যেই জাতি-রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘোষণা করেছেন। চট করেই মনে পড়ে কেনিচি ওহমায়ে’র বহুল-আলোচিত বই দ্য এন্ড অব দ্য নেশান-স্টেট-এর কথা। এই শিরোনাম নিজেই বইটির মূল প্রতিপাদ্যকে সরবে ঘোষণা করছে।
কেন্চি ওহমায়ে’র বিপরীতে অবশ্য সমির আমিন এবং ডেভিড হারভিসহ আর্জেন্টিনার মার্কসবাদী চিন্তাবিদ এনরিক ডুসেল এবং মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী সাসকিয়া সাসেন জাতি-রাষ্ট্রের পক্ষে বিভিন্ন পরিপ্রেতিক্ষে এবং পরিসরে তাঁদের যুক্তি উত্থাপন করেছেন। তাঁদের মতে কর্পোরেট পুঁজির অভূতপূর্ব উত্থান ও বিস্তারের যুগে সেই পুঁজির সঙ্গে জাতি-রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক সবসময় একমাত্রিক বা একরকম থাকে না সত্য, কিন্তু পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণই জাতি-রাষ্ট্রের উপস্থিতিকে শুরুতেই ধরে নেয়। সত্য, পুঁজির ইতিহাসই আমাদের বলে দেয় যে, পুঁজি আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে চায় বা এমনকি পুঁজি মানেই আন্তর্জাতিক পুঁজি। এও সত্য যে, ক্ষেত্রবিশেষে এমনকি ‘জাতীয় পুঁজি’র ধারণাটিও ধোপে টেকে না। তার অর্থ এই নয় যে, পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণে জাতি-রাষ্ট্রের ভূমিকা নেই। আসলে ‘আন্তর্জাতিক’ কথাটার ভেতরেই তো ‘জাতি’ কথাটা থেকে যাচ্ছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টেনে বলা যাবে যে,
আন্তর্জাতিক পুঁজিও জাতীয় রূপ নিতে পারে, যাকে আরেক প্রসঙ্গে আর্নেস্ট ম্যান্ডেল বলেছিলেন পুঁজির ‘ফেনোমেনাল ফর্ম’। জাতি-রাষ্ট্র কিভাবে কাজ করে, সেটা বোঝার জন্য রিচার্ড রবিনস্-এর একটা উদ্ধৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে : জাতিরাষ্ট্রগুলো বাজার উন্মুক্ত করার লক্ষেই আইন ও চুক্তি তৈরী করে; একই সঙ্গে জাতিরাষ্ট্রগুলো অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর জোর দেয় (রাস্তাঘাট, বিমান ও নৌবন্দর, বিদ্যুৎ সরবরাহ, আর্থিক লেনদেনের ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যান্য দিক, ইত্যাদি)। কেননা এ-সব কিছুই পণ্য উৎপাদনে, সার্ভিস বিতরণে এবং মূল্য নির্ধারণে প্রতিযোগিতামূলক ভাবে পুঁজিকে সাহায্য করে। জাতি-রাষ্ট্রগুলো বিনিয়োগকে রক্ষা করার ও বাজারকে উন্মুক্ত করার স্বার্থে এমনকি সামরিক বাহিনীও মোতায়েন করে। (গ্লোবাল প্রবলেমস্ এ্যান্ড দ্য কালচার অব ক্যাপিটালিজম, পৃ ৫৯-৬০) কিন্তু রিচার্ড রবিনস্ যেখানে ছাড়েন, সেখানে আরেকটু অগ্রসর হন এনরিক ডুসেল। তিনি দেখান যে, বর্তমান বিশ্বের মার্কিনায়িত একচেটিয়া পুঁজিবাদের জন্য জাতি-রাষ্ট্র কেবল জরুরীই নয়, বরঞ্চ তা পুঁজিবাদের গতিপ্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যেরই অন্তর্গত বটে। ডুসেল আরো মনে করেন যে, জাতিরাষ্ট্র মাঝে মাঝে একাই উদ্বৃত্ত মূল্যের স্থানান্তরকে যুগপৎ একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রূপান্তরিত করে। হ্যাঁ, জাতি-রাষ্ট্র থাকেই, যেমন থাকে বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের অসম উন্নয়ন, তবে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদের সঙ্গে জাতি-রাষ্ট্রের সম্পর্ক সবসময় একরকম বা স্থির থাকে না, যে-বিষয়টির ইঙ্গিত আমরা আগেই দিয়েছি। উভয়ের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের টানা-পোড়েনও থাকতে পারে। এ-সব কিছুই নির্ভর করবে একটি জাতি-রাষ্ট্রের চরিত্রের ওপর।
বর্তমান বিশ্বের একচেটিয়া পুঁজিবাদের সাম্প্রতিকতম স্তর হিসেবে নগ্ন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য অনেকেই ‘আন্তর্জাতিক শ্রেণী জোটে’র ধারণাকে সামনে এনেছেন। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন সমির আমিন ও কেভিন ড্যানাহার। এঁরা মনে করেন যে, জাতি-রাষ্ট্রের ধারক হিসেবে মার্কিন সরকার নিজেই, মার্কিন কর্পোরেশন, মার্কিন সামরিক বাহিনী, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান (ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-আই.এম.এফ-ডাব্লিউ.টি.ও) এবং অন্যান্য জাতীয় শাসক শ্রেণী বিভিন্ন কায়দায় জোট বেঁধে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের পারস্পরিক লেনদেন ও সহযোগিতার ভিত্তিতেই বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্ক এবং সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতা-সম্পর্ককে পুনরুৎপাদিত করতে থাকে। এও বলা যাবে যে, সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি বা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের সংকটের বিভিন্ন কারণের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে ওই জোট-সম্পর্কেরই সংকট।

উগ্রবাদী ওলফেড©স মতবাদের আধুনিক সংস্করণ মাকি©ন সাম্রাজ্যবাদ
উগ্রবাদী পল ওলফেড©স মতবাদের নব্য আধুনিক সংস্করন হলো মাকি©ন সাম্রাজ্যবাদ। উগ্রবাদী পল ওলফেড©স আমেরিকান সবেচেয়ে নিন্দিত প্রেসিডেন্ট জজ© বুশ জুনিয়র এর প্রশাসনের উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ২০০০ সালে সিনিয়র বুশের পুত্র জজ© ওয়াকা©র বুশ জুনিয়ার রিপাবলিকান পাটি হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিবা©চিত হন। সঙ্গে নিয়ে আসেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডিক চেনীকে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে ডোনাড রাস©ফেল্ডকে, উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে পল ওলফেড©সকে। এরা সবাই একত্রে সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানি এবং জজ©© বুশ সিনিয়রের প্রশাসনে গুরুত্বপূণ© পদে নিযুক্ত ছিলেন। পল ওলফেড©স ব্যক্তিভাবে দীঘ©দিন যাবত রিপাবলিকান পাটির নিউ কনজারবেটিব এর নেপথ্য নায়ক হিসাবে পরিচিত। সেই রোলান্ড রিগ্যানের সময় থেকে তিনি বছরে পর বছর ধরে আমেরিকান প্রশাসনযন্ত্রকে বুঝাতে চেয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত বিভিন্ন আন্ত©জাতিক চুক্তি, আইন এবং জাতিসংঘের মতো বহুজাতিক সংস্থাগুলোর ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গির পূণ©বিবেচনা করা। বিশ্বময় মাকি©ন সামরিক আধিপত্য বিস্তারের এক বদ্ধ মৌলবাদী ধারণা সব©প্রথম রাষ্ট্রীয় কম©সূচীতে অন্ত©ভূক্ত হয় জজ© বুশ সিনিয়র আমেরিকান প্রেসিডেন্ট থাকাকালিন সময়ে। যদিও প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এসব কম©কান্ড ছিল। ১৯৯২ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ে কাজ করার সময় পল ওলফেড©স ‘দি নিউ ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডিফেন্স প্ল্যানিং গাইড’ নামে একটি সামরিক কৌশলপত্র তৈরি করেন এবং প্রশাসনের সামনে পেশ করেন। তখন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তার এ সামরিক মতবাদ তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিল। বিশেষভাবে,

‘আমরা অতিরিক্ত শক্তি সংগ্রহ এবং তা সংহত করতে বরাবর প্রস্তুত,
যে কোন বিবাদী শক্তিকে আঞ্চলিক আধিপত্য অজ©ন থেকে বিরত রাখতে হবে,
নতুন ধারার বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় এবং তা রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই তার নেতৃ©ত্বের যোগ্যতা প্রমান করতে হবে,
নতুন প্রতিদ্বন্ধী উত্থান রুখতে হবে, উপসাগরীয় তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলে অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’
এ বিষয়গুলো থেকে ওলফেড©স মতবাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্কার হয়ে যায়। বুশের পর বিল ক্লিলটন ডেমোক্রেটিক পাটি হয়ে ক্ষমতায় আসলে পল ওলফেড©স এর মতো থিংক ট্যাংক গণ রিপাবলিকান পাটির স্নায়ুকেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় গ্রহন করেন। ২০০০ সালে ন্যাশনাল ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্যাডেজী’ শিরোনামে তিনি আর একটি প্রস্তাব আনেন। এটা ‘প্রজেক্ট দ্য নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরী’ নামে প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি মূল যে প্রস্তাবগুলো আনেন, সেগুলো হচ্ছে,

‘আমেরিকান সামরিক ব্যয় ১০০ বিলিয়ন মাকি©স ডলারে উন্নিত করা,
অন্যান্য দেশকে মহাকাশ ব্যবহার থেকে বিরত রাখা,
দৃঢতার সাথে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া,
সংকট সৃষ্টি হওয়ার আগেই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রন করা এবং
ইরাকের মতো রাষ্ট্রগুলোকে কঠোরভাবে দমন করা।’
কিন্তু প্রশাসনের কতা©ব্যক্তিগণ জানতেন যে, কনজারটিভদের এ সব উগ্র পরিকল্পনা আন্ত©জাতিক সমথ©ন পাবে না, এমন কি দেশীয় সমথ©ন নয়। তাই একে ‘রিবিল্ডিং আমেরিকান ডিফেন্স’ নামে নতুন মোড়ক দিয়ে ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে আবার প্রকাশ করা হয়। তারা জানতেন যে, এ পরিবত©ন আনার জন্য যদি বিপ্লব সংগঠনের চেষ্টা করা হয় তবুও তা তাদের জীবন দশায় সম্ভব নয় বা তাদের দেখে যাবার ভাগ্য হবে না। তাই তাদের দরকার পাল© হারবাল অথবা নাইন ইলেভেনের মতো অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো কোন ঘটনা। এসব পরিকল্পনার আধুনিক সংস্করণ হলো বত©মান মাকি©ন সাম্রাজ্যবাদ। বরং বত©মানে ওলফেড©সের উগ্র মতবাদের চেয়েও ভয়ংকর উগ্রবাদী আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ।

২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হেঁটে আসে বৈশাখ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০০


বৈশাখ, বৈশাখের ঝড় ধূলিবালি
উঠন জুড়ে ঝলমল করছে;
মৌ মৌ ঘ্রান নাকের চারপাশ
তবু বৈশাখ কেনো জানি অহাহাকার-
কালমেঘ দেখে চমকে উঠি!
আজ বুঝি বৈশাখ আমাকে ছুঁয়ে যাবে-
অথচ বৈশাখের নিলাখেলা বুঝা বড় দায়
আজও বৈশাখ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×