somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-৪

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১২:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

* মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পঞ্চস্তম্ভ

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের লক্ষে পাঁচটি সেক্টরকে তাদের মূল স্তম্ভ হিসাবে নির্ধারণ করেছে। প্রখ্যাত লেখক আজফার হোসেন তার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামপ্রতিক ব্যাকরণ প্রবন্ধে এ সম্পর্কে বিস্তরিত বর্ণ না করেছেন। সেখানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পাচঁটি স্তম্ভ এর কথা বলা হয়েছে।সেগুলো হলোঃ
১. প্রযুক্তিগত আধিপত্য,
২. বিশ্বব্যাপী ফাইন্যান্স বাজারের নিয়ন্ত্রণ,
৩. পৃথিবীর তাবৎ প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আধিপত্য,
৪. মিডিয়া ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর আধিপত্য, এবং
৫. গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ওপর আধিপত্য ।
(ক্যাপিটালিজম্ ইন দ্য এজ অব গ্লোবালাইজেশান্, পৃ ৪-৫) । এগুলোকে তিনি আবার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পঞ্চবলয়ও বলেছেন। কারণ, বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন মাত্রার যোগসাজশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ওই পরস্পর-সম্পর্কিত পাঁচটি বলয়ে তার প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য জারি রেখেছে, যদিও এই আধিপত্য সব ক্ষেত্রে যান্ত্রিকভাবে একই ধরনের নয়। বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ওই আধিপত্যের হেরফেরও ঘটে। এই পাঁচটি বলয় নিয়ে এখন সংক্ষেপে আলোচনা করব।
১. প্রথমেই আসি প্রযুক্তি প্রসঙ্গে। মার্কিন কর্পোরেশনগুলো-ধনবান রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে প্রযুক্তিগত আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। আর এ-ধরনের আধিপত্য বিশাল ব্যয়ভার বহন ব্যতিরেকে অসম্ভবই বটে। সনির আমিন ঠিকই বলেন, বিশেষ করে সামরিক খরচাপাতির ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রের সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া আধিপত্যের বলয়ের অধিকাংশই টিকে থাকতো না (ক্যাপিটালিজম্ ইন দ্য এজ অব গ্লোবালাইজেশান, পৃ ৪)। আর মিশেল বড্ তো মনে করেন যে, সাম্প্রপ্রতিক কর্পোরেট পুঁজিবাদ তথা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে আসলে মূলত চেনা যায় তার প্রযুক্তিগত আধিপত্যের ভেতর দিয়েই। বড্ বলেন, পুঁজিবাদ আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেশী শক্তিশালী হয়েছে আর আমরা দেখছি পুঁজিবাদের এক নতুন যুগের সূচনাকে। এ-যুগে নতুন পণ্য আর প্রকল্পের উদ্ভাবনে কর্পোরেশনগুলো অভাবনীয় মাত্রায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে চলেছে। (এ হিস্ট্রি অব ক্যাপিটালিজম্, পৃ ৩০২)
বড্ ‘মহাপ্রযুক্তিময় পুঁজিবাদ’-এর কথাও বলেছেন। এ পুঁজিবাদেই আমরা প্রত্যক্ষ করছি কিভাবে টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্কগুলো বেঁধে ফেলেছে কম্পিউটার, ফোন এবং টেলিভিশনকে। আমরা এও দেখছি কিভাবে সাইবার স্পেস উঁচুপ্রযুক্তির নমুনা হিসেবে হাজির হয়েছে। এছাড়া তো রয়েছেই কম্পিউটারায়িত শেয়ার বাজার। এভাবে অসংখ্য উদাহরণ জড়ো করা সম্ভব। তবে বোধ করি বিষয়টি এর মধ্যেই পরিষ্কার হয়েছে যে, বাজার থেকে যুদ্ধের ময়দান পর্যন্ত প্রায় সব ক্ষেত্রেরই উন্নত ও অগ্রসর প্রযুক্তির ব্যবহার করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেশনগুলোর পক্ষে যতোটা সম্ভব, অন্যদের পক্ষে ততোটা নয়। আর তাদের জন্য প্রযুক্তি কেবল ব্যবহারেই সীমাবদ্ধ নয়, তা নিয়ে তাদের বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য বিস্তৃত হয়েছে অভাবনীয় মাত্রায়।
২. প্রযুক্তির পরে আসে বিশ্বব্যাপী ফাইন্যান্স বাজারের নিয়ন্ত্রণ। সমির আমিন এ-বলয়ের নাম দিয়েছেন অর্থের বাজারের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ। বিশ্বব্যাপী ফাইন্যান্স পুঁজির আনাগোনা বা আমদানী-রফতানী একচেটিয়া পুঁজিবাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বিদেশী মুদ্রার লেনদেনের বৈশ্বিক বাজার পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টস্-এর পরিসংখ্যান মোতাবেক পৃথিবীতে প্রতিদিন গড়ে যে-পরিমাণ অর্থ বিনিময় করা হয়, তার অংক ১,৪৯০,০০০,০০০,০০০ ডলার। শূন্যের এই অব্যাহত মিছিল কোনো পরাবাস্তববাদী প্রপঞ্চকে নির্দেশ করে না; বরঞ্চ তা নির্দেশ করে বিশ্বায়িত ফাইন্যান্স পুঁজির বাজারের বৈভব ও বিস্তার, গতি ও শক্তিকেই। এই বাজারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যাকে রাজনৈতিক-অর্থনীতির পরিভাষায় বলা হয় ফো বা প্রবহ। ওই বাজারের মোট আটটি প্রবহকে অল্পায়াসেই শনাক্ত করা যায় : ১. দেশ থেকে দেশে নিট দীর্ঘমেয়াদী সম্পদের প্রবহ; ২. প্রাতিষ্ঠানিক প্রবহ ; ৩. প্রাইভেট প্রবহ; ৪. প্রাইভেট ঋণ প্রবহ; ৫. বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রবহ; ৬. বন্ডের প্রবহ; ৭. পোর্টফোলিও ইকুইটির প্রবহ; এবং ৮. সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের প্রবহ। এ-সব প্রবহই অর্থের বাজারের চেহারাকে তুলে ধরে। আর মিশেল বড্ ও সমির আমিনের মতে এ-প্রবহের ওপর প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য করছে মার্কিন কর্পোরেশনগুলোই। এখানে বলা দরকার যে, অর্থের বাজারকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ভূমিকা আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে অনেক। প্রযুক্তির কারণেই ল্য করছি ভারচুয়াল শেয়ার বাজারের অভূতপূর্ব বিস্তৃতি। আর প্রযুক্তির কারণেই তো উদ্ভাবিত হয়েছে যাকে বলা হচ্ছে ইলেকট্রনিক । হ্যাঁ, ওই প্রযুক্তির কারণেই অভাবনীয় অংকের টাকা বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে স্থানান্তরিত হয় মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই। উড়ে-উড়ে ঘুরে-বেড়ানো এবং জুড়ে-বসা পুঁজির আরেক নাম ওই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই। আর এই পুঁজির দুনিয়া-সফরকে অবাধ করার ক্ষেত্রের সহায়কের ভূমিকায় থাকে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো-ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আই.এম.এফ. এবং ডাব্লিউ.টি.ও.।
তবে অর্থের বাজারের সঙ্গে পণ্যের বাজার যুক্ত থাকে বটে। বস্তুত, অর্থের বাজার পণ্যের বাজারকেও গতিশীল করে। সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমা মুলুকের কিছু কিছু রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ও সংস্কৃতি-তাত্ত্বিক পুঁজির নতুন চেহারাকে বোঝার জন্য জল্পনামূলক পুঁজির ওপর জোর দিয়েছেন। এঁদের ভাষ্য অনুসারে বর্তমানের কর্পোরেশনগুলো পণ্যোৎপাদনের চেয়ে জল্পনামূলক পুঁজিতে বেশি আগ্রহী। অর্থাৎ উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের চেয়ে অর্থ দিয়ে অর্থ আনার বিষয়টিতে বেশী আগ্রহী হয়ে উঠেছে আজকের কর্পোরেশনগুলো। কিন্তু এর অর্থ আবার এও নয় যে, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে এখন উৎপাদন ও পণ্যের মৃত্যু ঘটেছে। মিশেল বড্ আমাদের জানাচ্ছেন যে, ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এই দশ বছরে পণ্যোৎপাদনের পরিমাণ ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্যই লক্ষ্য করা যাবে বিশ্বব্যাপী মার্কিন পণ্যের ছড়াছড়ি-গাড়ি ও অস্ত্র থেকে টুথব্রাশ ও দাঁতের খিলাল পর্যন্ত। পুঁজিবাদের সেই পুরনো সংজ্ঞার্থটা এখনো কার্যকর ঠেকে : পুঁজিবাদ হচ্ছে সাধারণীকৃত পণ্যোৎপাদনের বৈশ্বিক ব্যবস্থা, যে-ব্যবস্থার বিকশিত রূপ আজ আমরা প্রত্যক্ষ করি ওই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেই।
৩. ফাইন্যান্স বাজারের নিয়ন্ত্রণের পরেই আসে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আধিপত্যের বিষয়টি। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ ও লুণ্ঠন করার ক্ষেত্রেও ওই মার্কিন কর্পোরেশনগুলো (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির সহযোগিতায়) সবচাইতে এগিয়ে আছে। এখানেও কোনো জাতি-রাষ্ট্রের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে এমনকি জাতি-রাষ্ট্রের বিভিন্ন দমনমূলক হাতিয়ার (যেমন সেনাবাহিনী) ব্যবহার করা ছাড়া পুঁজিবাদী কর্পোরেশনগুলো তৃতীয় বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে পারে না। অসংখ্য উদাহরণ দেয়া সম্ভব। তবে একটি পুরাতন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ এখানে উপস্থিত করা যায়। নাইজেরিয়ার কথাই ধরা যাক। এই দেশের তেলসম্পদের প্রায় অর্ধেকটা চলে যায় ইঙ্গ-ডাচ কোম্পানী শেল-এর কাছে আর বাকি অর্ধেকের বেশীটা নিয়ে নেয় মার্কিন কোম্পানী শেভরন। এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো তাঁর আপসাইড ডাউন গ্রন্থে আমাদের জানাচ্ছেন যে, তেলসম্পদ লুটপাট করতে গিয়ে শেল ও শেভরন নাইজেরিয়ার অগোনি জনসম্প্রদায়ের ভূমি ও নদী-নালা সহ তাদের সমগ্র পরিবেশকেই ধ্বংস করে ফেলেছে।
নাইজেরিয়ার এ-অবস্থাকে চিত্রায়িত করতে গিয়ে নাইজেরিয়ার লড়াকু লেখক কেন্ সারো উইয়া নিজেই বলেছিলেন মার্কিন কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ-এর কথা। তিনি এ-কথা বলেই ক্ষান্ত হন নি। অগোনি জনসম্প্রদায়ের পক্ষে এবং সঙ্গে থেকেই সারো উইয়া লড়েছেন ওইসব কোম্পানীর বিরুদ্ধে; তাঁর লেখায় কর্পোরেশনগুলোর নগ্ন অপতৎপরতার বিভিন্ন দিক তিনি তুলে ধরেছেন এবং এও বলেছেন যে, তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাট এবং ভূমি-ও-পরিবেশ-ধ্বংসের আরেক নাম গণহত্যা। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ যেমন মানুষকে নির্দ্বিধায় হত্যা করে, কর্পোরেট পুঁজির প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটও ভূমি এবং পরিবেশকে ধ্বংস করার ভেতর দিয়েই মানুষকে হত্যা করে। এ-ধরনের অবস্থান থেকে টগবগে ভাষায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লেখালেখির জন্যই নাইজেরিয়ার লেখক কেন্ সারো উইয়াকে প্রাণ দিতে হয়। নাইজেরিয়ার সামরিক সরকার-শেল ও শেভরনের সুপারিশেই-সারো উইয়াকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলায়।
অবশ্যই নাইজেরিয়া একমাত্র উদাহরণ নয়, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ নিঃসন্দেহে। পৃথিবীর তাবৎ প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া আধিপত্য প্রসঙ্গে মার্কিন ইতিহাসবিদ হাওয়ার্ড জিন তাঁর এ পিপলস্ হিস্ট্রি অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস্ নামের গ্রন্থে আমাদের জানান যে, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের শতকরা ষাট ভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তার কর্পোরেশনগুলো বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় ১১টি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে মার্কিন কর্পোরেশনগুলোর একচেটিয়া প্রবেশাধিকার রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইরাক এখন মার্কিন কর্পোরেশনগুলোর লুটপাটের একটি প্রধান ক্ষেত্র। আর ঐতিহাসিকভাবে লাতিন আমেরিকা তো রয়েছেই। বিনিয়োগের নামে মার্কিন কর্পোরেশন এই মহাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ কিভাবে লুটপাট করেছে তার বোধ করি সবচাইতে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাবে এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানোর সাড়া-জাগানো গ্রন্থ ওপেন ভেইনস্ অব ল্যাটিন আমেরিকা-তে। গ্যালিয়ানো রাজনৈতিক অর্থনীতির একটি ইঙ্গিতজ্ঞাপক কূটাভাসকে চিহ্নিত করেন এই বলে যে, যে-দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে যত সমৃদ্ধ, সে-দেশ তত দরিদ্র। (পৃ ৭৬) হ্যাঁ, বিভিন্ন সময়ে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ সেটাই প্রমাণ করেছে বটে।
৪. এবারে আসি কর্পোরেট পুঁজির একচেটিয়া আধিপত্যের চতুর্থ বলয়ে। এটি গণমাধ্যম ও যোগাযোগের বলয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যুগে আজ পৃথিবীর সবচাইতে বড়ো গণমাধ্যমগুলোর স্বত্বাধিকারী হচ্ছে গুটিকয়েক কর্পোরেশন। গণমাধ্যমবিশারদ রবার্ট ম্যাকচেছনি তাঁর দ্য নিউ গ্লোবাল মিডিয়া গ্রন্থে আমাদের জানান, আটটি বহুজাতিক কর্পোরেশন এখন বৈশ্বিক গণমাধ্যমের বাজারকে শাসন করছে : জেনারেল ইলেকট্রিক (এন.বি.সি.র স্বত্বাধিকারী), এ.টিএ্যান্ডটি/ লিবার্টি মিডিয়া, ডিজনি, টাইম ওয়ারনার, সনি, নিউজ কর্পোরেশন, ভিয়াকম (সিবিএস-এর স্বত্বাধিকারী) এবং বার্তেলসমানসহ সি-গ্রাম। (পৃ ২২) এছাড়া তো এটা গত দশ বছরে বেশ পরিষ্কার হয়েছে যে, রূপার্ট মারডোক, সিলভিয়া বার্লুসকোনি এবং ওয়ারনার ভাতৃদয়সহ হেনরি লুচে মিডিয়া সম্রাট হিসেবে তাদের মিডিয়া-সাম্রাজ্য বিস্তৃত করে চলেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ও মহাদেশে। এরা বেতার-শিল্প, মুদ্রণ-শিল্প ও চলচ্চিত্র-উৎপাদনের ওপর তাদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব জারি রেখেছে, যেমন তারা নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে স্যাটেলাইট ও কেব্ল নেটওয়ার্কগুলো। হ্যাঁ, বইপত্র এবং পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে ভিডিও এবং খেলনাসহ টেলিভিশন প্রোগ্রাম এবং চলচ্চিত্র পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া-পণ্যের উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ও ভোগের বিষয়টি গণমাধ্যম ও যোগাযোগের রাজনৈতিক অর্থনীতিকেই সামনে আনে। আর এই রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর আবারো ওই মার্কিন কর্পোরেশনগুলোর প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য জারি রয়েছে। নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড হারমান তাঁদের গ্রন্থ ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট-এ বর্তমান বিশ্বের মিডিয়া-সাম্রাজ্যবাদকে মার্কিন আধিপত্য দিয়েই বিচার করেছেন। তাঁরা বলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব চাইতে উঁচু পর্যায়ের ২৪টি বৃহৎ মিডিয়া-সংস্থার আধিপত্যের কথা। চমস্কি ও হারমান আরো বলেন
এই চব্বিশটি মিডিয়া-সংস্থা নিজেরাই বড়ো আকারের মুনাফাভিত্তিক কর্পোরেশন। এদের মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ একচ্ছত্র ভাবে ধনবান ব্যক্তিদের হাতেই।...একটি বাদে উঁচু পর্যায়ের সকল কোম্পানীরই সম্পদের পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি...এই বৃহৎ মিডিয়া-সংস্থাগুলোর প্রায় তিন-চতুর্থাংশের কর-পরবর্তী মুনাফার পরিমাণ ১০০ মিলিয়ন ডলারকেও ছাড়িয়ে যায় এবং তাদের গড় মুনাফা দাঁড়ায় ১৮৩ মিলিয়ন ডলারে। (পৃ ৪) তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, বর্তমান বিশ্বের মিডিয়া-সাম্রাজ্যবাদ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে একচেটিয়া কর্পোরেট পুঁজির সাম্প্রতিকতম স্তর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু মিডিয়া-সাম্রাজ্যবাদ কেবল রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয় নয়; তা সাংস্কৃতিকও বটে। প্রকৃতপক্ষে মিডিয়া-সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির উৎপাদন-বিনিময়-ভোগ-বন্টনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মার্কিন মিডিয়া-সংস্থাগুলো ব্যবসায় করার পাশাপাশি এবং ব্যবসার স্বার্থেই বাজারের মতাদর্শ ও পুঁজিবাদী মূল্যবোধ বিভিন্নভাবেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে থাকে। হ্যাঁ, সত্য, মিডিয়া তো কেবল প্রযুক্তি ও প্রতিষ্ঠানই নয়, তা আখ্যানও বটে, যে-সব আখ্যানের পুনরাবৃত্ত প্রাত্যহিকতায় মগজ ও মনোজগতেরও বাজারায়ন ঘটে চলেছে এমনি এক মাত্রায় যে, মানুষের চিন্তা ও জ্ঞানের মূল্যও নির্ধারিত হয় বিনিময়-মূল্যের নিরিখে। সবার ওপরে বাজার ও বিনিময়-মূল্য সত্য, তাহার ওপরে নাই-এই মতাদর্শটাকে আধিপত্যবাদী এবং এমনকি একচেটিয়া করার ক্ষেত্রে মার্কিন মিডিয়া-সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন গত দশ বছরে অভূতপূর্ব তীব্রতা লাভ করেছে, যে-কথাটি আমাদের জানাচ্ছেন মিডিয়া-নৃতাত্ত্বিক কেলি আসকিউ ও রিচার্ড উইলক্। তাঁরা আরো বলেন যে, মানুষের জন্য বিশ্বের সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করার কাজ নিয়েছে এখন মার্কিন মিডিয়া-সাম্রাজ্যবাদ। এবারে আসকিউ ও উইলক্ থেকে একটি উদ্ধৃতি : পৃথিবীর অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর সামনে এখন সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করে সি.এন.এন., হলিউড ও এম.টি.ভিসহ অন্যান্য ক্ষমতাবান বৈশ্বিক মিডিয়া। আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই স্থানীয় জনগণ মুদ্রিত চিত্রকল্পে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা চলচ্চিত্রে দূর-দেশের জীবনাচরণকে দৃশ্যমান দেখে। বেতার-সম্প্রচার, সঙ্গীত-ভিডিও এবং গণহারে উৎপাদিত ক্যাসেটের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ অপরিচিত গান-বাজনা এবং ভাষা শোনার অভিজ্ঞতা অর্জন করে। (পৃ ১) অভিজ্ঞতা অর্জনের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া তো ভালো কথা, কিন্তু সম্পর্কিত হওয়ার অর্থ যদি দাঁড়ায় অসম বা বৈষম্যমূলক উৎপাদন-সম্পর্কের ও ক্ষমতা-সম্পর্কের বিস্তার ও আগ্রাসন, তাহলে তো প্রশ্ন থাকবেই। এখানে মার্কিন মিডিয়া-সাম্রাজ্যবাদের আরেকটি আগ্রাসী চেহারার দিকে তাকানো যাক। হলিউডের চলচ্চিত্র, ম্যাকডোনাল্ডের বার্গার, লেভি-স্ট্রাউস কোম্পানির জিনস্, নাইকি কোম্পানীর জুতো, কোকা-কোলা কোম্পানীর পানীয়সহ অন্যান্য পণ্যকে জনগণের আফিমে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে। তৃতীয় বিশ্বে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানীর কার্যকলাপ সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক শক্তি অর্জন করে। তাহলে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে: মার্কিন মিডিয়া-সাম্রাজ্যবাদ নিজেই সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক-অর্থনীতিকে সাংস্কৃতিক করে তুলেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে, একচেটিয়া পুঁজিবাদের সাম্প্রতিকতম স্তরে সংস্কৃতির আলোচনা রাজনৈতিক অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির আলোচনা সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে সবসময়ই অপর্যাপ্ত থেকে যায়।
৫. এবারে আসা যাক আধিপত্যের পঞ্চম ও শেষ বলয়ে। এবারে ফেরা যাক একচেটিয়া আধিপত্যের আরেকটি বলয়ে-গণবিধ্বংসী যুদ্ধাস্ত্র প্রসঙ্গে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান সময়ে যেমন, পুঁজিবাদের আগের পর্বেও তেমনি স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, অস্ত্রের বিষয়টি একই সঙ্গে সামরিক ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তাৎপর্য বহন করে। মার্কিন পুঁজিবাদের প্রধান মুখপত্র ফরচ্যুন পত্রিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচ্ছদের উদাহরণ ব্যবহার করা যাক। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের কিছু দিন পরে প্রকাশিত ফরচ্যুন পত্রিকাটির একটি বিশেষ সংখ্যার প্রচ্ছদে একটি ছবি ছাপা হয়। সে-ছবিটি ফোর্ড কোম্পানীর একজন হিসাব-ব্যবস্থাপকের। কিন্তু ছবিতে সেই ব্যবস্থাপককে দেখা যায় সামরিক পোশাকে। আর ছবির নিচে বেশ বড়ো হরফে লেখা আছে বাণিজ্য যুদ্ধে যায়।
হ্যাঁ, যেখানেই যুদ্ধ, সেখানেই তো অস্ত্রের ব্যবসায় জমে ওঠে। আর যুদ্ধ কেবল অস্ত্রের ব্যবসায়কেই আকৃষ্ট ও ত্বরান্বিত করে না; তা একই সঙ্গে যুদ্ধকালীন পণ্যের উৎপাদন-বিতরণ-বিনিময়-ভোগের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকেও চালু রাখে। আর এভাবেই তো কর্পোরেশনগুলো মুনাফা লোটে। এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো তাঁর আপসাইড ডাউন গ্রন্থে লেখেন, আমরা জানি যে, সন্ত্রাস উস্কে দেয় সন্ত্রাসকে, কিন্তু সন্ত্রাস আবার কোম্পানীগুলোর মুনাফাকেও বৃদ্ধি করে, যে-কোম্পানীগুলো সন্ত্রাসকে পণ্যে রূপান্তরিত করে তাকে পরে দৃশ্যকল্প হিসেবে বিক্রি করে। (পৃ ২৭১) এ-প্রসঙ্গে অবশ্যই বলা দরকার বেলজিয়ামের প্রভাবশালী রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ আর্নেস্ট ম্যান্ডেল-এর লেট ক্যাপিটালিজম গ্রন্থটির কথা। যুদ্ধের সঙ্গে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ককে তিনি তত্ত্বায়িত করেছেন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই। লেট ক্যাপিটালিজম্-এ ম্যান্ডেল লেখেন, তিরিশের দশকের শেষ দিক থেকেই সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিতে অস্ত্রের উৎপাদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।...অদূর ভবিষ্যতে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই যে, চিরস্থায়ী অস্ত্রের অর্থনীতির ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবে হ্রাস পাবে। আর এভাবেই তো আমার লক্ষ্য করি সাম্প্রতিকতম পুঁজিবাদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিরস্থায়ী অস্ত্র অর্থনীতিকে। (পৃ ২৭৩-৭৪) হ্যাঁ, অস্ত্র অর্থনীতির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিঃসন্দেহে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনিবার্য সামরিকায়িত চেহারাকেই নির্দেশ ও নির্দিষ্ট করে। আর ঊনিশ শতক থেকে আজ পর্যন্ত মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের ইতিহাস একই সঙ্গে মার্কিন পুঁজিবাদের ইতিহাসও বটে। মার্কিন সামরিক ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ব্লাম আমাদেরকে জানান যে, ১৯৪৫ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের ৬৯টি দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক যুদ্ধ পরিচালিত করেছে বা সামরিক হামলা চালিয়েছে। এবং ১৯৪৫ সাল থেকেই সারা পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ-অর্থনীতির ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর পরিসংখ্যান মোতাবেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই অস্ত্র-ব্যবসায় পয়লা স্থান অধিকার করে আছে।
অস্ত্রের ব্যবসায় থেকে কিভাবে মার্কিন কর্পোরেশনগুলো মুনাফা লোটে তার অনেক উদাহরণ জড়ো করা সম্ভব। তবে এখানে শুধু বোয়িং কোম্পানীর কথা উল্লেখ করাটাই যথেষ্ট হবে। বোয়িং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম রপ্তানীকারী পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান, দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র-উৎপাদক এবং জাতীয় মিসাইল প্রতিরা প্রকল্পের বৃহত্তম ঠিকাদার। কেভিন মার্টিন ও তাঁর দলের একটি সমীক্ষা অনুসারে বোয়িং-এর বার্ষিক আয় ২০০০ সালে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল মোট ৫১.৩ বিলিয়ন ডলারে (বোয়িং কর্পোরেশন,পৃ ৩৪)। ওই সমীক্ষা থেকে একটি উদ্ধৃতি : বোয়িং-এর এ-এইচ-৬৪/এ আপাচে বিক্রি করা হয়েছে মিশর, গ্রীস, ইজরায়েল, সৌদি আরব এবং যুক্ত আরব আমিরাতের কাছে। ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে ইজরায়েল ব্যবহার করেছে বোয়িং-এরই তৈরী করা হেলিকপ্টার। বোয়িং-এর এফ-১৫ ঈগল বিক্রি করা হয়েছে ইজরায়েল, জাপান এবং সৌদি আরবের কাছে। আর অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফিনল্যান্ড, কুয়েত, মালয়েশিয়া, স্পেন এবং সুইজারল্যান্ডের কাছে বিক্রি করা হয়েছে বোয়িং-এর এফ/এ-১৮ হর্নেট। ইরাকের বিরুদ্ধে ১১ বছর ধরে বোমাবাজি অভিযানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ব্যবহার করেছে বোয়িং-এর এফ-। বোয়িং তার নিজস্ব যুদ্ধ-বিমানের চাহিদাকে চিরস্থায়ী করার জন্যই কৌশলে অস্ত্র রপ্তানী করে থাকে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য আবার বোয়িং নিজেই নতুন নতুন অস্ত্র উদ্ভাবন ও উৎপাদন করে। একই অস্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রশক্তিদের কাছেও বিক্রি করে থাকে বোয়িং। অস্ত্রের রপ্তানী আবার নিজেই উন্নততর ও ব্যয়বহুল প্রযুক্তির উদ্ভাবন দাবি করে, যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্যকে সবসময়ই নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। (বোয়িং কর্পোরেশন পৃ ৩) ওপরে উদ্ধৃত আখ্যানটি চিরস্থায়ী অস্ত্র-অর্থনীতির চেহারাকেই তুলে ধরে। এই অর্থনীতির সঙ্গে পৃথিবীব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক উপস্থিতির বিষয়টিও যুক্ত বটে। জন বেলামি ফস্টার তাঁর ইম্পিরিয়ালিজম এ্যান্ড এম্পায়ার নামের প্রবন্ধে জানান, পৃথিবীর ৬৯টি দেশে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি আছে; এ-সংখ্যা কেবলই বাড়ছে। (পৃ ৫) হ্যাঁ, এভাবেই মার্কিন কর্পোরেশন, চিরস্থায়ী অস্ত্র-অর্থনীতি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়-বিশেষ করে এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায়-মার্কিন সামরিক বাহিনীর সরাসরি উপস্থিতি ও হামলা গভীর ভাবে পরস্পর-সম্পর্কিত হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামপ্রতিক ব্যাকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককেই নির্দেশ করে। আগের অংশে আলোচিত আধিপত্যের পাঁচটি বলয়-যা আসলে পরস্পর-সম্পর্কিত-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামপ্রতিক ব্যাকরণকেই নির্দেশ করে।

মার্কিনীদের সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠার ধাপ

আজকের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কিভাবে পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি রুপে আর্বিভূত হলো? কি সেই শক্তি যার মাধ্যমে তার বিশ্বের সুপার হয়ে ওঠা? তার সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে হিংস্র, রক্তাত্ব ও নিষ্ঠুরতার এক মহা উপখ্যান। আজকের মানবাধিকারের ফেরীওয়ালা খ্যাত মার্কিনীদের আদি পেশা ছিলো দস্যুতা। তাদের প্রধান ব্যবসা ছিলো মাদক ও দাস বাণিজ্য।বিশ্বের দেশে দেশে দস্যুতা, নিষিদ্ধ মাদক ব্যবসা আর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিরীহ মানুষ অপহরণ করে দাস বানানো এগুলোই তাদের প্রধান কাজ। দস্যুতা, মাদক আর দাস বাণিজ্যের মাধ্যমে কিভাবে বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তির দেশে পরিণত হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবার তা সংক্ষেপে আলোচনা করব।

আদি পেশা দস্যুতা

আজকের মানবতা ও মানবাধিকারেরে ফেরী করে বেড়ানো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আদি পেশা ছিলো দস্যুতা।মুসলিম বিজ্ঞানী আবু রাইহান আল বেরুনী আমেরিকা যাবার পথ চিহিৃত করার পর ব্যবসা ও ধর্ম প্রচারের লক্ষে দলে দলে ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা আমেরিকা যাতায়াত শুরু করে দেয়। তাদের মূল কাজ ছিল দস্যুতা। আমেরিকার আদিবাসী যারা রেড ইন্ডিয়ান বলে চিহিৃত, তাদের সহায় সম্পত্তি শক্তিবলে দখল করাই ছিলো তাদের আদি প্রধান পেশা। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের উল্লেখযোগ্য ব্যবসা ছিল দাস ও মাদক ব্যবসা। আর উভয় প্রকার ব্যবসাই ছিল রেড ইন্ডিয়ানদের স্বার্থবিরুধী। দাস ব্যবসার মাধ্যমে যেখানে তারা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করত এবং এই শক্তি দিয়ে রেড ইন্ডিয়ানদের উপর হামলা চালাত। তাদের জমাজমি দখল করে নির্দোষ দাসত্বের মাধ্যমে চাষাবাদ করাত। আর মাদক ব্যবসার মাধ্যমে গোটা অধিবাসীদের মধ্যে মাদকাসক্তি ছড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। সেখানে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী শ্বেতাঙ্গরা রেড ইন্ডিয়ানদের সংখ্যালঘুতে পরিনত করার জন্য সংক্রামক ও মরণব্যাধী ছড়ায়, ব্যাপক মাদকাসক্তির বিস্তার ঘটায়। নির্বিচারে গণহত্যা চালায় ও পালের পর পাল বুনো মেষ হত্যা করে পরিকল্পিত খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। আজকে ওবামা বুশের পূর্ব পুরুষরা যারা ধর্মীয় উন্মাদের হাত থেকে বাচাঁর জন্য ইউরোপ থেকে পালিয়ে আমেরিকা গিয়েছিল, তারা আনন্দ উল্লাসের জন্য রেড ইন্ডিয়ানদের ও তাদের খাদ্যের প্রধান উৎস বুনো মেষ হত্যা করত। এর ফলে আধিবাসীরা এক পর্যায়ে রোগ ব্যাধি, খাদ্যভাব ও গণহত্যার শিকার হয়ে সংখ্যালগু জনগোষ্ঠিতে পরিনত হয় এবং বহিরাগতদের নির্দেশে অনুর্বর ও অস্বাস্থ্যকর স্থানে অমানবিক পরিবেশে বাস করতে বাধ্য হয়। বর্তমানে সভ্যতার ছোঁয়া থেকে তারা সম্পূর্ণ বঞ্চিত। দিন দিন তাদের সংখ্যা কেবল হ্রাসই পাচ্ছে। এ হল আমেরিকার আদি ইতিহাস!!

আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের গণহত্যা

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি মার্কিনীদের হাতে রেড ইন্ডিয়ানদের গণহত্যার কথা। কিন্তু পাশ্চাত্য মিডিয়া প্রচার করেছে তারা নাকি বিভিন্ন রোগে নির্মূল হয়ে গেছে। খুবই বিস্ময়ের কথা! এতো দিন তারা ঠিক ছিলো, কিন্তু শ্বেতাঙ্গরা আসার পরই নাকি মহামারীতে শুধু রেড ইন্ডিয়ানরা মারা গেল।মহামারীই নাকি শুধু রেড ইন্ডিয়ানকেই শেষ করেছে, শ্বেতাঙ্গদের বাদ দিয়ে। আসলে এ মহামারীর পেছরে নাটের গুরু ছিলো শ্বেতাঙ্গরাই, তাইতো সেই মহামারী তাদের কিছু করতে পারে নাই।কিভাবে তাদের গণহত্যা করে নির্মূল করা হয়েছিল আসুন একটু পরিসংখ্যান জেনে নিই।ইউরোপীয়রা যখন প্রথম আমেরিকায় পর্দাপন করে। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এক কোটি দশ লাখ আদিবাসী বাস করত। ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের গণহত্যার কারণে বর্তমানে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এদের সংখ্যা এসে দাড়িয়েছে দশ লাখেরও নীচে। কানাডায় মাত্র পাঁচ লাখের মত রেড ইন্ডিয়ান বেঁচে আছে যা সেখানকার মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ মাত্র। আর আমেরিকায়ও পাঁচ লাখের মতো বেঁচে ছিলো। তাহলে সেখানে কি পরিমান গণহত্যা চালানো হয়েছিল তা নিশ্চয় পাঠকরা বুঝতে পেরেছেন।এক কোটি দশ লাখ আদিবাসী খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে শুধু দশ লাখে পরিণত করা হলো।বাকি এক কোটি কোথায় গেল? কি আজব পদ্ধতি জনসংখ্যা কমানোর!কি পরিমান গণহত্যা চালানো হয়েছে রেড ইন্ডিয়ানদের ওপর? অথচ এর বাস্তব প্রমান আজ আমরা বিশ্বব্যাপী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের শিকার জনপদে লক্ষ্য করতেছি।শুধু ইরাকেই গত দশ বছরে ২৭ লাখের অধিক মানুষকে গণহত্যা করা হয়েছে। আর এর প্রশিক্ষণ আমেরিকানরা সেই রেড ইন্ডিয়ানদের দিয়ে নিয়েছিল।(আল্লাহ এদের থেকে বিশ্ব মানবতাকে রক্ষা করুন) তবে তারা যে পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে তাতে এপিচি, মাইকান, সুবিকেট, বিউথাক, নারাংগানসেট, ওয়াম, পানাগ প্রভূতি উপজাতীয়দের মত নিশ্চিহৃ হতে বেশি সময় লাগবে না। শ্বেতাঙ্গদের নির্মূল অভিযানের শিকার হয়ে এসব উপজাতি সমূহ নিশ্চিহৃ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে সারা বিশ্বকে কবজা করার জন্য শ্বেতাঙ্গরা রেড ইন্ডিয়ানদের ওপর দস্যুতা ও গণহত্যা চালিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলো।

নিষিদ্ধ মাদক ব্যবসা

বর্তমানে এটা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য যে, মাদকাসক্ততা হচ্ছে সকল অপরাধের মূল।কারণ ড্রাগ আসক্তদের ভেতরে মানবিক কোন অনুভূতি থাকে না। তাই তারা শুধু রেড ইন্ডিয়ানদের হাসিরচ্চলে গণহত্যা করে ক্ষান্ত হতো না তাদের প্রধান খাদ্য বুনো মেষ গুলোকেও নির্মমভাবে হত্যা করত। এগুলো নাকি তখন তাদের বিনোদনের কাজ ছিলো।তাদের সেই আদি নিষ্ঠুরতার প্রমাণ আজকে ইরাকে, আফগানিস্তানে, ভিয়েতনামে, ফিলিস্তিনেসহ পৃথিবীর দিকে দিকে আজ আমরা চাক্ষুস দেখতে পাচ্ছি মিডিয়ার বদৌলতে।তাদের এ নিষ্ঠুর বিনোদন প্রিয়তার আজ বাস্তব সাক্ষী আজকের আবু গারিব ও গুয়েন্তানামো বে কারাগার। এখন আসি তাদের মাদক ব্যবসা সম্পর্কে।রেড ইন্ডিয়ানদের শেষ করার পর আমেরিকার কর্তৃত্ব যখন শ্বেতাঙ্গদের হাতে গিয়ে পড়ল। তখণ শ্বেতাঙ্গরা মার্কিন নাগরিক পরিচয়ে বাণিজ্যের নামে রণপ্রস্তুতি নিয়ে এশিয়ার উদ্দ্যেশে তরী ভাসায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক বছর পরই মার্কিন বাণিজ্য ও রণতরী মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় গিয়ে হাজির হয়। প্রথমে তারা শুরু করে আফিম ব্যবসা যা প্রাচ্যের জাতিসংঘের কাছে গর্হিত অপরাধ হিসাবে চিহিৃত। প্রথমে এই ব্যবসায় বৃটিশরা মনোনিবেশ করে। পরে মার্কিনীরা এতে ভাগ বসায়। এই ব্যবসায় শতকরা ৫শ ভাগের বেশি লাভ হত। এই লাভজনক ব্যবসাকে নিরাপদ করার লক্ষে মার্কিনীরা উঠেপড়ে লাগে। আজকের আমেরিকার ওয়াইন সংষ্কৃতি তাদের আদি মাদক ব্যবসার সাক্ষ্য বহন করে। মার্কিন বণিকরা ইজমির ও অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে আফিম ক্রয় করে ভূমধ্য সাগরে পাড়ি দিয়ে আটলান্টিক সাগর হয়ে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘূরে ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগর দিয়ে চীনের ক্যান্টনে নিয়ে যেত। এ জন্য তাদেরকে মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও আধুনিক লিবিয়ার জলসীমা ব্যবহার করতে হত। বাণিজ্য তরীগুলো এসব দেশের বন্দর থেকে খাদ্য ও পানীয় সংগ্রহ করত। সেজন্য এসব দেশকে মার্কিন বণিকদের বড় অংকের কর দিতে হত। যা মার্কিন সরকার ১৭৮৭ সালে মার্কিন বণিকদের নিরাপত্তা বিধান ও আনুষাঙ্গিক সুবিধা প্রদান সংক্রান্ত একটি স্বাক্ষর করতে মরক্কোকে বাধ্য করে। একই ধরণের চুক্তি স্বাক্ষর করতে ১৭৯৬ সালে লিবিয়াকে এবং ১৭৯৭ সালে তিউনিসিয়াকে বাধ্য করে। দস্যুবৃত্তির সফল বাস্তাবায়ন! এভাবে তাদের মাদক ব্যবসার পাশাপাশি দস্যুবৃত্তি আস্তে আস্তে আন্তজাতিক রুপ লাভ করে। আর মাদক ব্যবসার সাথে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিরীহ নাগরিক অপহরণ করে দাসের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠল।

নিষ্ঠুর দাস বাণিজ্য

শুরুতে আমরা তাদের প্রধান কাজ মাদক আর দাস বাণিজ্যের কথা উল্লেখ করেছি।তাদের মাদক বাণিজ্যের আর দস্যুবৃত্তির আলোচনার পর এবার তাদের নিষ্ঠুর দাস ব্যবসা সম্পর্কে আসুন একটু জেনে নিই।আবু রায়হান পূর্বযুগ থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। উপরে আমরা রেড ইন্ডিয়ানদের কিভাবে দাস বানিয়ে তাদের ওপর নিষ্ঠুরতা চালানো হতো তা সংক্ষেপে উল্লেখ করেছি। আবু রায়হান পূর্ব যুগের অনেক ইতিহাস অজানা হলেও ষোড়শ শতকের আরো আগে থেকেই মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাস বাণিজ্যের সন্ধান যাওয়া যায়।বস্তুত সে সময় যুদ্ধবন্ধী এবং ঋণ পরিশোধে অপারগ ব্যক্তিদের দাসকর্মে বাধ্য করা হত। দাসদের শুধু কঠোর কাজে বাধ্য করা হতো না, তাদের নিষ্ঠুর যৌন দাস বৃত্তিতেও বাধ্য করা হতো।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাস ব্যবসার এতোই নির্মম ও ব্যাপক পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিল যে, ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত ১১টি সাউদান ষ্টেটস ও নর্দান ফেডারেল স্টেটস এর মধ্যে রীতি মতো গৃহযুদ্ধ সংগঠিত হয়। পরে ১৮৬৩ সালে তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাস প্রথা বিলুপ্ত ঘোষনা করেন।দাস প্রথা বিলুপ্ত হলেও এখন শ্রম দাস প্রথার অভিশাপ দাস প্রথা থেকেও মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক বছর পরই মার্কিন বাণিজ্য ও রণতরী মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় গিয়ে হাজির হয়, তখন মাদক ব্যবসার পাশাপাশি নিষ্ঠুর এ দাস বাণিজ্যে নেমে পড়ে মার্কিন শ্বেতাঙ্গরা।১৬১৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান দাস-দাসী আমদানীর গোড়াপত্তন হয়। সে বছর বিশজন মতান্তরে ত্রিশজন আফ্রিকান নাগরিককে অপহরন করে একটি ডাচ জাহাজে করে আমেরিকার ভার্জিনিয়া প্রদেশে নিযপ্রদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকেই আমেরিকার সর্বত্র দাসপ্রথার ব্যাপক প্রসার ঘটতে শুরু করে। ঔপনিবেশকদের পাশাপশি স্থানীয় স্বচ্ছল নাগরিকদের মাঝেও দাস গ্রহনের প্রবনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কৃষি, শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে অদক্ষতার কারনে আমেরিকার তৎকালীন পর্তুগীজ এবং বৃটিশ ঔপনিবেশকদের একেবারেই সুবিধা হচ্ছিল না। উপরন্তু বৃটেন এবং পর্তুগাল থেকে যে সকল গরীব কৃষক এবং শ্রমিকদের কৃষি এবং অন্যান্য কাজ সম্পাদন করানোর উদ্দেশ্য আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হত তাদের চেয়ে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গরা ছিল অধিকতর কর্মঠ এবং দক্ষ। ফলে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকার সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল থেকে তারা কৃষ্ণাঙ্গদের অপহরন শুরু করে এবং তাদেরকে আমেরিকায় বিভিন্ন জায়গায় ধরে নিয়ে দাসকর্মে বাধ্য করে।অপহরণকৃত দাসদের মধ্যে শুধু নিরীহ গরীব মানুষজনই ছিলো না, ছিল বিভিন্ন সাম্রাজ্যের রাজপুত্র ও রাজকন্যাও। ইতিহাসবিদদের মতে আফ্রিকা থেকে ধৃত আমেরিকায় পাচারকারী দাস-দাসীদের শতকরা দশ থেকে ত্রিশ ভাগ ছিল মুসলমান এবং মুসলমান দাসীদের সংখ্যা ছিল শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ। এমনও দেখা গেছে পুরো একটি জনগোষ্টিতে ছিল একজন মাত্র মুসলমান যাকে আফ্রিকা থেকে ধরে এনে দাসকর্মে বাধ্য করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান দাস-দাসীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুন। নিজেদের ইচ্ছামত ধর্ম কর্ম পালন করা ছিল অনেকটাই অসম্ভব, তার উপর অনেক মুসলমান দাস-দাসীদের জোরপূর্বক খৃষ্টধর্ম গ্রহনেও বাধ্য করা হত। আজকের আগ্রাসনের শিকার অঞ্চলসমূহে নিরীহ মানুষদের খৃস্ট ধম© গ্রহনের প্রলোভন তাদের সেই পুরনো মানসিকতারই বহিৃপ্রকাশ। প্রথমদিকে আমেরিকায় আগত আফ্রিকান মুসলমান দাস-দাসীদের অধিকাংশের নামই অজানা থেকে যায়। ক্রীতদাসদের সম্পত্তির তালিকায় কারো কারো নাম পাওয়া গেলেও তাদের আগমনের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন তথ্য জানা সম্ভব হয় নি। মুসলমান দাস-দাসীদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকই স্কুলে যাওয়ার, সম্পত্তির মালিক হওয়ার, বিয়ে করার, আদালতের দ্বারস্ত হওয়ার অথবা তাদের মৃত্যু আইনগতভাবে নথিভুক্ত করার সুযোগ পেতেন। এদের উপর নির্যাতনের নানামুখী মাত্রা ছিল অসহনীয়, এদের নাম পয©ন্ত পরিবত©ন খৃস্ট নাম রাখতে বাধ্য করা হতো যা পরবর্তীতে বিভিন্ন লেখকের সত্যসন্ধানী রচনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান দাস-দাসীদের জীবনচরিত অধ্যয়ন করে নির্দ্বিধায় বলা যায়, মুসলমানেরা সেখানে তিনশ বছর ধরে চরম নিপীড়নের স্বীকার হয়েছিলেন। তথাপি ইসলামী রীতি নীতি পালনে তারা ভীষন অকৃপনতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। ইসলামের প্রতি ভালবাসা এবং আল্লাহর প্রতি তাদের সীমাহীন আস্থা এখনও প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন মুসলমানকে শিহরিত করে। নানা প্রতিকুলতার মধ্যে থেকেও তারা যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামের জন্য কাজ করেছেন তা দৃষ্টান্তস্বরুপ। শত বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়নের মাঝেও অনেকেই ছিলেন প্রতিবাদী। তাদের শক্ত এবং পরিচ্ছন্ন প্রতিবাদের ফলেই বহু বছর দাসকর্ম করেও অনেকে এ যন্ত্রনা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম সম্প্রসারনের ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমান দাস-দাসীদের ভূমিকা স্বীকারযোগ্য। তাদের মাধ্যমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামের বীজ বপন হয়েছিল যার শস্যদানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমান মুসলমানের সংখ্যা পার করেছে আড়াই মিলিয়ন।

উঠতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ

রেড ইন্ডিয়ানদের গণহত্যার মাধ্যমে নিমূ©ল, মাদক ও নিষ্ঠুর দাস বাণিজ্যের মাধ্যমে অথ©নৈতিক সমৃদ্ধি অজ©নের পর এবার রাজ্য বিস্তারের উগ্র বাসনায় নেমে পড়ে সাম্রাজ্যবাদ হয়ে ওঠা মাকি©নীরা। আজকের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চেহারা ও চরিত্র বোঝার জন্যই ভূমি-প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে হাজির হয়। প্রখ্যাত কলামিস্ট আফজর হোসেন তার ‘মাকি©ন সাম্রাজ্যবাদের সাম্প্রতিক ব্যাকরণ’ প্রবন্ধে তাদের সেই রাজ্য বিস্তারের উগ্র বাসনার কথা এভাবেই উল্লেখ করেন, ‘ভূমিতেই সাম্রাজ্যবাদ সবচাইতে দৃশ্যমান ও নগ্ন হয়’-কথাটা একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো। ভূমি যে সাম্রাজ্যবাদের জন্য-বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য-ঐতিহাসিকভাবে কতটা জরুরী হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে ক্যাস্ত্রোর একটি চমৎকার আলোচনা আছে তার সামপ্রতিক গ্রন্থ ওয়ার, রেইসিজম্ এ্যান্ড একোনমিক ইনজাস্টিস-এ। সেখানে ক্যাস্ত্রো আমাদের জানাচ্ছেন যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস এবং তার ভূমিদখলের ও ভূমিদস্যুতার ইতিহাস কেবল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালেই সীমাবদ্ধ নয়। ক্যাস্ত্রোর মতে সেই ইতিহাসের জন্য আমাদেরকে যেতে হবে ঊনিশ শতকেই। তিনি তিনটি গরুত্বপূর্ণ সনের ওপর জোর দেন। এগুলো হচ্ছে ১৮২৩, ১৮৪৮ এবং ১৮৯৮। হ্যাঁ, ১৮২৩ সালে সরবে ঘোষিত হয় ‘মনরো ডকট্রিন।’ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতির নামাঙ্কিত এই মতবাদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূমিদস্যুতার একটি মতাদর্শিক ভিত্তি তৈরি করার তাগিদেই প্রচার করে যে, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই লাতিন আমেরিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেফাজতে রাখা জরুরী। রাষ্ট্রপতি মনরো নিজেই একটি রূপক চালু করেন : ‘লাতিন আমেরিকা হচ্ছে আমাদের বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগের উঠোন।’ কিন্তু মতবাদ ও রূপকের চেয়ে আরো সত্য ও বাস্তব হয়ে থাকে ইতিহাসে মূর্ত-হয়ে-ওঠা ঘটনা। ১৮৪৮ সালে মেঙিকোর অর্ধেকেরও বেশি ভূমি ছিনিয়ে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভৌগোলিক সীমানা সমপ্রসারিত করে। এভাবে নিজের দেশেই পরবাসী হয়ে ওঠেন অসংখ্য মেঙিকান। এরপর ১৮৯৮ সালে উঠতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূমিদখলের ও ভূমিদস্যুতার চেহারা আরো নগ্ন হয় : কিউবা, পুর্তো-রিকো, গুয়াম, হাওয়াই এবং ফিলিপাইনস্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি উপনিবেশে রূপান্তরিত হয়। মার্কিন সামরিক ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ব্লামের গবেষণা-মোতাবেক ভূমিদখলের জন্য বিংশ শতাব্দীতে কেবল লাতিন আমেরিকাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় শতাধিক ছোটো-বড়ো ও প্রত্য-পরো সামরিক যুদ্ধ পরিচালিত হয়।

একমাত্র পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ

উঠতি মাকি©ন সাম্রাজ্যবাদ সামরিক আগ্রাসনের এবং দেশে দেশে দস্যুবৃত্তি চালিয়ে লুন্ঠনের মাধ্যমে তার রাজ্য বিস্তাররের উগ্র বাসনা সফল বাস্তবায়নের ফলে ১৮৭০-এর দশকেই মার্কিন অর্থনীতি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির শিরোপা পায়। স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সামরিক শক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা দান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরমানু শক্তির অধিকারীর দাপট প্রমানের জন্য জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা হামলা চালায়। সে হামলায় কয়েক লক্ষ নিরীহ মানুষ নিহত হয়, এবং ধ্বংসের স্তুপে পরিণত হয় ওই অঞ্চল। আর এর মাধ্যমে মানবতা ধ্বংসকারী প্রথম পরমানু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা আত্মপ্রকাশ করে এবং রাষ্ট্রসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করে। ঠান্ডা যুদ্ধের শেষভাগে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন যুদ্ধ পরিচালনা ও গোয়েন্দাবৃত্তির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাড়িয়ে দিয়ে তার পতন নিশ্চিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র মহাশক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয়ের দুই-পঞ্চমাংশ খরচ করে এই দেশ। এভাবেই মাকি©ন যুক্তরাষ্ট্র তার সকল শক্তি ও সম্ভবনাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের প্রজনন,দস্যুবৃত্তি, সামরিক আগ্রাসন, লুন্ঠনতন্ত্র, মানবতা ধ্বংস, মানবাধিকার লংঘন এবং জুলুমবাজীর মাধ্যমে আজকের পৃথিবীর একমাত্র সুপার পাওয়ার খ্যাত বিশ্ব শান্তির হুমকি, সভ্য দুনিয়ার দুশমন মা-কি©-ন সা-ম্রা-জ্য-বা-দ এ পরিণত হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১:১৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×