somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধারাবাহিক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-১৪

১৬ ই মে, ২০১৫ রাত ১০:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উইকিলিকসের আয়নায় মাকিন ষড়যন্ত্রবাদ

একের পর এক কুটনৈতিক তথ্য ফাঁস করে স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে যদি কেউ মুখের উপর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়িছে তাহলে নির্ধিদায় সেটা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। একের পর এক নথি ফাস করে মার্কিন প্রশাসনের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।
আবারো ‘সাইবার বোমা’ ফাটালো উইকিলিস। আফগানিস্তান, ইরাক যুদ্ধের গোপন দলিল প্রকাশের পর এবার ফাঁস করলো মার্কিন কূটনৈতিক তত্পরতার গোপন দলিলপত্র। প্রথমে কয়েক হাজার দলিলপত্র প্রকাশ করেছে তারা, পরে ধারাবাহিকভাবে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রকাশিত হবে আরো কয়েক লক্ষ দলিল।
মূলত: বিভিন্ন দেশে মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো রাষ্ট্রদূতদের বার্তা ও মূলায়ন প্রকাশ পেয়েছে এসব দলিলে। এককথায় বলতে গেলে, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৭০ টি মার্কিন দূতাবাসের মধ্যকার গোপন বার্তা প্রকাশ হয়েছে এবার৷ প্রকাশ করা বেশির ভাগ বার্তাই গত তিন বছরের মধ্যে পাঠানো।
গত ২৮ নভেম্বর রোববার উইকিলিস এসব দলিল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার ওয়েবসাইটে সাইবার হামলা হয়। কিন্তু তারা আগেই দলিলপত্রগুলি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস, যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান, ফ্রান্সের ল্য মঁদে, জার্মানির ডের স্পিগেল ও স্পেনের এল পাইসে পত্রিকায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। তারাই একযোগে এসব বার্তা প্রকাশ করে।
কি নেই এসব দলিলপত্রে? মার্কিন সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইরানের পরমাণু আলোচনা থেকে শুরু করে পাকিস্তানে পারমাণবিক অস্ত্রের নিরাপত্তা সম্পর্কে মার্কিন মূল্যায়ন, গুগল হ্যাক করার চীনা উদ্যোগ, গুয়ান্তানামো বন্দিদের অন্য দেশে হস্তান্তরে চাপ, আফগানিস্তানে দুর্নীতি, ইয়েমেনে বিমান হামলা সম্পর্কে, কোরিয় উপদ্বীপে উত্তেজন, ইরানে আক্রমণের জন্য সৌদি চাপ।
এছাড়াও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র নায়কদের সম্পর্কে মার্কিন কুটনৈতিকদের মূলায়ন ও বিরূপ মন্তব্য রয়েছে ফাঁস হয়ে যাওয়া এসব দলিলপত্রে। ফাঁসকৃত বাতায় দেখা যায়, কিভাবে মাকি©ন কুটনৈতিকরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে বসে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিল। তাই আমরা এ সবের নাম দিয়েছি মাকি©ন ষড়যন্ত্রবাদ। আসুন এর উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ জেনে নিই, তাদের ষড়যন্ত্রবাদ বুঝার স্বাথে।

জাতিসংঘ বিষয়ক

জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনসহ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের ওপর নজরদারি করতে মার্কিন কূটনীতিকদের নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। উইকিলিসের ফাঁস করে দেয়া তার বার্তায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই অপর্কীতির কথা প্রকাশ পায়।
হিলারি ক্লিনটনের নাম উল্লেখ করে জাতিসংঘে মার্কিন কূটনীতিকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা যেন জাতিসংঘে বিদেশি কূটনীতিকদের ক্রেডিট কার্ডের নম্বরের মতো ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করেন। সাধারণত এসব তথ্য গোয়েন্দারাই সংগ্রহ করে থাকেন। গত বছরের জুলাইয়ে কূটনীতিকদের কাছে পাঠানো এ ধরনের এক তারবার্তায় জাতিসংঘের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কী ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা ব্যবহার করেন সে সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। হিলারি ক্লিনটনের সই করা আরেকটি বার্তায় উত্তর কোরিয়ার কূটনীতিকদের বায়োমেট্রিক ও বায়োগ্রাফিক তথ্য জানতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এক সাক্ষাৎকারে উইকিলিসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বলেন, হিলারির বিরুদ্ধে জাতিসংঘে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য মার্কিন কূটনীতিকদের নির্দেশ দেওয়ার ঘটনা প্রমাণিত হলে তাঁর পদত্যাগ করা উচিত। কারণ, এটা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাক্ষর করা আন্তর্জাতিক সনদের লঙ্ঘন। তাঁর অবশ্যই পদত্যাগ করা উচিত।

ন্যাটো সম্পকিত

রাশিয়ার যে কোন সামরিক আক্রমণের হাত থেকে বাল্টিক দেশ লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এ্যাস্তনিয়াকে রক্ষার জন্য একটি সামরিক পরিকল্পনা নিয়েছে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো। চলতি বছরের গোড়ার দিকে এ পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তবে রাশিয়ার ক্ষোভের মুখে পড়ার ভয়ে নতুন প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাটির কথা গোপন রাখতে অত্যান্ত কড়া নির্দেশ দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। উইকিলিকসের ফাঁস করা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের গোপন নথিতে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ন্যাটো-রাশিয়া সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনার তৈরি করতে পারে উইকিলিকসের প্রকাশ করা এ তথ্য। উল্লেখ্য, রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ন্যাটোর নীতি পরিপন্থী বলে বিবেচনা করে মস্কো। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী ন্যাটোর আনুষ্ঠানিক নীতি হলো, এই সামরিক জোট রাশিয়াকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করবে না। উইকিলিকসে প্রকাশিত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক গোপন বার্তায় দেখা যায়, ২০০৮ সালে জর্জিয়া-রাশিয়া সংঘর্ষের পর থেকেই নিজদের জন্য বিশেষ প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করতে ন্যাটোর কাছে দাবি জানাতে থাকে বাল্টিক অঞ্চলের তিন দেশ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ এ তিন দেশ ন্যাটোর কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে, জর্জিয়ার মতো যেকোনো সময় রাশিয়া তাদের দেশেও হামলা চালাতে পারে। শুরুতে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া ও ন্যাটোর নীতির কথা বিবেচনা করে এ আবেদনে সাড়া দেওয়ার বিরোধিতা করেন মার্কিন কূটনীতিকরা। তবে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি ওয়াশিংটন থেকে পাঠানো এক বার্তায় দেখা যায়, বাল্টিক দেশগুলোকে প্রতিরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে রাজি হয়েছে ন্যাটো। সে মোতাবেক পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়াকে যুক্ত করা হবে। এ চার দেশ মিলিয়ে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর নতুন প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার নাম হবে ‘ঈগল গার্ডিয়ান’। জানুয়ারিতেই এ পরিকল্পনা অনুমোদনের কথা জানিয়ে বাল্টিক দেশ ও ন্যাটো সদস্যদের উদ্দেশে চিঠি দেন হিলারি। এতে তিনি কঠোরভাবে সতর্ক করে দেন যে, এ পরিকল্পনার কথা গোপন রাখতে হবে। তবে উইকিলিকস রাশিয়ার সীমান্তঘেঁষা বাল্টিক দেশগুলোর জন্য ন্যাটোর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার তথ্যসংবলিত নথি প্রকাশ করার পরপরই বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় রাশিয়া। এ বিষয়ে ন্যাটোর আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানতে নিজেদের দূতকে নির্দেশ দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। উইকিলিকস ওয়েবসাইটে ফাঁসকৃত অপর এত বার্তায় দেখা যায়, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী সের্গেই লেভরোভকে মিথ্যাবাদী বলেছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি। জর্জিয়ার সঙ্গে ২০০৮ সালের অগাস্টে মস্কোতে একটি আলোচনার সময় সারকোজি লেভরোভ সম্পর্কে এ মন্তব্য করেন।
সারকোজি এ সময় যুদ্ধ বিরতি চুক্তি বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। এসময় তিনি রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে কাছে টেনে নিয়ে তাকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলেন বলে মার্কিন এক কূটনীতিক জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র:

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ২০০ পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেছে, বিশেষ করে বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, জার্মানি ও তুরস্কে এসব অস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছে। এ বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে উইকিলিস বেশ কিছু কূটনৈতিক তারবার্তা প্রকাশ করেছে। ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক ওয়ারহেড মোতায়েন রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহ করে আসছে। তবে ওই সব ওয়ারহেড সুনির্দিষ্টভাবে কোথায় মোতায়েন রয়েছে, তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। উইকিলিকস বলেছে, চারটি দেশে মোতায়েন করা যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে গত বছর তাঁদের মধ্যে কথা হয়। উইকিলিকস আরও বলেছে, ওই কথোপকথনে প্রকাশ পেয়েছে, জার্মানিতে রাশিয়ার হাজার হাজার পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন রয়েছে। এ অবস্থায় সেখানে মোতায়েন থাকা যুক্তরাষ্ট্রের ২০টি কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র একতরফাভাবে সরিয়ে আনা ঠিক হবে না। ওই তারবার্তায় আরও বলা হয়, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনও জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র সরিয়ে আনার বিষয়ে গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জার্মানি, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র প্রত্যাহার করা হলে তুরস্কে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের মজুদের নিরাপত্তাব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে যাবে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা প্রিন্স তুর্কি আল কাবির এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ডাচ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বৈঠকের বিষয়বস্তু উইকিলিস ফাঁস করে দেয়। সেখানে ওই কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে কথা বলেছেন। উইকিলিকস বলেছে, ওই বৈঠকে প্রিন্স তুর্কি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করলে উপসাগরীয় দেশগুলো হয় নিজেরা তা তৈরি করতে বাধ্য হবে, নয়তো ইরানের হুমকি থেকে বাঁচতে তারা বিদেশি শক্তিকে সেখানে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের অনুমতি দেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো বা স্থাপনা রয়েছে। ওই সব স্থাপনা যে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ওপর তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়বে। এ রকম স্থাপনাগুলোর একটি তালিকাও রয়েছে তাদের। সর্বশেষ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত মার্কিন কূটনৈতিক মিশনগুলোকে ওই তালিকা হালনাগাদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অতি গুরুত্বপূর্ণ সেই তালিকাই এবার ফাঁস করে দিয়েছে উইকিলিকস। প্রকাশিত এ তালিকায় তেলের পাইপলাইন থেকে শুরু করে গুটি বসন্তের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানেরও নামও আছে। এ তালিকায় যোগাযোগের কেন্দ্রস্থল, গ্যাস পাইপলাইনের মতো কৌশলগত অবকাঠামো স্থান পেয়েছে। তালিকায় আরো আছে, পানামা খাল থেকে শুরু করে সাপে কাটার রুগীর চিকিৎসার ওষুধ উৎপাদনকারী ইতালি ও অস্ট্রেলীয় প্রতিষ্ঠান।
উইকিলিকসের এ পর্যন্ত ফাঁস করা গোপন নথি পত্রের মধ্যে এ তারবার্তাটিকেই সবচেয়ে বিতর্কিত নথি বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। যে স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার ওপর ‘তাৎক্ষণিক ও ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে’। তালিকায় ইউরোপের স্থাপনাগুলোর মধ্যে আছে জার্মানির রাসায়নিক কারখানা লুদভিগজহাফেন। একে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাসায়নিক কমপ্লেক্স হিসেবে বলা হয়। রাশিয়ার নাদিম গ্যাস পাইপলাইন জংশনকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্যাসক্ষেত্র’ বলে বর্ণনা করা হয়। কাতার সম্পর্কে বলা হয়, ২০১২ সাল নাগাদ দেশটি যুক্তরাষ্ট্রে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াবে। তালিকায় এমন শত শত স্থাপনার নাম আছে। এগুলোর মধ্যে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার খনি ও খনিজ সম্পদ, সাগরতলের পাইপলাইন ও তার, চীন ও জাপানের বন্দর, ফ্রান্সের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, মধ্যপ্রাচ্যের অপরিশোধিত তেল শোধনাগারের নামও আছে। পাশাপাশি আছে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাতা ও টেলিযোগাযোগ স্থাপনা, ভারতের ক্রোমাইট খনি, বাঁধ, কানাডার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ইত্যাদি। কানাডার এ প্রকল্প থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
উইকিলিকসের এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার তালিকা ফাঁসের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ব্রিটেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বলেন, ‘আমরা গোপন তথ্যের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রকাশের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। এটা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ অন্য দেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে’।
উইকিলিকস আরো জানায়, মার্কিন পররাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দপ্তর থেকে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোর কাছে সংশ্লিষ্ট দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও প্রধান সম্পদের তালিকা চেয়ে পাঠায়। তবে এ কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে পরামর্শ না করার জন্য বলা হয়।
জাতীয় অবকাঠামো প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার আওতায় এ তালিকা তৈরির অনুরোধ জানানো হয়।

বিশ্ব নেতাদের সম্পর্কে মার্কিন নেতাদের বিদ্রুপ

বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কে মার্কিন রাজনীতিবিদদের মূলায়ন ও বিরূপ মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে ফাঁস হয়ে যাওয়া উইকিলিকসের এসব দলিলপত্রে।
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে যারা ক্ষমতায় রেখেছে সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই কারজাইকে একজন বিপদজনক, মানসিক রোগী ও দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কার্ল একেনবেরি তার মধ্যে দু’ধরনের বৈশিষ্ট দেখেছেন। প্রথমত, কারজাই একজন মানসিক রোগী এবং দুর্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী যিনি একটি জাতি গঠনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি অক্ষম। দ্বিতীয়ত, কারজাই একজন ধূর্ত রাজনীতিবিদ এবং নিজেকে সবসময় জাতীয় নেতা মনে করেন। তিনি কখনো সত্য জানতে চান না। তবে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন যেকোনো গল্প বলে তাঁকে প্রভাবিত করা সম্ভব, তা যতই উদ্ভট হোক। একটি বার্তায় দেখা গেছে, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদকে নাৎসি বাহিনীর প্রধান এডলফ হিটলারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকোনি সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি শারীরিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল। আধুনিক ইউরোপীয় নেতা হিসেবে অক্ষম, ব্যর্থ ও নিষ্ক্রিয়। রাত জাগায় অভ্যস্ত এবং আমোদ-ফুর্তির পার্টির প্রতি ঝোঁক বেশি। ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকোনির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন মার্কিন কূটনীতিকেরা। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা কির্চনার মার্কিন কূটনৈতিকদের মতে অস্থির এবং আবেগী নেতা। তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে হিলারি ক্লিনটন জানতে চান, কির্চনার নিজেকে শান্ত রাখার জন্য কোনো ওষুধ খান কি না। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি একজন র্নিলজ্জ সম্রাট। তিনি যথেষ্ট সমালোচনা-কাতর এবং কর্তৃত্ববাদী ভাব ধরে থাকতে পছন্দ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ ‘অনিষ্টকর অক্ষচক্র’র মানুষ। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন সম্পর্কে মার্কিন কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল, তাঁর ‘ট্র্যাক রেকর্ড খুব বাজে’ এবং তিনি রাজনীতিতে ভুলের পর ভুল করে যাচ্ছেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একজন রুচিশীল ও মনোমুগ্ধর মানুষ; কিন্তু কখনো প্রতিশ্রুতি রাখেন না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ হলো প্রধানমন্ত্রি পুতিনের পুতুল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন হলো নেকড়ে দলের প্রধান সর্দার। তিনি রাশিয়াতে ব্যাটম্যানের ভূমিকা পালন করছেন। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং ইল একজন নিস্তেজ বুড়ো। জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে একটা পাগল বুড়ো। প্রকাশ্যে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী বলে অভিহিত করলেও মার্কিন কূটনীতিকরা তাঁদের গোপন বার্তায় ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহ ‘উদ্ভট ও বিরক্তিকর’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেলের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তিনি খুবই সৃজনশীল। তবে ঝুঁকি নিতে একদমই পছন্দ করেন না তিনি।
লিবিয়ার প্রবীণ নেতা মুয়াম্মের গাদ্দাফি সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি একজন অদ্ভুত মানুষ। পানির ওপর দিয়ে তিনি বিমানে চড়তে ভয় পান। হোটেলের এক তলা ছাড়া অন্য কোনো তলা তাঁর ভীষণ অপছন্দের। কোথাও গেলে তাঁর বিশ্বস্ত ইন্দ্রিয় সুখকর সোনালি চুলের ইউক্রেনিয়ান সেবিকাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে কখনোই ভুল হয় না তাঁর।

সৌদি আরব :

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থামাতে সে দেশে হামলা করে সব পরমাণু স্থাপনা গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি একাধিকবার আহ্বান জানিয়েছে বলে উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মার্কিন দূতাবাসের পাঠানো তারবার্তা থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। উইকিলিসের তথ্য থেকে জানা যায় যে সব আরব দেশ ইরানের ওপর হামলার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, জর্দান, মিশর ,বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এসব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছে ‘যে কোন মূল্যে’ ইরানে হামলা চালানোর জন্য। যুক্তরাষ্ট্র, আরব অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ ও ইসরায়েলের সন্দেহ, তেহরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে। ২০০৮ সালে মার্কিন জেনারেল ডেভিড পেট্রাউসের সঙ্গে বাদশাহ আবদুল্লাহর একটি বৈঠকের উল্লেখ করে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত আদেল আল-জুবায়ের বলেন, ‘বাদশাহ আবদুল্লাহর আমেরিকান উদ্দেশে সাপের মাথা কেটে ফেলার কথা বলেছেন।’

পাকিস্তান :

পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এ্যানা পিটারসন, তিনি বিভিন্ন সময়ে ওয়াশিংটনে যে সব তার বার্তা পাঠিয়েছেন তার এক বড় অংশই ফাঁস করে দিয়েছে উইকিলিস। ওয়েবসাইটটি জানাচ্ছে, ভারতে মুম্বাই হামলার পর তার সাথে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি এই গোপন বৈঠক ডেকেছিলেন। তিনি এই বৈঠকে মুম্বাই হামলার তদন্তে পাকিস্তানের পরবর্তি পদক্ষেপ কি হতে পারে সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। বৈঠকে তিনি পিটারসনকে জানিয়েছেন, কোন বিদেশী শক্তিকে তিনি তার দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে দেবেন না।
তিনি আরো বলেন, নয়া দিল্লি পাকিস্তানের ভূখণ্ডে হামলার পরিকল্পনা করলে ইসলামাদের কাছে একমাত্র উপায় থাকবে সামরিক পন্থায় মোকাবিলা করা। ওই বৈঠকে জারদারি বলেন, ভারত-মার্কিন পরমানু চুক্তিতে পাকিস্তান কোন বিরোধীতা করেনি তার একমাত্র কারন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা একটি মাত্র ফোন কল। পিটারসনের পাঠানো বার্তায় আরো জানা যায়, ২০০১ সাল থেকে সন্ত্রাস দমনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ১৬০০ কোটি ডলার দিয়েছে। অথছ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও আইএসআই দীর্ঘদিন ধরে চারটি জঙ্গি গোষ্ঠিকে সহায়তা করে আসছে। এমনকি পাকিস্তানের শীর্ষ নেতারা তাকে এটাও জানিয়েছে কোন রকম অর্থ সাহায্যের বিনিমনে এই চার জঙ্গি গোষ্ঠিকে সাহায্য দেয়া থেকে পিছিয়ে আসবে না পাকিস্তান। পিটারসন আরো জানাচ্ছেন, ভারতের সাথে ক্রমবর্ধমান মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে ওয়াশিংটনকে আরো ভাবতে হবে। কারন ভারত-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতি পাকিস্তানকে আরো বেশী করে সন্ত্রাসের দিকে ঝুকে পড়তে বাধ্য করছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত তো এই সন্দেহও প্রকাশ করেছেন যে পাকিস্তানে মার্কিন সহায়তা বাড়ানো হলেও তাতে ইসলামাবাদের জঙ্গী দমনের কার্যকারিতা আদৌ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে হয় না। মার্কিন কূটনৈতিক দলিলে দেখা গেছে পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের উদ্বেগ প্রকাশ হয়েছে অনেক বেশি। আর এর সব কিছুর মূলে আছে পাকিস্তানের পরমাণু সরঞ্জাম জঙ্গিদের হাতে পড়ার প্রবল আশঙ্কা। এছাড়াও পরমাণু অস্ত্রধর একটি দেশ হিসেবে পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা এবং পশ্চিমী দেশগুলোর মিত্র হিসেবে তার নির্ভরযোগ্যতা।পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যানে প্যাটারসন ওয়াশিংটনকে জানান, ‘ইসলামি জঙ্গিরা পাকিস্তানি পরমাণু অস্ত্র লুট করবে এটি প্রধান উদ্বেগ নয়, তার চেয়ে গুরুতর বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তান সরকারের মধ্যে থাকা কেউ কেউ অস্ত্র বানানোর মতো উপকরণ পাচার করে দিতে পারে, আর এটাই উদ্বেগের বিষয়।” দেশের ভেতর অস্থিতিশীলতা ক্রমশ বাড়তে থাকলেও পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্রের মজুদ ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে বলে উল্লেখ করা হয় বছর কয়েক আগের একটি বার্তায়। বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত অ্যান ডাবি্লউ প্যাটারসনের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। যদিও ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা একবার সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, পাকিস্তানের পরমাণু সরঞ্জাম ‘জঙ্গিদের হাতে পড়বে না’। ওবামার আশ্বাসের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাটারসন একটি তার বার্তায় জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি তীব্র আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। ২০০৯ সালের ২৭ মে ওয়াশিংটনে পাঠানো এক বার্তায় প্যাটারসন বলেন, পরমাণু সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে দুই বছর আগে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে চুক্তি হয়, তা থেকে আবারো সরে যেতে চাচ্ছে ইসলামাবাদ। তিনি লেখেন, কোনোভাবে বিষয়টি গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ পেলে তারা বলবে, ‘যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছে’। এই দলিলে আরো দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি প্রেসিডেন্ট জারদারিকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে বা হত্যা করে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করছেন বলে একবার আশঙ্কা প্রকাশ করেন প্যাটারসন। কায়ানি ২০০৯ সালের মার্চে এক বৈঠকে প্যাটারসনকে বলেন, তিনি ‘হয়তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও’ পদত্যাগের ব্যাপারে জারদারিকে চাপ দেবেন। বার্তায় উল্লেখ করা হয়, জারদারির উত্তরসূরি হিসেবে জেনারেল কায়ানি মুসলিম লিগের নওয়াজ শরিফ নন বরং আওয়ামী ন্যাশনাল লীগ পার্টির আসফানদিয়ার ওয়ালি খানকে সমর্থন করতে পারেন।প্রেসিডেন্ট জারদারি মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে গত বছর জানান, কায়ানি তাঁকে হত্যা করতে পারেন এমন আশঙ্কা তাঁর মধ্যে প্রবলভাবে ছিল। তিনি তাঁর ছেলে বিলাওয়ালকে বলেছেন, তাঁকে হত্যা করা হলে তাঁর বড় মেয়ে ফারিয়াল তালপুর হবেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। ফাঁস হওয়া এক বার্তায় বলা হয়, জারদারি নিহত হতে পারেন এমন আশঙ্কায় পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন। আরেকটি বার্তায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সামনে জারদারি খোলামেলাভাবেই স্বীকার করেন, ‘দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, তালেবানবিরোধী যুদ্ধে আমরা জিততে পারছি না’। পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী আদিবাসী এলাকাগুলোতে আল-কায়েদা ও তালেবান সদস্য নির্মূলে যুক্তরাষ্ট্রের চালকবিহীন গোয়েন্দা বিমান বা ড্রোন হামলার ব্যাপারে পাকিস্তানের নেতাদের অনুমোদন রয়েছে। ফাঁস হয়ে যাওয়া বার্তায় রাষ্ট্রদূত প্যাটারসন লেখেন, ‘পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মালিক বলেছেন, বাজাউরের অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত ড্রোন হামলা বন্ধ রাখতে পারি আমরা’। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলেন, সঠিক লোকগুলোকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তারা যদি অভিযান অব্যাহত রাখে আমি কিছু মনে করব না। আমরা জাতীয় পরিষদে এর প্রতিবাদ করব, তারপর ভুলে যাব।পাকিস্তান থেকে পাঠানো বার্তাগুলোতে আফগান তালেবানের প্রতি দেশটির সমর্থন, আল-কায়েদার প্রতি সহনশীলতা, অস্থিতিশীলতা, একটি অজনপ্রিয় নির্বাচিত সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার মার্কিন প্রচেষ্টাসহ বহু চিত্রই ফুটে উঠেছে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্যে জানা গেছে, পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার পরও বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে দ্রুত গতিতে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে।

আফগানিস্তান :

আফগানিস্তানে নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনাদের কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান প্রশাসন। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজায় ও যুক্তরাষ্ট্রের কুটনৈতিক মহল মনে করে যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বা যথেস্ট মান সম্মত ভূমিকা পালন করতে পারেনি। উইকিলিসের ফাঁস করে দেয়া দলিলপত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তারা তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি বলে উপহাস করেছে হামিদ কারজায় ও সে দেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তালেবানদের শক্ত ঘাঁটি দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমন্দ প্রদেশে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সেনারা হেলমান্দ প্রদেশে এককভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। হেলমান্দ প্রদেশে শান্তি রক্ষা এবং মাদক চোরাচালান রোধে তাদের ব্যার্থতায় হামিদ কারজায় ও সে দেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত উদ্বেগ প্রকাশ করে। ২০০৮ সালে কাবুলের মার্কিন দূতাবাস থেকে সে দেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পাঠানো এক বার্তায় উল্লেখ করা হয়, আমি ও কারজায় একমত ছিলাম যে বৃটিশ বাহিনী হেলমন্দ প্রদেশে যথেস্ট অনুপযুক্ত, এবং তারা পরিস্থিতি গুলিয়ে ফেলেছে। ফেব্রয়ারি ২০০৯ সালে তার পাঠানো অপর এক তার বার্তায় তিনি জানিয়েছেন, হামিদ কারজায় তাকে বলেছিল বৃটিশ বাহিনী হেলমন্দ প্রদেশের আইন শৃ্ঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটিয়েছে। যখন আমি আফগানিস্তানে ফিরে আসি তখন আমার সাথে মাত্র ১৪জন মার্কিন সেনা ছিল। হেলমন্দ প্রদেশটি শান্ত শিস্ট ছিল, সেখানে মেয়েরা নিরাপদে স্কুলে যেতে পারতো। কিন্তৃ বৃটিশরা হেলমন্দের দায়িত্ব নেবার পর থেকে থেকে এটি আর নিরাপদ ছিল না, হামিদ কারজায়ের এ মন্তব্য ফাঁস করে দেয় উইকিলিস। ২০০৭-২০০৮ সালে আফগানিস্তানে নিযুক্ত ন্যাটো বাহিনীর প্রধান জেনারেল ড্যান ম্যাকনিলকে যুক্তরাষ্ট্রের মাদক নিয়ন্ত্রণ অফিসার রিপোর্ট করেন, হেলমন্দে নিযুক্ত বৃটিশ বাহিনীর কৌশল সম্পূর্ণ ভুল ছিল। সেখানে মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিতে ব্রিটিশ সেনারা ব্যার্থ হয়েছিল। হেলমন্দের গর্ভরন গালিব মঙ্গল যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসকে ‘বৃটিশ বাহিনী তার প্রদেশের পরিস্থিতি গুলিয়ে ফেলেছে’। বলে মন্তব্য করেন। আফগান সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের দূর্নীতির বিষয়টিও ফুটে উঠেছে উইকিলিসের ফাঁকরা দলিলপত্রে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, আফগান সরকারের দুর্নীতির বিষয়টি তাঁদের চোখের সামনেই ঘটছে। দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট জিয়া মাসুদ নগদ পাঁচ কোটি ২০ লাখ ডলার নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যান। ফাঁস হওয়া বার্তায় আরো জানা যায়, প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজায়ের সৎভাই ও কান্দাহারের প্রাদেশিক পরিষদের নেতা আহমাদ ওয়ালি কারজাই দুর্নীতি ও মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। তাঁর মতো সরকারের বহু শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এসব কাজে জড়িত জেনেও কারজাই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। অন্য নথিতে দেখা গেছে, কাবুলে মার্কিন প্রতিনিধি কার্ল একেনবেরি প্রেসিডেন্ট কারজাইকে ‘দিশেহারা’ ও ‘দুর্বল’ রাষ্ট্রনায়ক বলে আখ্যা দেন। তিনি মনে করেন যে রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক ও মৌলিক নীতি অনুসরণের জন্য যে সক্ষমতা ও আদর্শিক শক্তি থাকা দরকার, কারজাইয়ের তা নেই। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই মানসিক বৈকল্যে ভুগছেন।

ভারত :

ভারতের সেনা প্রধান জেনারেল ভি. কে. সিং বলেছেন, নয়াদিল্লির সামনে ‘কোল্ড স্টার্ট’ নামের কোন সামরিক মতবাদ নেই, ভারতীয় সরকারি বার্তা সংস্থা পিটিআইকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি এ কথা বলেছেন। নাইন ইলেভেনের পর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তান সম্পর্কে এ ধরনের মতবাদ সামনে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এ বিষয়ে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত টিমোথি রোয়েমারের একটি পর্যালোচনা তুলে ধরেছে উইকিলিক্স ওয়েবসাইট। রোয়েমারের উদ্ধৃতি দিয়ে উইকিলিক্সের প্রকাশ করা তথ্যের প্রতিক্রিয়ায় জেনারেল সিং পিটিআইকে এ সব কথা বলেছেন। উইকিলিক্সের নথিপত্রে ভারতীয় বাহিনীকে ‘ধীরগতিসম্পন্ন এবং খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। জেনারেল ভি কে সিং উইকিলিক্সের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, কোনো দেশের সেনাবাহিনীই শতকরা একশ ভাগ আধুনিক হতে পারে না। জেনারেল সিং বলেন, যে কোনো দেশের সেনাবাহিনীতে শতকরা ৩০ ভাগ পুরনো অস্ত্র ও সরঞ্জমাদি থাকাটা অবাস্তব নয়। এ ছাড়া, ৩০ থেকে ৪০ ভাগ আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ায় থাকে এবং বাকি ৩০ থেকে ৪০ ভাগ তাকে সম্পূর্ণ আধুনিক। তিনি বলেন, ভারতের মতো একটা বড় দেশে সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে আধুনিক করতে সময়ের দরকার। তবে, ভারতীয় সেনাবাহিনী তার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে এখনও সক্ষম বলে দাবি করেন জেনারেল ভি. কে. সিং।

নেপাল:

হইচই ফেলে দেওয়া ওয়েবসাইট উইকিলিকস নেপাল নিয়েও দুই সহস্রাধিক গোপন নথি ফাঁস করেছে। দেশটির ১০ বছরের ধরে চলা মাওবাদী বিদ্রোহ, রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে উত্তরণ ইত্যাদির এসব বার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে। হিমালয়ের এই জাতিটি অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় ফাঁস হওয়া নথির পর্যবেক্ষণ করছে। সন্ত্রাসবাদী, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চুক্তির বিষয়ে উইকিলিকসের কাছে দুই হাজার দুইশ ৭৮টি নথি হস্তগত হয়। নথিগুলো ১৯৯৬ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রয়ারি পর্যন্ত কাঠমাণ্ডুর মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছিল। নথিগুলো মূলত মাওবাদী বিদ্রোহ, সামরিক অভুত্থানের মাধ্যমে রাজা জ্ঞানেন্দ্রর মতা কুক্ষীগত করে রাখার
চেষ্টা ও দেশজুড়ে আন্দোলনের মুখে তার সরকারকে মতাচ্যুত করা সম্পর্কিত।

শ্রীলংকা :

শ্রীলংকায় সরকারী বাহিনীর সাথে তামিল গেরিলাদের গৃহযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে সরকারী বাহিনী তামিল জনগণের ওপর ব্যাপক গণহত্যা চালায়। শ্রীলংকায় অবস্থিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেরিসের ওয়াশিংটনে পাঠানো এ ধরনের বেশ কিছু গোপন বার্তা ফাঁস করে দিয়েছে উইকিলিস। সেদেশে অবস্থিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস বিশ্বাস করেন যে, আদিবাসী তামিল বিদ্রোহীদের ওপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছে তার সম্পূর্ণ দায় দায়িত্ব বহন করতে হবে প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ্রা রাজা পাকশেকে। প্রায় সাত হাজার তামিল বিদ্রোহীকে সরকারী বাহিনী হত্যা করে। বিউটেনিস ওয়াশিংটনে পাঠানো তার বার্তায় আরো উল্লেখ করেন, শ্রীলংকায় গণহত্যাসহ যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধীকার লংঘনের ঘটনার জন্য দায়ী থাকবে প্রেসিডেন্ট রাজা পাকশে, তার ভাই ও নিরাপত্তা সচিব গোতাবায়া রাজাপাকশে এবং সাবেক জেনারেল ও বর্তমান বিরোধী দলের নেতা ফনসেকা। তিনি আরো বলেন, যুদ্ধের সময় ও পরবর্তিতে সরকারী বাহিনী অসংখ্য তামিল গেরিলাদের গ্রেপ্তার করে কিন্তু তাদের পূর্ণবাসনে বা বিচার আন্তর্জাতিক মান সম্মত হয়েছে কিনা তা পরিস্কার নয়। এছাড়াও প্রেসিডেন্ট রাজা পাকশে তার সেনাবাহিনী বিরুদ্ধে ওঠা গণহত্যার অভিযোগ তদন্তে নিদের্শ দেন। কোন সরকার তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এমন তদন্তের নিদের্শ দিয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। মূলত উইকিলিসের ফাঁসকৃত এই তার বার্তাগুলো থেকে শ্রীলংকার গণহত্যার বিষয়ে মার্কিন প্রশাসন যে অবগত ছিল তা বোঝা যায়, কিন্তু সরকারী বাহিনীর এই গণহত্যা বন্ধে তারা কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

বাংলাদেশ :

উইকিলিকস যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে যে সব তার বার্তা ফাঁস করেছে তার মধ্যে রয়েছে দুই হাজার ১৮২টি বাংলাদেশ বিষয়ক। এছাড়া প্যারিস ও ইসলামাবাদ থেকে পাঠানো চারটি নথিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে। প্রকাশিত নথিগুলির সবই বাংলাদেশে জঙ্গি তত্পরতা বিষয়ক। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো এক তার বার্তায় উল্লেখ রয়েছে, সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা, ডিজিএফআই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী বা হুজিকে জাতীয় রাজনীতির মূল ধারায় আনতে চেয়েছিল। এ লক্ষ্যে ডিজিএফআই ও হুজির কয়েকজন সিনিয়র নেতাদের উদ্যোগে গঠিত হয় ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (আইডিপি)। তবে ডিজিএফআইয়ের এই উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। শুধু মার্কিন দূতাবাসই নয় এর বিরোধীতা করে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসআই)। তাদের যুক্তি ছিল হুজিকে এই সুযোগ দেয়া হলে প্রকাশ্য রাজনীতির আড়ালে তারা জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটাবে। কিন্তু তার পরও ডিজিএফআই ও হুজির জ্যেষ্ঠ নেতারা আইডিপি নামে নতুন এক রাজনৈতিক দল গঠন করে।

ইরান :

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেই মারাত্মক ক্যান্সারে আক্রান্ত৷ আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যেতে পারেন তিনি৷ ইরান সম্পর্কে এরকমই এক মার্কিন গোপন বার্তা পাওয়া গেছে উইকিলিসের দলিলপত্রে৷ ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে ইস্তানবুলের মার্কিন কনস্যুলেট থেকে এই বার্তা পাঠানো হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে৷

ইরাক :

প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল। ফাঁসি কার্যকরের মুহূর্তে কারারক্ষীরা সাদ্দাম হোসেনকে তীব্র কটাক্ষ করেছে। সাদ্দামের উদ্দেশে তাঁরা ‘নরকে যাও’ বলে মন্তব্য করে।
উইকিলিকসে প্রকাশিত গোপন মার্কিন তারবার্তা থেকে ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি সম্পর্কে এ তথ্য জানা গেছে। প্রকাশিত দলিলে আরো দেখা গেছে, সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসির সময় বাইরের লোকজনের উপস্থিতি নিষিদ্ধ থাকলেও সেখানে অন্তত ২০ থেকে ৩০ জন উপস্থিত ছিল। তাঁরা সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কার্যকরের দৃশ্য মোবাইলের ক্যামেরায় ধারণ করে। পরে ধারণকৃত ফাঁসির দৃশ্য ইন্টারনেটে ছাড়া হয়। সেখানেও দেখা যায়, সাদ্দামের ফাঁসি কার্যকরের আগে ও কার্যকরের মুহূর্তে তাঁকে তিরস্কার করছেন উপস্থিত লোকজন। উইকিলিকসের ফাঁস করা একটি বার্তায় দেখা যায়, এ অবস্থায় ইরাকে নিযুক্ত তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত জালমেই খলিলজাদ আশঙ্কা প্রকাশ করেন, সাদ্দাম হোসেনের নিরপেক্ষ বিচার নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর সমর্থকেরা ফাঁসির সময়কার এই বাজে পরিবেশকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করতে পারেন। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কার্যকর হয়। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তাঁর ফাঁসি কার্যকরের দৃশ্য ইন্টারনেটে প্রকাশ পায়। উইকিলিকসে প্রকাশিত একটি বার্তা অনুযায়ী, মার্কিন রাষ্ট্রদূত খলিলজাদের সঙ্গে এক বৈঠকে ইরাকের ডেপুটি কৌঁসুলি মনকিথ আল-ফারুন বলেন, সাদ্দামকে পাহারা দিয়ে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার সময় একজন কারারক্ষী তাঁকে ভর্ৎসনা করে বলেন, ‘নরকে যাও’। কৌঁসুলি ফারুন আরও বলেন, ফাঁসি কার্যকরের স্থানে মোবাইলের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কার্যকরের সময় সেখানে উপস্থিত অনেক কর্মকর্তা মুঠোফোনের ক্যামেরায় এই দৃশ্য ধারণ করেন। তিনি বলেন, ফাঁসির আগে সাদ্দাম হোসেন নামাজ পড়েন। এ সময় সেখানে উপস্থিত এক ব্যক্তি বলেন, ‘মুকতাদা, মুকতাদা, মুকতাদা’। এমনকি সাদ্দামের ফাঁসি কার্যকরের অন্তিম মুহূর্তেও ফাঁসি কার্যকরের দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যদের কয়েকজন ‘মুকতাদা, মুকতাদা, মুকতাদা’ বলে ওঠেন। প্রসঙ্গত, সাদ্দাম হোসেনের শাসনের পতনের পর শিয়া ধর্মীয় নেতা মুকতাদা আল-সদর ইরাকের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন।
নাম প্রকাশ না করে গোপন একটি বার্তার বক্তাকে বরাত দিয়ে উইকিলিকস জানায়, সাদ্দামের ফাঁসি কার্যকরের সময় সেখানে উপস্থিত কর্মকর্তাদের তালিকা বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হয়। শেষ পর্যন্ত সেখানে ২০ থেকে ৩০ জন কর্মকর্তা হাজির হন। অথচ আইন অনুযায়ী শুধু একজন কৌঁসুলি, একজন বিচারক, একজন ধর্মীয় নেতা ও কারা পরিচালকের সেখানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল।

ইসরায়েল :

২০০৮ সালের শেষের দিকে গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে আক্রমণের সময় মিশর এবং ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ইসরায়েল৷ ইসরায়েল চেয়েছিল হামাসকে পরাস্ত করার পর গাজার ক্ষমতা ফাতাহ কিংবা মিশরের হাতে তুলে দিতে৷ কিন্তু উভয়পক্ষই এবিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। তেল আবিবে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস এই খবরটি ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছিল। এক বার্তায় মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়াই ইরানে হামলা চালানোর সামর্থ্য রাখে ইসরায়েল। তবে এককভাবে এই হামলা চালালে তা সফল নাও হতে পারে।

উত্তর কোরিয়ার:

বিদেশে কর্মরত উত্তর কোরিয়ার বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে যোগ দিয়েছেন বলে উইকিলিকসের ফাঁস করা গোপন তথ্যে জানা গেছে।দক্ষিণ কোরিয়ায় নিযুক্ত ক্যাথলিন স্টিফেন্সের মার্কিন রাষ্ট্রদূত গত জানুয়ারিতে এই তথ্যসংবলিত তারবার্তাটি ওয়াশিংটনে পাঠান। এতে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, বিদেশে কর্মরত ওই কর্মকর্তাদের স্বপক্ষ ত্যাগের খবর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। ওই তারবার্তায় জানানো হয়, দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ মিয়ুং-হোয়ান বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং ইলের কাছ থেকে তাঁর ছেলে কিম জং উনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সহজ হচ্ছে না। দল ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্থান থেকে এর বিরোধীতা আসছে। এমনটি কিম জং ইলের বড় ছেলে পর্যন্ত ছোট ভাই উনের কাছে রাষ্ট্র ক্ষমা হস্তান্তরের বিরোধীতা করেছে। এছাড়া দেশটির মুদ্রাব্যবস্থার সাম্প্রতিক সংস্কারও কমিউনিস্ট শাসকগোষ্ঠীর জন্য বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করেছে। বিদেশে কর্মরত উত্তর কোরিয়ার বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইতিমধ্যে স্বপক্ষ ত্যাগ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইরান উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্টে আঘাত করতে সক্ষম এমন মিসাইলের সরবরাহ পেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মার্কিন প্রশাসনকে জানিয়েছে উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার প্রযুক্তিতে নির্মিত আর-২৭ মিসাইল ও এর প্রযুক্তি ইরানকে সরবরাহ করতে পারে। এই প্রযুক্তি দিয়ে পারমানবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম এমন নতুন প্রযুক্তির মিসাইল বানানো সম্ভব। রাশিয়ার এই প্রযুক্তি দিয়ে উত্তর কোরিয়া পারমানবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম বিএম-২৫ মিসাইল তৈরী করেছে। ইরান এমন ১৯টি মিসাইল উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারে যার পাল্লা তিন হাজার কিলোমিটার। রাষ্ট্রদূত তার বার্তায় আরো জানাচ্ছেন, শুধু বিএম-২৫ মিসাইল নয়, ইরান আরো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মিসাইল নির্মানের প্রযুক্তি সংগ্রহ করতে পারে।

মাফিয়া রাষ্ট্র :

রাশিয়া, বেলারুশ ও চেচনিয়া পরিস্কারভাবে একটি মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে একজন সিনিয়র স্প্যানিস কৌসুলি জোসে গনজলেস এ মন্তব্য করেন। গনজালেস গত এক দশক ধরে স্পেনে রাশিয়ার সংগঠিত গোয়েন্দা তত্পরতা ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠিদের কাজ নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছেন।গনজালেস আরো বলেন, দেশটির রাজনৈতিক দলগুলো মাফিয়া সন্ত্রাসী গোষ্ঠির সাথে খুব ঘনিষ্টভাবে অপরাধ মূলক কাজকর্ম করে থাকে। উইকিলিসের ফাঁস করা দলিলপত্রে এই তথ্য রয়েছে। উইকিলিস আরো জানিয়েছে, রাশিয়ার সরকার ও মাফিয়া সন্ত্রাসী গোষ্ঠির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। মাফিয়াদের সাথে রাজনীতিবিদদের সম্পর্কের কারনে তারা বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে।উইকিলিকসে প্রকাশিত ওই তথ্যে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনও এই মাফিয়া চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। মাদ্রিদের মার্কিন দূতাবাসের গোপন দলিলে বলা হয়েছে, পুতিন মাফিয়াদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং তাদের কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করেন। সাবেক রাশিয়ান সেক্রেটারি জেনারেল আলেকজান্ডার লিতভিনিকো যিনি ২০০৬ সালে খুন হয়েছিলেন। ওয়াশিংটনের ধারনা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন লিতভিনিকো হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে। কিন্তু তিনি এর কোন ব্যবস্থা নেননি। ২০০৯ সালে আটলান্টিক মহাসাগরে অস্ত্র বোঝায় একটি জাহাজ আটক করা হয়, যেটি ইরান থেকে অস্ত্র নিয়ে তুরস্কের দিকে যাচ্ছিল। উদ্দেশ্য ছিল, তুরস্কের কুর্দি বিদ্রোহীদের এই অস্ত্র সরবরাহ করা। তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এই অস্ত্র চালানের সাথে জড়িত।
আরেকটি তথ্যে দেখা গেছে, একজন প্রভাবশালী উকরাইনিয়ান ব্যবসায়ী রাশিয়ায় সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার কথা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের কাছে স্বীকার করেছেন। উইকিলিকসে প্রকাশিত গোপন মার্কিন দলিলের বরাত দিয়ে গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে স্পানিশ কৌশলী জোসে পিপি গ্রিনডা গঞ্জালেস অভিযোগ করেন, রাশিয়া, বেলারুশ ও চেচনিয়ার সরকার এবং সংগঠিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রমের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

ভেনিজুয়েলা :

যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ ‘অনিষ্টকর অক্ষচক্র’র মানুষ, উইকিলিকসের প্রকাশিত তার বার্তায় হুগো শ্যাভেজ সম্পর্কে মার্কিন কূটনেতিকদের এই মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। অন্য একটি বার্তায় ইরানের সঙ্গে ভেনেজুয়েলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে এবং দেশটিতে ইহুদিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা জানা গেছে। এছাড়াও ভেনেজুয়েলায় কিউবার ভূমিকা নিয়েও উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। কারাকাসে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো এক গোপন বার্তা ফাঁস করে উইকিলিকস একথা জানিয়েছে। কারাকাস থেকে পাঠানো একটি বার্তায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী ভেনেজুয়েলার গোয়েন্দা সংস্থাকে অনেক লাভজনক প্রস্তাব দেয় কিউবার গোয়েন্দা সংস্থা। ওই দুই দেশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে কারাকাসে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলেন, কিউবা ও ভেনেজুয়েলা অনিষ্টকর অক্ষচক্র। গত ১২ বছর ধরে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শ্যাভেজ কিউবার বিপ্লবী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো ও তার ভাই বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেছেন। ভেনেজুয়েলায় হাজার হাজার কিউবান ডাক্তার চিকিৎসা সেবা দেয়। আর বিনিময়ে কিউবাকে কম মূল্যে তেল সরবরাহ করে ভেনেজুয়েলা। এদিকে, মার্কিন দলিলপত্র ফাঁস করার জন্য উইকিলিসকে অভিনন্দন জানিয়েছে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ। তিনি মার্কিন পরারষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটনকে পদত্যাগের আহ্বান। শ্যাভেজ বলেন, ‘এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রনীতির পুরো কাঠামো নগ্ন হয়ে পড়েছে। হিলারির অবশ্যই পদত্যাগ করা উচিত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যান্যদের নিয়ে পদত্যাগ করাই এখন একমাত্র পথ।’

ইয়েমেন :

ইয়েমেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি গোপন সামরিক চুক্তির বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে উইকিলিকসের ফাঁস করে দেয়া বার্তায়। এসব বার্তায় দেখা যাচ্ছে, ইয়েমেনে আল-কায়েদার বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে যুক্তরাষ্ট্র বিমান হামলা চালাবে কিন্তু এর দায়িত্ব বহন করবে ইয়েমেন সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতেই দেশটির বিভিন্ন আল-কায়েদা ঘাঁটিতে সরাসরি হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে প্রকাশ্যে এসব হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করতেন না সালেহ। দেশবাসীর কাছে এসব হামলাকে তিনি ইয়েমেনি বাহিনীর অভিযান বলে তুলে ধরতেন। এমনকি পার্লামেন্টেও তিনি বিষয়টি নিয়ে মিথ্যা কথা বলেন। ইয়েমেনের রাজধানী সানা থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো মার্কিন কূটনীতিকদের বার্তায় দেখা যায়, আল-কায়েদা বিরোধী অভিযান নিয়ে অতিমাত্রায় উৎসাহী ছিলেন সালেহ। মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি ইয়েমেনের আল-কায়েদা দমনের গুরুত্ব তুলে ধরতেন এবং তাদের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান শুরুর অনুরোধ জানাতেন। তবে এর বদলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন সুবিধা চাইতেন তিনি। চাহিদামতো সুবিধা না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন সালেহ। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকের বরাত দিয়ে কূটনীতিকদের বার্তায় বলা হয়, জঙ্গি তৎপরতা বাড়ার কারণে সালেহ ইয়েমেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে দেশটিতে সোমালিয়ার পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা করছেন তিনি। আরেক বার্তায় দেখা যায়, সালেহ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সহকারী উপদেষ্টা জন ব্রেনানকে বলেন, ‘আপনাদের জন্য দরজা খোলা রেখেছি’।
গত ২০০৯ সালের শেষ ও ১০ সালের জানুয়ারি মাসের দিকে সালেহর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক কমান্ডার জেনারেল ডেভিড পেট্রাউসের সঙ্গে এক বৈঠকে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহ বলেন, ‘আল-কায়েদা ব্যাধি দূর হওয়া পর্যন্ত আপনারা হামলা চালান। আর আমরা বলতে থাকব যে আমরাই এ হামলা চালাচ্ছি, আপনারা নন’। ‘আমরা সব সময়ই বলব, এসব বোমা হামলা আমরাই চালিয়েছি, যুক্তরাষ্ট্র নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কাজ হচ্ছে না, আপনারা সরাসরি বিমান হামলা চালান।‘
যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সচিব রর্বাট গেটস আল কায়েদা হামলা মোকাবেলায় ইয়েমেনের নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়ে আগ্রহের বিষয়টিও প্রকাশ হয়ে গেছে।

মিয়ানমার :

উত্তর কোরিয়ার সাহায্য নিয়ে মিয়ানমার ক্ষেপণাস্ত্র এবং পরমাণু স্থাপনা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য দেশটির দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গলে তারা গোপনে পরমানু স্থাপনা নির্মাণ করছে। উইকিলিকসের ফাঁস করে দেয়া মার্কিন গোপন তার বার্তা থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
ওই বার্তায় বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়ার প্রযুক্তি ও পরমানু বিজ্ঞানীদের সহায়তায় মিয়ানমার দুর্গম বনাঞ্চলে মাটির নিচে একটি বাঙ্কার তৈরি করেছে। এখানে মিয়ানমার পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার চেষ্টা করছে। ওই বার্তায় বলা হয়েছে, বিদেশি ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানীরা ৬ বছর ধরে ওই বাঙ্কারে আসছেন। এটি ভূমি থেকে মাটির নিচে ও উপরে ৫০০ ফুট লম্বা। কংক্রিকেটের এ স্থাপনা নির্মাণে মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়ার ৩শ’র বেশি শ্রমিক কাজ করেছে। তবে মিয়ানমার এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।২০০৪ সালের আগস্টে মিয়ানমারের এক প্রকৌশলীর বরাত দিয়ে ওই দলিলে বলা হয়, মধ্য মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের মিনবু শহরে ভূমি থেকে আকাশে উৎপেণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করার কাজ চলছে। একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইয়াঙ্গুনে মার্কিন দূতাবাসকে জানান, তিনি একটি পরমাণু স্থাপনা তৈরির কথা শুনেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মিয়ানমার পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য গোপনে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছে।

চীন :

চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের ওয়াশিংটনে পাঠানো তারবার্তায় চীন সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। উইকিলিস এসব বার্তাগুলো ফাঁস করে দেয়।চীন সরকারের ইন্টানেট সার্চ ইন্জিন গুগলে হ্যাক করা সম্পর্কিত তথ্য, উত্তর কোরিয়ার আকস্মিক পতনের মধ্য দিয়ে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণ ইত্যাদি বিষয়েও প্রচুর গোপন তথ্য প্রকাশ পেয়েছে উইকিলিসের প্রকাশিত তার বার্তাগুলিতে। চীনা নেতৃত্ব ব্যাক্তিগতভাবে প্রত্যাশা করেন দুই কোরিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাক। তবে তারা উত্তর কোরিয়া ভেঙে যাক তা চান না। কাজাকাস্তানে অবস্থিত চীনের রাষ্ট্রদূত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে একথা জানিয়েছিলেন। তাদের কথায় আরো জানা যায়, কোরিয়ার নেতা কিম জং ইল তার কনিষ্ট ছেলে কিম জং উনকে রাষ্ট্র প্রধান করতে চাইলেও বিষয়টি এতো সহজে হচ্ছে না। দক্ষিণ কোরিয়ার সহ পররাষ্ট্রমন্ত্রি সেদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছেন, দুইজন উচ্চ পদস্থ চীনা অফিসার তাকে জানিয়েছে উত্তর কোরিয়ার নেতৃত্বে দুই কোরিয়া এক হয়ে যাক এটা চীন প্রত্যাশা করে।ফাঁস হয়ে যাওয়া বার্তায় আরো জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে গুগল সার্চ ইন্জিন ও পশ্চিমা সরকারগুলোর ওয়েবসাইটে চীন হামলার চেষ্টা করছে। সাইবার হামলা চালানোর জন্য চীনা সরকার হ্যাকারদের সাথে যোগাযোগ করেছে। চীনে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন ‘একটি চীনা সূত্র’ থেকে তিনি এই তথ্য পেয়েছেন। উইকিলিসের ফাঁস করে দেয়া ২০০৯ সালের মার্চে মাসের আরেক তারবার্তায় দেখা যায়, অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনকে অন্তর্ভুক্ত করে তাকে বৃহত্তর দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিতে হবে। তবে আমাদের সব চেষ্টা যদি ব্যার্থ হয় তাহলে চীনের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের প্রস্তুতিও রাখতে হবে। তবে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী রাড বলেন, চীনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে এবং ফাঁস হয়ে যাওয়া তারবার্তা নিয়ে চীনা নেতাদের সঙ্গে কথা বলার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই। গুগল হ্যাকিংয়ে চীনের শীর্ষ নেতৃত্ব জড়িত গত জানুয়ারিতে সার্চ ইঞ্জিন গুগলের ওয়েবসাইটে যে আক্রমণ চালানো হয়, তার পেছনে চীনের শীর্ষপর্যায়ের নেতারা জড়িত ছিলেন। মার্কিন গোপন কূটনৈতিক নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। বেইজিংয়ে মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো গোপন বার্তায় বলা হয়, চীন সরকারের একটি সূত্র মার্কিন কূটনীতিককে জানিয়েছেন, গত বছরের শেষভাগে গুগল ইনকরপোরেশনের ওয়েবসাইটে চালানো আক্রমণ সমন্বয় করেছিল চীন সরকার। তবে এই বার্তার বিস্তারিত তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। চীনের শীর্ষস্থানীয় নেতা লি চ্যাংচুন ও নিরাপত্তাবিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা ঝো ইয়োংকাং গুগলের ওয়েবসাইটে হ্যাকিং করার বিষয়টি দেখভাল করেন।

বৃটেন :

উইকিলিকস ওয়েবসাইটে ফাঁস করে দেয়া গোপন মার্কিন তার বার্তা থেকে জানা গেছে, সন্ত্রাস দমনসহ নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করলেও ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের সমালোচনায় পিছিয়ে নেই ওয়াশিংটন। তাদের সমালোচনা থেকে বাদ যাননি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও।
সাইপ্রাসের আক্রোতিরিতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি থেকে গোয়েন্দা ফ্লাইট পরিচালনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। তুরস্ক, লেবানন ও উত্তর ইরাকে জঙ্গিদের অনুসন্ধান ও তাদের গতিবিধির ওপর নজরদারির জন্য মার্কিন কর্তৃপক্ষ ইউ টু বিমানের মাধ্যমে যে গুপ্তচরবৃত্তি করেছে, তা নিয়ে যুক্তরাজ্য সুনির্দিষ্টভাবে আপত্তি করে। ওই গোয়েন্দা ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যে তথ্য সংগ্রহ করেছে, তা তুরস্ক ও লেবাননের কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছে।উইকিলিকসের এই বার্তা ফাঁসের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র দেশের মধ্যে বিরোধের সাম্প্রতিক এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। ২০০৮ সালের ওই বার্তা থেকে আরও জানা গেছে, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সাইপ্রাসের আক্রোতিরি বিমান ঘাঁটি থেকে পরিচালিত গোয়েন্দা ফ্লাইট সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চায়। তারা জানতে চায়, এই কার্যক্রম সম্পর্কে অন্য কোনো দেশের সরকার অবহিত কি না। কারণ তারা নিশ্চিত হতে চাইছিল, এ ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে কোনো ধরনের মানবাধিকার লংঘনের সম্ভাবনা দেখা দেবে কিনা। ব্রিটেনের ওই ধরনের অনুরোধ মার্কিন প্রশাসন ক্ষুব্ধ হয়। মার্কিন কর্তৃপক্ষের বার্তায় বলা হয়, মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে ব্রিটিশদের উদ্বেগকে যুক্তরাষ্ট্রও গুরুত্ব দেয়। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়ে লেবাননে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটতে দিতে পারি না আমরা। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় লেখা ওই বার্তায় মার্কিন কূটনীতিক লেখেন, ঐতিহ্যগতভাবে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ দুই দেশের সম্পর্কে অনাস্থার মেঘ জমছে। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন সম্পর্কে মার্কিন কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল, তাঁর ‘ট্র্যাক রেকর্ড খুব বাজে’ এবং তিনি রাজনীতিতে ভুলের পর ভুল করে যাচ্ছেন। উইকিলিকসের ফাঁস করা মার্কিন কূটনৈতিক বার্তা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। ওই বার্তায় দেখা গেছে, মার্কিন কর্মকর্তারা ব্রিটেনের লেবার পার্টির দিশেহারা অবস্থায় ব্রাউনের নেতৃত্বে পথ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করেছেন।
২০০৮ সালের ৩১ জুলাই ব্রিটেনে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত রবার্ট টিউটেলের লেখা ওই বার্তায় ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, ব্রাউনকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিতে বিদ্রোহ করতে পারেন লেবার নেতারা। সেখানে আরও বলা হয়, লেবার পার্টির ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ডের সম্ভাবনা সবচেয়ে উজ্জ্বল। যুক্তরাজ্য গুচ্ছবোমা নিষিদ্ধ করার আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সই করার পরও তাদের মাটিতে অবৈধ্যভাবে এই বোমা ব্যাবহার ও মজুদ রাখতে বোমা মজুদ রাখতে জেনেশুনেই ওয়াশিংটনকে সাহায্য করেছিল লন্ডন এবং এ ব্যাপারে তারা একটি চুক্তিও সাক্ষর করেছিল। উইকিলিকসে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের গোপন কূটনৈতিক বার্তা থেকে যুক্তরাজ্য সম্পর্কে এ তথ্য জানা গেছে। প্রকাশিত বার্তায় আরো জানা যায়, গুচ্ছবোমা নিষিদ্ধ করার চুক্তির অনুমোদন নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিতর্কের জটিলতা এড়াতে দুই সহযোগী দেশই মজুদের ব্যাপারে চুক্তির প্রস্তাবটি গোপন রাখার ব্যাপারে একমত হয়। ২০০৯ সালের মে মাসে পাঠানো এক তারবার্তায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উধর্তন এক কর্মকর্তার সূত্রে উইকিলিকস এ তথ্য জানিয়েছে। ওই বার্তা থেকে আরো জানা গেছে, যুক্তরাজ্যের অধীনে থাকা ভারত মহাসাগরের দ্বীপ দিয়াগো গার্সিয়ায় ভূমি ও আকাশ থেকে গুচ্ছবোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দিয়াগো গার্সিয়া দ্বীপটি ইজারা দিয়েছে। ভারত মহাসাগরের ওই দ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। সেখানে তারা গুচ্ছবোমারও বড় মজুদ গড়ে তুলেছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের প্রকাশ্য অবস্থান হচ্ছে, ২০১৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ওই দ্বীপ থেকে গুচ্ছবোমার মজুদ সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু গোপনে তারা মজুদ রাখতে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করেছে।

বলিভিয়া :

বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসের নাকে বড় ধরনের টিউমার হয়েছিল, তবে অস্ত্রোপচার করে তা অপসারণ করা হয়েছে। উইকিলিকসের ফাঁস করা এক মার্কিন কূটনীতিকের গোপন নথিতে এ তথ্য পাওয়া গেছে।ব্রাজিলে মার্কিন দূতাবাস থেকে গত বছরের জানুয়ারি মাসে ওয়াশিংটনে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, ব্রাজিলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নেলসন জোবিম সে দেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্লিফোর্ড সোবেলকে নিশ্চিত করেন, মোরালেসের নাকে টিউমার হয়েছে।
জোবিমের বরাত দিয়ে ওই বার্তায় আরও বলা হয়, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা ডা সিলভা তখন মোরালেসকে সাও পাওলোতে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু তার প্রয়োজন হয়নি কারন কিউবার একদল চিকিৎসক নাকের টিউমার দূর করতে মোরালেসকে চিকিৎসা দিয়েছেন। বর্তমানে তাঁর নাকে কোনো টিউমার নেই। বলিভিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ২০০৮ সালে বহিষ্কারের পর থেকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে মোরালেসের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না।

নতুন তথ্য :

বাংলাদেশ সম্পর্কে উইকিলিকস আরো বেশ কিছু নতুন তথ্য ফাঁস করেছে। বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাস থেকে এসব গোপন তার বার্তাগুলো মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো হয়েছিল। সেসব কূটনৈতিক বার্তায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে সরকারি ‘ডেথ স্কোয়াড’ হিসেবে নিন্দিত র‌্যাবকে যুক্তরাজ্য সরকারের উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়াও যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে র‌্যাব ‘অনুসন্ধানী জেরার কৌশল’ ও কর্মকৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছে।
ছয় বছর আগে র‌্যাব গঠন করার পর এ পর্যন্ত এর সদস্যরা এক হাজারের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। এসব হত্যাকাণ্ডকে ‘ক্রসফায়ার’-এ মৃত্যু বলে বর্ণনা করা হয়। এই বাহিনীর সদস্যরা অপহরণ, চাঁদাবাজি ও ক্রসফায়ারে হত্যা করার জন্য মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণের সঙ্গে জড়িত বলে উউকিলিকসর প্রকাশিত তার বার্তায় উল্লেখ আছে। এদিকে মানবাধিকার বিষয় ছাড়া র‌্যাবের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কথিত অনাগ্রহ সত্ত্বেও মার্কিন কূটনৈতিক বার্তাই ইঙ্গিত দিচ্ছে, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানকে শক্তিশালী করার সংকল্প থেকে র‌্যাবের সক্ষমতা বাড়ানোর পক্ষে। শুধু তাই নয় তারা র‍্যাব বিলুপ্তির বিপোক্ষে মত দেন। ফাঁস হওয়া ওই সব বার্তা অনুযায়ী, তিন বছর আগে গত লেবার সরকারের আমলে যুক্তরাজ্য র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অনেকবার র‌্যাবকে বাংলাদেশ সরকারের ‘ডেথ স্কোয়াড’ বা ‘খুনি বাহিনী’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
র‌্যাবের জন্য অন্তত কয়েকটি প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছেন যুক্তরাজ্যে কর্মরত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। ন্যাশনাল পুলিসিং ইমপ্রুভমেন্ট এজেন্সির (এনপিআইএ) অধীনে এ প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষণ কোর্সগুলো সরকার ও অ্যাসোসিয়েশন অব চিফ পুলিশ অফিসার্স কর্তৃক অনুমোদিত। ফুলবাড়ী কয়লা খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার অনুমতি দিতে বাংলাদেশ সরকারকে ব্যাপক চাপের মধ্যে রেখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা। এ বিষয়ে সংসদীয় সমর্থন তৈরি করতে রাজি হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। জ্বালানি উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা এবং এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের কথা ওয়াশিংটনকে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি। ঢাকা থেকে পাঠানো তাঁর সেই গোপন বার্তা প্রকাশ করে দিয়েছে উইকিলিকস। উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ফুলবাড়ী কয়লা খনি বন্ধ করে দেওয়ার পরও জিসিএম বাংলাদেশে বহাল তবিয়তে কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে এবং সরকারের ওপর-মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। ফুলবাড়ী খনি আবার খুলে দিয়ে জিসিএমের পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন চালানোর অনুমতি দিতে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়ে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরাও। একটি বার্তা থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলাই সবচেয়ে ভালো হবে। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বৈঠকে এ বিষয়ে মরিয়ার্টির সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করেন এবং উন্মুক্ত পদ্ধতির পক্ষে সংসদীয় সমর্থন তৈরির ব্যাপারে সম্মতি দেন। ওয়াশিংটনে পাঠানো তারবার্তায় মরিয়ার্টি লিখেছেন, ফুলবাড়ী কয়লা খনিতে সম্পৃক্ত এশিয়া এনার্জির ৬০ শতাংশ বিনিয়োগই যুক্তরাষ্ট্রের। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠক্রম পরিবর্তনে একসঙ্গে কাজ করেছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। এক তারবার্তায় জেমস এফ মরিয়ার্টি বলেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলের অংশ হিসেবেই এ প্রকল্প পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশের অনিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাগুলোর জন্য একটি ‘মানসম্মত’ পাঠক্রম তৈরি ও প্রয়োগের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কিভাবে দেওয়া হবে তা দুই দেশের সমন্বিত পরিকল্পনায় আছে বলেও মরিয়ার্টি তাঁর বার্তায় জানান।বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘ভারত-ঘনিষ্ঠতার’ যে প্রচার রয়েছে, সে বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন ও সতর্ক ভারত সরকার। রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি এক তারবার্তায় ওয়াশিংটনকে জানান, এই সতর্কতা থেকেই সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যৌথ টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়ে শেখ হাসিনার প্রস্তাবকে স্বাগত জানায় ভারত। ঐতিহাসিকভাবে নয়াদিল্লির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক রয়েছে বলেও তারবার্তায় উল্লেখ করেন মরিয়ার্টি। (তথ্যসূত্র-গার্ডিয়ান, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, বিভিন্ন ব্লগ ও বিবিসি অনলাইন)
মার্কিনসহ পশ্চিমা সরকারগুলো বলছে এভাবে তথ্য ফাঁস করার জন্য অনেকে বিপদের মুখে পড়বে তাই কাজটি অন্যায় কিন্তু মজার বিষয় কেউ প্রকাশিত তথ্যগুলোকে মিথ্যা বলার সাহস দেখাচ্ছে না। জুলিয়ান এ্যাসান্জকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ঠুনকো একটি মামলায়, তথ্য ফাঁস করার অপরাধে নয়। তবে আর যাই হোক এ ঘটনার মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর তথাকথিত গণতন্ত্রের মুখোশ খুলে পড়েছে।
বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের জন্য আবারো ওবামার ৫ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের ঘোষণা
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিশ্বব্যাপী আরো ব্যাপক আকারে সন্ত্রাস উৎপাদনে বিভিন্ন দেশকে সাহায্য করার জন্য ৫ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড ঘোষণা করেছেন। এই ফান্ড মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে সন্ত্রাসী কাজের জন্য দেয়া হবে। এ বছর শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানের মিশন শেষ হচ্ছে। আফগানিস্তান থেকে বেচে যাওয়া অর্থ সন্ত্রাস উৎপাদনে ওবামা অন্যত্র ব্যবহার করতে চাচ্ছেন। তিনি তার ভাষণে বলেন, আমি সন্ত্রাস বিরোধী (ইসলাম নিমূ©লে) সহযোগিতা বাড়াতে ৫ বিলিয়ন ডলার অনুমোদনে কংগ্রেসের সমর্থন আশা করছি। আমি মনে করি এই সাহায্য আমাদের সন্ত্রাসের ক্ষমতা বাড়াবে এবং আমাদের সহযোগী দেশগুলোকে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করবে। তিনি বলেন এই সাহায্য ইয়েমেনের নিরাপত্তাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে, সোমালিয়ার বহুজাতিক শান্তি বাহিনীকে সাহায্য, লিবিয়ায় নিরাপত্তা বজায় রাখতে ইউরোপিয়ান মিত্রদের সাহায্য এবং মালিতে অভিযান পরিচালনায় ফ্রান্স বাহিনীকে সাহায্য করতে ব্যবহার হবে। তিনি আরও বলেন সিরিয়ায় আসাদ বিরোধীদের সাহায্য দান অব্যাহত থাকবে। নাইজেরিয়া বোকো হারামের সাম্প্রতিক সহিংসতা বৃদ্ধি এবং সিরিয়ার গৃহ যুদ্ধ সহ আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসীদের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবিতে তুলেছে। তাই বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস দমন করে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের এবং তার মিত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইছে। নাকি বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে মাকি©ন আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে?

হামাস নিমূলে ইসরাইলকে ২২ কোটি ডলার দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

হামাসকে নিমূল করার জন্য ইসরাইলের চেয়ে আমেরিকায় প্রচেষ্টা কম যায় না। তাইতো পেছনে নাটের গুরু হয়ে অস্ত্রসহ আথিক সহায়তা দিতে মোটেও দেরী করছে না আমেরিকা। ইসরাঈল সহযোগিতা না চাওয়ার আগে আমেরিকা আগ বাড়িয়ে দেয়। মাকিন প্রেসিডেন্টের বক্তৃতা বিবৃতি দেখলে মনে হয় বারাক ওবামা সাহেব আমেরিকার নয় ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট। তাইতো ফিলিস্তিনে গণহত্যার রেকড গড়ার জন্য, মুসলিমদের শেষ করে দেওয়ার জন্য আবারো ২২ কোটি ডলার দান করেছে। বর্বর ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিপূর্ণ করতে ২২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের একটি প্যাকেজ অনুমোদন করেছে মার্কিন কংগ্রেস। গাজায় ইসরাইলের গণহত্যার মধ্যেই ইহুদিবাদী দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্র এই বিপুল অর্থ বরাদ্দ দিতে যাচ্ছে। সিনেটে প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট পড়ে ৩৯৫টি আর বিপক্ষে ৮টি। পাঁচ সপ্তাহের অবকাশ শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে সিনেটে প্রস্তাবটি পাস হয়।এই অর্থ দিয়ে ইসরাইলের ‘আয়রন ডোম’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। হামাসের রকেট হামলা থেকে রক্ষা পেতে আয়রন ডোম বসিয়েছে ইসরাইল।এদিকে শুক্রবার যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার ২ ঘণ্টার মধ্যেই ইসরাইল গাজার আক্রমণ চালালেও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের জন্য হামাসকে দায়ী করেছেন। হোয়াইট হাউসে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, নিজের প্রতিরক্ষার অধিকার ইসরাইলের রয়েছে। এপি/রয়টার্স/আরটিএনএন
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×