এক কালে আমাদের দেশে ডিম কে বলা হত গরীবের মাংস।তখন ডাল আর ডিম ছিল নিম্নবিত্ত বাঙ্গালীর প্রোটিনের অন্যতম উৎস। গত এক দশকে পোল্ট্রি শিল্পের ব্যাপক প্রসারের ফলে দেশে উৎপাদিত ডিম দিয়েই জনগণের চাহিদা মেটানো যেত। কিন্তু সর্বনাশা বার্ড ফ্লুর ছোবলে কয়েক বছর পূর্বে এ শিল্পে প্রবল ধ্বস নামে। যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়া এ ব্যাপক সম্ভাবনাময় খাত আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি আজো। দ্রব্য মূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে ডিম এখন চলে গেছে নিম্নবিত্তের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। দেশে ডিমের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বর্তমান চাহিদার জোগান দিতে ইদানিং বাইরে থেকে ডিম আমদানির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে পার্শ্ববর্তী ভারত, চীন ও মায়ানমার থেকে আমদানিকৃত ডিমের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে শোনা যাচ্ছে। ডিমের এ অত্যাধিক চাহিদাকে পূঁজি করে বেনিয়ার জাত চীন কেমিক্যাল দিয়ে উৎপাদিত কৃত্রিম ডিম বাজারজাত করা শুরু করেছে। মুরগী ডিম পাড়ার জন্য এখন আর তারা ২১ দিন অপেক্ষা করতে রাজী নয়। একটা ডিম তৈরি করতে গড়পড়তায় তারা সময় নিচ্ছে মাত্র ৫ মিনিট। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বৈকি। কারন কৃত্রিম ভাবে তৈরি এসব ডিম জনস্বাস্থ্যের জন্য বিশাল হুমকি স্বরূপ।
বাজারে ডিম কেনার প্রাক্কালে তাই ভোক্তা সাধারণকে চায়নিজ ডিমের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। এখন মনে নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে কিভাবে চিনবেন ডিম আসল না নকল। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাবো পরে। আসুন আগে একটু জেনে নিই কিভাবে তৈরি হয় নকল ডিম।
নকল ডিমের কাঁচামাল তৈরির পদ্বতিঃ
• আমরা জানি একটি ডিমে থাকে কুসুম(Egg yolk) , সাদা অংশ( Egg white) , পাতলা আবরন( Egg membrane) এবং খোলস বা খোসা ( Egg shell)। নকল ডিম তৈরির পূর্বে বিভিন্ন কেমিক্যাল সহযোগে এ সকল অংশ( Raw material) আলাদা ভাবে তৈরি করা হয়। যেমন খোলস তৈরিতে ব্যবহার করা হয় ক্যালসিয়াম কার্বোনেট। ডিমের কুসুম আর সাদা অংশ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় সোডিয়াম এলগিনেট, এলাম, জিলেটিন, ভক্ষণ যোগ্য ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, পানি এবং কৃত্রিম রং।
• প্রথমে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোডিয়াম এলগিনেট গরম পানিতে মিশিয়ে সাদা রঙ তৈরি করা হয়। এরপর এর সাথে জিলেটিন, বেঞ্জয়িক এসিড, এলাম এবং অন্যান্য কিছু রাসায়নিক পদার্থ যোগ করে তৈরি করা হয় ডিমের সাদা অংশ।
• ইতোপূর্বে তৈরি সাদা অংশের সাথে লেমন ইয়েলো খাদ্য রঞ্জক মিক্স করলেই তৈরি হয়ে যায় ডিমের কুসুম।
• একই ভাবে ডিমের পাতলা আবরণ তৈরির জন্য সাদা অংশ তৈরির কাঁচামালের সাথে মিক্স করা হয় ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড।
• আর খোলস তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় মোম, জিপ্সাম পাউডার, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট এবং অন্যান্য কিছু পদার্থ।
নকল ডিমের পুষ্টিগুণঃ
কৃত্রিম ভাবে তৈরি ডিম আসল ডিমের তুলনায় সুস্বাদু হলেও এর কোন পুষ্টিগুণ নেই। বরং এ ডিম তৈরিতে যে সকল কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় তা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
নকল ডিমে ব্যবহৃত বিভিন্ন কেমিক্যালের ক্ষতিকারক দিক সমূহঃ
(১) গ্লুকোলেকটনঃ ইহা বিপাকীয় সমস্যা সৃষ্টি করে।
(২) বেনজয়িক এসিডঃ ইহা মস্তিষ্ক ও স্নায়ু কোষের ক্ষতি করে। যকৃতের রোগ এবং বোধশক্তি হ্রাসে ইহা ভূমিকা রাখতে পারে।
(৩) ক্যালসিয়াম ক্লোরাইডঃ ইহা যকৃত ও স্নায়ু রোগ তৈরি করে এবং শরীরে রক্ত উৎপাদনে বাধা প্রদান করে।
(৪) সেলুলোজঃ ইহা বিপাকীয় জটিলতা সৃষ্টি করে।
(৫) এলামঃ ইহা যকৃত ও স্নায়ু রোগ তৈরি করে এবং শরীরে রক্ত উৎপাদনে বাধা প্রদান করে।
(৬) এমিনো এসিড, খাদ্য রঞ্জক, সোডিয়াম এলগিনেট, জিলেটিনঃ বিপাকীয় জটিলতা সৃষ্টি করে।
চায়নিজদের ব্যবসায়িক হিসাবঃ
১ কেজি আসল ডিম উৎপাদনে খরচ পড়ে ৬.৫ ইউয়ান। অন্যদিকে ১ কেজি সোডিয়াম এলগিনেটের দাম ৪২ ইউয়ান, যা দিয়ে ১৫০ কেজি নকল ডিম তৈরি করা যায়। অন্যান্য সকল খরচ হিসাব করে ১ কেজি নকল ডিম তৈরির খরচ পড়ে মাত্র ০.৫৫ ইউয়ান! মূলত এ লাভের অংক কষেই চায়নিজরা সকল নীতি নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে প্রস্তুত ও বাজারজাত করছে নকল ডিম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই চায়নিজরাই দুই এক বছর পূর্বে গুঁড়ো দুধে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক মেলামিন মিশিয়ে বাজারজাত করে। এ দুধ খেয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনায় সারা বিশ্বে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হলে ঐ গুঁড়ো দুধ কোম্পানি তাদের সকল মেলামিন যুক্ত দুগ্ধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং বিশাল অংকের জরিমানা দিতে বাধ্য হয়। অতএব আমাদের এখন সময় এসেছে সর্বক্ষেত্রে চায়নিজ পণ্য বর্জনের; যদি ও বিশ্ব বাজারে চায়নিজ পণ্যের আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে বিষয়টা অতোটা সহজ সাধ্য নয়। তথাপি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সম্ভাব্য অকল্যাণের হাত থেকে রক্ষা করতে এ ব্যাপারে সর্ব মহলের সচেতনতা বৃদ্ধির আবশ্যকতা রয়েছে।
নকল ডিম তৈরির ধাপ সমূহঃ নকল ডিম তৈরির কাঁচামাল সমূহ তৈরি হয়ে গেলে শুরু হয় নকল ডিম তৈরির আসল কাজঃ
১ম ধাপঃ
প্রথমে ইতোপূর্বে তৈরি ডিমের কুসুমের কাঁচামালের মিশ্রণকে কুসুমের আকৃতির ন্যায় ছাঁচ বা কন্টেইনারে ফেলে ছাঁচের তিন ভাগের দুই অংশ পূর্ণ করা হয়।
এরপর সাথে যোগ করা হয় ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড ও পানি। পরবর্তীতে কন্টেইনারটিকে আস্তে আস্তে ঝাঁকি দেওয়া হয় যাতে কুসুমের বাইরে একটা পাতলা আবরণ তৈরি হয়। কিছুক্ষণ পর কুসুমটি শক্ত হতে শুরু করলে এটিকে ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড দ্রবণে এক ঘণ্টা চুবিয়ে রাখা হয়। তারপর শুকিয়ে পরবর্তী স্টেপের জন্য রেখে দেওয়া হয়।
২য় ধাপঃ এই ধাপে কন্টেইনার বা ছাঁচের তিন ভাগের এক অংশ পূর্বে তৈরি সাদা অংশের কাঁচামাল দ্বারা পূর্ণ করা হয়। তারপর ১ম ধাপে প্রস্তুত কুসুমটি এর উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। কুসুমের উপর আরও কিছু সাদা অংশ ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর এটিকে ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড দ্রবণে ডুবিয়ে আস্তে আস্তে ঝাঁকালে তৈরি হয়ে যায় খোসা বিহীন একটা আস্ত ডিম।এই খোসাবিহীন ডিমটাকে শক্ত করা হয়, তারপর ওয়াশ করে শুকিয়ে রাখা হয়।
৩য় ধাপঃ এই ধাপে খোসাবিহীন ডিমটার ভেতর সুতো প্রবেশ করিয়ে সুতোর দুই প্রান্ত ধরে ডিমটাকে ডোবানো হয় মোম এবং ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের মিশ্রিত দ্রবণে।
তারপর ডিমটাকে ঠাণ্ডা পানিতে চুবিয়ে আবার পূর্বের দ্রবণে ডুবানো হয়। ডিমের বাইরে শক্ত খোলস তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করা হয়। এরপর সুতোটাকে বের করে কোটিং করে দিলেই তৈরি হয়ে যায় একটি আস্ত নকল ডিম।
আসল ও নকল ডিম চেনার উপায়ঃ
এখন জেনে নেওয়া যাক আসল ও নকল ডিমের পার্থক্যঃ
( ১) নকল ডিমের খোলস আসল ডিমের চেয়ে পাতলা হবে, যদিও বাহ্যিকভাবে এটা অত ভালভাবে বুঝা যায়না।
(২) হাত দিয়ে স্পর্শ করলে নকল ডিম আসল ডিমের চেয়ে বেশী খসখসে মনে হবে।
(৩) নকল ডিমকে ঝাঁকালে ভেতর থেকে কিছু শব্দ শোনা যেতে পারে পানি থাকার কারনে।
(৪) আসল ডিমের গন্ধ কিছুটা কাঁচা মাংসের মত যা নকল ডিমের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।
(৫) নকল ডিম ভাঙ্গার পর কিছুক্ষণের মধ্যে কুসুম এবং সাদা অংশ এক সাথে মিশে যাবে, কারণ তারা একই উপাদানে তৈরি।
(৬) নকল ডিমকে ফ্রাই করলে কোন ফ্রাই করলে কোন প্রকার স্পর্শ ছাড়াই ডিমের কুসুম ছড়িয়ে পড়বে যা আসল ডিমের ক্ষেত্রে ঘটবে না।
(৭) আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিলে আসল ডিম নকল ডিমের চেয়ে অধিকতর ‘ ক্রিস্প সাউন্ড’ তৈরি করবে।
( ৮)নকল ডিম কে ফ্রাই করলে আসল ডিমের চেয়ে বেশী বাবল বা বুদবুদ তৈরি হয়।
শেষ কথাঃ
আশা করা যায় কেনার সময় অথবা ঘরে বসেই এখন আমরা আসল ও নকল ডিমের পার্থক্য ধরতে পারব। পরিবারের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে বিষয়টি সবার সাথে শেয়ার করার জন্য অনুরোধ রইল। নইলে ভোক্তা সাধারণের অজ্ঞাতে তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে সর্বনাশা এই চায়নিজ ডিম।
( ছবি এবং তথ্য সুত্রঃ ইন্টারনেট) View this link
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১২ ভোর ৬:৫৯