আয় রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে
ঢ্যাম কুড় কুড় ঢ্যাম কুড় কুড় বাদ্যি বেজেছে
গাছে শিউলি ফুটেছে কালো ভোমরা জুটেছে
আর পাল্লা দিয়ে আকাশে মেঘেরা ছুটেছে...
শরৎ মানেই তো পুজোর গন্ধ। ঢাকের বাদ্যি। কাশফুলের রেশমি উড়নি গায়ে জড়িয়ে ‘শিউলি ছোপানো শাড়ি পরে’ ‘আগমনী গীত’ গাইতে গাইতে শরৎকুমারী তো আসে মা দুগগার হাতটি ধরেই! বাতাসে তখন ভেসে বেড়ায় ধানফুল আর ধুপধুনোর গন্ধ। চারপাশে কেমন নীল নীল সাদা সাদা ফটফটে আলো। সেই আলোর মধ্যে খড়ের কাঠামোর ওপরে মগ্ন শিল্পীর হাত থেকে লেগে যাচ্ছে কাঁচা মাটির তাল। একটু একটু করে চালচিত্রের ভেতরে সপরিবারে মা দুগগার অবয়ব উঠছে ফুটে। তারপর শিল্পীর তুলির টানে যেই না প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলো Ñ চোখ মেললেন দনুজদলনী অসুরনাশিনী অন্নপুর্ণাÑ অমনি ঢাকের কাঠি নেচে উঠলো নতুন বোলে। শাঁখের আওয়াজে বাতাস জাগলো শিহরন। আরতি নৃত্যের ভঙ্গিমায় শরতকুমারীর কোমর উঠলো দুলে।
আমাদের নানাবাড়ি বিক্রমপুরে। গ্রামের নাম গনাইসার। আশেপাশের গ্রামগুলোর চমৎকার সব নাম পঞ্চসার, টুনিসার, সিদ্ধেশ্বরী, রাইয়তভোগ, বায়হাল, বাইনখারা, মটুকপুর, হাসকিরা। আমরা ছোটবেলায় আশ্বিনে আরতির কাসর-মন্দিরা আর ঢাকের শব্দ শুনলেই দৌড়ে যেতাম হিন্দু পাড়ায়। ঝলমলে শাড়ি আর গিল্টি করা গহনায় সাজানো দেবী দুর্গাকে দেখে দেখে আমাদের চোখের আশ মিটতো না। দুর্গোৎসবে হিন্দুপাড়ার সাথে মেতে উঠতো মুসলমানও। দল বেঁধে পাড়ার মেয়েরা দেখতে যাচ্ছে পুজো। হাতে পেতে নিচ্ছে পুরুত ঠাকুরের দেয়া আলোচাল চাঁপা কলা নারকেল আর চিনি মেশানো প্রসাদ। বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে হিন্দুবাড়ির মেয়েবউদের চোখে জল দেখে মুসলমান বউ ঝিদের চোখও ছলছল করে উঠতো।
কিন্তু মা দুগগার দিনকাল এখন বড় খারাপ। অন্নপুর্ণার বড় ফকিরি হালত। অন্যকে অন্ন দেবে কি, তার নিজের ভাঁড়ারই অনেক সময় ঢুঁ ঢুঁ হয়ে পড়ে। এই আকালে অত শাড়িচুড়ি গহনাগাটির ঝমঝমানি অত ঢাকের বাদ্যির রমরমানি নিয়ে মচ্ছব করার দরকার কী! দিনকাল বদলেছে। দুগগার কি বুঝজ্ঞান নেই? সব কিছু সমঝে না চললে সমস্যা। কী থেকে কী হয়ে যায় Ñ পুরান আমলের এই বেটি অনেক সময় হাল জমানার হালহকিকত বুঝতে পারে না। ধুমধাম করে ডাঁট দেখিয়ে আসে। শেষে তার আসনবেদী উল্টে পড়ে, যুগযুগান্তরে জমিয়ে তোলা স্বর্ণালংকারের পোটলা লুট হয়ে যায়। শক্তিমানদের ক্রোধ আর হিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় মন্দির। রাতের অন্ধকারে কারা যেন এসে দশভুজার ভুজগুলো মটমট করে ভেঙে দিয়ে যায়। অসুরনাশিনীর নিজের মুণ্ডুই অসুরদের খাঁড়ার ঘায়ে ধুলোয় গড়াগড়ি খায়।
তাই এখন মা দুগগা আসে পুলিশি প্রহরায়। ঢাক বাজে রয়ে সয়ে। ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া’ যদি কারো নরম কোমল অনুভূতিকে আহত করে ফেলে! শাঁখ আর উলুধ্বনি তো রাজনৈতিক সম্পত্তি! ওসবের আওয়াজ করতে হলে আদালতের আদেশ লাগবে! কাসর মন্দিরা হরিনাম ঢপকীর্তন এসবের ঝংকার শারদীয় উৎসব থেকে হারিয়ে গেছে কবে! আর এবার তো মা দুগগাকে অনেক হিসাব করে পা ফেলতে হচ্ছে Ñ শেষে না আবার ফেসবুকের বুকে পা দিয়ে বসেন। তাতে লাগবে কক্সবাজারের মতো ধুন্দুমার। বেচারা বুদ্ধ, বউ ছেলেপুলে রাজসিংহাসন Ñসব ছেড়েছুড়ে বোধিবৃক্ষের তলায় ধ্যান করে এত জ্ঞান অর্জন করলেন, অথচ আত্মরক্ষার উপায়টাই তার জানা হলো না। ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ বলে এত চেঁচালেন তার পরেও তিনি বারবার পুড়ে মরেন হিংসার আগুনে। রামু উখিয়া পটিয়ার মন্দিরে বুদ্ধর অগ্নিদগ্ধ দেহ আর বিধ্বস্ত মন্দিরগুলো থেকে এখনও ধোঁয়া উঠে শরতের নীলাকাশ ঢেকে দিচ্ছে। কিন্তু ‘ওম শান্তি’ রক্ষা করা তো জাতীয় কর্তব্য। তাই হাই ভল্যুমে হার্ডমিউজিকে শান্তির ললিত বাণীর রিমিক্স বাজানো হচ্ছে Ñ
বাংলাদেশ সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির দেশ।
এই স¤প্রীতি যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।
স¤প্রীতি-সংহারকদের খুঁজে বের করা হবে।
কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে Ñ ইত্যাদি।
তো এবারের শরতের আকাশে কাপাশের পালতোলা সাদা মেঘের ভেলা না থাকুক শারদীয় চীবরের ভেতর থেকে স¤প্রীতি-জাদুকরের বের করে-আনা শান্তির শ্বেতকপোত তো দিব্যি উড়ছে! তার পানে চেয়ে চেয়েই আমরা খুশি থাকি! ঢাকেশ্বরী মন্দির জগন্নাথ হল, শাঁখারিবাজার, সুত্রাপুর শহরের আরও কিছু কিছু এলাকায় ঢাকের বাদ্যি এই শরতেও বাজবে। শক্তিশালী পুজোরক্ষা কমিটির তত্ত্বাবধানে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশকে সাথে নিয়ে মা দুর্গা আসবেন। পুজোর গন্ধও হয়তো ভাসবে বাতাসে। কিন্তু শরতের গন্ধ তো শুধু পুজোর গন্ধ দিয়ে পরিপূর্ণ হবে না। শিউলি চাই। গাছে গাছে শিউলি ফোটা সকালÑ সে আসবে তো?
শিউলি ছাড়া শরৎ কীভাবে আসে? ভোর বেলা শিউলি তলা ছেয়ে থাকবে সাদা ফুলে। তার কমলা রঙের বোঁটায় থাকবে কোমল স্বপ্নের রঙ। এই রঙ শিউলির বিয়ের মেহেদীর। শিউীলকে নিয়ে শরতের করুণ কিংবদন্তি!
সূর্যকে যে সে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু শিউলি তো রাতেই ফোটে, অথচ সূর্যের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয় সেই সকাল পর্যন্ত। বিয়ের মেহেদী হাতে নিয়ে শিউলি তার প্রেমাষ্পদকে একবার রাতের বেলা দেখতে পাওয়ার বাসনা করলো। বনের দেবতা বললেন, রাতে সূর্য উঠলে অনর্থ হবে।ওদিকে দয়িতের অনুরোধ ফেলতে না পেরে রাত্তিরে উদয় হলো সূর্য, অমনি প্রকৃতিতে শুরু হয়ে গেল চরম বিশৃঙ্খলা। বনবনানীর ঘুমন্ত কলিগুলো ধড়মড় করে চোখ মেলে চাইলো, কাঁচা ঘুম ভেঙে নীড় থেকে উড়াল দিলো পাখপাখালির দল, পত্রকোরকে গা মুড়ে থাকা কচি শীষগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ল্যাকপ্যাকে দেহ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। চেঁচিয়ে উঠলেন বনদেব, কী হলে কী হলো? এই তো এক ফোঁটা মেয়ে শিউলি, তার কি না এত বড় সাহস! তবে যাও, মরো। সূর্যকে আর জীবনে দেখা হবে না তোমার। বিবাহের রাতের হলদিমেহেদির রঙ গাঢ় হওয়া মাত্রই ঝরে পড়বে মাটিতে। দিনের আলো আর দেখা হবে না! শিউলিকে অভিশাপ দিলেন Ñ সারারাত সে সূর্যের জন্য অপেক্ষা করবে আর সূর্যের উদয়ের পূর্বমুহূর্তেই পড়বে ঝরে!
সত্যিই ভোরের আলো ফোটার আগেই মেহেদীর সাজ নিয়ে শিউলি ঝরে পড়লো। ঘাসের ওপর ঝরে পড়া সেই শিউলির শুভ্রতায় আর শুচিস্নিগ্ধ সৌরভে শরতের সকাল হয়ে উঠলো করুণ সুন্দর। কিন্তু পল্লীবালারা যখন সেই ঝরা ফুল কুড়াতে চলে আসে তখন যেন ফুলগুলো আনন্দে নেমে আসে ওদের চুলে চোখে মুখে। “শেফালি পুলকে ঝরে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশে উতলা..”!
কিন্তু হায়! আমার শহরে কোথায় এই শুচিশুভ্র শেফালি সকাল? আমার যাপিত জীবনের চারপাশে কোথাও একটি শিউলি গাছ দেখি না। ছোটোবেলায় আমিও পল্লীবালা হতাম। শিউলি ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথা আর বোঁটা ছিড়ে হাতের পাতা রাঙানো এ খেলা কোনো পল্লীবালা খেলেনি তা কি হয়? বেশি ফুল নিয়ে এলে মা আবার বোঁটাগুলো রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে রাখতেন জর্দার রঙের জন্য, পানিতে সেদ্ধ করে তার মধ্যে সাদা কাপড় চুবিয়ে প্রাকৃতিক রঙকারিগর হতেন আমার মা।
আমি যে কলেজে পড়াই, বছর পনের আগে আমার ঝুলোঝুলিতে বাধ্য হয়ে আমার কৃষিবিদ সহকর্মী একটি শিউলির চারা এনে পুঁতে দিলেন আমাদের বসার রুমটার দক্ষিণ কোণে। কয়েক বছর পরে এক শরতের সকালে সে গাছ ডালপালা ছড়িয়ে ‘ শিউলি তলায় ভোর বেলায়..’ নজরুল সংগীত গাইতে গাইতে এক মুঠো ফুল ফুটিয়ে ফেললো। গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আমি বিমুগ্ধ নয়নে সেই শোভা দেখছি। এক ছাত্রী আমার পাশে এসে বলে, ম্যাডাম এটা কী গাছ? আমি বলি, এর নাম শিউলি, দেখ ফুল ফুটেছে। এর আর এক নাম শেফালি বা শেফালিকা।
মেয়ে লাফিয়ে উঠে বলেÑ ত্ত্ত্াইইইই! এগুলো শিউলি? তার মানে শরৎকাল এসে গেছে?
তখন ছিলো আশ্বিনের প্রায় শেষের দিক। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও খুশি হয়ে যাই। শহুরে এই মেয়ে তো তবু শিউলির সাথে শরতের সম্পর্কটা জানে, ফুল না হয় না-ই চিনলো!
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৩১