somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিয়াং মাই এর পথে

১৯ শে মার্চ, ২০১৭ সকাল ১০:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অভ্যর্থনারত শহর চিয়াং মাই
“আচ্ছা আপনি কবে থেকে এই জগতে আসার কথা ভেবেছেন’? এক সময় টিভিতে কোন শিল্পীর ইন্টারভিয়ু নেয়ার সময় উপস্থাপকদের গৎবাধা এই প্রশ্নটি থাকতোই ।এটা শুনলেই আমার এক কাজিন ঠাট্টা করে বলতো,‘দেখবে উনি এখনি বলবে,“ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল এই জগতে আসার”।আমার কাজিনের কথা সত্য প্রমান করে অতিথি এই উত্তরটাই দিত। অর্থাৎ আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিল্পীই হঠাৎ করেই যে এ জগতে এসেছে এমনটি খুব কমই ঘটেছে।


চিয়াং মাই এর পথে ছুটে চলা ট্রেন
সেই সব শিল্পীদের মত যদি আমার ভ্রমন বাতিক নিয়ে কেউ কোনদিন এমনধারা প্রশ্ন করতো তবে আমিও হয়তো উত্তরে বলতাম, “সেই ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর”। অবশ্য বাবার বদলীর চাকরীর কারনেও এ শখটি যেন আমার রক্তে্র ভেতর মিশে গিয়েছিল বলা যায়।পরবর্তী জীবনে জীবনসংগীও আমার মতই মন মানসিকতার, ফলে যা হবার তাই হলো উঠলো বাই তার কটক যাই প্রবাদ এর মত অবস্থা ।এই বাই অর্থাৎ বাতিকের কারনে অজ্ঞাত অখ্যাত কটকের মতও কত জায়গায় যে গিয়েছি তার ইয়াত্তা নেই । সেখানে কি জানি কেনো বহু বছর ধরে পরিকল্পনা করেও বিভিন্ন বাধায় থাইল্যান্ডের উত্তর সীমান্তে পাহাড় ঘেরা বিখ্যাত পর্যটন নগরী চিয়াং মাই যাওয়া বার বার পিছিয়ে যাচ্ছিল। মনে হলো স্বপ্নের শহর পাহাড় কন্যা চিয়াং মাই যেনো অধরাই থেকে যাবে আমাদের কাছে।প্রতিজ্ঞা করলাম না আর দেরী নয় এবার যাবোই যাবো।


শীতের সময় এখানে সেখানে গাছ ভরে ফুটে থাকা সিয়ামিজ সাকুরা বা ওয়াইল্ড হিমালয়ান চেরী
গ্রীস্ম,বর্ষা আর শীত এই তিন ঋতুর অঞ্চল চিয়াং মাই এ পর্যটনের জন্য সেরা সময় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারীর শেষ পর্যন্ত শীতের তিন মাস। আমরা ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি যাওয়া আসা বাদ দিয়ে ছয়দিনের জন্য যাবো বলে ঠিক করলাম। ঢাকা থেকেই হোটেল বুকিং, ট্রেন ভাড়া সব কিছুর ব্যবস্থা হলো অনলাইনে।


রাজা চুলালংকর্ন ( পঞ্চম রামা) ১৮৬০ খৃঃ সিয়াম অর্থাৎ থাই স্টেট রেলওয়ের প্রতিষ্ঠাতা
পর্যটনের সেরা সময় বলে ব্যাংকক থেকে চিয়াং-মাই আভ্যন্তরীন রুটের প্লেনের কোন টিকেটও মেলেনি। বিলাস বহুল নৈশ বাসের টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল কিছু কিছু যার ভাড়া প্রায় প্লেনের কাছাকাছি। তবে যত এসি হোক আর আরামদায়কই হোকনা কেনো চলন্ত কোন যানবাহনে নির্ঘুম আমি একা বসে থাকি । আর এই এক রাত জাগার মাসুল শরীর পরবর্তী তিন দিন ধরে আদায় করে নেয়। তাছাড়া ঐ সব বাসের সাস্পেনশনের কারনে ক্রমাগত দুলুনীও আমাকে অসুস্থ করে তোলে।


ব্যাংকক চিয়াংমাই হাইওয়ের একটি অংশ

শেষপর্যন্ত আমার সবচেয়ে পছন্দের ট্রেনে যাবো বলেই সিদ্ধান্ত হলো। বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক বিভুতিভুষনের পথের পাঁচালীর অপু দুর্গার স্বপ্নের ট্রেনের মতই যার খোলা জানালা দিয়ে হু হু বাতাস এসে সব উড়িয়ে পুড়িয়ে একাকার করে দিয়ে কু ঝিক ঝিক শব্দ তুলে তার গন্তব্যে ছুটে চলবে। এর চেয়ে উপভোগ্য আর কিছু আছে বলুন? এ ছাড়াও নেটের তথ্য অনুযায়ী এটি একমাত্র এক্সপ্রেস ট্রেন যাতে সেই কাক ডাকা ভোর থেকে পরের প্রায় চারটি ঘন্টা এক অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনার সাথী হয়ে চলতে থাকবে।
ব্যাংকক থেকে চিয়াং-মাই নন এসি এই ট্রেনের মাথাপিছু ভাড়া ৫৮১ বাথ। মধ্য ফেব্রুয়ারীর এক রাতে আমরা দুজন ট্যাক্সি করে হোটেল থেকে রওনা হোলাম ব্যাংককের প্রধান ট্রেন স্টেশন হুয়ালামফং এর উদ্দেশ্যে।


রাতের ব্যাংকক

দেশটিতে গত কয়েক বছর ধরে সামরিক শাসন চলছে তার উপরে পিতৃসম রাজা ভুমিবলের মৃত্যু ব্যবসা বানিজ্যে নিয়ে এসেছে কিছুটা মন্দাভাব। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন যে একটু বাধাগ্রস্ত তা পরিস্কার নজরে আসে থাইল্যান্ডের প্রধান প্রবেশ দরজা সুবর্নভুমি এয়ারপোর্টে নামলেই। আগেরমত সেই ঝা চক চকে ভাব নেই।অর্থনৈতিক মন্দায় সবকিছুতেই একটু মলিন অবস্থা যা দেখা গেলো রাস্ট্রীয় মালিকানাধীন State Railway of Thailand (SRT) এর প্রধান স্টেশনেও। তারপরও টার্মিনাল বা প্ল্যাটফর্মের কোথাও সামান্যতম নোংরা-ময়লার অস্তিত্ব নেই। সারাক্ষন ধুয়ে মুছে পরিস্কার রাখার আপ্রান চেষ্টা করে চলেছে পরিচ্ছন্ন এই জাতিটি।


টার্মিনালের এক অংশে সিয়াম রেলওয়ের আধুনিকায়নের জনক প্রয়াত রাজা ভুমিবলের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ।

বহু লোকের উপস্থিতি থাকা সত্বেও ট্রেন টার্মিনালে সরগরম যাকে বলে সে রকম কিছু দেখলাম না। বেশিরভাগ দেশের মানুষের কাছেই সময় বাচানোর জন্য যানবাহন হিসেবে ইদানীং ট্রেনের চেয়ে বাসের কদর বেশি। তারপরও ভাড়া কম বলে স্থানীয় লোকজনের কাছে পছন্দের যানবাহন ট্রেন তা রেলওয়ে থাইল্যান্ড এর পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়। ২০১৪ এর হিসাব অনুযায়ী এ সংস্থাটি ৪৪ মিলিয়ন যাত্রী পরিবহন করেছে।


অপেক্ষারত যাত্রী

আমরাও চেয়ারে বসে প্রতীক্ষারত। তাকিয়ে দেখলাম সেখানে কোন হৈ হল্লা নেই, নেই কুলীদের হাঁকা-হাঁকি ডাকাডাকি, কানের কাছে ঝালমুড়িওয়ালার কৌটায় মুড়ি চানাচুরের মিলিত ঝাকুনির ঝুম ঝুম শব্দ। উপরে ঝোলানো বড় ডিসপ্লে বোর্ডে ট্রেনের নাম ও প্ল্যাটফর্ম নম্বর দেখামাত্র চেয়ার ছেড়ে যাত্রীদের নিঃশব্দ প্রস্থান । একটু পরেই সেখানে আমাদের ট্রেনের নামটি ভেসে উঠলে নির্ধারিত বগির নির্ধারিত সিটে গিয়ে বসলাম। সিটি বাজিয়ে সময়মত অর্থাৎ রাত দশটায় আমাদের ট্রেন ছাড়লো ৭৫১ কিঃমিঃ দুরের চিয়াং মাই এর উদ্দেশ্যে।


আমাদের ট্রেন প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষায় ।

স্লিপার কোচ তাই ট্রেনে উঠতেই একজন এটেন্ডেন্স এসে সদ্য কাচা ঝকঝকে পরিস্কার সাদা চাদর আর বালিশের কভার দিয়ে বিছানা করে দিল।সাথে সাবানের সুন্দর মিষ্টি মৌ মৌ গন্ধ মাখানো প্যাকেট করা একটি কম্বল। ফ্যান চলছে তাও বেশ গরম লাগছিল। জানালার কাচ উপরে সামান্য খোলা ছিল, সেখান দিয়ে মাঝে মাঝে বাইরে থেকে সামান্য ঠান্ডা বাতাস এসে গা জুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ভেবেই পেলাম না কম্বল দিয়ে কি হবে!


বিছানার পাশে অবহেলা ভরে পরে থাকা প্যাকেট করা কম্বল

শহর এলাকা পার হতেই জানালার বাইরে ঘুটঘুটে আঁধার নেমে আসলো।কাঁচে নাক ঠেকিয়েও কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। বাধ্য হয়ে নজর দিলাম ভেতরে। আমাদের পুরো বগিটাই মনে হলো পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত। এদের মাঝে আমরা দুজন ছাড়া আর সবাই ইউরোপ অথবা আমেরিকান ব্যাগ প্যাকার্স। পাশের কম্পার্টমেন্টটাই হলো রেস্টুরেন্ট। খানিক পরে সেখান থেকে এক হাসিখুশী মহিলা মেনু এনে জানতে চাইলো রাতে কিছু খাবো কিনা? যদিও বেশ কিছু শুকনো খাবার সাথে ছিলো তারপরও মুরগী,সবজী আর স্টিকি রাইসের একটি থাই খাবার দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না, ২০০ বাথ তার দাম।


ছবিটা ২০১৫ এর হলেও খাবারটা ঠিক এমনই ছিল।

রাত প্রায় বারোটা বাজে, সব যাত্রীরাই যে যার মত খেয়ে দেয়ে পর্দা টেনে শুয়ে পড়লো, চার বার্থের কুপে নীচের দুদিকের বার্থ দুটো ছিল আমাদের দুজনার জন্য । চেয়ে দেখি পাশে উপরের বাংকের শ্বেতাংগ লোকটি শুয়ে শুয়ে চিয়াং মাই এর উপর লেখা একটি বই গভীর মনযোগ দিয়ে পড়ছে। শুধুমাত্র এই জ্ঞ্যানটুকু লাভের কারনেই তারা যে কোনো জায়গায় গিয়ে পরিপুর্নভাবে সে স্থানটিকে দেখে আসতে পারে। আমাদের মত টাউট বাটপারের পাল্লায় খুব কমই পরতে হয় তাদের।


ছুটে চলা ট্রেনের জানালা দিয়ে তোলা

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা তবে মাঝ রাতে প্রচন্ড শীতে যখন ঘুম ভেঙ্গে গেলো তখন বিছানার কোনে অবহেলায় ছুড়ে দেয়া কম্বলের মাহাত্য অনুধাবন করতে পারলাম। কাঁপতে কাঁপতে জানালার কাঁচ পুরোটা বন্ধ করে কম্বল মুড়ি দিয়ে আবারো ঘুমানোর চেষ্টা করছি, কিন্ত ফল হলো না, ঠান্ডায় বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। শুয়ে শুয়েই টের পাচ্ছি ট্রেনটি কখনো তার গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে, কখনো বা দুলে দুলে যাকে বলে ঢিমে তেতালে এগিয়ে চলেছে নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে।


সব কিছুতেই থাইদের রুচির পরিচয় বহন করে যা চিয়াং মাই স্টেশন এর নামফলকেও লক্ষনীয়

চলবে ---

১০০ বাথ = ২৪৫ টাকা ।

ছবিঃ হাইওয়ের ছবিটি ছাড়া বাকি সব আমাদের ক্যামেরা ও মোবাইল ফোনে তোলা ।
কপিরাইটঃ লেখকের বিনা অনুমতিতে এই লেখা ও ছবি যে কোন মিডিয়ায় পুর্ন অথবা আংশিক প্রকাশ অগ্রহনযোগ্য ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১০
৬৩টি মন্তব্য ৬৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×