মুন্ডুবিহীন ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ মুর্তি, একই ধর্মের অনুসারীর হাতে সংঘটিত।
ইতিহাসে পড়লে বোঝা যায় একদা বার্মা বর্তমান মায়ানমার সব সময়ই মনে হয় এক নিষ্ঠুর হিংস্র জনগোষ্ঠির বিচরনভুমি। এক সময়ের স্বাধীন রাজ্য আরাকানকে দখল করে সেখানকার জনগনের উপর দীর্ঘদিন ধরে কি নির্মম অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে মায়ানমার প্রশাসন তা ইলেকট্রনিক আর প্রিন্ট মিডিয়া খুললেই বিশ্ববাসী দেখছে । নাগরিক অধিকার হরণ করে রাখা এই লোকগুলিকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদই শুধু নয় খুন, ধর্ষন, অত্যাচার ছাড়াও তাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে সরকারী মদদপুষ্ট বর্মী জান্তাবাহিনী সাথে বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও সামিল। বার্মার নির্যাতিত এই জাতি বিশ্বে রোহিংগা জাতি হিসেবে পরিচিত। আত্মীয় পরিজন হারিয়ে প্রানটুকু সম্বল করে আজ তারা আমাদের দেশের আশ্রয়প্রার্থী। আমাদের ছোট দেশ, সম্পদও অল্প তাই হয়তো আমরা তাদের সেভাবে জায়গা দিতে পারছি না । কিন্ত তাদের চোখের জলে আমাদের হৃদয় ভেসে যাচ্ছে।
বর্মী বাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাচীন রাজধানী আয়ুথিয়ার কিছু ক্ষত চিনহ
বার্মিজরা নরম প্রতিবেশী পেলে বিনা কারনে বা সামান্য অজুহাতে আক্রমন করে বসে যার প্রমান দেখি থাইল্যান্ডের ইতিহাসে। একদা থাইল্যান্ডের অর্থাৎ শ্যামদেশের রাজধানী এক জৌলুসময় সম্পদশালী সমৃদ্ধ নগরী আয়ুথিয়া মোট দুই দুইবার বর্মীদের আক্রমনের শিকার হয়।প্রথমবার ১৫৪৭ সনে আর দ্বিতীয়বার ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে। দ্বিতীয়বার আক্রমনের পরে আয়ুথিয়া রাজের সন্ধির আমন্ত্রন প্রত্যাখান করে এই হিংস্র বর্মী বাহিনী ১৭৬৭ এর ৭ই এপ্রিল অবরুদ্ধ আয়ুথিয়ার লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত জনগনসহ সমস্ত স্থাপনাসমুহ জ্বালিয়ে পুড়ে ছারখার করে দিয়েছিল। এই ঘটনা আজও এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে একটি গভীর কালো দাগ রেখে গেছে।
রাজপ্রাসাদের একাংশ।
এই ইতিহাসটা আমাদের জানা হতো না যদি না মাস দুয়েক আগে এক থাই বন্ধুকে আমাদের সাথে মায়ানমার সফরের আমন্ত্রন জানাতাম । আমাদের কথা শোনার সাথে সাথে তার স্বভাবের বাইরে গলার স্বর তুলে দৃঢ় ভাবে বল্লো,
“না না আমি বার্মা যেতে চাইনা, ওরা বর্বর, আমাদের দেশ আক্রমন করেছে, আমাদের দেশের মানুষকে মেরেছে এবং সবার ওপরে তারা আমাদের গড লর্ড বুদ্ধার মুর্তিগুলো ধ্বংস করে দিয়ে গেছে”।
একটি ধর্মীয় স্থাপনার সামনে মাথাবিহীন তিনটি বুদ্ধ মুর্তি।
এই ব্যাপারটাই আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছিল ২০১৬ র ফেব্রুয়ারীতে আয়ুথিয়া নগরী সফর করতে গিয়ে। বর্তমান প্রত্মতাত্মিক এলাকা হিসেবে ঘোষিত এই নগরীর ধ্বংসস্তুপের মাঝে রয়েছে লাল ইটের অসংখ্য স্থাপনা যার ভেতরে আছে রাজপ্রাসাদ ও বিভিন্ন মন্দির, মঠ। দু একটা মন্দির দেখলাম কিছুটা সংস্কার করছে এবং বেশ কিছু বুদ্ধ মুর্তির মাথা পুনস্থাপন করেছে। সেসব মন্দিরে বুদ্ধ ধর্মের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল থাই জনগন পুজা অর্চনা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্ত রাজকীয় প্রাসাদ ও তার আশেপাশের স্থাপনাগুলো পুরোই ধ্বংসস্তুপে পরিনত। এসব স্থাপনার চারিদিক ঘেষে অজস্র বুদ্ধের মুর্তি যার বেশিরভাগই মাথা নেই।
লাল দেয়ালের গা ঘেষে সার সার মাথাবিহীন বুদ্ধের মুর্তি
এ বিষয়ে বলতে গিয়ে গাইড তার চোখেমুখে সামান্য ক্রোধের চিনহ ফুটিয়ে তুলে আমাদের জানিয়েছিল এটা বর্মী বাহিনীর নৃশংসতার প্রতীক। অবাক হয়ে ভাবছিলাম যুদ্ধের রীতি নীতি অনুযায়ী এক দেশ অন্য দেশকে আক্রমন করে ধ্বংস করতে পারে, সৈন্যদের মেরে ফেলতে পারে, কিন্ত সাধারন জনগনকে না খাইয়ে মেরে ফেলা এবং একই ধর্মের অনুসারী হয়ে তাদেরই পুজনীয় ইষ্ট দেবতার মুর্তির উপর আঘাত ও ধ্বংস করাতেই বোঝা যায় তারা ভেতরে ভেতরে কতটা পাশবিক আর হিংস্র একটি জাতি।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নেত্রীও যে কতটা নিষ্ঠুর নৃশংস হতে পারে তার প্রমান সেদেশের অং সান সুচী ।
মাটির গভীরে প্রথিত হয়ে যাওয়া বুদ্ধের মাথাটি অশোক গাছের শেকড়ে জড়িয়ে আবার উঠে এসেছে ধরায়
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৫৫