somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমগ্র থাইল্যান্ডবাসীকে আরেকবার কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন কিম্বদন্তীতুল্য মহান রাজা ভুমিবল

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কল্পিত স্বর্গের আদলে তৈরী রাজা ভুমিবলের স্বর্নালী অগ্নিশয্যা ফ্রা মেরু মাস জ্বলে ওঠার জন্য প্রস্তত
ছাব্বিশে অক্টোবর ২০১৭ বৃহস্পতিবার থাইল্যান্ডের জনগনের জন্য ছিল এক চিরস্মরণীয় শোকাবহ দিন। বছরব্যাপী শোক পালনের পর এবার সময় হলো প্রানপ্রিয় রাজা ভুমিবলের নশ্বর দেহকে স্বর্গে পাঠানোর দিন। আপামর থাই জনগন যার মাঝে আছে উচ্চ শিক্ষিতও তাদেরও দৃঢ বিশ্বাস যে তাদের রাজা একজন দেবতা সুতরাং ২০১৬ এর ১৩ই অক্টোবর মৃত্যুর পরপরই তাঁর আত্মা স্বর্গে চলে গিয়েছে। তাঁর নশ্বর দেহটিও স্বর্গবাসী আত্মার সাথে যেন মিলিত হতে পারে তার জন্য সারা বছর ধরে রাজ্য জুড়ে আয়োজন করেছিলো এক মহাযজ্ঞের।


ওগো মা রাজার দুলাল যাবে আজ শেষবার তাঁর ঘরের সন্মুখ পথে
শোকাকুল জনগনের প্রতি সরকারী অনুরোধ ছিল এক মাসের জন্য কালো পোশাক পরার। থাই জনগন কেবল একমাসই নয়, গত একটি বছর ধরে কালো পোশাকে নিজেদের আবৃত করে শোক প্রকাশ করেছে। এটা কারো নির্দেশে নয়,করেছে তাদের ভেতরের আবেগ, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়। থাই জনগনের একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল তাদের রাজা ভুমিবল যিনি বর্তমান চক্রী বংশের নবম রামা উপাধীতে ভুষিত। নিয়মতান্ত্রিক রাজা হয়েও দেশের সবার কাছে ছিলেন সর্বোচ্চ সন্মানের আর ভালোবাসার একজন, ছিলেন চুড়ান্ত ঐক্যের প্রতীক। দেশের দূঃসময়ে বারবার তিনি দৃঢ় হাতে হাল ধরেছিলেন, দিয়েছিলেন দিক-নির্দেশনা যা অমান্য করার সাহস হয়নি কখনো কারো। আর এটা ছিল শুধু মাত্র দেশের প্রতি, তাঁর জনগনের প্রতি গভীর মমতার জন্য।


মেয়েকে নিয়ে মাটিতে বসে হাতে কলমে সট্রবেরী চাষ শিক্ষাচ্ছেন উত্তরে চিয়াং মাই এর পাহাড়ী প্রজাদের
সোনার সিংহাসনে বসেও তিনি ছিলেন মাটির কাছাকাছি, ছিলেন তাঁর প্রিয় প্রজাদের হৃদয়ের একান্ত গভীরে। তাঁর সত্তর বছরের দীর্ঘ রাজত্বকাল জুড়ে অমানুষিক পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে কৃষিকাজে প্রাচীন রীতি নীতির উপর নির্ভরশীল থাইল্যান্ডের জনগনকে বিশ্বে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখে গেছেন। উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সাফল্য ছিল ঈর্ষনীয়, যার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান তাঁর হাতে আজীবন সন্মাননা স্মারক তুলে দেয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত সাফিসিয়েন্সী ইকোনমির সুফল আজও ভোগ করছে সমগ্র থাইবাসী।


আমি ভিক্ষে করে ফিরতেছিলাম গ্রামের পথে পথে, তুমি তখন চলেছিলে তোমার স্বর্নরথে ।
অপুর্ব এক স্বপ্ন সম লাগতেছিল চোক্ষে মম, কি বিচিত্র শোভা তোমার কি বিচিত্র সাজ।
আমি মনে ভাবতেছিলাম এ কোন মহারাজ !


রাজা ভুমিবলের জন্য প্রস্তত অগ্নিশয্যা ফ্রা মেরু মাস
থাই শিল্প ও সংস্কৃতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাজা ভুমিবলের প্রয়ানের সাথে সাথেই শুরু হয় কত আড়ম্বর আর কত সুন্দর ভাবে তাঁর শেষ কৃত্যের আয়োজন করবে তার বছরব্যাপী পরিকল্পনা। রাজপরিবারের জনপ্রিয় মুখ, আজন্ম রাজার সকল উন্নয়ন কাজের সাথী প্রিয় কন্যা মহাচাক্রী শ্রীনির্ধন ছিলেন এই কমিটির প্রধান, যাকে নির্বাচন করেছিলেন বর্তমান রাজা মহাভাজিরালংকর্ন।


দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত রাজার প্রতীক
থাই আর্ট এন্ড কালচারের প্রধান ডিজাইনার Korkiat Thongphut ও art technician Theerachat কে রাজা ভুমিবলের মৃত্যুর পর পরই নির্দেশ দেয়া হয় তাঁর শেষ শয্যা তৈরীর জন্য। চোখের জল মুছে তারা দুজন সহযোগীদের নিয়ে শুরু করেন এই নকশাঁর কাজ। অনেক ভাবনা চিন্তা আর বাছাইয়ের পর অবশেষে রাজবাড়ির পাশেই ৭৩ হেক্টর জায়গা জুড়ে সানাম লুয়াং নামে যে বিশাল খোলা চত্বরটি রয়েছে সেখানে তৈরী করা হলো অসাধারন নান্দনিক নকশাঁর সেই স্থাপনাটি যা ফ্রা মেরু মাস নামে তারা নামাকরন করেছেন।


রাজার প্রতি অসীম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিয়ে গড়ে তুলছে তার চির বিদায়ের স্থানটি।
শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম অগ্নিশয্যাটি তৈরী করতে বৌদ্ধ এবং হিন্দু মিথের আশ্রয় নিয়েছেন শিল্পীরা। নীল সমুদ্রের মাঝে ৫৩ মিটার উচু এবং ৬০ মিটার প্রস্থ জুড়ে অপুর্ব কারুকার্য্য আ্রর ভাস্কর্য্যে সাজানো স্বর্নালী স্বর্গীয় স্থাপনাটি বৌদ্ধ ধর্মের কল্পিত স্বর্গ সুমেরু পর্বতের আদলে তৈরী করা হয়েছে। এতে পৌরানিক কাহিনীর অনেক চরিত্রর সাথে যুক্ত করা হয়েছে রাজার প্রিয় দুই কুকুরকে যার একজন তোংদায়েন যাকে নিয়ে রাজা একটি বইও লিখেছিলেন। প্রায় এক বছর ধরে থাইল্যান্ডের বাঘা বাঘা শিল্পীদের দিন রাতের দক্ষ হাতের ফসল রাজার বিদায় অগ্নিশয্যা।


পৌরানিক চরিত্রের ভাস্কর্য্য
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কালো পোষাকে আপাদমস্তক ঢাকা লাখো জনতার ঢল শুরু হয়েছিল রাজকীয় প্রাসাদের আশেপাসে। যে পথ দিয়ে রাজার দেহটি নিয়ে সোনায় মোড়ানো অপরূপ কারুকার্য্যময় বিজয় রথটি যাবে তা এক নজর দেখার জন্য অনেকেই তিনদিন ধরে কখনো গা পুড়ে যাওয়া রোদ মাথায় নিয়ে রাজার ছবি হাতে বসে আছে নির্বাক। তাদের চোখ বেয়ে মাঝে মাঝে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা যা কখনোবা ঢল বৃষ্টি এসে ধুইয়ে দিচ্ছে কোন অতিলৌকিক করুনাময় হাতের পরশ নিয়ে।


পথের ধারে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে আছে রাজার ছবি বুকে নিয়ে অসীম ধৈর্য্যের সাথে।
এই রথে যে থাকবে তাদের প্রিয় রাজার নিস্তব্দ দেহখানি। শেষবারের মত ছুটে এসেছে কালের সাক্ষী হতে, শুধু একবার চোখের পানিতে কম্পিত ঠোটে, হৃদয় মন্থন করে বিদায় বলবে মনে মনে।


উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে, ঐ যে তিনি ঐ যে বাহির পথে ।

আমি ২২ শে অক্টোবর এলাকাটির আশপাশ থেকে ঘুরে এসেছি। তখন চলছিল রাস্তার দুপাশ জুড়ে ফুলের কারুকাজ। লাখো লাখো ফুলের মেলা বসেছিল রাজপুরী যাবার বিশাল চওড়া পথ Ratchadamnoen_Avenue র দুপাশের ফুটপাত জুড়ে। সরকারী ভাবে ঘোষনা করা হয়েছিল বিদেশীদের যাওয়াতে নিষেধ নেই তবে সানাম লুয়াং চত্বরে ঢুকতে হলে কঠোর ড্রেস কোড মেনে চলতে হবে। এছাড়াও পাসপোর্ট সাথেতো নিতেই হবে ।

যাতায়তের ব্যাপারটিও মাথার মধ্যে ছিল। সরকার সাধারন নাগরিকদের যাতায়তের সুবিধার্থে শহরের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রচুর সাটল বাসের ব্যাবস্থা করেছে কিন্ত বাসের গায়ে থাই ভাষায় লেখা পড়ে গন্তব্য খুজে বের করা সম্ভব নয়।তাছাড়া আমার শারিরীক অবস্থাও তা পারমিট করছিলো না । সুতরাং টিভিই ছিল আমাদের মত অনেকেরই ভরষা।


রাজ প্রাসাদে যাবার পথের দু পাশে অপুর্ব নকশায় ফুলের সারি

টিভিতে দেখলাম এই যে প্রায় তিন লাখ সাধারন মানুষ সেখানে উপস্থিত তারপরও কোন ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি, বিশৃংখলার কোন দৃশ্য নজরে এলো না।জায়গায় জায়গায় বিনে পয়সায় খাবার দিচ্ছে, পানীয় দিচ্ছে, স্বাস্থ্য সেবা দিচ্ছে কিন্ত সবাই সুন্দর লাইন বেধে তা পালন করছে। এমন কিছু করছে না যাতে রাজার প্রতি অসন্মান দেখানো হয়।


সারিবদ্ধ কালো পোশাকে থাই বাসীরা
২৬শে অক্টোবর ২০১৭ ভোরে আমরা টিভি খুলে বসেছি। পাঁচদিন ব্যাপী এই পুরো অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করবেন ভুমিবলের একমাত্র পুত্র ও তাঁর উত্তরাধিকারী দশম রামা রাজা মহা ভাজিরালংকর্ন। সকাল সাতটায় রাজার আগমনের সাথে সাথে পাঁচদিনব্যাপী শেষকৃত্য অনুষ্ঠান শুরু হলো দুসিত মহাপ্রসাদ থর্ন হলে। এই হলে যেখানে চন্দন কাঠের কফিনে রাজার দেহ সংরক্ষিত ছিল গত একটি বছর প্রিয়জন আর দেশবাসীর শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায়। রাজার কল্যান কামনা করে ধর্মীয় গ্রন্থ ত্রিপিটকের বানী উচ্চারিত হয়েছে অনুক্ষন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মুখ থেকে। আজও তার ব্যাত্যয় হয়নি।


দুসিত মহাপ্রসাদ থর্ন হল যেখানে গত এক বছর ধরে ছিল রাজার কফিন

স্ত্রোত্র পাঠ শেষে আজও রাজা প্রতিদিনের মত তাদের খাবার ও জাফরানী রঙের নতুন কাপড় দান করলেন। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা পালন করলেন একে একে । এবার নতুন রাজার অনুমতি নিয়ে রাজা ভুমিবলের কফিনের প্রতীক রাজকীয় উরন তুলে নিলেন বিজয় রথে যে রথটি আমি তৈরী অবস্থায় দেখে এসেছি ব্যাংকক মিউজিয়ামের একটি বিশেষ কক্ষে ।


একে একে নিভিছে দেউটি


ম্লান মুখে তাকিয়ে আছে রাজার কন্যারা। বাঁ দিক থেকে আজন্ম পিতার পথের অনুসারী মহাচাক্রী শ্রীনির্ধন , ডানে অপর কন্যা প্রিন্সেস উবলা রত্না রাজকন্যা


আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরন ধুলার পরে

সেই স্বর্নালী রঙের বিজয় রথটি টেনে নিয়ে গিয়েছিল লাল পোশাকের ৫০০ সদস্যের ড্রাম বাদক দলটি, মতান্তরে ২১৬ জন। এই দলে শরিক ছিলেন রাজকীয় চিকিৎসক সিরিরাজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ডিন, যিনি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত রাজার চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন। পাঁচশ জনের মধ্যে আরেকজনের কথা উল্লেখ না করলেই নয় সে ছিল রাজা ভুমিবলের বহুদিনের পুরনো ব্যাক্তিগত গাড়ীচালক যে কিনা গাড়ীর স্টিয়ারিং এর বদলে রথের দড়ি ধরে টেনে টেনে শেষবারের মত গন্তব্যে পৌছে দেন তার প্রিয় মালিককে।


রাজার সার্বক্ষনিক চিকিৎসক অশ্রুসজল চোখে দেশের ৬ কোটি জনগনের উদ্দেশ্যে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন "রথের রশিতো সবাই ধরতে পারবে না, আমার হাতটিই হবে আপনাদের সবার হাত"

সুর ভক্ত রাজা ভুমিবল ছিলেন চল্লিশটির উপর গান ও সুরের রচয়িতা। যে সুরের প্রতিধ্বনী আপনি এখানের আনাচে কানাচে কান পাতলে শুনতে পাবেন। নিপুন কারুকার্য্যময় সোনার উরনটি বিজয় রথের উপর বসিয়ে ড্রামের তালে তালে টেনে নেয়ার মিছিল পরিচালনার জন্য তাঁর কম্পোজ করা সুর থেকে তিনটি সুর বেছে নিয়েছিলেন কতৃপক্ষ।


জ্যাজ মিউজিকের ভক্ত ও নিজের গড়া ব্যান্ড দলের সদস্য রাজা ভুমিবল


সেই সুরের প্রতি ভালোবাসা তাঁর বৃদ্ধ বয়সের ছবিতেও দেখা যায়।

তবে কফিন বা উরনটি বয়ে নিয়ে যাওয়া ছিল প্রতিকী। এটি হচ্ছে প্রাচীন আয়ুথিয়া রাজত্বকাল থেকেই থাই রাজাদের একটি প্রথা। আগের দিনে নিয়ম ছিল রাজাদের মৃত্যুর পর না পোড়ানো পর্যন্ত খাড়াভাবে হাত পা বেঁধে হাত জোড়ের ভংগীমায় এই উরনের ভেতর বসিয়ে রাখা। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্যও একই ব্যাবস্থা। তবে রাজা ভুমিবলের শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে চন্দন কাঠের কফিনে শোয়ানো অবস্থায় রাখা হয়েছিল।


উরনের ভেতর মৃতদেহ রাখার পদ্ধতি ।


এটা ছিল প্রতিকী রাজকীয় উরন
পিতা ভুমিবলের লাশবাহী সেই বিজয় স্বর্ন রথের পেছনে পেছনে বর্তমান রাজা মহাভাজিলালংকর্ন এর নেতৃত্বে তাঁর তিন বোন উবালারত্না রাজকন্যা, মহাচাক্রী শ্রীনির্ধন এবং চুলাবর্ন, দুই মেয়ে প্রিন্সেস বাজরক্তআভা ও শ্রীভান্নাভারী নারীরত্না, রাজপুত্র রাশমীজ্যোতি । থাই রয়েল এয়ারফোর্স, থাই রয়েল নেভী, থাই রয়েল আর্মি, কিংস পার্সোনাল বডিগার্ড, পুলিশ ও মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যরা রাজার সৃষ্ট সুরের তালে তালে ধীরে ধীরে মার্চ করে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে প্রতীকি উরনটি নিয়ে বিজয় রথের সেই অল্প দুরত্বে পাড়ি দিতে দুপুর হয়ে এসেছিল।


থাই সৈন্য বাহিনীর সারি
বিজয় রথটি স্বর্নালী সেই প্রতীকি স্বর্গপুরীর সামনে এসে দাড়ানোর পর প্রতিকী উরনটি পুলির সাহায্যে উপরে তার জন্য নির্ধারিত স্থানে বসানো হলো। যে অবিশ্বাস্য দক্ষতা আর সুশৃংখলতার সাথে সব কিছু একে একে সম্পন্ন হচ্ছিল তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয়না। এরই মাঝে সবার অগোচরে রাজার কফিনটিও এনে রাখা হলো সেখানে । এরপর কিছুটা বিরতি দিয়ে বিকেলে এসে স্থাপনাটিতে বাতি জালিয়ে গেলেন নতুন রাজা মহা ভাজিরালংকর্ন। মুহুর্তের মাঝে আলোয় ঝলমল করে উঠলো পুরো স্থাপনাটি।


কফিনটি বসিয়ে দেয়া হলো মুল চত্বরে।
এই অনুষ্ঠানে প্রায় চল্লিশটি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহন করেছিল সম্পুর্ন স্বইচ্ছায়। পেপারে পড়েছি তারা কাউকে অফিসিয়ালী আমন্ত্রন জানায়নি, তবে কেউ যদি নিজ আগ্রহে আসে তবে তাকে সাদর আমন্ত্রন জানাবে। তারা জানিয়ে দিয়েছে তাদের প্রথম অগ্রাধিকার নিজ দেশের জনগনের অংশগ্রহন। সেই প্রত্যাশার মুল্য দিয়েছে সানাম লুয়াং ও আশেপাশে হাজির হওয়া তিন লাখ মানুষ।


বিশ্ব প্রতিনিধিদের মাঝে হলুদ ফিতায় সস্ত্রীক ভুটানের রাজা জিগমে খেসার ওয়াংচুক সামনের সারিতে বসা

রাজা ও যথাক্রমে তার তিন বোন কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর একে একে সব দেশের প্রতিনিধিরা সেখানে উঠে ফুল দিয়ে রাজার প্রতি তাদের শেষ শ্রদ্ধা জানান। তারপর সবাই রাজা ও তাঁর বোনদের সাথে করমর্দন করে শোক জ্ঞ্যাপন করেন। আমাদের বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধিও গিয়েছিলেন। কিন্ত ক্যামেরা অত কাছে না হওয়ায় তাকে সেই মুহুর্তে চিনতে পারিনি।


যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দ-মন্থরে, সব সুর গেছে থামিয়া। তবু বিহংগ ওরে বিহংগ মোর, এখনি অন্ধ বন্ধ কোরোনা পাখা।

রাত সাড়ে দশটায় চিতা্র অনল জলে ওঠার কথা, বিভিন্ন চ্যানেল সেই বিশাল প্রাঙ্গন থেকে রাজাকে উদ্দেশ্যে করে আবেগ ঘন গান, পৌরানিক কাহিনী নিয়ে মুখোশ নাচ হচ্ছে। সাঝ নেমে আসার আগেই চিতা প্রাঙ্গনে বাতি জ্বালিয়ে গেলেন নতুন রাজা।


মুহুর্মুহু কামানের গোলার শব্দে প্রিয় রাজার বিদায় বার্তা ঘোষিত হচ্ছে
রাত প্রায় বারোটা বাজে, তখন ভাবছিলাম কি হলো? ওরাতো ঘড়ির কাটা ধরে সব কিছু করছে তাহলে এখনো অগ্নি সংযোগ করছে না কেন! পরে জানতে পারলাম দেশবাসীর প্রবল প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে রাজপরিবারের ইচ্ছায় এই অনুষ্ঠানটি টিভিতে সরাসরি দেখানো হবে না। কিন্ত বিষয়টি আমরা জানতামনা।পরদিন পেপারে দেখলাম রাত সাড়ে দশটায় শুধুমাত্র রাজ পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে দশম রামা রাজা মহা ভাজিরালংকর্ন পুত্র হিসেবে তার মুখাগ্নি করেন।


দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সেই স্বর্নালী স্বর্গপুরীর আগুন
পরদিন ২৭ শে অক্টোবর শুক্রবার সকাল ৮.৩০ মিনিটে বৌদ্ধ ভিক্ষু সহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাই রাজা ফিরে আসেন তাঁর পিতার ছাই হয়ে যাওয়া দেহবাশেষ কুড়িয়ে নিতে । টিভিতে দূর থেকে দেখা গেলো একটি উচু প্লাটফর্মে জড়ো করে রাখা কিছু হাড় ছাই। একটি একটি করে সেই হাড় তুলে নিয়ে পবিত্র পানিতে ডুবিয়ে একে একে পদ্মফুলের আকারের তিনটি সোনার পাত্রে রাখলেন।


রাজা মহা ভাজিলালংকর্ন তার পিতার দেহাবশেষ তিনটি পাত্রে পবিত্র পানি দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে রাখছে।
মোট তিনটি স্বর্ন পাত্রে পিতার দেহাবশেষ নিয়ে সোনার বরন পাল্কীতে করে পুর্ন মর্যাদায় আবার গ্রান্ড প্যালেসে ফিরিয়ে আনলেন রাজ পুত্র মহাভাজিরালংকর্ন । এর একটি গ্রান্ড প্যালেসের ওয়াট ফ্রা খিউতে থাকবে আর বাকি দুটো থাইল্যান্ডের দুটো বিখ্যাত ও পবিত্র মন্দিরে রাখা হবে যার একটিতে তাঁর পিতা দীক্ষা নিয়েছিলেন ভিক্ষু হিসেবে।


রাতের আলোয় রাজপ্রাসাদ
মুল এই স্থাপনায় সবার আসা সম্ভব না ভেবেই সরকারী নির্দেশে তৈরী হয়েছে দেশের ৭৬ টি বিভাগে একটি করে ৭৬ টি রেপ্লিকা এবং বাকি নয়টি ব্যাংককে। ছাওপ্রায়া নদীর ধারে যেখানে আছে থাইল্যান্ডের বিশাল ফুলের বাজার, ঐতিহাসিক মেমোরিয়াল ব্রীজ ও ১ম রামার স্ট্যাচু সেখানে তৈরী রেপ্লিকাটি কাছ গিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার ।


ছাওপ্রায়া নদীর উপর মেমোরিয়াল ব্রীজের পাশে একটি রেপ্লিকা যেখানে আমি গিয়েছি ২৫শে অক্টোবর
রাজার উদ্দেশ্যে শেষ নিবেদন হিসেবে সব জায়গায় সারিবদ্ধ ভাবে থাইরা গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় একটি করে চন্দন কাঠের তৈরী ফুল উৎসর্গ করেছে যার বেশ কিছু আমিও তৈরী করেছিলাম । প্রায় এক বছর ধরে দেশব্যাপী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বিভিন্ন শপিং মলে তৈরী হয়েছে এই লাখ লাখ ফুল ।


এখানে আমার বানানো ফুলও রয়েছে


মেমোরিয়াল ব্রিজের সামনের রাস্তায় পাশের ফুল দোকানীদের ফুল দিয়ে তৈরী থাইল্যান্ডের জাতীয় পতাকা


ফুল ব্যাবসায়ীরা ফুল দিয়ে রাজার পদবী ৯ অক্ষরটি সৃষ্টি করেছে
প্রায় তিন বিলিয়ন বাথ অর্থাৎ ৯০ মিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে রাজার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে। তাতেও থাইবাসীদের কোন অনুযোগ, অভিযোগ বা আক্ষেপ নেই। তাদের কথা হলো তাদের পিতা তাদের জন্য যা করেছে তার ভগ্নাংশও তারা তাকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি, সারাজীবন তারা শুধু নিয়েই গিয়েছে। থাইল্যান্ডের একটি প্রজন্ম রাজা হিসেবে ভুমিবলকেই জেনে এসেছে।


মেমোরিয়াল ব্রিজের দুধারে এমনি অর্কিডে সাদা হয়ে আছে পথ
আমার এদেশ ত্যাগ করার কথা ছিল এ মাসের মাঝামাঝি । শুধুমাত্র এই অনুষ্ঠানটি দেখার জন্য আমি যাত্রা পিছিয়েছি যার ফলে কোটি মানুষের অন্তর নিংড়ানো ভালোবাসা্র সাক্ষী হোলাম আমিও।

বেশিরভাগ ছবি টিভি থেকে মোবাইলে তোলা, রেপ্লিকার ছবি আমার মোবাইলে । দু একটা ছবি বিভিন্ন সুত্র থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৭
৫৮টি মন্তব্য ৫৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×