লান্না স্টাইলে নির্মিত বাড়ী
একজন শিল্পী সে হতে পারে চিত্রকর বা ভাস্কর।তাদের কথা চিন্তা করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইতালীর রেঁনেসা যুগের জগৎ বিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো, আমাদের দেশের গর্ব জয়নুল আবেদীন,এস এম সুলতান, স্পেনের পিকাসো অথবা ভারতের মকবুল ফিদা হোসেনের মুখ। কিন্ত থাইল্যান্ডেরও যে একজন শিল্পী তাঁর ব্যতিক্রমী শিল্পকর্ম দিয়ে সারা বিশ্বে ঝড় তুলেছেন তাকে আমরা কজনাই বা চিনি! নাকি তার নামই শুনেছি কখনো! না, উনি আমাদের অনেকের কাছেই অজানা, অচেনা হয়েই আছেন। এই না চেনা শিল্পীর নামটি হচ্ছে থাওয়ান দাচেনে (Thawan Duchanee)
শিল্পী থাওয়ান দাচেনের নিজ ভাস্কর্য্য
বিখ্যাত সেই শিল্পীর শিল্পকর্মের সাথে পরিচিত হবার জন্য দ্বিতীয় বারের মত উড়ে গিয়েছিলাম ব্যংকক থেকে সুদুর উত্তরের প্রদেশ চিয়াং রাই। মূল শহর থেকে সামান্য দূরে বিশ মিনিটের গাড়ি পথ পেরিয়ে গেলেই সীমান্ত শহর মেসাই প্রদেশ, সেই মেসাই যার পাহাড়ী গুহায় এ বছরের জুন মাসে হারিয়ে যাওয়া ১২ জন কিশোর ফুটবলার উদ্ধার নিয়ে বিশ্বব্যাপী ঝড় উঠেছিল। পাহাড় ঘেরা এই নিরিবিলি মেসাই শহরই তাঁর জন্মভুমি ।
কালো যাদুঘরের সদর দরজা
প্রায় দশটার সময় এসে উপস্থিত হোলাম শিল্পী থাওয়ান দাচেনের বানদাম মিউজিয়াম অর্থাৎ কালো গৃহের সদর দরজায়। মাথাপিছু ৮০ বাথ দিয়ে টিকিট কেটে কাঠের গেট পেরিয়ে হাজির হোলাম বিশাল প্রাঙ্গনের এক প্রান্তে। ঢোকার সময় হাতে ধরিয়ে দিল একটি ব্রশিওর তাতে রয়েছে দাচেনের দীর্ঘ শিল্পী জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও স্থানটির সংক্ষিপ্ত নির্দেশিকা। ঘন পাতায় আচ্ছাদিত এক বড় গাছের ছায়ায় গুড়িতে ঠেস দিয়ে বসে বসে পড়লাম তার সম্পর্কে কিছু কথা।
মিউজিয়ামে ঢুকতেই প্রধান আশ্রম ঘর
শিল্পী থাওয়ান দাচানে, ১৯৩৯ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর থাইল্যান্ডের চিয়াং রাই প্রদেশে জন্মগ্রহন করেন । অধ্যাপিকা শিল্পা ভিলাশ্রীর ছাত্র হিসেবে শিল্পাকম ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্য্য বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী অর্জন করেন । ম্যূরাল পেইন্টিং , মনুমেন্ট এবং আরবান প্লানিং নিয়ে শেষ করেন তার মাষ্টার্স কোর্স ।আমস্টারডাম, নেদারল্যান্ডের রয়্যাল একাডেমী অব ভিজ্যুয়াল আর্টস থেকে মেটাফিজিক্স আর এ্যাসথেটিকস নিয়ে সমাপ্ত করেন তাঁর পিএইচডি ।
চল্লিশটি বাড়ির একটি বাড়ী
আন্তর্জাতিক শিল্প জগতে সুনাম অর্জনকারী থাই চিত্রশিল্পীদের মাঝে থাওয়ান দুচানেও একজন । ৫০ বছরেরও বেশী সময় ধরে তিনি অনবদ্য শৈল্পিকতার সাথে যে সব শিল্পকর্ম করেছেন তা বিশ্বে স্বীকৃত । তাঁর শিল্পকর্ম “ দ্য ড্রয়ার” বুদ্ধের আদর্শকে (বুদ্ধিজম) সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে কি ভাবে ধারন করা হয়েছে যেন তাঁরই গভীর আর সতেজ প্রতিফলন । প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য দর্শনের সংমিশ্রনে এ যেন থাই আধ্যাতিকতার স্ফুরণ । থাই চিত্রশিল্পকে বহির্বিশ্বে জনপ্রিয় করতে থাওয়ান দাচেন দেশে ও বিদেশে তাঁর চিত্রশিল্পের প্রদর্শনীর মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন । আন্তর্জাতিক শিল্প সন্মেলনগুলিতে কখনও কখনও তাকে অতিথি বক্তা হিসেবে দেখা যায় । থাইল্যান্ড ও এশিয়া সহ ইয়োরোপ এবং উত্তর আমেরিকার বেশ কিছু দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট আর্ট মিউজিয়ামে তার কিছু কিছু চিত্রকর্ম জাতীয় সম্পদ হিসাবে স্থায়ী ভাবে প্রদর্শিত হয়ে আছে ।
ঘরের সদর দরজার উপরে কাঠের কি সুক্ষ অপরূপ কারুকাজ
আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অনেকেই তার জীবন ও শিল্পকর্ম নিয়ে ইতিমধ্যেই আগ্রহে মেতে উঠেছেন এবং অনেক প্রকাশনা, মুভি ক্লিপ আর টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে তিনি পরিচিত হয়ে উঠছেন । ২০০১ সালে তিনি“ফুকুওমা এশিয়ান কালচার প্রাইজ কমিটি” র দেয়া “আর্ট এ্যান্ড কালচার” পুরস্কার লাভ করেন । ভিজ্যুয়াল আর্ট শিক্ষায় থাওয়ান দুচানে ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা শিল্পের জগতে তার একটি অবদান । চিয়াং রাই এর মেসাই এ ১০০ রাই অর্থাৎ প্রায় ৪০ একর জায়গা নিয়ে গত ৫০ বছর ধরে তিনি গড়ে তুলছেন“ বানডাম মিউজিয়াম” নামের একটি লোকশিল্প যাদুঘর । এই যাদুঘরে রয়েছে অতীত আর বর্তমানের বিভিন্ন রকমের লোকশিল্প । এর শিক্ষনীয় মূল্য অসীম আর এটা তরুন প্রজন্মের জন্য শেখার একটা জায়গাও করে দিয়েছে । চিত্রশিল্পের জন্য থাওয়ান দাচানেকে সম্মানের সাথে ২০০১ সালের জাতীয় শিল্পীর মর্যাদা দেয়া হয় ।
শিল্পী থাওয়ান দাচেনের স্বপ্নের কালো বাড়ী
থাই ভাষায় “বান” হলো গৃহ বা বাড়ী এবং “দাম” মানে হলো কালো । এই কালোগৃহ শুধুমাত্র একটি ইমারতই নয় বরং বিভিন্ন আকৃতি নিয়ে শান্ত-সমাহিত একটি বাগানের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৪০টি ছোটবড় ঘরের সমষ্টি । এর স্রষ্টা থাওয়ান দাচানে এই বাগানটাকে সাজিয়েছেন ছোট ছোট ৪০টি কালোগৃহ দিয়ে যা তৈরী হয়েছে কাঠ, গ্লাস, কনক্রীট, ইট এবং টেরাকোটার কাজ দিয়ে যা এখন একটি যাদুঘর । দাচেনে একজন শিল্পীই শুধু নন তিনি একজন স্থপতিও বটে। তাই তো তার যাদুঘরটি এমন অনাবদ্য নিপুনতায় নির্মান ও সাজাতে পেরেছেন । স্থানীয় লোকজন ছাড়াও সারা বিশ্বের প্রচুর পর্যটক আসে এই অদ্ভুত যাদুঘরটি এক নজর দেখতে ।
শায়িত বুদ্ধের কাঠের মুর্তি
সাজানো হয়েছে থাওয়ান দাচানের শিল্পসংগ্রহ, ভাস্কর্য্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন প্রানীর হাড়, চামড়া, শিং, সোনা ও রূপার তৈরী সামগ্রী দিয়ে । এই কালোগৃহের অনেকগুলিতেই প্রদর্শিত হয়, সুবর্ণভূমি যুগ থেকে শুরু করে বর্তমানের লান-না এবং দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার স্থাপত্যশিল্প এবং চিত্রকলা । শিল্পের প্রতি নিবেদন থেকেই শিল্পী তার সকল সংগ্রহ দিয়ে সাজিয়েছেন এটিকে । এই ঘরগুলোর অনেকগুলো ব্যব্যহৃত হতো ধ্যানের জন্য । অনেকগুলো ঘরেই আমাদের কারো প্রবেশাধিকার ছিল না । কিন্ত শেকল ঘেরা দরজা আর বড় বড় খোলা জানালা দিয়ে দেখেছিলাম তাঁর অন্দর মহলটি।
কাঠের কারুকাজ আর পাথরের ভাস্কর্য্য
এ ঘরের টেবিল ক্লথটি বানানো হয়েছে নেকড়ে নাকি ভালুকের গা থেকে খুলে নেয়া আস্ত চামড়া। বসবেন কি খেতে ?
লোকজ শিল্পের সমাহার এই কালো ঘরে
এই ঘরটি সাজানো রয়েছে মহিষের শিং এর চেয়ার আর কুমিরের চামড়ার পাপোশ দিয়ে
শিং দিয়ে নির্মিত দাচেনের শিল্প।। এই শিং গুলো কিসের তা নিয়ে আমিও দিধ্বায়, মহিষ নাকি অন্য কোন প্রানী !
বসার ঘরটিতে মনে হচ্ছে কুমিরের চামড়া দিয়েই কার্পেট বানাতে চেয়েছিল শিল্পী
দেয়াল ঘেষে সাজিয়ে রাখা সারি সারি চেয়ার। তবে কাঠ বা অন্য কিছুর নয়, এই সেই শিং দিয়েই তৈরী।
কাঠের ঘোড়া তার নির্মানে কি নান্দনিকতার ছোয়া
বিশালাকৃতির শংখ সাজিয়ে রাখা হয়েছে মেঝেতে
শিল্পীর হাতে সাজানো এই পাথরের শিল্পকর্ম
বিশাল ঝিনুকের মাঝে গচ্ছিত রাখা মুদ্রা আর তা দেখে এগিয়ে আসছে কুমির
প্রাঙ্গন জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাঁর কালো বাড়ী
কালো কাঠের তৈরী আরেকটি ঘরের নিদর্শন
প্রাচীন নির্মান রীতিতে তৈরী কুটির
কাঠের নৌকা, পলো ইত্যাদি সব চিরায়ত লোক শিল্পের উদাহরন
পৌরানিক কাহিনীর পাথরের দৈত্য
কালো যাদুঘরের বিশাল প্রাঙ্গনে
প্রধান আশ্রম ঘরের এক কোনে বসে আপনমনে বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে ক্ষুদে শিল্পীরা
কাঠের উপর অসাধারন নৈপুন্যে নির্মিত গনেশ প্রধান আশ্রম ঘরে দন্ডায়মান, হিন্দু ধর্মের সিদ্ধিদাতা গনেশ থাইল্যান্ডে শিল্পের দেবতা হিসেবে গন্য হয়ে থাকে।
বাঁশের তৈরী বিশাল এক ছাতার কাঠিগুলোও যেন এক শিল্প
শ্বেত মর্মর পদ্মের উপর ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ।
পেছন ফিরে বিদায় নিলাম এক ব্যতিক্রমী শিল্পীর সৃষ্ট বানডাম মিউজিয়াম থেকে
সব ছবি আমাদের মোবাইলে তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ১১:৫৫