'আমার কথা -৩১' পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুনঃ আমার কথা -৩১
উত্তাল একাত্তরঃ
ক্যাডেট কলেজে থাকলেও ঊনসত্তর থেকে ঘনীভূত হওয়া দেশব্যাপী রাজনৈতিক আন্দোলন সমূহের সাফল্য আমার মনে উৎসাহ আর আগ্রহের সৃষ্টি করেছিলো। ঊনসত্তর এর ছাত্র আন্দোলনের ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ এর অভূতপূর্ব সফল নেতৃ্ত্ব দেখে গর্বিত বোধ করতাম। ঐ সময়ে আমার এক নিকটাত্মীয় ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকতেন। তারা তাদের কি একটা সমস্যা নিয়ে থানায় পুলিশের সাহায্য চাইতে গেলে থানার ওসি তাদেরকে বলেছিলেন, “তোফায়েল সাহাবকো পাস যাও। উনুনে আপকো আচ্ছা মদদ করনে সাকতা। উনকো রিকমন্ডেশন লে কার আও”। অর্থাৎ তোফায়েল সাহেবের নেতৃ্ত্ব আর কর্মদক্ষতার প্রতি অবাঙ্গালী পুলিশেরও যথেষ্ট আস্থা তৈ্রী হয়েছিলো। তখন কলেজের ছুটি শুরু হওয়াতে আমি ঢাকার শেরে বাঙলা নগরে (তৎকালীন আইয়ুব নগর) আমাদের বাসায় অবস্থান করছিলাম। রাজপথের মিছিল দেখে ও শ্লোগান শুনে রোমাঞ্চিত হ’তাম। সত্তরের ১২ই নভেম্বরে দেশব্যাপী এক সাইক্লোন বয়ে যায়। এর ফলে দেশের নিম্নাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে এবং ফসলের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এহেন জাতীয় দুর্যোগের সময় কেন্দ্রীয় সরকারের সীমাহীন অবহেলা প্রত্যক্ষ করে দেশবাসীর ন্যায় আমার কিশোর মনেও চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিলো। তখনকার মুখ্য রাজনৈ্তিক নেতৃবৃন্দ সকলেই অত্যন্ত সাফল্যের সাথে পশ্চিমা শাসকদের এই চরম বৈষম্য এবং উদাসীনতার কথা দেশের সাধারণ মানুষকে বোঝাতে পেরেছিলেন। তাই এর ফল পেতেও বেশী দেরী হয় নি। সত্তরের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। প্রায় পুরো বাঙালী জাতি তাদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একতাবদ্ধ হয়।
১৯৭১ সালের ০১ মার্চ ঢাকার মতিঝিলের হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সভা চলাকালে দুপুর একটা পাঁচ মিনিটে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে আকস্মিকভাবে বেতার ঘোষণা দেয়া হয়ঃ “পাকিস্তান আজ চরম ও ভয়াবহ রাজনৈ্তিক সঙ্কটের সম্মুখীন। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈ্তিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এবং আরও কয়েকটি রাজনৈ্তিক দল ০৩ মার্চ ৭১ তারিখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার সংকল্প প্রকাশ করেছে। এছাড়া ভারতের পরিকল্পিত উত্তেজনাকর পরিস্থিতি জাতির সার্বিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। তাই আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান পরবর্তী কোন তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম”।
(তথ্যসূত্রঃ রেহমান সোবহান, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ঃ একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা-২০০০, পৃষ্ঠা-৭৭)
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ গভীর উৎকন্ঠার সাথে এ ঘোষণা শোনার পর বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। বিক্ষোভ শুধু রাজপথেই নয়, খেলার মাঠ পর্যন্ত গড়ায়। এ সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান একাদশ বনাম MCC (Marylebone Cricket Club) এর মধ্যকার খেলা অসমাপ্ত রেখে খেলোয়াড়গণও মাঠ ছেড়ে চলে যায়। অল্পক্ষণের মধ্যেই হাজার হাজার মানুষ বাঁশের লাঠি, লোহার রড, ভাংগা কাঠের টুকরা, এমনকি হাতের কাছে যে যা পেয়েছে, তাই নিয়েই হোটেল পূর্বাণীতে ছুটে আসে।
(তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৭-১৮)
একাত্তরের পহেলা মার্চের এই বেতার ঘোষণা আমি নিজ কানে আমাদের হাউজ কমন রুমে বসে শুনেছিলাম। যদিও আমি মূলতঃ সেই ক্রিকেট খেলার সর্বশেষ ফলাফল জানার জন্যেই কমন রুমে গিয়েছিলাম, তথাপি এই আকস্মিক ঘোষণায় আমারও আগ্রহ ঐ মুহূর্ত থেকে খেলার মাঠ ছেড়ে রাজনীতির মাঠের প্রতি স্থানান্তরিত হয়। এর পর থেকে প্রতিটা খবর শোনার চেষ্টা করতে থাকি এবং ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় উল্লসিত বোধ করতে থাকি। ০৩ মার্চ এর পর থেকে ঘটনার খুব দ্রুত পট পরিবর্তন হতে থাকে। কয়েক ঘন্টা পর পর বাংলা সংবাদ পাঠকদের দৃপ্ত কন্ঠস্বর দেশবাসীকে উজ্জীবিত করতে থাকে। তখনকার দিনে ঢাকা স্টেশনের খবর পড়া আরম্ভ হতো এভাবেঃ “রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা। খবর পড়ছি …..”। কিন্তু হঠাৎ একদিন শুনি খবর পাঠ শুরু হলো এভাবে- “ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে …. খবর পড়ছি”। খবর পড়া শেষও হলো এভাবে- “ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে এখনকার মত খবর পড়া এখানেই শেষ হলো”। অর্থাৎ খবর পাঠকের কন্ঠ থেকে ‘পাকিস্তান’ শব্দটা হঠাৎ উধাও! মনে পড়ে, এই নতুন স্টাইলে খবর পাঠ শুনে আমাদের কমন রুমে সবাই সেদিন মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছিলো এবং রেডিও পাকিস্তানের স্থলে “ঢাকা বেতার কেন্দ্র” কথাটা মনের মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করেছিলো।
ক্যাডেট কলেজে শহীদ দিবস পালনঃ
প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারী এলে আমরা “আমার ভাই এর রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?” গানটা গেয়ে প্রভাত ফেরীর আয়োজন করতে চাইতাম। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ কখনোই তার অনুমতি দেয় নাই। ‘আমার কথা-২৯’ অধ্যায়ে এ ব্যাপারে সামান্য আলোকপাত করে আমাদের হাউজের আবরার ভাই এর কথা লিখেছিলাম। চৌধুরী রফিকুল আবরার, কলেজে যিনি আবরার, সি আর নামে পরিচিত ছিলেন, (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের প্রফেসর এবং বিভাগীয় প্রধান ছিলেন এক সময়ে) প্রতি বছরই শহীদ দিবস পালনের প্রস্তাবক হতেন। তিনি একজন একনিষ্ঠ রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন এবং সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতেন। ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীর প্রাক্কালে তিনি এবং আরো কয়েকজন আবারও শহীদ দিবস পালনের জোর দাবী তুলেন। ততদিনে সারাদেশব্যাপী দিবসটি ভক্তিভরে পালন করাটা প্রায় প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। প্রিন্সিপাল কীয়ানি একজন বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ব্যক্তি হওয়াতে ব্যাপারটি বুঝেছিলেন, তাই তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্যাডেটদেরকে শহীদ দিবস নিয়ে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দেন। কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান জনাব আব্দুল্লাহ আল আমীন স্যার এবং প্রভাষক জনাব র,ম,ম ইয়াকুব স্যার এই দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন। দিবসটি নিয়ে আলোচনার অনুমতি লাভের এই প্রাথমিক সাফল্যে ক্যাডেটরাও খুশী হয় এবং স্যারদের বক্তব্য শুনে উজ্জীবিত হয়। প্রিন্সিপাল কীয়ানি অবশ্য পুরো বক্তব্য না শুনে এক সময় নীরবে মিলনায়তন কক্ষ ত্যাগ করেন। (তথ্যসূত্রঃ “My Memorable Days At MCC: Decade Of Glorious Achievements” – By RMM Yakub, published in the MCC 12th Reunion magazine, ‘The Vanguards’ page-35)
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণঃ
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ সেদিন আমরা সরাসরি শুনতে পারিনি, তবে খবরে কিছু কিছু চুম্বক অংশ শুনেছিলাম। পরে পুরো ভাষণটা শুনে জানতে পেরেছিলাম, এমন একটা কাব্যিক, ঐতিহাসিক, অলিখিত ভাষণ পুরো জাতিকে কতটা ঐন্দ্রজালিক বিমুগ্ধতায় আবদ্ধ করেছিলো। প্রিন্সিপাল কীয়ানি পরের দিন অর্থাৎ আটই মার্চ সকাল সাড়ে এগারটায় সকল শিক্ষকদের নিয়ে স্টাফরুমে বসে ভাষণটি শোনেন এবং তাদের কাছে জানতে চান, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে কী বলেছিলেন। তাকে যখন জানানো হয় যে বঙ্গবন্ধু সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি কিছু সময় চিন্তা করে নিজ থেকেই ঘোষণা করেনঃ কলেজ এই মুহূর্ত থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হলো। তিনি কলেজ এ্যডজুট্যান্টকে নির্দেশ দেন, মির্জাপুর থেকে দ্রুত কয়েকটি বাস ভাড়া করে ক্যাডেটদেরকে ঢাকায় এবং ময়মনসিংহে পৌঁছে দিতে। বিকেল তিনটের মধ্যে সকল ক্যাডেট ক্যাম্পাস ত্যাগ করার পর তিনিও গোপনে কলেজ ত্যাগ করেন। প্রিন্সিপাল কীয়ানি সমূহ বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরেছিলেন, তাই তিনি ঢাকা থেকে কোন নির্দেশের জন্য অপেক্ষা না করে আপন বুদ্ধিমত্তায় এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে এমন একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন, যার ফলে বহু ক্যাডেট আর শিক্ষকদের জীবন চরম অনিশ্চয়তায় নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। অবশ্য এর জন্য তাকে বড় মাশুল গুনতে হয়েছিলো। তিনি কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং পরে চাকুরীচ্যুত হন। ধারণা করা হয়ে থাকে, ভারতেশ্বরী হোমসের অধ্যক্ষা মিজ জয়া পতি তাকে গোপনে ভেতরের খবর দিয়ে তাকে কলেজ ত্যাগের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি কলেজ ত্যাগের কিছুক্ষণ পর কিছু লোকজন তার খোঁজে কলেজে প্রবেশ করেছিলো বলে জানা যায়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, যে জয়াপতি এই অবাঙ্গালী প্রিন্সিপালকে গোপন পরামর্শ দিয়ে তার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, তার কিছুদিন পর সেই পাকিস্তানী সেনাদের হাতেই তার পিতা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, মিজ জয়া পতি এবং উইং কমান্ডার সুলেমান হায়দার কীয়ানির মাঝে সখ্যতার কথা ‘আমার কথা-১৮ ও ১৯’ এ কিছুটা উল্লেখ করেছিলাম। (তথ্যসূত্রঃ অধ্যাপক র,ম,ম ইয়াকুব এর প্রাগুক্ত প্রবন্ধ)
অনিশ্চয়তার পথে যাত্রাঃ
আমাদের কলেজ যখন ছুটি হতো, তার আগে কলেজ থেকে চিঠি দিয়ে আমাদের অভিভাবকদেরকে আমাদের ঢাকায় আগমনের সময়, তারিখ, স্থান ইত্যাদি জানিয়ে দেয়া হতো এবং তারা সেই অনুযায়ী আমাদেরকে রিসিভ করতে আসতেন। কিন্তু ০৮ মার্চ ৭১ এ অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তড়িঘড়ি করে কলেজ বন্ধ ঘোষণা করাতে আমাদের অভিভাবকদের সবাইকে সে খবরটা জানানো সম্ভব হয় নাই। এ ছাড়া ১৯৭০ এর ফেব্রুয়ারী মাসে আমার বাবা অবসর গ্রহণ করে ঢাকায় আমাদের সরকারী বাসাটা সরকারকে হস্তান্তর করে দেশের বাড়ী লালমনিরহাটে চলে আসেন। তাই আমি লালমনিরহাট যাবার ব্যবস্থা করার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করি। ঐ সময়ে দিনাজপুরে থাকতো আমারই ব্যাচমেট হেলাল, যার বাবা দিনাজপুরের জেলা আনসার এ্যডজুট্যান্ট ছিলেন। হেলালের বড় ভাই জনাব আনিসুল হক বর্তমানে ঢাকা উত্তর এর মান্যবর মেয়র এবং ছোটভাই জেনারেল বেলাল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান। আমি কৃতজ্ঞ যে ঐ সময়ের টালমাটাল অবস্থায়ও কলেজ কর্তৃপক্ষ আমার এবং হেলালের জন্য পরদিন ০৯ মার্চ তারিখে “দ্রুতযান এক্সপ্রেস” যোগে যথাক্রমে লালমনিরহাট আর দিনাজপুর যাবার দুটো রেলটিকেট আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের আরেক সহৃদয় ব্যাচমেট ইকবাল কাদের চৌধুরী আমাদেরকে জোর করে তার ধানমন্ডির বাসায় নিয়ে গিয়ে ০৮ মার্চের রাতটা থাকার ব্যবস্থা করে। মনে আছে, তার মা আমাদেরকে সে রাতে আদর করে অনেক কিছু খাইয়েছিলেন। ০৯ মার্চ তারিখে খুব ভোরে হেলাল, আমি আর আমাদের আরেক বন্ধু মাহবুব, যে হেলালের সাথে দিনাজপুর যেতে খুব ইচ্ছুক ছিল, কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে “দ্রুতযান এক্সপ্রেস” এ উঠলাম। শুরু হলো আমাদের এক অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা।
ঢাকা
০১ জুলাই ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৪:৪৬