আজ সকালে দেখি আমেরিকার ওকলাহোমা প্রবাসী আমার ভাগ্নে তার বাসার নিকটস্থ Bartlesville Amtrak station এ সাজিয়ে রাখা steam engine locomotive এর কয়েকটা ছবি পোস্ট করে শৈশবে তার নানাবাড়ী যাওয়ার স্মৃতিচারণ করেছে। লোকোমোটিভ ইঞ্জিন এর ছবিগুলো দেখে আমিও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম। তবে শৈশব-কৈশোরে আমার দেখা ইঞ্জিনগুলো এরকম Silverish Black ছিল না, ছিল একেবারে ভুশভুশা কালো। ছোটবেলায় নানাবাড়ী-দাদাবাড়ী যাবার সময় আমদের ট্রেনে করেই যেতে হতো। কয়লার শক্তি-চালিত এসব ইঞ্জিন চলার সময় ভোঁশ ভোঁশ করে কালো ধোঁয়ার হলকা বাতাসে ছড়িয়ে দিত। আব্বা আম্মার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখতাম, বিশেষ করে ট্রেনের গতি প্রকৃ্তি অনুভব করে যখন বুঝতে পারতাম যে ট্রেনটা বাঁক নিচ্ছে। মাঝে মাঝে বাতাসে ভেসে আসা কয়লার গুঁড়ো চোখে ঢুকে যেত, সাথে সাথে বকুনিও খেতাম। ১৯৬২-৬৪ সালে আমরা কমলাপুরে থাকতাম। এখন যেখানে রেলের পার্সেল অফিস, আমাদের বাসাটা প্রায় সেখানেই ছিল। তখন কেবল নতুন স্টেশনের নির্মাণ কাজ এবং নতুন রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। নতুন বসানো লাইন একটু একটু করে এগোচ্ছিল আর সেগুলো দিয়ে মালবাহী ক্যারেজ এবং ক্যারিয়ারে করে আলকাতরা মাখা সেগুন কাঠের স্লিপার এবং টুকরো পাথরের চালান এনে স্তুপ করা হচ্ছিল। আমরা সেসব স্তুপের আড়াল নিয়ে লুকোচুরি খেলতাম। সেই আলকাতরার গন্ধটা আমার খুব ভাল লাগতো, এখনো নাকে লেগে আছে। আলকাতরার সাথে ডিজেল, তার্পিন তেল কিংবা অন্য কোন কেমিক্যাল হয়তো মেশানো থাকতো, যার কারণে গন্ধটা খুব তীব্র হতো।
১৯৬৫ সালের দিকে বন্ধুপ্রতিম দেশ আমেরিকা কর্তৃক দানকৃত হলুদ রঙের ডিজেল চালিত ইঞ্জিন প্রথম ঢাকায় এলো। বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ আমেরিকার পতাকা আকৃ্তির একটি ছাপের উপরে হ্যান্ডশেক করা দুটো হাতের ছবি ইঞ্জিনের গায়ে উৎকীর্ণ ছিল। প্রথম প্রথম কমলাপুর থেকে নারায়নগঞ্জ পর্যন্ত শুধু দিনের বেলায় ট্রেনগুলো চলতো। তারপর শুরু হয় লম্বা যাত্রার ট্রেনগুলোর চলাচল। খুব সম্ভবতঃ ১৯৭০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কমলাপুর রেল স্টেশনটি ঢাকা স্টেশন নামে পূর্ণাঙ্গরূপে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চালু করা হয়। তখন থেকে ঢাকা থেকে বাহাদুরাবাদঘাট পর্যন্ত আমাদের ট্রেনটিকে ঝড়ের বেগে টেনে নিয়ে যেত এই হলুদ রঙের ডিজেল ইঞ্জিন। তারপর স্টীমারে করে যমুনা নদী পার হয়ে তিস্তামুখঘাট থেকে অন্য একটি ট্রেনে উঠতাম, যা টেনে নিয়ে যেত ভুশভুশা কালো রঙের সেই কয়লার ইঞ্জিন। ওটার গতিবেগ ডিজেল ইঞ্জিনের চেয়ে সামান্য একটু কম থাকতো। আমি কান পেতে থাকতাম, চলতে চলতে কখন ইঞ্জিনের হর্ন/হুইসল শুনতে পাবো। দুটো ইঞ্জিনের ডাকে দু’ধরণের আওয়াজ হতো। ডিজেল ইঞ্জিনের হর্ন বাজতো অনেকটা ভোঁ ভোঁ করে, সেটার মধ্যে একটা পুরুষালি বিকটতা ছিল এবং সেটা তুলনামূলকভাবে স্বল্পক্ষণ ধরে বাজতো। কিন্তু আমার ভাল লাগতো কালো কয়লার ইঞ্জিনের হুইসল শুনতে। সেই ট্রেনটা দীর্ঘক্ষণ ধরে কূ...................... কূ আওয়াজ তুলে ছুটে চলতো, বিশেষ করে কোন বাঁক নেয়ার সময় কিংবা কোন সিগনাল পোস্ট নিকটবর্তী হলে। সেই হুইসলের আওয়াজে নারীর কমনীয়তা ছিল, অনেকটা উত্তরবঙ্গের নারীদের কন্ঠে শোনা ভাওয়াইয়া গানের মত আকুলতা ছিল।
নানাবাড়ী-দাদাবাড়ী যাওয়াই হতো কনকনে শীতের মৌসুমে, স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর ডিসেম্বর মাসে। উভয় বাড়ী থেকে চলমান ট্রেনের আওয়াজ শোনা যেত। দাদাবাড়ী থেকে বিন্যাগাড়ীর বিলের অপর পারে গাছগাছালির মাঝ দিয়ে খেলনার মত ট্রেনটিকে দেখাও যেতো। প্রায়ই হুইসলের শব্দ শুনে সব খেলা ফেলে বিলের পাড়ে ছুটে যেতাম গান গেয়ে যাওয়া ট্রেনটিকে দেখতে। আবার খেলতে খেলতে এও মাঝে মাঝে চোখে পড়তো যে ট্রেনটি কোন আওয়াজ না করেই সতর্ক আরশোলার মত পায়ে পায়ে স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে। নানাবাড়ীর ট্রেনের লাইনটি দাদাবাড়ী থেকে তুলনামূলকভাবে বাসা থেকে একটু দূরে ছিল। ট্রেনটিকে আমরা দেখতে পেতাম না, কিন্তু আওয়াজ শুনতে পেতাম। বিশেষ করে মাইল দশেক দূরে তিস্তা সেতুর উপর যখন ট্রেনটা উঠতো, তখন বেশ জোরেশোরেই ট্রেনের ঝমঝমাঝম শব্দ কানে ভেসে আসতো। আমার বড়নানা (নানার বড়ভাই) ঠিক একদম ফজরের ওয়াক্ত শুরু হবার সাথে সাথে দীর্ঘ সুরা ক্বিরাত পাঠ করে নামায পড়তেন। ওনার বাড়ী ছিল আমার নানাবাড়ীর পাশাপাশি, একেবারে লাগোয়া। আমি প্রায়ই আধো ঘুমে ওনার সুরা ক্বিরাত পাঠ শুনতাম। এভাবে শুনতে শুনতেই কয়েকটি সুরা’র কিয়দংশ আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। নামাজের পর বড়নানা সুর করে নানারকমের হামদ, না’ত ও গজল গাইতেন। ওনার কন্ঠ সুমধুর ছিল। ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি ওনার এসব গান শুনতে শুনতে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। তবে ঠিক একই সময়ে প্রতিদিন কূ......ঝিক ঝিক করে একটি ট্রেন লালমনিরহাট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতো। নানার গান এবং ট্রেনের গান, এতদুভয়ের সংমিশ্রণে এক বিচিত্র সুরের আবেশে আমি হারিয়ে যেতাম।
এই ট্রেন নিয়ে শৈশব থেকে লালিত আমার একটি শখ আজও অপূর্ণ রয়ে গেছে। জানি, সেটা জীবনে আদৌ আর কখনো পূরণ হবার নয়। সেটা হচ্ছে, ট্রেনের ইঞ্জিনের ভেতরে বসে ঢাকা-চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকা- ময়মনসিংহ লাইনে, কিংবা অন্য কোথাও, কিছুটা পথ পাড়ি দেয়া। যতদূর জানি, ডিজেল ইঞ্জিনগুলোর ভেতরে শুধু দুইজন চালক ছাড়া তৃতীয় কোন ব্যক্তির বসার কিংবা দাঁড়িয়ে থাকার মতও কোন জায়গা নেই। এই শখ মেটানোর কেবল একটাই উপায় ছিল, যদি কোনদিন রেলের চালক হতে পারতাম। শখ পূরণের এ সুযোগটা জীবনে অন্য আরও অনেক শখের মতই হেলায় হারিয়েছি।
ঢাকা
১১ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।