somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিক্ষিপ্ত ভাবনাঃ হক সাহেবের হালচাল

১২ ই মার্চ, ২০১৮ সকাল ১১:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হক সাহেব কবিও নন, লেখকও নন, তবে একনিষ্ঠ সাহিত্যানুরাগী। জীবনে খুব যে বেশী সাহিত্য পড়েছেন তাও নয়; কিন্তু সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পকলার প্রতি তার একটা আকর্ষণ সেই ছেলেবেলা থেকেই ছিল। নিজে ভাল গাইতে না পারলেও ভাল লাগা গানের কলি সবসময় তার কন্ঠে আশ্রয় খুঁজতো। গলা যেমনই হোক, সময় সুযোগ পেলেই তিনি নিবিষ্ট মনে সেসব কলি মেলে ধরতেন, সুর মেলাতেন। বিশ্বের বড় বড় কবি লেখকদের সম্পর্কে তিনি কিছুটা ধারণা রাখতেন, তাদের অমর সৃষ্টিসমূহের নাম জানতেন, কিন্তু আগ্রহ এবং আকর্ষণটা খুব বেশী তীব্র না থাকায় সেগুলো সংগ্রহ করে পড়েন নি। নিজে কখনো আঁকাআঁকি করেন নি, এ ব্যাপারে একেবারেই অনভিজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু তার বাসার নিকটস্থ ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে কোন আর্ট এক্সিবিশনের খবর পেলেই হাজির হতেন, প্রদর্শিত ছবিগুলো দেখে শিল্পীর ভাবনার কথা ভাবতে ভালবাসতেন। বয়ঃসন্ধিকালে একটি হিন্দী গান তার মনে গেঁথে গিয়েছিল- “সাওয়ান কা মাহিনা পাওয়ান কারে শোর”। সে সময় তিনি হিন্দী মোটেই জানতেন না, বুঝতেন না। জীবনে তখনো একটিও হিন্দী ছবি দেখেন নি, কিন্তু তবুও নুতন ও সুনীল দত্ত অভিনীত “মিলন” ছবির এ গানটি তিনি যখনই শুনতেন, তখনই একটা ঘোরের মধ্যে চলে যেতেন। কিন্তু কেন? তিনি কি গানের কথাগুলো তখন বুঝতেন? তখন কেন, এখনও কি বুঝেন? না, বুঝতেন না, এখনো তেমন বুঝেন না। কিন্তু তিনি আচ্ছন্ন হন সুরে। প্রথম যখন তিনি এ গানটা শোনেন, তখন তিনি ডর্মে থাকতেন। তার এক রুমমেট খুব ভাল গান গাইতে পারতো, কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই। সেই রুমমেট যখন এই গানটি গাইতো, তিনি তন্ময় হয়ে শুনতেন। গান শেষ হলে তার কাছে উঠে গিয়ে তিনি গানের অর্থ জিজ্ঞেস করতেন। তার বন্ধুটিও জানতো না। ডিশ টিভি তখন ছিলনা, তাই হিন্দীও লোকে বুঝতো না। তবে এ গানটি তারা উভয়ে না বুঝেই ভালবাসতেন, গাইতেন। গানের সুরের সাথে একাত্ম হয়ে যার যার নিজের মত করে ভাবতে ভাবতে কল্পনার ডানা মেলে সপ্তাকাশে বিচরণ করতেন।

এর অনেক পরে মধ্যবয়সে এসে হক সাহেব “মিলন” ছবিটি দেখেছিলেন। গানের পিকচারাইজেশন দেখে তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন। গান শেখার সময় নায়িকার অভিব্যক্তি, নীলাকাশের ছায়া প্রতিফলিত নীল জলের নদীবক্ষে দোদুল্যমান নৌকোয় মাঝি এবং নায়িকা মিলে ময়লা ও তালিযুক্ত পাল ওড়ানোর দৃশ্য (বাস্তবচিত্র), মাস্তুলে বেঁধে রাখা মাঝির খোরাক বহনকারী টিফিন ক্যারিয়ার, ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়ে চিত্র পরিচালকের সজাগ দৃষ্টি দেখে তিনি খুবই ইমপ্রেসড হয়েছিলেন। শিল্পী, কবি, লেখকদের এই দৃষ্টির সাযুজ্য দেখে তিনি সৃষ্টির অভিন্ন যোগসূত্রতা অনুভব করেছিলেন। সাঁঝের নদীতে প্রতিফলিত অস্তগামী সূর্যের সোনালী রশ্মিতে ভাসমান ঢেউ এ নৌকো চালিয়ে ওদের গান গাওয়া, চন্দ্রালোকিত রাতে লন্ঠনের মৃদু আলোয় নির্জন নদীর বুক চিরে নৌকো বেয়ে চলার সময় গানের সুরে ওদের কথোপকথন, ইত্যাদি তিনি মোহাবিষ্ট হয়ে শুনেছিলেন, দেখেছিলেন। বিশেষ করে মাঝি যখন বলছিল, নদীর জলধারা তাকে জিজ্ঞেস করছে ‘কোথায় চলেছো’? নায়িকা তখন বলেছিল ‘মর্জি তোমার, যেখানে খুশী নিয়ে চলো’ – তাদের এই প্রেমের কথোপকনটুকু তাকে জীবনের গন্তব্য সম্বন্ধে ভাবিয়েছিল।

এর পর তিস্তা যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, প্রমত্তা নদীগুলো শীর্ণ হয়ে গেছে। সেই নদীগুলোতে হক সাহেব এখন নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পান। শীর্ণ হলেও, সেসব নদী দিয়ে এখনো পাল তোলা নৌকো চলে, নারীরা সে নৌকো চড়ে ছেলেপুলে নিয়ে নাইওর যায়, চন্দ্রালোকিত জ্যোৎস্না রাতে মাঝির দল কন্ঠে ভাটিয়ালি সুর ধরে। হক সাহেব দু’চোখ বন্ধ করে এসব দেখতে পান, এবং মনে মনে একটা প্রচ্ছন্ন সুখ অনুভব করেন। মাঝে মাঝে তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেন, তিনি কি জীবনে সুখী? অধুনা তিনি নিজেও কিছু লেখালেখি শুরু করেছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছেন, কবি লেখকেরা মানুষের দুঃখবোধ নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, কখনো কখনো তা নিজের দুঃখবোধ কিংবা অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে দেখেন, আর তার পরে হয়তো লিখে ফেলেন একটি অনবদ্য কবিতা, গল্প কিংবা গদ্য। কিন্তু আদতে মানুষ নিজে সুখী না হলে অন্যের দুঃখ নিয়ে লিখতে পারে না, কারণ দুঃখী লোকের সময় কোথায় এসব নিয়ে লেখার? এ ছাড়া একজন দুঃখী লোক যতক্ষণ দুঃখী থাকে, ততক্ষণ সে নিজের দুঃখটাকে কিংবা তার জানা অন্যের দুঃখকেও গোপনই রাখতে চায়। তবে নিজেকে সুখী ভাবলেও, হক সাহেবকে অন্যের দুঃখ খুব সহজেই স্পর্শ করে। তখন তিনি মনে একটা ভার অনুভব করেন। তার চিন্তাভাবনা, গতিবিধি, কাজ কারবার সব কিছুই শ্লথ হয়ে যায়। তিনি আশ্রয় খুঁজেন কোন কল্পনায়, কবিতায়, প্রার্থনায় কিংবা সঙ্গীতে।

হক সাহেব সেদিন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, তার দেখা জীবনেও তো এমন অনেক উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যেগুলো দিয়ে বেশ চমৎকার কিছু গল্প লেখা যায়। তিনি বসে গেলেন একটা গল্প লিখতে। গল্পটা লিখা শুরু করে তিনি এগোতে পারছিলেন না। তিনি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে উপলব্ধি করলেন, এ গল্প লেখা তার কাজ নয়। গল্পের নায়িকাকে তার কাছে মনে হচ্ছিল দেবীতুল্য। তার অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সৌন্দর্যকে কিছুতেই তিনি সঠিক মাত্রায় উপস্থাপন করতে পারছিলেন না। তার মুখে কোন সংলাপই তুলে দিতে পারছিলেন না। দেবী না মানবী, সারল্য না সৌন্দর্য, বাস্তব না কল্পনা, ইত্যাদি দ্বন্দ্ব তার কলমকে নিশ্চল করে দিচ্ছিল। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল, কন্ঠে বাষ্প দলা পাকাচ্ছিল। উপায়ন্তর না দেখে তিনি কলম থামিয়ে দিলেন, ইউ টিউবের আশ্রয় নিলেন। খুঁজে বের করলেন একটি গান, যে গানের অর্থ তিনি আজও ঠিকমত জানেন না, কিন্তু যে গান তাকে সহজেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়- “সাওয়ান কা মাহিনা পাওয়ান কারে শোর”।


ঢাকা
১২ মার্চ, ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

সাওয়ান কা মাহিনা পাওয়ান কারে শোর
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৮ সকাল ১১:৪৭
২৬টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×