আজ থেকে শুরু হয়েছে হেমন্তকাল। হেমন্ত, যে ঋতুর পুরোপুরি সঠিক কোন ইংরেজী প্রতিশব্দ নেই। এখন থেকে শুরু হবে এই হ্রস্ব বিকেলটাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি। ভাতঘুম হবে, না লেখালেখি, নাকি দুটোই? (প্রশ্নটা শুধুই আমার মত বিশ্রামে থাকা কর্মহীন অবসরপ্রাপ্তদের জন্য, কর্মরত কোন নিষ্ঠাবান কাজপাগল মানুষের জন্য নয়।) এ প্রশ্নের উত্তর- যেকোন একটি হতে পারে, দুটো কিছুতেই নয়। এখন থেকে লাঞ্চের পর আর বেশী কিছু করার সময় পাওয়া যাবে না। আগে লাঞ্চের আগে বা পরে একটা লম্বা ঘুম দেয়ার পরেও অনায়াসে ঘন্টা দুয়েক বা তারও বেশী কিছু নিটোল সময় লেখালেখির জন্য পাওয়া যেত। এখন যে কোন একটা বিসর্জন দিতে হয়- হয় ভাতঘুম, নয়তো লেখালেখি। লাঞ্চের পর কিছু লিখতে বসলে শেষ করার অনেক আগেই আসরের আযান দিয়ে দেয়। আসরের নামাযের পর না থাকে ঘুমোবার সময়, না থাকে লেখালেখির। এরই মধ্যে আসে মাগরিবের ডাক। লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সন্ধ্যার পরের সময়গুলোও দ্রুত পার হয়ে যায়। রাত জাগার অনুমতি নেই, তাই লেখালেখির জন্য অপেক্ষা করতে হয় পরের প্রত্যুষের জন্য। প্রত্যুষ পরবর্তী এবং মধ্যাহ্ন পরবর্তী সময়টুকুই আমার লেখালেখির জন্য বরাদ্দ।
এ সময়টাতে গ্রামীণ জীবনে নবান্নের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়, ক্ষেতে ক্ষেতে পাকা ধান দেখে কৃষকদের মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। হেমন্তে কাটা হয় বলে কোন এলাকায় এই ধানকে “হেমতি ধান”ও বলা হয়ে থাকে। গ্রামের গেরস্তদেরকে দেখেছি, হেমন্তের বিকেলগুলোতে চিরপরিশ্রমী এই মানুষগুলোও যেন কিছুটা আলস্যের প্রশ্রয় খোঁজে। তবুও তাদের বিশ্রাম ফেলে রেখে হাটে যেতে হয়, গবাদি পশুদের গোয়ালে ডেকে আনার আগেই ধূলি ধূসরিত কুয়াশা আর বিচালি পোড়ার ধোঁয়াশা মিলে আঁধারটাকে যেন একটু আগে ভাগেই ডেকে আনে। বধূবালারা দীঘির জলে ডুবসাঁতার দেয়ার বেশীক্ষণ সময় পায়না। স্নানশেষে ক্ষুন্নিবৃত্তির পর তারা উন্মুক্ত উঠোনটাতে চুল ছেড়ে দিয়ে গা এলিয়ে বসে ক্ষণিক সময় গল্পগুজবে মেতে ওঠে ঠিকই, কিন্তু চুল শুকোবার আগেই রবিমামার অন্তর্ধানের ফলে তাদের ভেজা চুলেই বেণী কিংবা খোপা বাঁধতে হয়। কেউ কেউ গোধূলি বেলায়ও স্নান সেরে কাঁখে জলভরা কলসি নিয়ে হয়তো ঘরে ফেরে। তাদের দেখে হয়তো বাংলা গানের চেয়ে হিন্দী গান শুনতে অভ্যস্ত আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মনে পড়ে যায় “কাঁহি দূর যব দিন ঢল্ যায়ে সাঁঝ কি দূলহন্ বদন চুরায়ে চুপকে সে আয়ে” গানটির কথা।
কাঁহি দূর যব দিন ঢল্ যায়ে
দ্রুত অপসৃয়মান হলেও, এই নাতিদীর্ঘ মধ্যাহ্ন পরবর্তী সময়টার প্রতি আমার ভীষণ মায়া। আমার খুব ভাল লাগা একটি সময়- কিছু লেখার, কিছু গান শোনার, নয়তো দৈবচয়নের ভিত্তিতে কোন বই কিংবা প্রিয় লেখকের কোন ইলেক্ট্রনিক লেখালেখি পড়া- এসব করেই কাটে এসব হ্রস্ব বিকেলগুলো। জানালাটার পর্দা সরানো থাকলে মেঘের আনাগোনা কিংবা পাখির ওড়াউড়ি দেখতেও ভাল লাগে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই দেখি, এক চিলতে সোনালী রোদটুকু খুব দ্রুতই ম্লান হয়ে যাচ্ছে, কিসের যেন তার তাড়া! দেখতে দেখতে দীপ্যমান সূর্যটা কমলা রঙ ধারণ করে ঝুপ করে ওপারে ডুব দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে নেয়। আমার ভাললাগা ভাবনাগুলোতেও অকস্মাৎ ঘটে যবনিকাপাত।
ঢাকা
০১ কার্ত্তিক, ১৪২৫
১৬ অক্টোবর ২০১৮
বিকেল চারটা পঁয়ত্রিশ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৩:১৭