প্রতিমাসে অন্ততঃপক্ষে দুই একটা দিন হাসপাতালে যেতে হয়, কখনো নিজের বা পরিবারের কারো প্রয়োজনে, আবার কখনো শুধুই অসুস্থ বন্ধু/সতীর্থ/আত্মীয়-স্বজন/অতীতের কোন জ্যেষ্ঠ/কনিষ্ঠ সহকর্মীদের অসুস্থতার খবর পেয়ে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য। আমার বাসার কাছাকাছি তিনটে হাসপাতাল আছে। প্রায়ই আত্মীয়, পরিচিত পরিজনদের অসুস্থতার খবর পেয়ে সেখানে যেতে হয়। যেহেতু হাসপাতালগুলোর অবস্থান আমার বাসার কাছেই, সেহেতু এতে আমার তেমন অসুবিধে হয় না।
আজ সারাদিনের জন্য হাতে অনেক কাজ জমা ছিল। তার মধ্যে হাসপাতাল যাওয়াও অন্যতম একটা কাজ ছিল। হাসপাতালে নিজের কাজটুকু সেরে একজন অসুস্থ রোগীকে দেখতে যাবার জন্য সংশ্লিষ্ট লিফটের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় শুনতে পেলাম, কে যেন পেছন থেকে আমার নাম ধরে ডেকে বলছেন, ‘তোমাকে আমি এখনি লিফটে যেতে দেব না, আগে আমার সাথে কিছু কথা বলে যাও'। পিছে তাকিয়ে দেখি একজন জ্যেষ্ঠ প্রাক্তন সহকর্মী আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। তিনি সম্প্রতি ফেইসবুক একাউন্ট খুলেছেন, সেই সুবাদে তিনি মাঝে মাঝে আমার কিছু কিছু পোস্ট পড়ে থাকেন। অনেক আগে এক সময়ে তিনি আমার বস ছিলেন। একবার যিনি বস থাকেন, আর তিনি যদি আমার চোখে নেহায়েৎ খারাপ মানুষ না হয়ে থাকেন, তবে তিনি সারা জীবনের জন্য আমার শ্রদ্ধা ও সমীহের ন্যায্য পাওনাদার হয়ে থাকেন। তাই আমি লিফটের কিউ থেকে বের হয়ে এসে ওনার সাথে কুশলাদি বিনিময় করতে শুরু করলাম। উনি প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এত সুন্দর কিভাবে লেখ? আমি যে তোমার লেখা পড়ে মাঝে মাঝে মন্তব্য করি, তা কি তুমি জান?’ প্রশ্নটা তিনি কথাচ্ছলেই করেছিলেন, কারণ তার মন্তব্যের উত্তর আমিও যথাসময়ে দিয়েছি (সবগুলোর না হলেও)। আমি সে কথাই তাকে বললাম, এবং তিনিও সাথে সাথেই স্বীকার করলেন, হ্যাঁ, তুমি তা দিয়েছো। কেমন আছেন, জিজ্ঞেস করতেই তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ভাইরে, বুড়া বয়সে যার বউ নাই, তার কেউ নাই। উল্লেখ্য, বছরখানেক আগে তাঁর স্ত্রী দীর্ঘদিন রোগ শোকে ভোগার পর ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর স্ত্রী একজন খুবই স্নেহময়ী জননীসুলভ মহিলা ছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন তাঁকে বেহেস্ত নসীব করুন!
আজ তিনি চোখের একটা অসুখের কারণে এসেছেন চোখে ইঞ্জেকশন নেয়ার জন্যে। বিদায় নেয়ার আগে আমার কাঁধে একটি হাত রেখে বললেন, ‘বুঝলা আহসান, একমাত্র মশামাছি ছাড়া বুড়াদের কাছে আর কেউ আসে না’! কথাটা শুনে খুবই ব্যথিত বোধ করলাম। কত মায়া নিয়ে আমরা সংসার গড়ি, একদিন সব মায়া শূন্য হয়ে যায়, মানুষ আপন বৃত্তে ঘুরপাক খায়।
আরেকদিনের কথা। আমার এক জ্যেষ্ঠ্য, অসুস্থ প্রাক্তন সহকর্মীকে দেখার জন্য হাসপাতালে গিয়েছিলাম। উনিও একসময় আমার বস ছিলেন। অসুস্থ হবার মাস কয়েক আগেও ওনাকে একদিন ফার্মেসী থেকে ওষুধ সংগ্রহের সময় দেখা হওয়াতে কুশল জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি ছোট্ট করে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ভাই এখন আর কেমন থাকা! ওপারের ডাকের প্রতীক্ষায় আছি।' তারপর টুকটাক কিছু কথাবার্তা এবং শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বিদায় নিয়েছিলাম। এবার তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তিনি এবারে বেশ অসুস্থ। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল, তবুও তিনি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে কথা বলছিলেন এবং মনযোগ দিয়ে আমার কথাও শুনছিলেন। একটু পরে একজন সহকারী এসে ওনাকে দশ মিনিটের জন্য নেবুলাইজার দিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করে জানলাম, আট ঘন্টা পর পর দিনে তিন বার করে তাকে দশ মিনিট নেবুলাইজার সাপোর্ট নিতে হয়। রক্তের হেমোগ্লোবিন কমে যাচ্ছে বলে কিছুদিন পর পর সাপ্লিমেন্ট নিতে হয়। খাওয়ার কোন রুচি নেই, মুখে মাঝে মাঝে ঘা হয়। দাঁড়িয়ে থাকা তো দূরের কথা, চেয়ারে বসে থাকতেও তিনি দুর্বল বোধ করেন। আমি যখন তাকে দেখতে গিয়েছিলাম, তখন কক্ষে আর কোন দর্শনার্থী ছিল না। আমাকে একলা পেয়ে তিনি অতীতের অনেক স্মৃতিচারণ করলেন। ছাত্রজীবনে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং এইচ এস সি’তে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। তার পরে কিভাবে দ্রুত জীবনটা পার করে এলেন, তার কিছু কিছু ছোট ছোট স্মৃ্তিকথা শোনালেন। আমি যখন ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন ওনার দিকে খেয়াল করে মনে হলো, উনি কিছু একটা বলতে চাচ্ছেন। বুঝতে পারছিলাম, উনি আমাকে কিছু একটা বলার জন্য ভেতরে ভেতরে স্ট্রাগল করছেন। চোখ দুটো কিছু একটা পাবার আশায় চক চক করছে। উনি বললেন, ‘আহসান, আমি আজ তোমার কাছে মাত্র একশ’টি টাকা ধার চাচ্ছি। আমি সুস্থ হবার পর ব্যক্তিগতভাবে তোমার সাথে দেখা করে এ টাকাটা ফেরত দিয়ে আসবো, দ্যটস মাই ওয়ার্ড অভ অনার’! আমি সাথে সাথে পেছন পকেটে হাত ঢুকালাম মানিব্যাগটা বের করার জন্য। তা দেখে ওনার চোখদুটো আবারো চক চক করে উঠলো। মানিব্যাগ বের করতে করতে মুহুর্তের মধ্যে আমার মনে একটা প্রশ্ন খেলে গেল, আচ্ছা, টাকাটা উনি কেন চাচ্ছেন? ওনার স্ত্রী তো প্রতিদিনই দুপুরে বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসে তাকে খাইয়ে দিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যান, এ কথাটা তিনি তো একটু আগেই আমাকে বললেন। আর হাসপাতাল থেকে দেয়া পথ্য/খাবার দাবার তো আছেই। তা'হলে???
আমার স্মরণ হলো, তিনি একসময় চেইন স্মোকার ছিলেন, হয়তো এখনো অতটা না হলেও কিছুটা আছেন। আমি কোন কিছু চিন্তা না করেই তাকে বললাম, স্যর, টাকাটা আমি আপনাকে দিতে পারি এক শর্তে, যে আপনি এ টাকা দিয়ে সিগারেট কিনে খাবেন না। এ কথা শুনে মুহুর্তেই যেন ওনার যে চোখ দুটো দিয়ে এতক্ষণ আশার আলো ঠিকরে বেরোচ্ছিল, তা দপ করে নিভে গেল। উনি জামার হাতা দিয়ে কপাল মুছতে লাগলেন। তারপর আস্তে করে বললেন, ‘মিথ্যে বলতে তো পারিনা, আমি ঠিক সেজন্যই টাকাটা চেয়েছি, আহসান!’ এবারে আমার কপাল ঘামতে শুরু করলো। আমি মহা ফাঁপড়ে পড়ে গেলাম। এক দিকে আমি তার অন্যায্য আস্থার প্রতীক, আশার দীপশিখা, অন্য দিকে আমার বিবেক বলছে, একজন অতি অসুস্থ ব্যক্তি যিনি শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, নেবুলাইজার নিচ্ছেন, মুখে ক্ষত নিয়ে কষ্ট পাচ্ছেন, তাকে কী করে জেনে শুনে সিগারেট কেনার জন্য টাকা দেই? আমি তাকে বোঝাতে উদ্যত হতেই তিনি বললেন, এসব বলে লাভ নেই। আই ওয়ান্ট ইয়োর কো-অপারেশন। মনে ভাবনা শুরু হলো, কো অপারেশন ফর হোয়াট? ডেথ? কয়েক দশক আগে তার স্ত্রীকে দেখেছিলাম এক সামাজিক অনুষ্ঠানে। তার আবছা একটা চেহারা মনে ভেসে উঠলো। কল্পনা করলাম, উনি এখন এ রোগীকে নিয়ে কতই না হিমশিম খাচ্ছেন! আমি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, আমি এ কাজে তাকে সহযোগিতা করতে পারি না। এবারে পরিষ্কার করেই তাকে না বললাম। তিনি একেবারে চুপসে গেলেন। চেহারায় কথা বলার অনীহা ফুটে উঠলো। আমি নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে দরজায় করাঘাত, মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট এসে তার ব্লাড প্রেসার মাপা শুরু করলো। আমি নীরবেই প্রস্থান করলাম।
সেদিন বাকী সারাটা দিন আমি ন্যায্য-অন্যায্যতা নিয়ে ভেবেছিলাম, দোদুল্যমান ছিলাম। এ ঘটনা শুনে সবাই হয়তো একবাক্যে বলবেন, আমি যেটা করেছি, সেটাই ঠিক ছিল। আমার নিজের বিবেকও তাই বলে। কিন্তু মন ততটা শক্তভাবে সে সায় দেয় না, কারণ আমার মন সেদিন তার চোখের ভাষা পড়তে পেরেছিল। সেখানে তার একটি আকুল আবেদন ছিল, এবং পরবর্তীতে একজন তীক্ষ্ণ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির আবেদন প্রত্যাখাত হবার হতাশা ও বেদনা ছিল। তার শেষ অভিব্যক্তিটুকু কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারি না। হয়তো মনের এই দোদুল্যমানতা, এমন একটি ডিলেমা কে প্রশ্রয় দেয়াটাই অন্যায়, তবুও ঘুরে ফিরে একটা ভাবনা এসে যায়, সেই ‘কো-অপারেশন” টুকু করলে কি তার অবস্থার খুব বেশী ইতর বিশেষ হতো? জানিনা-----
ঢাকা
১০/১১ মার্চ ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০২০ সকাল ১০:০২