সিরিজের পূর্বের পোস্টঃ আমাদের কাশ্মীর ভ্রমণ- ১২: প্যাহেলগামের বেতাব উপত্যকায়
সেদিন (০৫ মে ২০১৯) বেতাব উপত্যকার অনুপম সৌন্দর্য ছেড়ে আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, কিন্তু দ্রুত গতিতে সোনালী বিকেলটুকু ফুরিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। বিকেল সাড়ে ছয়টার দিকে (তখনো বিকেলই ছিল) উঠতেই হলো। আরু উপত্যকা দেখার জন্য হাতে দিনের আলোয় সময় আছে মাত্র একটি ঘন্টা, আর তার পরেও আরো আধা ঘন্টা অর্থাৎ সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত আলোর আভা থাকে। আমরা তাই আর কোথাও না থেমে গাড়ীতে করেই উঁচু থেকে ‘পাখির চোখে’ দেখে নিচ্ছিলাম আরু উপত্যকার সান্ধ্য সৌন্দর্য। একটি জায়গায় এসে ওদের একটি হস্তশিল্পের দোকানে আমার স্ত্রী ছেলেকে সাথে নিয়ে প্রবেশ করলেন, আমি চারিদিকে হেঁটে হেঁটে আশে পাশের এলাকাটিকে দেখে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ উপরে টিনের চালাসহ মাটির দেয়ালের একটি ঘরের দিকে দৃষ্টি আটকে গেল। আমার আগ্রহের কারণ ছিল ঘরটির সামনের একটি সাইনবোর্ড, যাতে লেখা ছিল “GOVT. HIGH SCHOOL”। স্কুলটি সে সময়ে বন্ধ ছিল, তাই ইচ্ছে থাকা সত্তেও ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। তবে বাহির থেকে দেখেও বুঝতে পারছিলাম, ভেতরের অবস্থাও বেশী ভাল হবে না। এখন আমাদের দেশের গ্রামে গঞ্জেও সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এর চেয়ে অনেক ভাল দেখা যায়। বুঝলাম, ঐ এলাকায় শিক্ষার চেয়ে ব্যবসা/হস্তশিল্প অগ্রাধিকার পায়।
সেদিন মাগরিবের আযান পড়েছিল ৭টা ২৫ মিনিটে। আঁধার নেমে আসছিল, সেই সাথে চারিদিকে এক ধরণের নিস্তব্ধতাও। একটু আগেও পর্যটকবাহী গাড়ীর হর্নের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম (পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে হর্ন না বাজিয়ে উপায় নেই, তবে ওরা অযথা তা বাজায় না), ধীরে ধীরে সে শব্দও স্তব্ধ হয়ে আসছিল। অনুচ্চ পাহাড়গুলোর চূড়ায় তখনো এক স্বর্গীয় প্রভা লেপ্টে ছিল। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখান থেকে একটা পায়ে চলা পথ বাঁকা হয়ে গ্রামের ভেতরে চলে গিয়েছে। কিছু ছেড়ে দেওয়া পনি ঘোড়া আস্তাবলে যাবার আগে আগে পথটির দু’পাশের ঘাসের আস্তরণ থেকে দিনের শেষ আহার খুঁজে নিচ্ছিল। এরকম বাঁকা পথ দেখতে কেন জানি আমার খুব ভাল লাগে। বাঁকসর্বস্ব জীবন পথের কথাই মনে করিয়ে দেয়। দেখলাম, সেই পথ দিয়ে একজন কাশ্মীরি ব্যক্তি লম্বা ওভারকোট জড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আমাদেরকে দেখে তিনি একটু থেমে আমরা ট্যুরিস্ট কিনা তা জিজ্ঞেস করলেন। আমিও হ্যাঁসুচক জবাব দিয়ে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জানালেন, তিনি একজন স্কুল শিক্ষক। ওভারকোট জড়ানো লোকটাকে দেখে হাল্কা পাতলাই মনে হচ্ছিল, কিন্তু তার পেটের দিকটা অস্বাভাবিক মোটা মনে হচ্ছিল। লক্ষ্য করলাম, তার বুকের কাছ থেকে একটা হাল্কা ধোঁয়ার মত কিছু একটা বের হয়ে আসছে। এর কারণ জিজ্ঞেস করাতে উনি হেসে তার ওভারকোটটা ফাঁক করে একটা মাটির পাত্র বের করে আনলেন। দেখলাম, পাত্রটির অর্ধেক পর্যন্ত ছাই দিয়ে ঢাকা। সেখান থেকে একটা সুবাসিত ধোঁয়ার হাল্কা ধূসর রেখা বের হয়ে আসছে। উনি জানালেন, তীব্র শীতের সময় হাতের আঙুলগুলো যখন অবশ হয়ে আসে, তখন রক্ত সঞ্চালন ঠিক রাখতে কাশ্মীরিরা ওভারকোটের নীচে এই জ্বলন্ত কয়লার পাত্রটি ধরে রাখে উষ্ণ থাকার জন্য। কাপড়ে আগুন ধরার কোন সম্ভাবনা থাকে কিনা আমি তা জিজ্ঞেস করলাম। উনি বললেন, এগুলো ছাই চাপা কয়লার কুচি, সাথে ধুপজাতীয় সুগন্ধি মেশানো। এই ছাইচাপা কয়লার কুচিতে অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হবার কোন সম্ভাবনা থাকেনা। ধিকি ধিকি জ্বলে কয়লার কুচিগুলো মাটির পাত্রটিকে গরম রাখে। আর সুগন্ধিযুক্ত ধোঁয়া বন্ধ হওয়া নাককে ক্লীয়ার রাখে। পাত্রটির স্থানীয় নাম “আঙ্গারা”।
লোকটি চলে যাবার পর আমি একা একা আমাদের চালক রেহানের কথা ভাবছিলাম। দশ ভাইবোনের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছেলেটা মা বাবা আর বোনদের প্রতি কতটা নিবেদিত প্রাণ! যা কিছু উপার্জন করে সবকিছুই তাদের জন্য ব্যয় করে। আমাদের ডিউটি শেষ করে সে প্রায় দশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তবে তার নিজ ঘরে পৌঁছাবে। এ কথা মনে করতেই আমি ওকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম। আমার স্ত্রী যে দোকানটাতে কেনাকাটা করছিলেন, সেখানে প্রবেশ করে আমি তাকে তাগাদা দিলাম, তাড়াতাড়ি শেষ করতে। সে জানালো, কেনাকাটা শেষ হয়েছে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছিল মূল্য পরিশোধ নিয়ে। আরু উপত্যকার ওসব দোকানে ক্রেডিট কার্ডে মূল্য পরিশোধ করা যাবেনা, এ কথা আগে থেকে ভাবতে পারিনি। এদিকে চলে আসার আগের দিন বলে আমাদের কাছে যে নগদ রুপী ছিল, তাও প্রায় নিঃশেষ হবার পথে ছিল। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা আমরা পথের বিপদ আপদের কথা ভেবে নিঃশেষ করতে চাইনি, তাই অগত্যা আমরা ক্রয়কৃত পোষাকগুলো ফেরত দিতে চাইলাম। দোকানী বললো, চলুন, আমি দোকান বন্ধ করে আপনাদের সাথে প্যাহেলগাম শহরে যাচ্ছি। সেখানে আমার অনেক পরিচিত দোকান আছে, যারা আপনার এ ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট নিবে।
প্যাহেলগামে এসে আমরা দোকানীকে তার পাওনা পরিশোধ করলাম। কিন্তু তার আগে আমি রেহানকে শাফি’র সেলফোন নাম্বারটা দিয়ে বললাম, সে যেন শাফিকে একটা ফোন দিয়ে তাকে গাড়ী নিয়ে সেখানে আসতে বলে, শাফি আসলে আমি ওকে ছেড়ে দিব। লক্ষ্য করলাম, সে সেই দোকানীর কাছ থেকে সেলফোন চেয়ে নিয়ে শাফিকে একটা ফোন দিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শাফি চলে আসায় আমি ওকে সাব্যস্ত করা ভাড়ার চেয়েও বেশ কিছু অতিরিক্ত অর্থ তার দারিদ্র্যের কথা ভেবে দানের নিয়্যতে দিয়ে দিলাম। মনে মনে তার জন্য দোয়া করে তাকে শুভকামনা জানালাম, সেও চোখে মুখে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে গেল। কিন্তু এখানে আরেকটা বিপদ আমার জন্য ওঁৎ পেতে ছিল।
রেহানের গাড়ীর সীটে আমি আমার কালো সেলফোনটি রেখেছিলাম। কিছুক্ষণ পর কালো হাতমোজা দুটো খুলে তার উপর রেখেছিলাম। দোকানীর মূল্য পরিশোধের জন্য যখন তার গাড়ী থেকে নেমে দোকানে প্রবেশ করি, তখন ফোনটা সাথে নিতে আমার খেয়াল ছিলনা, বোধকরি রেহানও সেটা খেয়াল করেনি। ওর যেমন বাড়ী ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো ছিল, আমারও তেমনি ওকে ছেড়ে দেয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে একটা তাগিদ ছিল। এই দুইয়ে মিলে ফোনটার কথা উভয়কে বেমালুম ভুলিয়ে দিয়েছিল। দোকানীকে মূল্য পরিশোধ করে দিয়ে আমরা শাফি’র গাড়ীতে উঠে বসলাম। গাড়ীতে বসেই ভাবলাম, সারাটা বিকেলের তোলা ছবিগুলোকে একটু দেখি। পকেট হাতড়ে দেখি ফোন নেই, স্বভাবসুলভ সীটের আশে পাশেও হাতড়ালাম- নাহ, সেখানেও নেই! বুঝলাম, সেটা রেহানের গাড়ীতে ফেলে এসেছি, সেখানেই পাওয়া যাবে। শাফিকে বললাম, রেহানকে একটা ফোন দিতে। শাফি বললো, ওর কাছে কোন ফোন নেই। পরে আস্তে করে বললো, উও বহুত গরীব আদমী স্যার! মনে হলো, তাই তো, সে তো শাফিকেও ফোন করেছিল সেই দোকানীর ফোনটা চেয়ে নিয়ে! আমি বললাম, গাড়ীর মালিককে ফোন দাও। সে বললো, মালিকের ফোন নম্বরটা তার জানা নেই।
শাফি বললো, দ্রুত ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গেলে হয়তো ওকে এখনো সেখানে পাওয়া যেতে পারে। এই বলে সে খুব দ্রুত গতিতে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড অভিমুখে গাড়ী চালাতে শুরু করলো। আমার ঐ সেলফোনে ঢাকায় যাওয়ার এয়ার টিকেট সেভ করা আছে, যার কোন হার্ড কপি আমি রাখিনি, কারণ দিল্লী ও শ্রীনগর এয়ারপোর্টে আমি দেখেছিলাম, সেলফোন বের করে টিকেটের ফটো দেখিয়েই সবাই ভেতরে প্রবেশ করছে, এমনকি চেক ইনও করছে। ফোনটা না পেলে আমাদের টিকেট টা মার যাবে, একথা যখন শাফিকে জানালাম, তখন সে আরও দ্রুতবেগে গাড়ী চালাতে শুরু করলো। ভাগ্যিস, আমরা রেহানের গাড়ীর নম্বরটা মুখস্থ রেখেছিলাম। আচমকা এক সময় আমার ছেলে বলে উঠলো, ঐ যে রেহানের গাড়ীটা! শাফি দ্রুত গাড়ীটার সামনে গিয়ে থামার সংকেত দিলে গাড়ীটা থেমে গেল। গাড়ীটা তখন রেহান নয়, মালিক নিজেই চালাচ্ছিলেন। রেহান মালিককে গাড়ী বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেছে। ওনাকে কিছু বলার আগেই উনি শাফিকে বললেন, উনি ভাবছিলেন কী করে গাড়ীতে রাখা হাতমোজা জোড়া তার মালিককে ফেরত দিবেন। শাফি বললো, হাতমোজা নয়, সেলফোনটা বেশী জরুরী, কারণ সেখানে আমার এয়ার টিকেট সেভ করা আছে। উনি বললেন, গাড়ীতে উনি কোন ফোন দেখেন নাই। আমি নেমে অন্ধকারেই হাতড়ে ফোনটা বের করলাম, কারণ আমি জানতাম ফোনটা ঠিক কোন জায়গাটাতে রেখেছিলাম। ফোনটা সেই জায়গার একটি ফাক দিয়ে নীচে পড়ে গিয়েছিল। জায়গাটা স্বাভাবিকভাবে মালিকের চোখে না পড়ারই কথা। যাহোক, ফোনটা পেয়ে যাওয়াতে সবারই যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো! গাড়ীটির মালিক কপালে দু'চোখ তুলে শাফিকে জিজ্ঞেস করলেন, "এভাবে দৈবক্রমে যদি আমাদের এখানে দেখা হয়ে না যেত, তবে আগামীকাল উনি দিল্লী যেতেন কী ভাবে? আমরা তো একে অপরের টেলিফোন নম্বর রাখিনি!"
চলবে.....
ঢাকা
২৭ জুন ২০১৯
"আমার আগ্রহের কারণ ছিল ঘরটির সামনের একটি সাইনবোর্ড, যাতে লেখা ছিল 'GOVT. HIGH SCHOOL' "
চিত্রে প্যাহেলগামের 'আয়েশমোকাম' এলাকার একটি উচ্চ বিদ্যালয়।
অনুচ্চ পাহাড়গুলোর চূড়ায় তখনো এক স্বর্গীয় প্রভা লেপ্টে ছিল।
পাত্রটির নাম "আঙ্গারা"।
কিছু ছেড়ে দেওয়া পনি-ঘোড়া আস্তাবলে যাবার আগে আগে পথটির দু’পাশের ঘাসের আস্তরণ থেকে দিনের শেষ আহার খুঁজে নিচ্ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৫০