শ্রীনগর বিমান বন্দর টার্মিনালের মেঝেতে বিচরণরত একটি শালিক পাখি
টার্মিনাল ভবনের প্রবেশ ফটকে এসে দেখলাম, তখনো সময় হয়নি বলে নিরাপত্তা প্রহরীরা যাত্রীদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেনা। অগত্যা আমরা বাহিরে একটা অপেক্ষা ছাউনিতে বসে কিছু স্ন্যাকস খেয়ে নিলাম। লক্ষ্য করলাম, টার্মিনাল এর সামনে একটা ফুলের বাগান রয়েছে। ছেলেকে লাগেজ পাহাড়া দেয়ার দায়িত্বে রেখে আমি ও আমার স্ত্রী সেখানে গিয়ে কিছু ছবি তুলে আনলাম। মধ্যপ্রহরেও ফুলের ছবি তুলতে ভালই লাগছিল। ফিরে এসে আবার ছেলের পাশে বসলাম। সে আপন মনে সেলফোনে ব্রাউজিং করে চলেছিল। কোথা থেকে এক নিরাপত্তা রক্ষী এসে পাশে রাখা একটা অরক্ষিত মালামাল সমেত ট্রলী দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, সেটা আমাদের কি না। আমি না বললাম। আশেপাশের সবাইকে সে এ প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু কেউ তার মালিকানা দাবী করলো না। যখন সেই নিরাপত্তা রক্ষী মালসমেত ট্রলীটিকে জব্দ করার পাঁয়তারা করছিল, ঠিক সেই সময়ে এক ব্যক্তি ভেজা মুখ মুছতে মুছতে এসে ট্রলীর মালিকানা দাবী করলো। নিরাপত্তা রক্ষীটি তাকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বললো, আর কখনো যেন তিনি এভাবে মালামাল অরক্ষিত রেখে কোথাও না যান। ওয়াশরুমে গেলে ট্রলী সেখানেও নিয়ে যেতে হবে!
টার্মিনাল ভবনের বাহিরে অপেক্ষা করার সময় এক মধ্যবয়সী লোক আমার কাছে এসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমরা সেদিনই ঢাকা অথবা চট্টগ্রাম ফিরে যাচ্ছি কিনা। প্রশ্নটা শুনে আমি কিছুটা অবাক হ’লাম (এই ভেবে যে উনি কিভাবে বুঝলেন, আমরা ঢাকা বা চট্টগ্রামেই যাব!), তবে পরক্ষণেই ভদ্রলোককে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। উনি আমার অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে জানালেন, আমরা শ্রীনগরে একই হোটেলের বাসিন্দা ছিলাম। আমি চিনতে পারলাম। ব্রেকফাস্ট এবং ডিনারের সময় যখন হোটেলের রেস্টুরেন্টে নেমে আসতাম, তখন ঐ ভদ্রলোককে দেখতাম তিনি সপরিবারে আহার গ্রহণ করছেন। উনি জানালেন, উনি হায়দ্রাবাদের বাসিন্দা, ধর্মে মুসলমান। তার কিছু বাংলাদেশী কর্মচারী রয়েছে, যারা চট্টগ্রামের বাসিন্দা। তাই তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম নামটির সাথে সুপরিচিত। তার কথা শুনে আমি প্রীত হ’লাম। ইতোমধ্যে টার্মিনাল ভবনের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি ঘোষিত হওয়ায় তার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে আমরা একসাথে ভেতরে প্রবেশ করলাম। তিনি এগিয়ে গেলেন তার কাউন্টারে, আমরা আমাদেরটায়। প্রথমেই আমাদেরকে কিছু নিরাপত্তা ফর্ম পূরণ করতে হলো। অবশ্য এসব ফর্ম পূরণে কর্তব্যরত অফিসার যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন। আমি শুধু আমার ফর্মটাই পূরণ করেছিলাম। আমার পূরণকৃত ফর্মটা দেখে অফিসার নিজেই আমার স্ত্রীর এবং ছেলের ফর্ম দুটো পূরণ করে সেখানে তাদের স্বাক্ষর নিয়েছিলেন। চেক-ইন কাউন্টারের অফিসারও বেশ কিছু বন্ধুসুলভ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বোর্ডিং পাস হাতে ধরিয়ে দিলেন এবং পুনরায় কাশ্মীর ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়ে শুভেচ্ছাসূচক অভিবাদন জানালেন।
চেক-ইন সম্পন্ন করার পরেও আমাদের হাতে প্রচুর সময় ছিল। টার্মিনালের অভ্যন্তরে একটি নামায কক্ষ ছিল, আমি সেখানে গিয়ে যোহরের নামায পড়ে নিলাম। তারপর এদিক সেদিক লক্ষ্যহীন পায়চারী শুরু করলাম। ওদের টার্মিনালের অভ্যন্তরে শালিক পাখি এবং কবুতরের অবাধ বিচরণ দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দেখলাম একজন অতিথি চেয়ারে বসে কিছু খাচ্ছেন, আর তার সামনের উল্টোদিকের চেয়ারের মাথায় বসে অপেক্ষারত এক শালিক পাখি তাকিয়ে দেখছে কখন তিনি উঠে যাবেন, যেন সে টেবিলে পড়া আহার্য থেকে কিছুটা খুটে খেতে পারে। এভাবেই অলস সময় পার করতে করতে এক সময় বোর্ডিং এর অনুরোধ মাইক্রোফনে ঘোষিত হলো। আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। প্লেনে আসন গ্রহণ করে আমি সেলফোনের ফটোগুলো এডিট করা শুরু করে দিলাম। শ্রীনগর থেকে প্লেন দিল্লী পৌঁছার পর অধিকাংশ যাত্রী নেমে গেলেন। শুধু আমরা আর আরো ২/৩টা পরিবার কোলকাতা যাব বলে আমাদেরকে প্লেনেই বসে থাকার নির্দেশ দেয়া হলো। মাত্র ৩০ মিনিটের মাথায় বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের কর্মতৎপর স্টাফরা এসে প্লেনটিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে গেল, নিরাপত্তা স্টাফরা এসে আমাদের হ্যান্ড লাগেজ আমরা নিজেদের দখলে রেখেছি কিনা তা পরীক্ষা করে গেল, এবং নতুন এক সেট কেবিন ক্রু প্লেনে তাদের পোস্ট বুঝে নিল। দিল্লীতে চল্লিশ মিনিট বিরতির পর প্লেনটা আবার ট্যাক্সিইং শুরু করে অচিরেই আকাশে পাখা মেলে দিলো।
প্লেন যখন কোলকাতার নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোস বিমান বন্দরে অবতরণ শুরু করলো, আমি আমার ছেলেকে বললাম, গুগল সার্চ করে বিমান বন্দরের নিকটস্থ কোন হোটেলে এক রাতের জন্য বুকিং দেয়ার জন্য। সে চট করে তাই করলো। প্লেন থেমে গেলে সে প্লেনে বসেই হোটেলকে পনের মিনিট পরে গাড়ী পাঠাতে বললো। টার্মিনাল থেকে বের হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ীর ড্রাইভার ফোন দিয়ে আমাদের অবস্থান জেনে নিল। কিছুক্ষণ পর সে গাড়ী নিয়ে এলে আমরা লাগেজ গাড়ীতে উঠিয়ে নিজেরাও উঠে বসলাম। বিমল ভক্ত নামের সে চালক ছেলেটা কথায় বার্তায়, আচার আচরণে খুবই ভদ্র ছিল। কথায় কথায় সে জানালো, তাদের পূর্ব পুরুষের ভিটে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে ছিল।
আমরা হোটেলে মালপত্র রেখে একটা ঔষধ কেনার জন্য বের হ’লাম। তারপর ‘ঢাকা হোটেল’ নামের একটা রেস্টুরেন্ট থেকে বিরিয়ানী খেয়ে হোটেলে ফিরে আসলাম। হোটেলের ম্যানেজার সাহেব এক সময় ঢাকার ধানমন্ডিতে থাকতেন বলে জানালেন। হাঁটতে হাঁটতেই ফিরে এসেছিলাম বলে চারিদিকে তাকিয়ে রাতের কোলকাতাকে দেখে নিচ্ছিলাম। হোটেলে এসে কিছুক্ষণ নেট ব্রাউজিং করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে একে একে সবাই তৈরী হয়ে নিলাম। গাড়ীর জন্য আগেই সময় জানিয়ে রেখেছিলাম, সুতরাং নীচে নেমে দেখি গাড়ী আমাদেরকে নেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে আমরা গাড়ীতে উঠে বসলাম। বিমল ভক্ত আবার তার গল্প শুরু করলো। বললো, স্যার, এ রাস্তাটাই যশোর রোড, আপনাদের যশোরে গিয়ে উঠেছে। আপনাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বহু লোক এ রাস্তা দিয়ে ভারতে এসেছিল। এমনকি এ রাস্তা নিয়ে লেখা একটা গানও খুব বিখ্যাত হয়েছিল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি অনুমান করলাম, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ওর নিশ্চয়ই জন্মও হয়নি। তাই হয়তো ও লোকমুখে কথাগুলো শুনে নয়তো বই পড়ে জানতে পেরে কথাগুলো মনে রেখেছে। ভাল লাগলো, একজন ভিনদেশী বাঙালি হিসেবে শুধুমাত্র শেকড়ের কারণে সে আমাদের স্বাধীনতার সময়টাকে নিয়ে ভেবেছে বলে।
পনের মিনিটের মধ্যেই আমরা বিমান বন্দরে পৌঁছালাম। বিমল ভক্ত আমাদের লাগেজ নামিয়ে দিয়ে একটি হাসি দিল। গাড়ীভাড়া হোটেল বিলের সাথেই অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা আগেই মিটিয়ে দিয়েছিলাম। তার আচরণ ভাল ছিল বলে তাকে একটু ভাল টিপস দিব বলে মনে মনে আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। তার হাসির অর্থটা বুঝতে পেরে সেটাই করলাম। সে খুশী হয়ে সেলাম জানিয়ে চলে গেল। আমরা ধীরে ধীরে ট্রলী ঠেলে টার্মিনালের ভেতরে প্রবেশ করলাম।
বিমান বন্দরের সব প্রক্রিয়া নিয়মমাফিক এগোতে থাকলো। চেক-ইন, ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি চেক, সব শেষে বোর্ডিং। এসব সম্পন্ন করে প্লেনে বসে আল্লাহ’র শোকর গুজার করলাম, এ যাবত সফরটাকে নিরাপদে শেষ করতে পারলাম বলে। এবারে তো যাচ্ছি নিজ দেশে। মনে পড়লো সচরাচর যেসব অভিজ্ঞতা হয়, সে সবের কথা। লাগেজ বেল্টে লাগেজ আসতে বিলম্ব, হুড়োহুড়ির মধ্যে লাগেজ খুঁজে পেতে বিলম্ব, ইমিগ্রেশনে লম্বা লাইন, বিমান বন্দর থেকে প্রধান সড়কে উঠতে আধা ঘন্টার চেয়েও বেশী সময় নেয়া, ইত্যাদি। তার পরেও, নিজ দেশ বলে কথা! সব কিছু মেনে নিয়ে এবং মানিয়ে নিয়েই খুশী মনে চলতে হবে।
বিকেল চারটায় নিজ গৃহে এসে পৌঁছলাম। সেদিন ছিল প্রথম রোযার দিন। ঘরে কোন ইফতারির আয়োজন ছিল না। আমি একটু বিশ্রাম নিয়ে ফ্রেশ হয়ে উঠে ইফতারি কিনে আনার জন্য বের হ’লাম। ইফতারির পরে দেড় ঘন্টার অধিক সময় ধরে জামাতে তারাবীহ পড়তে হবে। মনে মনে সে প্রস্তুতিও নিতে থাকলাম। ইফতারি করার সময় মনে ভীষণ একটা প্রশান্তি অনুভব করতে থাকলাম। আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন সহায় থাকলে এবং তাঁর উপর নির্ভর করতে জানলে কত বড় বড় বিপদ পার হয়ে যায়, বান্দা কিছুই টের পায় না! এসব ভাবতে ভাবতে সফরের সুখস্মৃতি দূরে সরিয়ে রেখে নিবিষ্ট মনে রমযানের ইবাদতের জন্য ব্রতী হ’লাম। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা আল্লাহ তা’লার!
আমার গল্পকথা ফুরোলো!!!
ঢাকা
০৯ জুলাই ২০১৯
(এ সফর বৃত্তান্তে যাদের যাদের কথা উঠে এসেছে- সেই সাঈদ হাসান, মানযুর, শাফি, ফররোখ, রেহান, শিব্বির এবং বিমল ভক্ত, তাদের প্রত্যেকের জন্য রইলো শুভকামনা)
শ্রীনগর বিমান বন্দর টার্মিনালের বাহিরের বাগানের ফুল
শ্রীনগর বিমান বন্দর টার্মিনালের সম্মুখস্থ বাগানের ফুল
শ্রীনগর বিমান বন্দর টার্মিনালের সম্মুখস্থ বাগান থেকে তোলা
শ্রীনগর বিমান বন্দর টার্মিনালের সম্মুখস্থ বাগান থেকে তোলা
রেস্টুরেন্টটার নামটা বড়ই অদ্ভূত ছিল - VAANGO!
সেখানে একজন কাস্টমার কিছু খাচ্ছেন, তার সামনের চেয়ারের মাথায় উল্টোমুখি বসা একটি শালিক পাখি।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:২৬