বর্তমানে যে তারকাপ্রথা প্রচলিত আছে সেটা অল্পকিছু পেশায় সীমিত হয়ে আছে। প্রধানত: তারকাপ্রথা আবর্তিত হচ্ছে চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পীদের ঘিরে। সে সাথে যুক্ত হয়েছে টেলিভিশনের অভিনয়শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী আর বিজ্ঞাপনের মডেলরা। টেলিভিশনের সৌজন্যে ক্রীড়াবিদরাও এখন তারকা। যুগের হাওয়ায় কিছু টিভি উপস্থাপক, কিছু বেস্টসেলার লেখকও তারকাখ্যাতি পেয়েছেন।
আমাদের শৈশবকালে দেখেছি বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, ধ্রুপদী লেখকদের জীবনী আমাদের সামনে তুলে ধরা হতো আদর্শ মানুষ হিসাবে অনুসরণের জন্য। তখনও পত্রিকার কল্যাণে উত্তম-সুচিত্রা, শবনম-রহমান, রাজ্জাক-কবরী এসব জুটির তারকা খ্যাতি ছিলো। রুনা,সাবিনা, ফেরদৌসী রহমান, আব্বাস উদ্দিন, নীনা হামিদ, আবদুল আলীমরা তারকা ছিলেন রেডিওর কল্যাণে। কারো কারো কাছে লতা, মোহাম্মদ রফি, মুকেশ, মান্না, হেমন্ত, নূরজাহানরা তারকা ছিলেন। আবার দীলিপ কুমার, রাজকাপুরদেরও ভক্ত ছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু মূলধারার সংবাদপত্রে তাঁদের ঠাঁই ছিলো না বললেই চলে। এর জন্য ছিলো আলাদা বিনোদন পত্রিকা- সাপ্তাহিক চিত্রালী, পূর্বানী, মাসিক জোনাকি ইত্যাদি। বলাবাহুল্য এসব কাগজের মর্যাদা ছিলো মূলধারার কাগজের চেয়ে কম। এখন যুগ বদলে গেছে। আইনস্টাইন বা নিউটন এখন আর রোলমডেল নেই। এখন সে জায়গায় ঢুকে গেছেন অভিনয় আর সঙ্গীত তারকারা।
আমাদের দেশে এ তারকাপ্রথারও সীমানা আছে। এখন বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রের তারকারা গুরুত্বের বিচারে পিছিয়ে গেছেন। এখন টিভিতারকাদের প্রতাপ বেশি। সাথে আছেন বলিউড আর হলিউড তারাকারা। টালিউডের কেউ কেউ কল্কে পান কালেভদ্রে। সঙ্গীতশিল্পীর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের শিল্পীদের তারকাখ্যাতি সীমিত। পাশ্চাত্যের শিল্পীদের কদর বরং বেশি। মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাডোনা, সাকিরা, এমিনেম বলতে অনেকে অজ্ঞান।
মডেলদেরও কিছু প্রভাব আছে তারকাজগতে।
খেলার জগতে আমাদের অঞ্চলে ক্রিকেট তারকাদের প্রতাপ সবচেয়ে বেশি। দেশী ক্রিকেটারদের মধ্যে সাকিব, তামিম, মাশরাফি, মোস্তাফিজ, মুশফিকরা বড়ো তারকা। শচীন, আফ্রিদীরাও কম যান না। বাংলাদেশের ফুটবলারদের নাম না জানলেও মেসি,নেইমার বা রোনালদোরা এখন বড়ো তারকা। তাঁদের জার্সি পরে ঘুরে বেড়ায় বহু মানুষ।
কি এক বিচিত্র কারণে টেনিস নিয়ে আমাদের পত্রিকাগুলো বহুদিন ধরে রিপোর্ট ছাপছে। এর ফলে ফেদেরার, সেরেনা, ভেনাস বা শারাপোভারাও কম যান না আজকাল।
এক কালে এ দেশে বক্সিংয়ের খ্যাতি ছিলো মোহাম্মদ আলীর সুবাদে। এখন আর তেমন চোখে পড়ে না বক্সিং প্রসঙ্গ।
অথচ বাংলাদেশ যে খেলাটিতে বহুদিন আগে থেকেই বিশ্বমানের তার নাম দাবা। নিয়াজ মোর্শেদ মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৯৮৭ সালে আন্তর্জাতিক দাবার সর্বোচ্চ গ্রাণ্ডমাস্টার খেতাব লাভ করেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এবং এশিয়ার পঞ্চম গ্রাণ্ড মাস্টার। তিনি যখন গ্রাণ্ড মাস্টার হন তখন বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের গ্রাণ্ড মাস্টার ছিলেন ফিলিপাইনে। শুধু অবহেলা আর স্পনসরের অভাবে নিয়াজ রয়ে গেলেন অগোচরে। অথচ তাঁর পরে গ্রাণ্ড মাস্টার খেতাব পাওয়া ভারতের বিশ্বনাথন আনন্দ তারকা খ্যাতি আর স্পনসরের সুবিধা পেয়ে হয়েছেন দাবায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। নিয়াজ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারতেন কি না সে তর্কে না গিয়েও বলা যায়, আমরা চেষ্টাইতো করিনি। অবহেলার পরও নিয়াজ মোর্শেদের পর একে একে জিয়াউর রহমান,রিফাত বিন সাত্তার, আব্দুল্লাহ আল রাকিব, এনামুল হোসেন রাজিব গ্রাণ্ড মাস্টার খেতাব পেয়েছেন। আমাদের প্রকৃত বিশ্বমানের এসব ক্রীড়াবিদ তারকা নন !
আমাদের দেশে গলফের কথা আমরা পত্রিকায় দেখেছি এরশাদ সাহেবের কল্যাণে। সে সাথে সুদূর আমেরিকার টাইগার উডসও আমাদের কাছে তারকা বনে গেলেন। আমাদের আর কোন গলফারের আলোচনা নেই কাগজে। সাম্প্রতিককালে সিদ্দিকুর রহমান পেশাদার গলফে ভালো করছেন। মাঝে মাঝে তাঁকে নিয়ে আলোচনা দেখি। কিন্ত সেটা কি তেমন হালে পানি পাচ্ছে ? আইপিএল খেলে পাওয়া পারিশ্রমিকের গুনে মাশরাফি আর সাকিব কোটিপতি বনে গেছেন। গলফার সিদ্দিকুর রহমানই পুরস্কারের টাকায় কোটিপতি।
যারা তারকা তারা নিজ নিজ পেশার উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। তাহলে যে সব মানুষ নিজের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নিষ্ঠা আর সেবার মন নিয়ে কাজ করছেন তাঁদের কেন আমরা তারকা করে তুলছি না। এঁদেরকে তারকা করে তুলতে পারলে তাঁরাও মূল্যায়িত হবার কারণে উৎসাহিত হতেন, অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হতেন। আমাদের চিকিৎসা পেশায় অনেক নামী আর গুণী মানুষ জন্মেছেন। তাঁদের কাজের স্বীকৃতি কি আমরা দিচ্ছি। বারডেম-এর সূত্রে ডা.ইব্রাহীম কিছুটা প্রচারণার আলো পেয়েছেন। অন্যরা কি পেয়েছেন ? অথচ ভারত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দেবী শেঠীকে রীতিমতো তারকা বানিয়ে ফেলেছে। তাঁকে অনেকে ভক্তিভরে ডাকেন 'ভগবান শেঠী'।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী শিক্ষকদের ব্যাপারে আমরা কতোটা ওয়াকিবহাল ? অথচ প্রফেসর এডোয়ার্ড সাঈদ কিংবা প্রফেসর নোয়াম চমস্কি বিশ্ব-তারকা। সারা দেশের কলেজ, স্কুলে কতো নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক সারা জীবন বিলিয়ে গেছেন আমাদের ছেলে মেয়েদের মানুষ করার জন্য। তাঁরা হারিয়ে গেছেন বা যাচ্ছেন কালের অতলে। এটা কি তাঁদের উপযুক্ত প্রাপ্য?
হরিধানের জন্য হরিপদ কাপালিকে আমরা কেউ কেউ চিনছি। এরকম অনেক সৃজনশীল কৃষক ছিলেন অনেকেই। তাঁরা হারিয়ে গেছেন। আমাদের চোখের সামনেই হয়তো নিজের চাকরীর গন্ডির বাইরে গিয়ে নিষ্ঠা আর শ্রম দিয়ে হারিয়ে গেছেন অনেক পেশাজীবি। ডুবুরি চান মিয়া কিংবা অন্য কোন ফায়ার ফাইটার যাঁরা জীবন বিপন্ন করেন আগুন নেভাতে বা মানুষ বাঁচাতে তাঁদের কথা কি ভাবি কেউ ? নিবেদিতপ্রাণ সৃজনশীল ব্যাংকার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, গ্রন্থাগারিক বা গবেষককে আমরা চিনি না। স্রোতের বিপরীতে উজান ঠেলা চাকরিজীবী বা আমলা বা পুলিশ কর্মকর্তার সংগ্রামের কথা আমরা জানি না, সেই উজানঠেলা বিপন্ন প্রজাতির এ সব মানুষের পাশেও আমরা কি দাঁড়াই ? তাহলে কেমন করে পাবো জনবান্ধব আমলা বা পুলিশ অফিসার। বিচার বিভাগে অনেক নিষ্ঠাবান সাহসী বিচারক আছেন যারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কাটিয়ে দিয়েছেন বা দিচ্ছেন সারা জীবন। তাঁদের ক'জনকে আমরা চিনি। এভাবে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যাঁরা নিষ্ঠা আর শ্রম দিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করছেন তাঁদের মধ্যে সেরাদেরকে কেন আমরা তারকা হিসাবে তুলে ধরছি না ? কবে কাটবে তারকা প্রথার এ সীমাবদ্ধতার অন্ধকার ?
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৮:১১