somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তারকাপ্রথার সীমাবদ্ধতা

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বর্তমানে যে তারকাপ্রথা প্রচলিত আছে সেটা অল্পকিছু পেশায় সীমিত হয়ে আছে। প্রধানত: তারকাপ্রথা আবর্তিত হচ্ছে চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পীদের ঘিরে। সে সাথে যুক্ত হয়েছে টেলিভিশনের অভিনয়শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী আর বিজ্ঞাপনের মডেলরা। টেলিভিশনের সৌজন্যে ক্রীড়াবিদরাও এখন তারকা। যুগের হাওয়ায় কিছু টিভি উপস্থাপক, কিছু বেস্টসেলার লেখকও তারকাখ্যাতি পেয়েছেন।

আমাদের শৈশবকালে দেখেছি বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, ধ্রুপদী লেখকদের জীবনী আমাদের সামনে তুলে ধরা হতো আদর্শ মানুষ হিসাবে অনুসরণের জন্য। তখনও পত্রিকার কল্যাণে উত্তম-সুচিত্রা, শবনম-রহমান, রাজ্জাক-কবরী এসব জুটির তারকা খ্যাতি ছিলো। রুনা,সাবিনা, ফেরদৌসী রহমান, আব্বাস উদ্দিন, নীনা হামিদ, আবদুল আলীমরা তারকা ছিলেন রেডিওর কল্যাণে। কারো কারো কাছে লতা, মোহাম্মদ রফি, মুকেশ, মান্না, হেমন্ত, নূরজাহানরা তারকা ছিলেন। আবার দীলিপ কুমার, রাজকাপুরদেরও ভক্ত ছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু মূলধারার সংবাদপত্রে তাঁদের ঠাঁই ছিলো না বললেই চলে। এর জন্য ছিলো আলাদা বিনোদন পত্রিকা- সাপ্তাহিক চিত্রালী, পূর্বানী, মাসিক জোনাকি ইত্যাদি। বলাবাহুল্য এসব কাগজের মর্যাদা ছিলো মূলধারার কাগজের চেয়ে কম। এখন যুগ বদলে গেছে। আইনস্টাইন বা নিউটন এখন আর রোলমডেল নেই। এখন সে জায়গায় ঢুকে গেছেন অভিনয় আর সঙ্গীত তারকারা।

আমাদের দেশে এ তারকাপ্রথারও সীমানা আছে। এখন বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রের তারকারা গুরুত্বের বিচারে পিছিয়ে গেছেন। এখন টিভিতারকাদের প্রতাপ বেশি। সাথে আছেন বলিউড আর হলিউড তারাকারা। টালিউডের কেউ কেউ কল্কে পান কালেভদ্রে। সঙ্গীতশিল্পীর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের শিল্পীদের তারকাখ্যাতি সীমিত। পাশ্চাত্যের শিল্পীদের কদর বরং বেশি। মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাডোনা, সাকিরা, এমিনেম বলতে অনেকে অজ্ঞান।

মডেলদেরও কিছু প্রভাব আছে তারকাজগতে।

খেলার জগতে আমাদের অঞ্চলে ক্রিকেট তারকাদের প্রতাপ সবচেয়ে বেশি। দেশী ক্রিকেটারদের মধ্যে সাকিব, তামিম, মাশরাফি, মোস্তাফিজ, মুশফিকরা বড়ো তারকা। শচীন, আফ্রিদীরাও কম যান না। বাংলাদেশের ফুটবলারদের নাম না জানলেও মেসি,নেইমার বা রোনালদোরা এখন বড়ো তারকা। তাঁদের জার্সি পরে ঘুরে বেড়ায় বহু মানুষ।

কি এক বিচিত্র কারণে টেনিস নিয়ে আমাদের পত্রিকাগুলো বহুদিন ধরে রিপোর্ট ছাপছে। এর ফলে ফেদেরার, সেরেনা, ভেনাস বা শারাপোভারাও কম যান না আজকাল।

এক কালে এ দেশে বক্সিংয়ের খ্যাতি ছিলো মোহাম্মদ আলীর সুবাদে। এখন আর তেমন চোখে পড়ে না বক্সিং প্রসঙ্গ।

অথচ বাংলাদেশ যে খেলাটিতে বহুদিন আগে থেকেই বিশ্বমানের তার নাম দাবা। নিয়াজ মোর্শেদ মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৯৮৭ সালে আন্তর্জাতিক দাবার সর্বোচ্চ গ্রাণ্ডমাস্টার খেতাব লাভ করেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এবং এশিয়ার পঞ্চম গ্রাণ্ড মাস্টার। তিনি যখন গ্রাণ্ড মাস্টার হন তখন বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের গ্রাণ্ড মাস্টার ছিলেন ফিলিপাইনে। শুধু অবহেলা আর স্পনসরের অভাবে নিয়াজ রয়ে গেলেন অগোচরে। অথচ তাঁর পরে গ্রাণ্ড মাস্টার খেতাব পাওয়া ভারতের বিশ্বনাথন আনন্দ তারকা খ্যাতি আর স্পনসরের সুবিধা পেয়ে হয়েছেন দাবায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। নিয়াজ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারতেন কি না সে তর্কে না গিয়েও বলা যায়, আমরা চেষ্টাইতো করিনি। অবহেলার পরও নিয়াজ মোর্শেদের পর একে একে জিয়াউর রহমান,রিফাত বিন সাত্তার, আব্দুল্লাহ আল রাকিব, এনামুল হোসেন রাজিব গ্রাণ্ড মাস্টার খেতাব পেয়েছেন। আমাদের প্রকৃত বিশ্বমানের এসব ক্রীড়াবিদ তারকা নন !

আমাদের দেশে গলফের কথা আমরা পত্রিকায় দেখেছি এরশাদ সাহেবের কল্যাণে। সে সাথে সুদূর আমেরিকার টাইগার উডসও আমাদের কাছে তারকা বনে গেলেন। আমাদের আর কোন গলফারের আলোচনা নেই কাগজে। সাম্প্রতিককালে সিদ্দিকুর রহমান পেশাদার গলফে ভালো করছেন। মাঝে মাঝে তাঁকে নিয়ে আলোচনা দেখি। কিন্ত সেটা কি তেমন হালে পানি পাচ্ছে ? আইপিএল খেলে পাওয়া পারিশ্রমিকের গুনে মাশরাফি আর সাকিব কোটিপতি বনে গেছেন। গলফার সিদ্দিকুর রহমানই পুরস্কারের টাকায় কোটিপতি।

যারা তারকা তারা নিজ নিজ পেশার উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। তাহলে যে সব মানুষ নিজের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নিষ্ঠা আর সেবার মন নিয়ে কাজ করছেন তাঁদের কেন আমরা তারকা করে তুলছি না। এঁদেরকে তারকা করে তুলতে পারলে তাঁরাও মূল্যায়িত হবার কারণে উৎসাহিত হতেন, অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হতেন। আমাদের চিকিৎসা পেশায় অনেক নামী আর গুণী মানুষ জন্মেছেন। তাঁদের কাজের স্বীকৃতি কি আমরা দিচ্ছি। বারডেম-এর সূত্রে ডা.ইব্রাহীম কিছুটা প্রচারণার আলো পেয়েছেন। অন্যরা কি পেয়েছেন ? অথচ ভারত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দেবী শেঠীকে রীতিমতো তারকা বানিয়ে ফেলেছে। তাঁকে অনেকে ভক্তিভরে ডাকেন 'ভগবান শেঠী'।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী শিক্ষকদের ব্যাপারে আমরা কতোটা ওয়াকিবহাল ? অথচ প্রফেসর এডোয়ার্ড সাঈদ কিংবা প্রফেসর নোয়াম চমস্কি বিশ্ব-তারকা। সারা দেশের কলেজ, স্কুলে কতো নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক সারা জীবন বিলিয়ে গেছেন আমাদের ছেলে মেয়েদের মানুষ করার জন্য। তাঁরা হারিয়ে গেছেন বা যাচ্ছেন কালের অতলে। এটা কি তাঁদের উপযুক্ত প্রাপ্য?

হরিধানের জন্য হরিপদ কাপালিকে আমরা কেউ কেউ চিনছি। এরকম অনেক সৃজনশীল কৃষক ছিলেন অনেকেই। তাঁরা হারিয়ে গেছেন। আমাদের চোখের সামনেই হয়তো নিজের চাকরীর গন্ডির বাইরে গিয়ে নিষ্ঠা আর শ্রম দিয়ে হারিয়ে গেছেন অনেক পেশাজীবি। ডুবুরি চান মিয়া কিংবা অন্য কোন ফায়ার ফাইটার যাঁরা জীবন বিপন্ন করেন আগুন নেভাতে বা মানুষ বাঁচাতে তাঁদের কথা কি ভাবি কেউ ? নিবেদিতপ্রাণ সৃজনশীল ব্যাংকার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, গ্রন্থাগারিক বা গবেষককে আমরা চিনি না। স্রোতের বিপরীতে উজান ঠেলা চাকরিজীবী বা আমলা বা পুলিশ কর্মকর্তার সংগ্রামের কথা আমরা জানি না, সেই উজানঠেলা বিপন্ন প্রজাতির এ সব মানুষের পাশেও আমরা কি দাঁড়াই ? তাহলে কেমন করে পাবো জনবান্ধব আমলা বা পুলিশ অফিসার। বিচার বিভাগে অনেক নিষ্ঠাবান সাহসী বিচারক আছেন যারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কাটিয়ে দিয়েছেন বা দিচ্ছেন সারা জীবন। তাঁদের ক'জনকে আমরা চিনি। এভাবে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যাঁরা নিষ্ঠা আর শ্রম দিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করছেন তাঁদের মধ্যে সেরাদেরকে কেন আমরা তারকা হিসাবে তুলে ধরছি না ? কবে কাটবে তারকা প্রথার এ সীমাবদ্ধতার অন্ধকার ?
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৮:১১
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×