অফিসে আমার বসার ঘরটি রাস্তার কাছাকাছি। যখনই মোবাইলে বা ল্যান্ড ফোনে কেউ আমার সাথে কথা বলতে শুরু করেন তখনই বলেন, আপনি কি অফিসের বাইরে ? জবাবে যখন জানাই, অফিসেই আছি। তখন অনিবার্য যে কথাটি শুনতে হয় সেটি হলো, তাহলে গাড়ির এতো হর্ণ শুনছি কেন ?
গাড়ির উৎকট হর্ণের শব্দটি ফোনে অল্প একটু কথা বলার সময়ই সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। বেশি শব্দের কারণে আমাকে প্রায়ই একই কথা আবার বলতে হয়। তা না হলে ফোনের ওপারের লোক সেটা বুঝতে পারেন না। তাহলে বুঝুন সারাদিন হর্ণের অন্তহীন যে অত্যাচার সইতে হয় সেটা মনের এবং কানের ওপর কি ধরণের বিরূপ প্রভাব ফেলে চলেছে।
গাড়িতে হর্ণটা দেয়া হয়েছে দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য। যাতে অসচেতন পথচারী বা অন্য চালকদের শেষ মুহূর্তে হলেও সতর্ক করা যায়। সেই হর্ণের বিকট শব্দই এখন শব্দ দূষণের কারণ হয়ে উঠেছে।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের ড্রাইভাররা এতো হর্ণ বাজান কেন ?
আগে মাঝে মাঝে চোখে পড়তো সামনে হাসপাতাল/স্কুল। হর্ণ বাজাবেন না। এখন সেটাও চোখে পড়ে না। হর্ন যেন কর্তৃপক্ষের কাছেও সহনীয় হয়ে গেছে !
আমি আমাদের আসেপাশের অল্প কয়েকটি দেশে যাবার সুযোগ পেয়েছি। মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুরে হর্ন শুনেছি বলে মনে করতে পারছি না। সিঙ্গাপুরে অল্প কয়েকদিন থাকলেও মালয়েশিয়ায় তিন দফায় দেড় মাস ছিলাম। হোটেলে বা শপিং মলে বা এয়ারপোর্টে যেখানেই নামতে গেছি দেখেছি লাইন ধরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পর্যায়ক্রমে যাত্রীরা নামছেন। স্বাভাবিকভাবে। কোন তাড়াহুড়া করছেন না কেউ। বাকিরা অপেক্ষা করছেন গাড়িতে। কোন ড্রাইভারকেই হর্ণ বাজাতে শুনিনি।
চীন, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকায়ও হর্ন বাজাতে শুনেছি অতি অল্প। ভারতের দুটি শহর কলকাতা আর গৌহাটীতে হর্ণ শুনেছি। সেটাও আমাদের মতো প্রকট নয়।
আমাদের রাজধানীসহ বড়ো সব শহরে হর্ণের যে মহামারী চলছে তা আমাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ৬০ ডেসিবল শব্দে মানুষের শ্রবণশক্তি সাময়িকভাবে নষ্ট হতে পারে, ১০০ ডেসিবল শব্দে চিরতরে নষ্ট হতে পারে। শুধু শ্রবণশক্তি নয় শব্দ দূষণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, মাথা ব্যথা, অজীর্ণ, পেপটিক আলসার, অনিদ্রা, ফুসফুসের ক্ষতিসহ নানা সমস্যা হতে পারে। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে্এবং সন্তানসম্ভবা মা আর অনাগত শিশুরও সমস্যা হতে পারে। আকস্মিক বিকট শব্দে হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঘটনাও ঘটে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে শহরের আবাসিক এলাকায় শব্দের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে দিনে ৪৫ ডেসিবল আর রাতে ৩৫ ডেসিবল। মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ আর রাতে ৫০ ডেসিবল, শিল্প এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। রাজধানীতে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে ১০৬ ডেসিবল, বাংলামোটর আর যাত্রাবাড়ীতে ১০০ ডেসিবল, ফার্মগেট ও সোনারগাঁও হোটেলের মোড়ে ১০৪ ডেসিবল, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, মিরপুর আর গুলশানে ৯০ ডেসিবল; গাবতলীতে ১০২ ডেসিবল; মহাখালী, মগবাজার, মৌচাকে ১০৩ ডেসিবল। অন্যান্য জায়গায় ৭৮ থেকে ৯২ ডেসিবল। এ থেকে সুস্পষ্ট যে আমরা শব্দ দূষণের বিপসীমার অনেক ওপরে অবস্থান করছি।
হর্ণ বাজাতে হয় আমাদের অসেচতনভাবে রাস্তা ব্যবহারের কারণে। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখবেন অকারণেও হর্ন বাজানো হচ্ছে। ট্রাফিক সিগনালে বসে থেকে হর্ণ বাজাবার কারণ কি ? আপনি গাড়ি একপাশে নিয়ে লোক নামাচ্ছেন দেখবেন পেছনে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে জোরে জোরে হর্ণ বাজাচ্ছে। বিআরটিএ কিছু কিছু হর্ন ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। সেগুলো লাগিয়ে মনের সুখে জোরে জোরে হর্ণ বাজানো চলছে তো চলছেই !
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৪০