আধুনিক রাষ্ট্র ব্যাবস্থায় যেকোন দেশের আভ্যন্তরীন সমস্যার ফলে প্রতিবেশি দেশের জড়িয়ে পড়াটা যেন অবধারিত। বাংলাদেশও বহুদিন ধরে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যায় জর্জরিত। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অস্ত্রের মুখে পাখির মত গুলি খেয়ে মরতে বসা রোহিঙ্গাদেরকে আমাদের দেশে আশ্রয় দেয়া উচিত। অনেকেই তাদের মুসলমান পরিচয়ের কারনে আমাদের দেশে আশ্রয় দেয়ার পক্ষপাতী। তবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনকে ‘মুসলমানদের উপর বৌদ্ধদের নির্যাতন’ হিসেবে দেখলে তাতে ব্যাপারটাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়না। ব্যাপারটাকে বরং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর প্রধান জাতিগত সম্প্রদায়ের আধিপত্য বিস্তারের ফলাফল হিসেবে দেখা উচিত যে সমস্যা শুধু মিয়ানমারের একার নয় বর্তমান পৃথিবীর অনেক দেশেরই অন্যতম সমস্যা। যাক সে কথা। আমার আলাপ সে দিকে নয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার দাবীকে গনদাবীতে রূপ দিয়েছেন। কিন্তু অনেকেই আছেন যারা রোহিঙ্গাদেরকে আমাদের দেশে আশ্রয় দিতে চান না। যারা আশ্রয় দিতে চান না তাদের যুক্তি হল এই যে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নানারকম অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত। পূর্বেও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আর ফিরে যান নি উপরন্তু তাদের অনেকেই স্থানীয় দালালদের সহায়তায় অবৈধভাবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। বাংলাদেশ নিজেই যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দিক থেকে নাজুক অবস্থানে রয়েছে তাতে রোহিঙ্গাদের আমাদের দেশে আশ্রয় দেয়াটা ঠিক হবেনা বলে তাদের অভিমত। তবে এই যুক্তি দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। স্থানীয় লোকজনদের, যাদের অনেকেই আবার আগে বাংলাদেশে প্রবেশ করে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গা, সহায়তায় রাতের আঁধারে শত শত রোহিঙ্গা প্রতিদিন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। এমনকি খোদ বিজিবির লোকজন বলেছেন, তারা অনেক ক্ষেত্রেই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নৌকা দেখেও না দেখার ভান করছেন। যারা আশ্রয় নিচ্ছেন তাদের মধ্যে খুব কমই উদ্বাস্তু হিসেবে নিবন্ধন করছেন যেহেতু তারা বৈধভাবে অনুপ্রবেশ করেন নি। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজন তাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছেন উদ্বাস্তু হিসেবে নিবন্ধন না করানোর জন্য কারন উদ্বাস্তু হিসেবে নাম নিবন্ধন করালে পরবর্তীতে মিয়ানমারের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে তাদেরকে আবার ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তার চেয়ে ভালো বুদ্ধি হল কোন ভাবে পালিয়ে থাকা এবং পরবর্তীতে বাঙ্গালি হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা। একবার নাগরিক হিসেবে নাম নিবন্ধিত হয়ে গেলে পরবর্তীতে তাকে বের করে দেয়ার সাধ্য বাংলাদেশ সরকারেরও নেই। আগেও এভাবে প্রচুর সংখ্যক রোহিঙ্গা দক্ষিন চট্টগ্রামের মানুষের সাথে মিশে বাঙালি হয়ে গেছেন মূলত তাদেরকে বৈধ ভাবে অনুপ্রবেশ করতে না দেয়া এবং উদ্বাস্তু হিসেবে তাদের নাম নিবন্ধন না করার ফলেই।
বাংলাদেশের জনগনকে যেভাবে জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য নাম, ঠিকানা, ছবি এবং আঙ্গুলের ছাপ দিতে হয়েছে সেভাবে রোহিঙ্গাদেরকেও নাম, ঠিকানা, ছবি এবং আঙ্গুলের ছাপ সমেত ‘রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু’ পরিচয়পত্র দিয়ে সেই তথ্যগুলো কেন্দ্রীয় ডেটাবেজে সংরক্ষন করলে সেই তথ্যই পরবর্তীতে তাদের কেউ পরিচয় গোপন করে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিতে চাওয়ার ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। রোহিঙ্গাদেরকে বৈধভাবে অনুপ্রবেশ করতে দিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে যথাযথভাবে তাদের নাম নিবন্ধন করা হোক যেন পরবর্তীতে বাংলাদেশ চাইলে তাদেরকে নিজেদের নাগরিক হিসেবে গ্রহন করতে পারে। এতে বাংলাদেশ চাইলে যে কোন সময় মিয়ানমারের সাথে সমঝোতা সাপেক্ষে তাদেরকে ফেরত পাঠানোর রাস্তাও খোলা থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:২৩