এরপর ঝুমকী ফুপুর সাথে আমার বেশ কয়েকবার দীর্ঘ কথোপোকথনের পর তার সাথেই পাকাপাকি আবাস গড়ার পরিকল্পনা করি আমি। মাও এই সিদ্ধান্তে আপত্তি করলেন না বরং মনে মনে বোধ হয় খুশিই হলেন। কোনো এক বিশেষ কারণে সেই ছোট থেকেই আমার প্রতি ঝুমকি ফুপুর অস্বাভাবিক এক সুপ্ত ভালোবাসা বোধ করেছি আমি। ঝুমকীফুপুর মত এমন একজন শুভাকাংখী এ বাড়িতে যে আমার থাকতে পারে তা ভাবাই যায় না। একটা সময় তার প্রিয় বেহালা যা উনি কাউকেই ধরতেও দিতে চাইতেন না, তা আমাকে তিনি অবলীলায় দিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় আমার জন্য বেহালা শিক্ষক খুঁজে বের করা বা নাচ শেখার অনুমতী দান বা আমার শান্তি নিকেতনে যাবার পিছে তার যে অবদান তা আর কাউকে দিয়েই বুঝি এ বাড়িতে সম্ভব হত না।
উনি যখন এ কথা নতুন বাবার মাকে ও আমার মাকে জানালেন যে আমাকে পাকাপোক্তভাবে উনার কাছে নিয়ে যেতে চান, মা সানন্দে রাজী হলেন, তার কথায় মনে হলো ঝুমকী ফুপুর এ ইচ্ছায় উনি স্বস্থির নিশ্বাস ফেললেন। যদিও ঝুমকিফুপুর এ প্রস্তাবে নতুব বাবার মায়ের মুখে আষাড়ের মেঘ নেমে এলো। তিনি বোধ হয় মনে মনে ভাবলেন এ আপদ বালাই আবার আমার মেয়ের ঘাড়েও চড়াও হতে চলেছে। তার আচার আচরণে বা আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলা অনেক কথাতেই তার সে বিরক্তি প্রকাশও পেলো। কিন্তু আমার তখন এসব দেখবার সময় নেই। মুক্তি চাই আমি। এই কলুষিত পঙ্কিল জল হাওয়া থেকে বিশুদ্ধ সুনির্মল খোলা হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নিতে চাই। পালিয়ে যেতে চাই আমি এখান থেকে । দূরে কোথাও ..... বহু দূরে...
ঝুমকী ফুপু আমাকে তার কাছে নিয়ে যাবার তোড়জোড় শুরু করলেন। আমিও মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম চিরজীবনের জন্য এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার। কিন্তু এই দেশ, এই পরিচিত লোকালয়, এই প্রিয়জন যারা আমাকে প্রিয়জন না ভাবলেও আমি ভাবি সেসব আত্মীয়রুপী অনাত্মীয়ারা তাদেরকে ছেড়ে যেতে হবে এসব ভাবলেই কোনো এক অজানা কারণে জানিনা আমার বুকের মাঝে হু হু করে ওঠে। এখান থেকে আমি মুক্তি চাই বটে। কিন্তু যখনই ভাবি এই যে ছোট ছোট অতি প্রিয় দৃশ্যাবলী যেমন রমেশকাকুর গাছে পানি দেওয়া বা এই যে আমার ঘরের উত্তরের জানালার এক খন্ড আঁকাশ বা এই বাড়িতে আসার পরদিন সকালে বাগানের যে পাথরের চেয়ারে বসেছিলাম আমি সেই চেয়ারটা এসব তুচ্ছ তুচ্ছ জিনিস হয়তো তবে পরম মমতার এসব আর কখনও দেখা হবেনা । ভাবলেই বুকটা মুচড়ে ওঠে। অবাক হয়ে ভাবি এই পৃথিবীর চলমান জলজ্যান্ত জীবগুলোর সাথে সাথে কত কত মায়ায় জড়িয়ে থাকে স্থবির জড় নির্বাক মুক বস্তুগুলোও।
আমি ছাঁদে বসে থাকি রোজ বিকেলে। বিকাল গড়ায়। কখনও সারারাত আমার কেটে যায় ছাদের রেলিং এর ধারেই। ছাঁদটা আমার বন্ধু হয়ে ওঠে। সাথে ঐ সুবিশাল আকাশ। আজকাল বিকালে আমার সাথে সাথে ছাঁদে আসে তীতলীও। কি যে বক বক করতে শিখেছে সে। আমি ওর সাথে ছাঁদে ছক কেটে এক্কা দোক্কা খেলি। কখনও ও ওর স্কিপিং রোপ নিয়ে আসে। ওকে দেখে আমার মনে পড়ে ছেলেবেলা। আমার প্রিয় কাঠরঙ আর লাল বর্ডারের হ্যান্ডেল লাগানো স্কিপিং রোপটা আমার দাদুর বাসাতেই পড়ে আছে। হঠাৎ আমার মনে পড়ে যায় আমার প্রিয় রং পেন্সিল, লেখলিখির শ্লেট ছোট্ট জুতোর বক্সে বানানো কাপড়ের পুতুলগুলোর কথা। আমি ঠিক করি ঝুমকী ফুপুর সাথে চলে যাবার আগে আমি দাদুর বাসায় যাবো একদিন। আমার সেখানে কিছু কাজ বাকী পড়ে আছে। পড়ে আছে অনেক অনেক স্মৃতি। স্মৃতিগুলোকে মুঠোয় বন্দী করে আনতে হবে আমার।
দাদুর বাসায় কতদিন যাই না আমি। বাবাটা যে কোথায় হারিয়ে গেলো। বাবার মুখটা আমি প্রায় ভুলতেই বসেছি। বাবার কথা মনে পড়লেই আমার তার আগে মনে পড়ে মায়ের রুদ্র মূর্তী। রাগে পাগল হয়ে যাচ্ছেতাই গালাগাল করে যাচ্ছেন বাবাকে। বাবা নিশ্চুপ নির্বাক বেরিয়ে যেতেন বাসা থেকে। ফিরতেন রাত করে। গেস্ট রুম বা ড্রইং রুমের সোফায় ঘুমিয়ে পড়তেন। ও বাড়ি্তে বাবা মায়ের ঝগড়া এতই স্বাভাবিক হয়ে পড়েছিলো যে সেসবে কারো কর্নপাতও ছিলো না। কিন্তু আমি অবাক হই বাবা না হয় ওমনি মানুষ ছিলেন। নির্বিকার, নির্লিপ্ত। কিন্তু দাদু, দীদা তারা কেনো এসব সইতেন? মায়ের এই সব অকথ্য অত্যাচার যা কোনো শ্বশুরবাড়ির লোকজনই মেনে নেবে না তা তারা সঁয়ে যেতেন অবলীলায়? এ এক বিশাল রহস্য। তবে শুনেছি বিয়ের প্রথম দিকে মা এত বাড়াবাড়ি শুরু করেননি। মায়ের এসব আচরণ নাকি শুরু হয়েছিলো বা বেড়েছিলো আমার জন্মের পর পরই। তার আগে এই হাসব্যান্ড বা এই বিয়ে তার পছন্দ নয় এটা আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে দিলেও অসহ্য বাড়বাড়িটা উনি আমার জন্মের পর থেকেই নাকি শুরু করেন।
কত কিছু মনে হয় আমার। কত রহস্য, কত অজানা উত্তর জানতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা মায়ের কি কোনো প্রেমিক ছিলো? যার কারণেই কখনও সহ্য হয়নি বাবাকে তার। বাবাটাই বা কোথায় চলে গেলো? বেঁচে আছেন তো তিনি? আমি যখনই বাবার কথা ভাবি বুকের মধ্যে এক অজানা শুন্যতা অনুভব করি। এই শূন্যতার কারণ কি আমি জানিনা। বাবা তো আমার কথা ভাবেনি। ভাবেনও না হয়তো। আমাকে হয়ত উনি ভুলেই গেছেন এত দিনে। কোথায় আছি, কেমন আছি কোনো খবরই কি রাখতে ইচ্ছে করে না তার? নাকি ভাবেন মায়ের কাছে বাচ্চারা তো সুখেই থাকে। দীর্ঘশ্বাস পড়ে আমার।
প্রায় রাতেই আরবাজ ফোন করে। জানতে চায় আমার মত পরিবর্তন হয়েছে কিনা। মানে আমি কি এখন বিয়ের কথা ভাবছি কিনা। আমার হাসি পায়। আরবাজকে যত দেখছি তত ওর ভেতরে শিশুসুলভ কিছু কান্ড কারখানার হদিস পাচ্ছি। ওখানে সে নিজেই রান্না করে আর কুকিং যে তার কত প্রিয় তা বুঝি ওর জেলাপিনো দিয়ে নুডুলস বানানোর নানা রকম রেসিপি বা টুনা ফিশের চপ বানিয়ে সেটা আমাকে শেখানোর ট্রাই করা দেখে। সে প্রায়ই বলে আমি যখন ওর ওখানে যাবো তখন সে আমাকে কি কি রান্না করে খাওয়াবে। কোথায় কোথায় ঘোরাবে সেসব। ও ধরেই নিয়েছে একদিন না একদিন আমি রাজী হয়েই যাবো। আমি ওর কথা শুনে অনেক হাসি। আরবাজকে বড় আপন মনে হয়। তবুও আমি ভাবতে পারিনা ওকে বা কাউকেই বিয়ে করার কথা আর।
আবার দিন কেটে যায় নানা রকম সাত পাঁচ ভাবনায়। ঝুমকী ফুপু আমাকে উদ্ধার না করলে এই নির্বাসনেই কাটাতে হবে মনে হয় সারাটা জীবন এ ভাবনাটা আমাকে অস্থির করে তোলে। ঝুমকী ফুপু বলেছেন, উনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব ব্যাবস্থা করছেন। আমাকে ধৈর্য্য ধরতে। আমি ধৈর্য্য ধরে থাকি। কখনও বেহালা নিয়ে বসি, কখনও মায়ের বই এর আলমারী থেকে বই নিয়ে বসে থাকি। কখনও পড়ি, কখনও এক অক্ষরও পড়া হয় না আমার। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায়। অলস পাথর সময় বয়ে যায় অবলীলায়।
একদিন হঠাৎ তখন বিকেল গড়িয়েছে। আমি ছাদের রেলিং এ দূর আকাশের লাল আর হলুদ রঙের দুটি ঘুড়ির কাটাকুটি খেলায় চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ বাগান পেরিয়ে মেইন গেটের সামনে দিয়ে সোজা যে রাস্তাটা চলে গেছে। সে রাস্তা ধরে দেখলাম দোলন হেঁটে আসছে, সাথে ওর এ পাড়ারই একটি ছেলে। আমি চমকে উঠলাম। আমার বুকের ভিতরে তখন হাঁপরের বাড়ি। আমার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। দোলন আমার দিকে তাকিয়েই হেঁটে আসছিলো সামনের দিকে। আমার দিকে তাকিয়ে ও হাত নাড়লো। ওর মুখে সেই স্মিত চাপা হাসিটা আমি এত দূর থেকেও দেখতে পেলাম। হঠাৎ আমার পায়ের তলায় পৃথিবী দুলে উঠলো। কি করবো আমি এখন? আমার কি করা উচিৎ? আমি হয়তো তখনই ওখান থেকেই চিৎকার করে উঠতাম, দোলন..... কিন্তু আমার ভেতরে হঠাৎ কে যেন বলে উঠলো, না...
চিৎকার করতে গিয়েও থমকে গেলাম আমি। এক নিমিশে ঘুরে দাড়ালাম। দৌড়ে ফিরে আসলাম নীচে। হঠাৎ আমার ভীষন ভয় হচ্ছিলো। এত ঝড়ঝঞ্ঝা বিভীষিকাময় দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি আমি আমার জীবনে তবে এমন ভয় কখনও হয়নি আমার। হিস্টেরিয়া রোগীর মত কাঁপছিলাম আমি। আমার মাথা কিছুই কাজ করছিলো না। এত আতংক কখনও কোনোদিন ফিল করিনি আমি। তবে আমার এ ভয় আমাকে নিয়ে না। আমি আমাকে নিয়ে ভয় করিনা। যে কোনো নির্লিপ্ত পদচারণায় আমি মাড়িয়ে যেতে পারি বহু মাইল বন্ধুর পথ। অবলীলায় অবহেলায় আমি সয়ে যেতে পারি যে কোনো ক্রুঢ় কঠিন কষ্টকে। কিন্তু আমার ভয় দোলনকে নিয়ে। আমি আমার মাকে জানি। যে ইগোইজমে সে পাগল হয়ে উঠেছে। দোলনের ফ্যামিলী থেকে আসা যে সব কটু কথার বাক্যবাণে সে জর্জরিত হয়েছে তা তার আত্মসন্মানে কি পরিমান হেনেছে তা আমি ছাড়া হয়তো কেউই কখনও আঁচও করতে পারবেনা। দোলনের খবর পেলে সে ছাড়বে না। আমার প্রতিশোধ পরায়ন মা যে কোনো মূল্যে তার অপমানের প্রতিশোধ নেবেনই.......
আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিলো, দোলন কেনো তুমি আসতে গেলে? পালিয়ে যাও তুমি! আমাকে ভুলে যাও.....
একি খেলা আপন সনে - ১৭
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১১