somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একি খেলা আপন সনে - ২০

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বেশ কয়েক বছর পর এ বাড়িতে এলাম আমি। আমার ১৩ বছরের জন্মদিনের পরে আরও বছর তিনেক প্রতি জন্মদিনেই দাদু নিয়ম করে আমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসতেন। এরপর কিভাবে কিভাবে যেন একটা সময় এই আসাটা বন্ধ হয়ে গেলো। মা তো ভুলেও কখনও বলতেন না এ বাড়ির কথা। অথচ আমি যতদূর দেখেছি বা বুঝেছি মায়ের জন্য, মায়ের ভালোর জন্য এই পৃথিবীতে দাদুই বুঝি সবচাইতে বেশি ভেবেছেন। আজ এই অদ্ভুত ভোরে দাদুর বাসার গেট দিয়ে যখন গাড়িটা ঢুকছিলো, এই ভোরের স্নিগ্ধ আলোতেও বাসাটা বড় ম্লান দেখাচ্ছিলো। গাড়িটা পর্চের নীচে দাঁড়াতেই দাদুর বাসার পুরোনো বুড়ো দারোয়ান দৌড়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়ালেন।

আমি অলস এবং ক্লান্ত শরীরে সারা রাত্রীর জাগরণ ক্লিষ্ট চোখে তাকিয়ে দেখলাম, বাড়িটা ঘিরে এক অদ্ভুত বিষন্নতা, মন খারাপের মেলা। কত বছর যে বাড়িটা রং করা হয়নি কে জানে। বাগানের ফুলগুলো মরে শুকিয়ে আছে এখানে ওখানে। কোনো কোনো ফুলগাছ যত্নের অভাবে শুকনো পাতার কাঁঠি কাঁঠি ডালগুলি নিয়ে মৃত কঙ্কালের মত দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় গাছের পাতা ও বাঁকল শুকিয়ে কাঁঠ হয়ে আছে। দেবদারু গাছগুলিকেও দেখাচ্ছে যেন ভূতের বাড়ি পাহারা দিতে ভূতের মতই দঁড়িয়ে থাকা অদ্ভুত কিছু জন্তুর মত। বাসার সামনেটাতেও এখানে ওখানে শুকনো পাতার আবর্জনা। কেউ মনে হয় শুকানো পাতাও পরিষ্কার করে না আর এখানে। এরই মাঝে ধুলোময় শানের উপরেই জ্বলজ্বল করছে কিছু চকচকে বেগুনী গোলাপী রঙের বোগেনভেলিয়ার ঝরা ফুল। এই পর্চ ঘেসে উঠে যাওয়া অপূর্ব সুন্দর বোগেনভেলিয়ার ঝাঁড়টি বুঝি আপ্রাণ চেষ্টায় আজও বাড়িটিকে সৌন্দর্য্য দানে সচেষ্ট রয়েছে।

বাড়ির ভেতরে পা দিতেই এক গুমোট অন্ধকারের ঘ্রান নাকে এসে লাগলো, বদ্ধ সেগুন কাঁঠের দরজা জানালার কাঁঠের ঘ্রান। কিন্তু যেন কত পরিচিত, কত আপন। পুরোনো চেনা ঘ্রান, পুরোনো শেকড়ের টান, পুরোনো ভুলে যাওয়া স্ম্বতির গন্ধ। এক নিমিশে বিদ্যূৎ চমকের মত খেলে গেলো মস্তিস্কের তন্ত্রীতে এক অজানা চুম্বকীয় অতীতের সংকেত। আমি হেঁটে গিয়ে সোজা দীদার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পর্দা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই দেখলাম উঁচু খাটের উপরে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন দীদা। পাশে তার সোনার বরণ পানের বাটাটি। আমি জানি সেই আশ্চর্য্য সুন্দর কারুকার্য্যময় মুখ বন্ধ শেকল লাগানো বাটিটির ভেতরের খোপে খোপে থরে থরে সাজানো রয়েছে কুঁচোনো সুপারী, খয়ের, জর্দা ও নানা রকম বর্নীল মশলাগুলি। ছোটবেলায় মায়ের কুমকুমের বাক্সটি আর দীদার পানের এই বাটাটি ছিলো আমার কাছে সেই রহস্য ভরা সাত রাজার ধন এক মানিকের মূল্যবান এক রতন। জানালা দিয়ে ভোরের এক ফালি নরম আলো এসে দীদার বিছানার উপরে পড়েছে। দীদা আমাকে দেখে খুব অবাক হলেন। ফোকলা দাঁতে ফুটিয়ে তুললেন এক গাল স্নিগ্ধ হাসি। বললেন,
-তুমি! এত সকালে কোথা থেকে এলে দাদু?

"দাদু" আহ এই ছোট্ট ডাকটিতে কত যে অন্তরের আন্তরিকতা, কতখানি নিবিড় ভালোবাসার ছোঁয়া। এই নিস্বার্থ ভালোবাসায় বহুকাল কেউ আমাকে ডাকেনি। বহু বহু দিন কেউ এইভাবে আমার অন্তরের গোপন কুঠুরীতে করাঘাত করেনি। পৌছে দেয়নি কেউ এমন একটি ডাক আমার শুস্ক হৃদয়ের মনিকোঠায়। আমি নির্বাক হয়ে রইলাম। দীদার সবকটা চুলই ধপধপে সাদা হয়ে গেছে। গলার চামড়ায় কি আশ্চর্য্য কুচি কুচি কুঞ্চন। কপালের বলিরেখাগুলি শত শত শাখা প্রশাখার নদী হয়ে ছড়িয়ে আছে সারা কপাল জুড়ে। দীদার গলায় আজও সেই মনোহর সোনার চেইনটা। যা কনে দেখার সময় তার গলায় পরিয়ে দিয়ে আমার দাদুর বাবা মানে আমার দীদার শ্বশুরমশায় চেইনটাই দেখতে পাচ্ছিলেন না আর। মানে দীদার সোনার বরণ গায়ের রঙের সাথে ঐ সোনার চেইনের রঙটা ঠিক ঠিক এক হয়ে মিলে গিয়েছিলো সেদিন। আমার সেই অসামান্যা রূপবতী দীদা আজ বার্ধ্যকের দ্বারপ্রান্তে এসে অনেকটাই বদলেছেন বটে। তবুও সেই অসামান্য রূপের ছটা আজও অনেকটাই বিরাজমান তার ধুসর চোখের তারায়।

দীদা আর আমার মৃদু কথপোকথনও বুঝি দাদুর কানে গেলো। উনি পাশের রুম হতে উঠে আসলেন। হাতে দৈনিক পত্রিকা। আমাকে দেখে দারুন উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন। বললেন,
- কতদিন পরে এলে। আসো আসো আমার বুকে আসো দাদু। এইবার পাঁকাপাঁকিভাবে এখানেই থেকে যাও। এখন আর তুমি ছোট্টটি নেই। আমাদের একমাত্র বংশধর তো তুমিই। আমাদের সকল ভার নেবার দায়িত্বও তোমার...'
আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না। দাদুর এত শত কথার পাঁকে আমি বার বার জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিলাম উনাদের দিকে। কি বলছেন উনি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দাদু হাঁকডাকে চারপাশ সরগরম করে তুললেন, আম্বিয়ার মা, আম্বিয়ার মা আমার দাদুর জন্য নাস্তার ব্যাবস্থা করো শিঘ্রী। গরম গরম পরোটা, মাংস ভূনা আর সুজির হালুয়া বানাও, আমরা সবাই একসাথে নাস্তা করবো আজ। দাদু হই চই থামালেন না।
- কতদিন পরে আমার দাদুমনি এসেছে। ডাব আনতে পাঠাও। সে ডাবের শাঁস খেতে পছন্দ করে।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আমি কি ডাবের শাঁস পছন্দ করতাম কখনও কোনোকালে? মানে আমার ছোট বেলায়? মনে পড়ে না আমার। তবে মনে পড়ে নারকেলের ফোপল নামে এক অদ্ভুত স্পঞ্জের বলের মত একটি নারকেলের ফলের কথা। আমার চোখে ভাসছিলো খুব ছোট্টবেলা, টেবিলে দাদু,বাবা, আমি। মা কিংবা দীদা নাস্তা উঠিয়ে দিচ্ছেন প্লেটে। টেবিল ভরা নানা রকম নাস্তা পরোটা, মুগডালভুনা, সুজি বা ডিমের হালুয়া,বেগুনভাঁজা সোনালী দিনের স্মৃতি। ছেলেবেলার স্মৃতিগুলি বড় মধুময় যা আমি ভুলতেই বসেছিলাম। আমার হঠাৎ মনে পড়লো, আচ্ছা দাদু কি জানে বাবার কোনো খবর? আমি আচমকা দাদুকে বললাম,
- দাদু বাবার কোনো খবর পেয়েছো? দাদু চমকে উঠলেন। মুখখানা ম্লান ও গম্ভীর হয়ে উঠলো তার। তারপর বললেন,
- তুমি হাত মুখ ধুয়ে আমার ঘরে আসো আমি বলছি।
আমি বললাম,
- এখুনি বলো দাদু।

দাদুর বুক থেকে খুব অলখে চুপিসারে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হলো, তা আমার চোখ এড়ালো না। উনি চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে উনার রুমের দিকে চললেন। পিছে পিছে চললাম আমি। দাদু তার কালো কুঁচকুচে মেহগনী কাঁঠের ইজি চেয়ারটাতে গিয়ে বসলেন। আমি উনার মুখোমুখি বিছানার পরে। কিন্তু তারপর আমি দাদুর মুখ থেকে যা শুনলাম তাতে স্থবির হয়ে গেলাম কিছুক্ষনের জন্য। দাদু জানালেন, বাবার অন্তর্ধানের মাস ছয়েকের মাঝেই বাবা মাকে বিচ্ছেদের নোটিস পাঠান এবং এরপর তিনি ফোনে দাদুকে জানিয়েও দেন তার খবর। উনি মূলত আমাকে নিয়ে যাবার জন্যই ফোনটি করেছিলেন সেদিন বিদেশ থেকে তবে এও জানিয়েছিলেন মায়ের সাথে স্বেচ্ছায় বিচ্ছেদ ঘটিয়ে উনি পাড়ি দিয়েছিলেন সুদূর আমেরিকায়। সেখানেই উনি তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে বিয়ে করতে চান, সেখানেই আবাস গড়েছেন উনি এবং সেখানেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি আমাকেও। দাদু আরও বলেন, বাবার এই প্রেমিকাকে দাদুর পছন্দ না থাকায় তিনি এক প্রকার জোর করেই বাবাকে বাধ্য করেছিলেন মাকে বিয়ে করতে। সেই মুহুর্তে দাদুর মুখে চেয়ে তার সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও এই জিনিসটাই আসলে বাবা কখনও মানতে পারেননি।

আমার সামনে সারাজীবন বয়ে বেড়ানো অজানা অজ্ঞাত এক রহস্যের দূয়ার খুলে যায় তারপরও আমার হঠাৎ সেই জীবনটাও দেখতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা তাই যদি হত তো নতুন বাবার বাসার মত সেই বাড়িটা কেমন হত? বাবার বিয়ে করা নতুন বউটা হত আমার নতুন মা। সে কি আমাকে ভালোবাসতো নাকি সিনডেরেলার মায়ের মত ঘরের কাজ করাতো? হঠাৎ প্রচন্ড হাসি পায় আমার। প্রচন্ড হাসিতে ফেটে পড়ি আমি। হাসির দমকে আমার চোখ দিয়ে পানি এসে যায়। দাদু অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। চশমার কাঁচ মুছতে থাকা হাতটা থমকে যায় তার। বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে থাকেন উনি আমার দিকেই।

এরপর আমার মনে তখন নানা প্রশ্ন, নানা কৌ্তুহল। তবে কি এটাই ছিলো মা এবং বাবার মাঝে দুরত্বের কারণ? মা জেনে গিয়েছিলেন বাবার প্রাক্তন প্রেমিকার প্রতি এই দূরহ আসক্তির কথা? মোটামুটি অনেকখানি জবাব পেয়ে যাই আমি নিজের কাছেই। দাদু জানান বাবা আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু উনি রাজী হননি। দাদু বাবাকে বলে দিয়েছেন, বাবা যেন আর কখনও সন্তানের দাবী নিয়ে এ বাড়িতে না আসেন। যদিও এ অধিকার তার খাঁটে না। সন্তানের উপর সবচেয়ে বেশি অধিকার থাকে বাবারই তবুও উনি চান না। তিনি আরও জানিয়ে দিয়েছিলেন বাবাকে যে তার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন তিনি। তবে দাদু এরপর বলে চললেন, দাদুর এই বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক বালান্স সব কিছুই উনি দিয়ে যেতে চান তার একমাত্র উত্তরসূরি এই আমাকে। আমি নিস্তব্ধ বসে শুনে যাই আমাকে নিয়ে ঘটে চলা আমার অজানা কথনগুলি। দাদু তার সম্পত্তি ও নানা অর্থ প্রতিপত্তির বিশাল বিবরণ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার কানে কিছুই ঢুকছিলো না। আমি তখন শুধুই ভাবছিলাম বাবাকে নিয়ে। হঠাৎ বাবাকে বড় দেখতে ইচ্ছে করে আমার এই এতগুলো বছর পরেও। তবে যে দাদু বললেন, তার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন তবে কি বাবার সাথেও কখনও আর দেখা হবে না আমার ? বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত চিনচিনে ব্যাথা। ব্যাথাটা গোপন করি আমি।

খেতে বসে আমি অবাক হয়ে যাই। এত অল্প সময়ে এত আয়োজন! পুরানো আমলের সবুজ আর সাদা সাদা পাতা পাতা চীনামাটির মোটা মোটা তৈজসপত্রে পরোটা, ডাল, মাংস, সব্জী আরও কত কি? এত খাবার কে খাবে! দাদু খুব উৎসাহ নিয়ে খাচ্ছিলেন। তাকে উচ্ছসিত খাদ্যরসিক এক বুড়ো শিশুর মত দেখাচ্ছিলো। আমি একটু খেয়াল করে দেখলাম এ বাড়িতে আম্বিয়ার মা ছাড়া আর কোনো কাজের লোকের ছাঁয়াও দেখা যাচ্ছে না। বাইরেও দারোয়ান ছাড়া আর কেউ আছে বলে মনে হয় না। দাদুর তো অর্থনৈতিক কোনো সমস্যা নেই বরং উনাকে উচ্চবিত্তই বলা যায় তবে তার লোকবল এত কম কেনো? নানা প্রশ্ন মাথায় ঘোরে আমার। দাদু খুব মৃদু্স্বরে অপরাধীর মত মায়ের কথা জিগাসা করেন। জানতে চান, কেমন আছে মা? আমার মনে হয় বাবার এই কৃতকর্মের জন্য দাদু সারাজীবন নিজেকেই দায়ী করেছেন। কারণ আমার অসম্ভব রুপবতী মাকে তিনিই পছন্দ করে এ বাড়িতে এনেছিলেন যেটা তার জীবনের চরম ভুল বলে আজ তার মনে হয়। আমি দাদুকে আশ্বস্ত করি মা ভালো আছেন তবে আমি কিছুদিন এইখানে তাদের সাথে থাকতে চাই। দাদু বলে কিছুদিন নয়, তুমি সারাজীবন থেকে যাও দাদুভাই। এ বাড়ি তো তোমারই বলো। আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি চুপিসারে।

এরপরের বেশ কয়েকটা দিনই কেটে যায় আমার বহুদিন আগে ফেলে যাওয়া এ স্মৃতিময় বাড়িটির আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে। এক ঘর থেকে আরেক ঘর, ছাদ, বারান্দা, বাগান এমনকি আমি বাসার পিছনের সার্ভেন্টস রুমগুলোতেও উঁকি দেই। পরিত্যাক্ত পিছের এই রুমগুলোতে থাকতো একদিন এই বাসায় মালী বা রান্নার কাজ করতে আসা মানুষেরা কিংবা যে সব ড্রাইভারেরা গ্রাম থেকে আসতো এখানে কাজের জন্য কিন্তু থাকার জায়গা ছিলোনা ঢাকায়। আজ এখানে কেউ নেই। দরজাগুলো হাট করে খোলা এবং ভেতরে পরিত্যাক্ত জিনিসপত্রের স্তুপ।শুধু সামনের দিকের একখানা ঘরে মোটামুটি পরিষ্কার করে দারোয়ানচাচু থাকেন। আম্বিয়ার মা দীদার রুমেই ঘুমায় রাত্তিরে। হায়রে জীবন, কোথায় কখন স্থবির হয়ে যায়, জাঁকজমক জৌলুশহীন এই পরিবর্তিত চেহারা সম্পর্কে একদিন কোনো ধারনাই করা যায় না।

মায়ের রুমটি তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বাসার গেস্টরুমটিই তুলনামুলকভাবে পরিছন্ন থাকায় আমি আপাতত সেই রুমেই থাকছি। আম্বিয়ার মায়ের আমার সম্পর্কে দারুণ কৌতুহল। সে সুযোগ পেলেই আমার উপরে তার আহা উহু সহানুভূতি দেখাতে আসে এবং তার দারুন কৌতুহলী প্রশ্নবাণে আমাকে জর্জরিত করে তোলে তবে তার সহানুভুতির বাণী শুনে আমার দুঃখ কষ্ট বা বেদনার বদলে দারুন হাসি পায়। যেমন সে বলে, আহহারে, কি পুড়া কপাইল্লা মাইয়াডা। বাপ মাও সব থাকতেও এত্তিম। আরে এইডা কেমুন বাপ! বাপের মত্তন কামডা করলি? আর মাওর কতা যা হুনছি মা তো না ডাইনি রাক্ষুসী.. হাজার হাজার শাপশাপান্তে সে বাড়িঘর ভরিয়ে তোলে। দীদা এসব শুনলে দারুন রাগ করেন তাই তার এসব সান্তনা বা সহানুভুতির বাণী বেশিভাগ সময় হয় ফিসফিস স্বরে। আমার ভীষন হাসি পায়। আমার ধারণা আম্বিয়ার মাও হাসে। এই সব বলে গিয়ে আড়ালে গিয়ে সে অনেক হাসে কারণ এই সব সহানুভুতির বাণী যে তার মন থেকে নয় বরং এসব বলে সে দারুন মজা বা আত্মতৃপ্তি পাচ্ছে তা আর আমাকে কারো বলে দিতে হয় না। সত্যিকারের সহানুভুতি বা ভালোবাসার সুর যে আলাদা তা আমি ভালোই জানি। যা আম্বিয়ার মায়ের নেই।

সে তার আম্বিয়ার সুখের গল্প প্রায়ই আমার কাছে ফেঁদে বসে। কি সৌভাগ্যবতী মাইয়া। বাপ যতদিন বেঁচে ছিলো সে ছিলো বাপ সোহাগী আর এখন হইসে স্বামী সোহাগী। আসলে সৌভাগ্য বা সুখ যে টাকা থাকলেই হয় না বরং বড়লোকদের বাড়ীর এই সব অশান্তির চেয়ে তাদের গরীবের বাড়ির সুখ অনেক বেশি সেই কথায় সে আমাকে বার বার বুঝিয়ে দেয়। আমার ভীষন হাসি পায় কারণ আমি জানি এইসব বলে সে আমাকে আঘাত করতে চায় এবং এই আঘাত করাতেই তার আত্মতৃপ্তি হয়। বলতে গেলে এই বাড়িতে আম্বিয়ার মায়ের এইসব জ্ঞানী জ্ঞানী কথাগুলিই আমার এখন একমাত্র বিনোদন। নয়তো মাঝে মাঝেই আমার ভীষন দুশ্চিন্তা হয়। দোলনের জন্য। কিন্তু আমি আপ্রাণ ভুলে থাকি ওকে।

আরবাজের সাথে কথা হচ্ছে প্রায় রোজ রোজই। মেসেঞ্জারে সে বার বারই আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে আমি আমার মত বদলেছি কিনা এবং আরও জানায় আমার জন্য সে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। ঝুমকী ফুপুর সাথে যোগাযোগ রাখি আমি। আমার সেখানে যাবার বন্দোবস্ত প্রায় পাঁকা করে ফেলেছেন উনি। শুধু ও বাড়ি থেকে কেউ আমার খবর নেয় না। আমিও আমার খবর তাদেরকে দেবার কোনো চেষ্টাও করিনা। শেষ পর্যন্ত কি দোলন আমাকে খুঁজেছিলো নাকি মা দোলনের কথা জেনেছিলো। অনেক অনেক প্রশ্ন জাগে আমার মনে কিন্তু আমি জোর করে সেসব প্রশ্নকে চাপা দিয়ে ফেলি আমার বুকের মাঝেই।

এক দুপুরে দীদা আমাকে ডেকে পাঠালেন উনার বেডরুমে। দরজা বন্ধ করে উনি সিন্দুক থেকে বের করে আনলেন একটি বড় কারুকার্য্যময় গহনার বাক্স। গহনার বাক্সটি খুলে আমাকে বললেন, “এইখানে আমার সারাজীবনের যত উপহার রয়েছে। দেখো এটি আমার বিয়ের হার, সাতটি হীরে বসানো এই সাতনরী হার আমার বাবা আমাকে দিয়েছিলেন যা আমি জীবনে শুধু ঐ একদিনই পরেছি। এটি আমার শ্বাশুড়ির দেওয়া অনন্ত বালা। আমার বড় প্রিয়। বংশ পরম্পরায় উনি এই বালাদুটি সব ছেলেদের বড় সন্তানকে দিতে বলেছিলেন। এই দেখো আমার শ্বাশুড়ির দেওয়া আরেকটি দারুন সুন্দর উপহার এক জোড়া বাজুবন্দ। রুবি আর পান্না বসানো এই যে মলজোড়া দেখছো এটি ছিলো আমার শ্বশুর মশাই এর বড় সাধের উপহার। ঘরের বউ সারাবাড়ি হাঁটবে যখন ঝমঝম করে আওয়াজ হবে এটাই ছিলো তার চাওয়া। রুমঝুম শব্দে ভরে তুলবে সে চারিদিক…..” এমন কত শত গল্প। আমি অবাক হয়ে দেখি এক একটি গহনা এক একটি ইতিহাস বা কালের সাক্ষী বহন করে চলেছে।

এরপর উনি গহনার বাক্সটির ডালা বন্ধ করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, আজ থেকে এই বাক্সটি তোমার। আমি জানিনা আজকালকার মেয়েরা কখনও এসব পরে দেখবেও কিনা। তবুও এর একমাত্র মালিক আমি তোমাকেই মনে করছি। শুধু তোমার কাছে আমার একটি অনুরোধ থাকবে। শুনেছি তোমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন যেখানে সেই ঘরে একটি ছেলে মানে আমার একটি নাতী আছে। তোমার উপরে দায়িত্ব দিয়ে যাবো একটি। যদি কোনোদিন তার সাথে তোমার দেখা হয়। তাকে বলো তার বউ মানে আমার নাতবউ এর জন্য বাজুবন্দ আর টিকলিটি তার দাদীমার উপহার। আমার চোখ জ্বালা করে কান্না আসে এই চির দুখীনি বৃদ্ধা নারীটির জন্য। যাকে সহিষ্ণুতার পরাকাষ্ঠা বলে মনে হয় আমার। যাকে কোনোদিন কোনো উদ্বেগে উদ্দেলিত হতে দেখিনি আমি অথচ আজ আমার মনে হয় সংসারের প্রতি নির্লিপ্ত এই নারীটি সারাজীবন তার বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন এক কষ্টের আগ্নেয়গিরি।

আমি দীদার কাছ থেকে মায়ের রুমের চাবিটি চেয়ে নেই। গভীর রাতে আমি খুলে নিয়ে বসি মায়ের আলমারী থেকে বের করে আনা মায়ের ডায়েরীটি। ডায়েরীর পাতা উলটাই.......
পাতায় পাতায় খুলতে থাকে আমার সারা জীবন বুকের মাঝে বয়ে বেড়ানো অনেক অনেক রহস্যের জট। খুলে খুলে যায় জালগুলি, ছেড়া ছেড়া সুতোয় উড়ে উড়ে বেড়ায় তারা মাঝরাত্রীর বুক চিরে আমার চারপাশ ঘিরে ঘিরে ......

একি খেলা আপন সনে - ১৯
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:০৮
৫৮টি মন্তব্য ৬০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×