রাজু, আজকাল প্রায়ই আমি চুপি চুপি তোর ফেসবুকের ওয়ালে ঘুরে বেড়াই। তোদের ছবি দেখি। তোর সোনালী চুলের বিদেশী বউ, পুতুলের মত ফুটফুটে মেয়েটার ছবি, তোর নতুন কেনা গাড়ি, তোদের বেড়াতে যাবার সব ছবি আমার প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে। অবাক হয়ে দেখি, কি আশ্চর্য্যভাবেই মেয়েটা তোর মুখের আদল আর কালো চোখের তারা পেয়েছে। গায়ের রঙ আর চুলটা ঠিক ওর মায়ের মত। আমি খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। কি যে ভালো লাগে জানিস?
তোর বিদেশী বউ এর নানা রকম রান্নার ডিশ! অসাধারণ প্লানিং এর গার্ডেনিং! আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। আমার মনে হয় যে কোনো বাঙ্গালী মেয়েকে বিয়ে না করে তুই এই বিদেশী মেয়েটাকে বিয়ে করে ভীষন রকম সঠিক কাজটাই করেছিস। বাঙ্গালী মেয়েরাই যে শুধু ভালো বউ হতে পারে যে কারো এই ধারনা পালটে যাবে তোর বউকে দেখলে। আমার ধারনা সে একজন খুবই ভালো গৃহিনী ও একজন গুড মাদার। তোর হাস্যজ্বল মুখ আর সুখী সুখী চেহারাটা দেখলেও আমার মনে হয় তুই খুব ভালো আছিস। আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু ভুল করেও কখনও আমি সেসব জানতে দেইনা তোকে।
আচ্ছা তুই কি আমাকে খুঁজিস? নিজের ফেসবুক আইডিটাকে আমি খুব সযতনে মুড়িয়ে রেখেছি। প্রোফাইল পিকচার থেকে শুরু করে কোনো ছবি কিংবা বর্তমান কোনো তথ্যই আমি ওপেন রাখিনি। এমনকি আমার নিজের সকল ঘটনাবলীই আমি আড়াল করে রেখেছি তোর থেকে খুব যতনে। কেনো রেখেছি জানিনা। তোর জন্য তো আমার যে কোনো খবর পাওয়া এমন কোনো কঠিন কিছু না। তবুও কিসের সঙ্কোচ, কিসের যে সংশয় জানা নেই আমার। হয়ত আমাকে দেখে তোর পুরোনো কথা বার বার মনে পড়ে যাক এটাই চাই না আমি। খুব ভয় হয়। তোর সুখের জীবনে যেন কোনো অতীতের বেদনা ছায়াপাত না করে সেই শঙ্কাতেই কুন্ঠিত হয়ে পড়ি আমি বার বার।
আসলে ব্যাপারটাতো খুব একটা গোপন অতীতও না। বাড়ির অনেকেই কিছু না কিছু জেনেছিলো আর না জানলেও আঁচ করেছিলো। আমি যদিও চাই তুই অনেক সুখে থাক তবুও তোর কন্ঠলগ্না বউকে দেখি যখন হঠাৎ মনে হয় তোর কি চকিতেও এমন আমার কথা মনে পড়ে? সময় মানুষকে অতীতের সকল দুঃখই ফিকে করে দেয়। আর তুই তো সেই কবে থেকে দূর পরবাসে। কথায় আছে চোখের আড়াল তো মনের আড়াল। যদিও আমি জানি মনের সেই আড়াল পর্দাটার নীচেও থেকে যায় জ্বলজ্বলে কিছু চির অমলিন স্মৃতি।
গতকাল একটা পুরোনো বাংলা ম্যুভি দেখলাম। ম্যুভিটার নাম "উৎসব"। এরপর থেকেই শুধুই তোকে মনে পড়ছে। ঈদ, পূজো, পার্বনে দেশে বিদেশে যে যেখানে আছে সকলের দেশের বাড়িতে জড়ো হওয়া। আমাদের বাঙ্গালীদের জীবনে বলতে গেলে এ তো পান্তাভাত টাইপ সাধারণ ঘটনা। এ ম্যুভিতেও সেটাই ছিলো। শুধু একটি বিশেষ ঘটনায় চমকে উঠলাম আমি। ম্যুভির ছেলেটা ঠিক তোর মত। এই ছেলেটা আর তার চেয়ে কয়েক মাসের বড় পিসতুতো না খুড়তুতো বোনের সাথে সখ্যতা দেখে আর তাদের ভেতরের গোপন দুঃখটাই নাড়িয়ে দিলো আমাকে। মনে পড়ে গেলো সকলের অগোচরে ঘটে যাওয়া তোর আর আমার জীবনের কিছু অমলিন দুঃখ বা না পাবার বেদনার কথা। আচ্ছা তুই তো কত দেশ বিদেশ ঘুরলি। সমাজ সংস্কার বিধি নিষেধের বেড়াজাল পেরিয়ে তোর কি আজ মনে হয় সেই অতীত কোনো ভুল ছিলো?
আকাশে যেদিন গোল থালার মত চাঁদ ওঠে। সেদিকে তাকিয়ে আমার প্রায়ই মনে পড়ে। সেই জ্যোস্নারাতে আমাদের বাড়ির সকলের ছাদে মাদুর পেতে গান বাজনার কথা। সেই আলোকিত জ্যোস্নার সাথেই তাল মিলিয়ে ছোটমামী গেয়েছিলো "আজ জ্যোস্নারাতে সবাই গেছে বনে"। ছোটমামী হারমোনিয়াম বাঁজাতে পারতেন না। তার সাথে বাঁজাতে হত আমাকে। আর তুই তবলায় জানতিস কেবল একটাই বোল, কাহারবা। সব গানেই এই তাল লয় কমিয়ে বাড়িয়ে ঠিক ম্যানেজ করে ফেলতিস কি করে যেন। তুই তবলা বাঁজিয়েছিলি আমার গানে, মামীর গানে। আমরা অনেক রাত অবধি সেদিন গান গেয়েছিলাম।
নানুর প্রিয় গান "চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে উছলে পড়ে আলো ও রজনী গন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো" গাইতে গিয়ে সেদিনও রজনীগন্ধার সুবাস পেয়েছিলাম আমি। আজও সে কথা মনে হলেই আমার চারদিক ভরে ওঠে সেই রজনীগন্ধার ঘ্রানে। আমার পাশে বসেই তবলা বাজাচ্ছিলি তুই। সেদিনের সেই উতল বাতাসে মাঝেই মাঝেই আমার শিফনের গোলাপী ওড়নার প্রান্ত আছড়ে পড়ছিলো তোর গায়ে। আমি গাইছিলাম, ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভালো। কিন্তু আমার পাশে আর তো তেমন কেউ ছিলো না, ছিলি শুধু তুই। তুই গুনে গুনে আমার থেকে ৬ মাস ৬ দিনের ছোট ছিলি। তোর এই ছোটত্বের সুবাদে আমার সকল ফায় ফরমাশ খাঁটতে হত তোকে। কিন্তু আমি যখন ক্লাস নাইন আর তুই এইটে উঠেছিস সেই সময়টাতে একদিন তোর থেকে সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে প্রথম মামীর কাছে বকা খেলাম। মামী শুধু তোকেই বকা দিলো তাই নয় আমাকেও ভেতরে নিয়ে গিয়ে ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিলেন যে আগের মত তোর সাথে ওঠাবসা বা হা হা হি হি চলবেনা আর।
এরপর বুঝি মাকেও উনি কিছু বলেছিলেন, মাও আমাকে ডেকে নিয়ে নানা রকম উপদেশ দিলেন। মানে বড় হয়ে গেলে আমাদের মেয়েদেরকে কি রকম সচেতন হওয়া উচিৎ ইত্যাদি ইত্যাদি। মামা, কাকা, খালু, ফুপাএমনকি নিজের বাবাও যদি হয় তবুও নাকি পুরুষ মানুষ থেকে সাবধান হতে হবে। সেই তোর সাথে আমার প্রথম লুকোচুরির শুরু। সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে ভর দুপুরে ছাঁদে উঠে কাঁচা আম পাড়া, লুকিয়ে ঘুড়ি উড়ানো। জানিনা কেনো যে আমার হঠাৎ ওমন ঘুড়ির নেশা পেয়েছিলো। তোর মত পারতাম না আমি কিছুতেই, তাই অন্যদের ঘুড়ি কাঁটতে হলে তোকে আমার লাগতোই লাগতো। সেই তোকেই আবার আমার মার ধোর কিল চড় খামচি খেতে হত কেউ আমার ঘুড়ি কেটে নিলেই। বড্ড হাসি পায় সেসব ভাবলে এখন।
জানিস সেদিন দেখলাম আমাদের বাড়ির তিন/চারটা বাড়ি পরেই এক ছাঁদে এমনই ঘুড়ি উড়িয়েছে দুজন ছেলেমেয়ে। মেয়েটা আবার ছেলেটার চাইতে এক্সপার্ট। তারাই শুধু ঘুড়ি উড়াচ্ছিলো। আশে পাশে আর কোনো ঘুড়ি ছিলো না আমাদের মত। অথচ আমাদের সময় আমাদের ওয়ারীর বাড়িতে বিকেল হলেই যেন আকাশে আকাশে ঘুড়িদের রঙধনু উঠতো। সেই ঘুড়ি উড়ানো দেখতে দেখতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেলো একটি বিশেষ ঘটনা। আমাকে ঘুড়ি উড়ানো শেখানোর ছলে তুই যে প্রথম আমার ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়েছিলি। কি ভীষন রেগে গিয়েছিলাম আমি। রাগ করে তোর সাথে কথাই বলিনি এরপর কয়েকদিন। কিন্তু আমাদের দুই মামা ও আমার বিধবা মায়ের সংসারে ছোটমামীর এক বছরের ছেলে ছাড়া তো শুধু বন্ধু বলতে তুইই একজন। তাই রাগ করে থাকতে চাইলেও থাকা হত না। আর তাছাড়া এটা উচিৎ না, এমন হয় না ভেবে ভেবেও তোর উপর আমার এক অজ্ঞাত আকর্ষন জন্মেছিলো। যা তোর আমার উপর প্রত্যক্ষ আকর্ষনের চাইতে কোনো অংশেই কম ছিলো না।
তবুও সবকিছুর পরও আমাদেরকে অনেক দূরে চলে যেতে হলো। আমরা জানতাম আমাদের এ না বলা সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
তবুও সেই অবুঝ বয়সের অপরিপক্ক বুদ্ধিতে তুই স্যুইৎজারল্যান্ডে চলে যাবার আগে আকুল হয়ে আমাকে বলেছিলি মাত্র কয়েকটা বছর যদি আমি কোনোভাবে কাটিয়ে দিতে পারি, এ পৃথিবীর কেউ তোকে ঠেকাতে পারবেনা। শুধু কয়েকটা বছর আমাকে অপেক্ষা করতে হবে, আটকে দিতে হবে আমার সকল অনাগত সম্পর্ক। ভীষন হাসি পায় জানিস? কি নির্বোধ ছিলাম আমি! কি নির্বোধ ছিলি তুই! বাড়িতে আমার বিয়ের কথা চলছিলো। বড়মামী তো উঠে পড়েই লেগেছিলেন এই আপদ বিদায় করতে। কিন্তু আমি ঠিকই সকল কিছুই আটকেছিলাম। কিন্তু তুই আটকে গেলি ভিন্ন কোনো জগতে! সেই রঙ্গিন ঝকঝকে রাংতামোড়া অচিন দেশে বিবর্ণ ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেলো বুঝি তোর সকল পুরোনো স্মৃতিগুলি।
আজ তোকে সুখী সুখী চেহারায় ফেসবুকে হাসতে দেখি। পাশে তোর সোনালী চুলের অপরূপা বিদেশিনী বউ। আমার একটুও হিংসা হয় না জানিস? বরং বড় ভালো লাগে। তোর ধপধপে ফরসা রঙ কালো তারার চোখের মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে। বলতে ইচ্ছে করে বিদেশী বউ তো কি হয়েছে তুই এই মেয়েটাকে রবীন্দ্র সঙ্গীত শেখাস। কত্থক না হোক অন্তত ব্যালেট শেখাস কিন্তু কিছুই বলা হয় না তোকে। মা মারা যাবার পর আমি ও বাড়ি ছেড়ে এসেছি। শহরে নিজের মত একা থাকি সাবলেটে। প্রথম দিকে মামা মামী খোঁজ নিত বেশ। ইদানিং একেবারেই নেন না। আমিও যোগাযোগ কমিয়ে দিতে দিতে একেবারেই দূরে সরে এসেছি। আমি আসলেই মনে প্রাণে চাই সকল অতীত ভুলে যেতে। ও বাড়ি থেকে আমার সকল স্মৃতি উপড়ে ফেলতে। শুধু তোর জন্য জানিস? তবুও ভুলতে পারি না রে।
খুব জানতে ইচ্ছে করে তুইও কি সবকিছু উপড়ে ফেলতে পেরেছিস? জানিস তোকে কত কত দিন কত চিঠি যে লিখেছি। কিন্তু তোকে সেসব পাঠানো হয়নি। খুব ইচ্ছে করছে এই চিঠিখানা তোর মেইলে পাঠিয়ে দিতে কিংবা তোর ইনবক্সে। তোর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে অনেক কিছু। তোর খবরাখবর, তোর অতীত বর্তমান, ভবিষ্যতের কথা। তোর ফোন তো আমার জানাই আছে। কত কত দিন নাম্বারগুলো লিখে তাকিয়ে থাকি। সেন্ড বাটনে প্রেস করা হয় না। সত্যিই এই চিঠিটা তোকে পাঠিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ভীষন। রিস্ক নেই তোর বিদেশী বউ কি আর বাংলাতে লেখা আমার এ চিঠি পড়তে পারবে? ছি ছি কি ভাবছি এসব! পড়তে পারুক না পারুক তোর সাথে কোনোভাবেই আমার কোনো যোগাযোগ থাকা উচিৎ নয়।
কাল থেকে এই গান কত শত বার যে শুনেছি। কোনো কারণ নেই। ঐ ম্যুভিটাই হয়ত কারণ। শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গেছে পুরো গানটাই....
অমল ধবলও পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া
দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া....
কোন সাগরের পার হতে আনে, কোন সুদূরেরও ধন
ভেসে যেতে চায় মন, ফেলে যেতে চায় এই কিনারায়
সব চাওয়া সব পাওয়া...
ভেসে যেতে চায় মন, ফেলে যেতে চায় এই কিনারায়
সব চাওয়া সব পাওয়া... হ্যাঁ সত্যি যদি সব চাওয়া পাওয়া আশা আকাঙ্খাকে ফেলে আসা যেত, ভাসিয়ে দেওয়া যেত কোনো সুদূরের পারে...... ভালোই হত তাইনা?
জানি ভালো আছিস। তবুও একটাবার বড় জানতে ইচ্ছে করে, কেমন আছিস তুই?
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৮ সকাল ৮:০৫