ব্যাপারটা এখন মোটামুটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোয়েন্টিন টারান্টিনো ছবি বানাবেন, সেই ছবির গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করবেন ক্রিস্টোফ ওয়াল্টজ নামের এক অস্ট্রিয়ান ভদ্রলোক। আর বছর শেষে তিনি বাড়ি ফিরবেন বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার নিয়ে। টারান্টিনোর পরপর দুটি ছবিতে 'ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস' (২০০৯) আর 'জ্যাঙ্গো আনচেইন্ড' (২০১২) অভিনয় করে পার্শ্ব চরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার পুরস্কার জিতে নিয়ে তিনি সেটাই প্রমাণ করলেন। টারান্টিনো-ওয়াল্টজ জুটি ভবিষ্যতে আর কী চমক দেখাবেন, এটাই এখন সবচেয়ে আলোচ্য বিষয়!
কোয়েন্টিন টারান্টিনো আর ক্রিস্টোফ ওয়াল্টজ
চলচ্চিত্রে অসাধারণ অভিব্যক্তি আর অতিমানবীয় অভিনয়_ এই দুইয়ে মিলে ক্রিস্টোফ ওয়াল্টজ (Christoph Waltz ) এ মুহূর্তে বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা অভিনেতার নাম। পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেও তিনি প্রতি মুহূর্তে ম্লান করে দিচ্ছেন মূল ভূমিকায় অভিনয় করা অনেক খ্যাতনামা অভিনেতার কীর্তিও। তাই সবাইকে ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যে তিনি থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। ক্রিস্টোফের অভিনয় মানেই প্রতি মুহূর্তে চমক থাকবে। তার হাঁটা-চলা ,তাকানো, বাচনভঙ্গি, এমনকি চায়ের পেয়ালায় চুমুক দেয়া সবকিছুতেই এতটা সাবলীলতা আর চমক থাকে যে দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হতে বাধ্য। তার অভিনীত চরিত্রগুলোও যেমন ভিন্নধর্মী, তেমনি তার শক্তিশালী অভিনয়ের গুণেই চরিত্রগুলো আরো ব্যতিক্রমধর্মী আর দুর্দান্ত হয়ে উঠে। আগাগোড়া পেশাদার অভিনেতা ক্রিস্টোফের নিজের মুখেই শুনুন অভিনয় নিয়ে তার ভাবনার কথা, 'অভিনেতা হওয়াটা বাবা হওয়ার মতোই। কোনোটাই হওয়াটা খুব কঠিন নয়। কিন্তু এটাকে জীবন হিসেবে নেওয়াই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।'
ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস ছবিতে ক্রিস্টোফ ওয়াল্টজ
ক্রিস্টোফের জন্ম অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়, ১৯৫৬ সালে। বাবা জার্মান আর মা অস্ট্রিয়ান। ক্রিস্টোফের রক্তেই বইছে অভিনয়। তার বাবার দিককার আত্মীয়স্বজন বেশিরভাগই কোনো না কোনোভাবে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ক্রিস্টোফও তাই পূর্বপুরুষ আর পরিবারের পথেই হেঁটেছেন। অভিনয়ের হাতেখড়ি হয়েছিল ভিয়েনার একটি ফিল্ম স্কুলে। এরপর তিনি নিউইয়র্কের লি স্ট্রাসবার্গ থিয়েটার অ্যান্ড ফিল্ম ইনস্টিটিউটে যোগ দেন। অভিনেতা হিসেবে সর্বপ্রথম তার অভিষেক ঘটে মঞ্চ আর টেলিভিশনে। ১৯৭৭ সালে টিভির জন্য নির্মিত চলচ্চিত্রে কাজ করেন। তারপরই ধীরে ধীরে রূপালি পর্দায় তার আগমন ঘটে। একশ'রও বেশি ছবিতে অভিনয় করলেও হলিউডের দরজা তার জন্য উন্মুক্ত হয় বছর পাঁচেক আগে। ডাকসাইটে নির্মাতা কোয়েন্টিন টারান্টিনোর হাত ধরে, ২০০৯ সালে। 'ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস' ছবিতে হান্স লান্ডা ওরফে দি জ্যু হান্টার নামক ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর এক এসএস অফিসারের ভূমিকায় তিনি দেখালেন অবিশ্বাস্য, অতিমানবীয় অভিনয়! ব্যস! কান চলচ্চিত্র উৎসবে পেয়ে গেলেন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার। এরপর একে একে সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে অস্কার, বাফটা, গোল্ডেন গ্লোবসহ সব পুরস্কার তার ঘরে তুললেন। ওই বছরটি ক্রিস্টফের প্রভাবে কেউ টিকতেই পারল না! চরিত্রটি রূপায়ণে তিনি এতটাই দ্যুতি ছড়িয়েছেন যে, খোদ টারান্টিনোই স্বীকার করেছেন ক্রিস্টোফকে না পেলে হয়তো তিনি 'ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস' বানাতেনই না! টারান্টিনোর আস্থার প্রতিদান দিয়ে এবারও তিনি ছিনিয়ে আনলেন আরেকটি অস্কার। এবার অভিনয় করলেন ড. কিং শ্যুলজ নামক বাউন্টি হান্টারের ভূমিকায়। হারিয়ে দিলেন রবার্ট ডি নিরো, টমি লি জোন্স, ফিলিপ সিম্যুর হফম্যানের মতো বাঘা বাঘা অভিনেতাদের। তাই টারান্টিনোর সঙ্গে ওয়াল্টজের সম্পর্কটা মধুর। প্রিমিয়ার সাময়িকী তাকে জিজ্ঞেস করেছিল টারান্টিনোর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন? তিনি উত্তর দেন, 'তার সঙ্গে কাজ করে আমি একটা বিষয় খুব ভালো ভাবে উপলব্ধি করেছি। কেউ যদি তার কর্মপরিধি আর সাফল্যের সীমা একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে রাখতে পেরেই সুখী অনুভব করে, সে কখনও তার মেধা ও প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবেনা। টারান্টিনো এমন একজন ব্যক্তি, যার সঙ্গে কাজ করলে কল্পনার রঙ অনেক দূর পর্যন্ত পাখা মেলতে শুরু করবে, যা কেউ কখনও চিন্তাও করতে পারে না।'
জ্যাঙ্গো আনচেইন্ড ছবিতে ক্রিস্টোফ ওয়াল্টজ
সবার দৃষ্টিই এখন ক্রিস্টোফের দিকে নিবদ্ধ। মেধাবী সব চলচ্চিত্র নির্মাতারাই চাইছেন ক্রিস্টোফের সঙ্গে কাজ করতে। এরই মাঝে আরেক কিংবদন্তী চলচ্চিত্র নির্মাতা রোমান পোলানস্কির ( কারনেজ, ২০১১ ) ছবিতে কাজ করেছেন এই গুণী অভিনেতা। সামনে আছে আরো দারুন সব ছবিতে কাজ করার সুযোগ। নিজ ভিটে মাটির পাশাপাশি হলিউডেও তিনি তার আসন পাকাপোক্ত করতে চাইছেন। অচিরেই তার সাফল্যে আরো একটি নতুন পালক যুক্ত হতে যাচ্ছে । সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিনি! সময়টা এখন ক্রিস্টোফ ওয়াল্টজেরই।
(২১ মার্চ ২০১৩ দৈনিক সমকালের সাপ্তাহিক বিনোদন পাতা 'নন্দন'-এ ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশিত)
___________________________________________________
***চলচ্চিত্র বিষয়ক আমার যত পোস্ট***
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ৯:৩২