জহির রায়হান এর ‘জীবন থেকে নেয়া’র পেছনের অজানা গল্প ঃ
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১৯৭০ সালে নির্মিত ও মুক্তিপ্রাপ্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা চলচ্চিত্রে যে ছবিটি পুরো পাকিস্তান কাঁপিয়ে দিয়েছিল তার নাম ‘জীবন থেকে নেয়া’ । ছবিটির পরিচালক বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অগ্নিপুরুষ জহির রায়হান । ‘জীবন থেকে নেয়া’ শুধুই একটি পারিবারিক ড্রামা নির্ভর একটি সাধারন ব্যবসাসফল বাণিজ্যিক ছবি নয়। ‘জীবন থেকে নেয়া’ হলো একটি পরাধীন দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া একটি ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল
। ‘জীবন থেকে নেয়া’ হলো একটি অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে নিষ্পেষিত জনতার জেগে উঠার প্রতিচ্ছবি। ‘জীবন থেকে নেয়া’ হলো একটি দেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের পটভূমির জলজ্যান্ত চিত্র। তাইতো সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা বাংলা ছবির একটি জহির রায়হান এর ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি। আমি ছবিটি সম্পর্কে আজ কোন আলোচনা করবো না। কারন এই ছবি দেখে বহুজন বহুবার তাঁদের বিস্লেশন ও ভালো লাগা নিয়ে আলোচনা করেছেন। আজ আমি ছবিটি তৈরি করার পেছনের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করবো । কারন সবাইকে জানতে হবে কি কারনে ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন জহির রায়হান এবং কিভাবে তা হয়ে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়।।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যে কজন তরুন প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহন করেছিলেন এবং যে ১০ জন ব্যক্তি কারাবরন করেছিলেন জহির রায়হান সেই ১০ জনের একজন ব্যক্তিছিলেন। সেই সময়ে ঝির রায়হান তার ভাষা আন্দোলন এর প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘পোস্টার’ নামে একটি গল্প ও ‘আরেক ফাগুন’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। জহির এর ইচ্ছা ছিল ৫২ এর ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটি ছবির তৈরি করার। সেই ছবিটি তৈরি কয়ার প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন কিন্তু তৎকালীন সরকার ছবিটি তৈরি করতে অনুমতি না দেয়ায় তা আর তৈরি করতে পারেননি। তবুও জহির দমে যাননি। মনে মনে ঠিকই পরিকল্পনা করেন রুপক অর্থে হলেও তিনি বাঙ্গালীর আন্দোলন সংগ্রাম আর শোষকের হিংস্ররুপ সিনেমায় তুলে ধরবেনই। রাজনৈতিক মতাদর্শে জহির ছিলেন একজন প্রগতিশীল ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী। বাংলা চলচ্চিত্রের সুচনার পর থেকেই জহির তাঁর স্বপ্ন, আদর্শ ফুটিয়ে তোলার জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণে জড়িয়ে পড়েন । একে একে তৈরি করেন কাঁচের দেয়াল, সংগম, বাহানা, আনোয়ারা, টাকা আনা পাই ছবিগুলো। উল্লেখ্য যে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গিন ছায়াছবি ‘সংগম’ উর্দুতে নির্মাণ করেছিলেন জহির রায়হান। সেটাই ছিল পূর্ব –পশ্চিম দুই পাকিস্তানেরই প্রথম রঙ্গিন ছায়াছবি। ১৯৬৯ – ৭০ পর্যন্ত জহির প্রস্তুতি নেন তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত ছবিটি নির্মাণ করার। এবার জহির সরাসরি শাসকগোষ্ঠীকে আঘাত না করে পারিবারিক গল্পের বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি শাসকের অত্যাচার আর সাধারন জনতার জেগে উঠার চিত্র তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৭০ সালের মধ্য জানুয়ারিতে জহির রায়হান তাঁর বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত ছবিটি নির্মাণ শুরু করেন। তখন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। এই সময়টাকেই জহির রায়হান বেছে নেন ছবিটির কাজ শুরু করার। প্রথমে সিদ্ধান্ত নেন যে জহির তাঁর লিখা কাহিনী নিয়ে শুধু ছবিটি প্রযোজনা করবেন আর পরিচালনা করবেন নুরুল হক বাচ্চু। ছবিটির নাম রাখা হয় ‘তিনজন মেয়ে ও এক পেয়ালা বিষ’ ,কিন্তু সপ্তাহ খানেক পরেই ছবির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘জীবন থেকে নেয়া’ আর জহির শুধু প্রযোজক নয় পরিচালনাও করবেন। গল্পের বিভিন্ন চরিত্র ছিল তখনকার সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনার এক একটি রুপক চরিত্র যেখানে আনোয়ার হোসেন সেই সময়ের জনপ্রিয় কোন রাজনৈতিক নেতার প্রতিনিধিত্বকারী, রাজ্জাক এর ছাত্রনেতা ফারুক চরিত্রটি প্রতিবাদী ছাত্রনেতার প্রতিনিধি, মহুরি খান আতাউর রহমান স্বাধীন চেতনার পরিচায়ক, উগ্রচণ্ডী , দজ্জাল রওশন জামিল একনায়কতন্ত্র স্বৈরশাসক আইয়ুব/ ইয়াহিয়ার রুপক চরিত্র। সেই সময়ের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরীতে শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার দৃশটি সরাসরি ২১ এর প্রভাত ফেরিতেই চিত্রায়ন করা হয় যেখানে সারিবেধে খালি পায়ে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়া সবই ছিল বাস্তব এর সেই ১৯৭০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি থেকে নেয়া। ছবির কাহিনীটি সাজানো হয় উগ্রচণ্ডী দজ্জাল বড় বোন
রওশন জামিল এর নির্যাতনে স্বামী খান আতাউর রহমান নিষ্পেষিত , দুই ভাই শওকত আকবর ও রাজ্জাক ,দুই ভাইয়ের দুই বধু রোজী ও সুচন্দা এবং বাড়ীর চাকর বাকর ও রোজী –সুচন্দার বড় ভাই জনপ্রিয় দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ আনোয়ার হোসেন কে নিয়ে ।
পুরো বাড়ীতে দজ্জাল বড় বোন রওশন জামিল এর একচ্ছত্র আধিপত্য চলতে থাকা অবস্থায় দুই ভাই বিয়ে করে নববধুদের সংসারে প্রবেশ এবং পরবর্তীতে সংসারের চাবির ঘোছা নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখার কূটকৌশল চরমে পৌঁছে যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ইয়াহিয়া/ আইয়ুব খানের শোষণ ও ক্ষমতা থাকার কূট কৌশলের রুপক চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন জহির রায়হান। অন্যদিকে আনোয়ার হোসেন ও রাজ্জাক এর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষ্পেষিত বাঙ্গালীর আন্দোলন সংগ্রাম জেল জুলুম এর বাস্তব চিত্র ছিল ছবিটিতে। আনোয়ার হোসেন ও রাজ্জাক এর জেলের ভেতর থাকা অবস্থায় নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি ব্যবহার করে মুলত আন্দোলনে থাকা বাঙ্গালিদের উৎসাহ যোগান দেয়ার চিত্র। নবজাতক এর নাম ‘মুক্তি’ রুপক অর্থে স্বাধীন বাংলাদেশ এর জন্ম ও শোষকের হাত থেকে মুক্তির বহিঃপ্রকাশ। ছাত্রনেতা ইকবালের গ্রেফতার হয়ে কারাগারে প্রবেশ এর সময় উচ্চারিত রবীন্দ্রনাথ এর ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী’ ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ার উৎসাহের তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত যার সবই ছিল জহির রায়হান এর দূরদর্শী সৃষ্টি। এভাবেই ঝির রায়হান ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটির প্রতিটি ফ্রেমে ফ্রেমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। যার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। ছবিতে জহির রায়হান এর ব্যবহৃত রবীন্দ্রনাথ এর কবিতাটি স্বাধীন বাংলাদেশের ‘স্মৃতিসৌধ’ স্থান পেয়ে বাঙ্গালীর চির প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি যে স্বাধীন বাংলাদেশের ইঙ্গিত বহন করছে তা বিগ্রেডিয়ার রাও ফরমান আলী , মেজর মালেক ও তাঁদের এদেশীয় দোসররা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাঁরা ছবিটিকে সেন্সর ছাড়পত্র না দেয়ার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু দেশপ্রেমিক সচেতন দর্শকদের মিছিল, স্লোগান ও দাবির মুখে সামরিক সরকার বাধ্য হয়েছিল এ ছবির ছাড়পত্র দিতে। নির্ধারিত তারিখের এক দিন পর অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ১১ এপ্রিল। শেষ পর্যন্ত জীবন থেকে নেয়া ‘ ছবিটি মুক্তি দেন জহির রায়হান । ছবিটি মুক্তি দেয়ার ফলে ষড়যন্ত্রকারীরা হয়েছিল পরাজিত আর জনতাই হয়েছিল জয়ী। জীবন থেকে নেয়ার মাধ্যমে এভাবেই তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় আর বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছিল এক অসাধারন কালজয়ী ছবি।।
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আমিও যাবো একটু দূরে !!!!
আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন
যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে
প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের দাদার দাদা।
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।
আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?
আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন