এই গল্পটা আমার ছেলেবেলায় পড়া। বর্তমান আলোচিত চুরির প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল।
(১)
এক দেশে ছিলেন এক রাজা। একদিন দরবারে বসে নানা গল্পগুজবের মাঝে একজন বলল যে, স্বর্ণকাররা গয়না থেকে সোনা চুরি করবেই, এমনকি মায়ের গয়না বানালেও তারা কিছু সোনা চুরি করে। রাজামশাই বললেন,
" তাদের চুরি করার সুযোগ দেয়া হয় বলে তারা করে- আমার কাছ থেকে কেউ চুরি করার সুযোগ পাবে না। আমি এমন একখানা প্রহরা তৈরি করব যা কেউ ভাবতেও পারবে না।"
সভাসদদের কেউ কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করলেন। বললেন, স্বর্ণকাররা এমন যে তারা কিছু না কিছু পথ বের করবেই সোনা চুরি করার!! রাজামশাই শুনে বললেন,
"বেশ! তবে স্বর্ণকারদের ডাকাও- আমি নিজেই পরীক্ষা নেব।"
ডাক পেয়ে পরদিন দরবারে হাজির সব বড় বড় স্বর্ণকাররা। রাজা বললেন, "রানীর জন্য একশ ভরি সোনা দিয়ে একটা নেকলেস বানাতে হবে, এই রাজপ্রাসাদের একটা ঘরে বসে। সেই ঘরের দরজার থাকবে প্রহরী, ঘরে স্বর্ণকার ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারবে না, তার সব যন্ত্রপাতিও এই ঘরেই রাখা থাকবে কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। কাজের শেষে স্বর্ণকার প্রতিদিন বাড়ি যেতে পারবে, কিন্তু তাকে সাত স্তরের নিরাপত্তা প্রহরা পার হতে হবে, অর্থাৎ সে যেন এক আনা সোনাও বের করে না আনতে পারে তা নিশ্চিত করা হবে। আবার প্রতিদিন কাজে আসার সময়ও সাত স্তরের নিরাপত্তা চেকিং পার হয়ে তাকে কাজের ঘরে ঢুকতে হবে। ঘরের চাবি থাকবে আমার কাছে।
এই সাত ধাপের নিরাপত্তা প্রহরা পার হয়ে, রাজ প্রাসাদে বসে সোনা চুরি করা কি সম্ভব? যদি সম্ভব হয় তাহলে কতটুকু?"
রাজার প্রশ্ন শুনে স্বর্ণকাররা কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর একেকজন উত্তর দিতে লাগল। কেউ বলল শতকরা ১০ ভাগ, কেউ বলল ৪০ ভাগ, কেউ বলল ৮০ ভাগ, আর একজন স্বর্ণকার বলল যে, সে পুরো ১০০ ভাগ সোনাই চুরি করে ফেলতে পারবে। রাজা শুনে খুবই অবাক হলেন। যে বলেছিল সব সোনা চুরি করতে পারবে, সেই স্বর্ণকারকে বললেন, "করে দেখাও, যদি পারো তবে তোমার জন্য অনেক পুরস্কার থাকবে। আর যদি না পারো, তবে মিথ্যা বলার জন্য তোমার গর্দান যাবে।" স্বর্ণকার এতে রাজি হল।
(২)
এরপর প্রাসাদে স্বর্ণকারের কাজ করার জন্য একটা ঘর নির্দিষ্ট করা হল। সেই ঘরে স্বর্ণকারের জন্য একশ ভরি সোনা রাখা হল, ভালোমত চেকিং করিয়ে স্বর্ণকার তার সমস্ত যন্ত্রপাতি নিয়ে ওই ঘরে রাখল। পরদিন থেকে শুরু হলো স্বর্ণকারের কাজ। সাত প্রহরা দলের কাছে চেকিং শেষে ঘরে এসে প্রতিদিন সে নেকলেস বানানোর কাজ করতে থাকে, ঘরের দরজা বন্ধ করে। বাইরে থেকে খালি শোনা যায় ঠুক ঠুক আওয়াজ, হাঁপরের শব্দ। মাঝে মাঝে রাজামশাই এসে কিছুক্ষণ বসে স্বর্ণকারের কাজ দেখেন, আন্দাজ করতে চেষ্টা করেন কিভাবে সোনা চুরি করা সম্ভব, কিন্তু ব্যাপারটা রাজার কাছে পুরোপুরি অসম্ভব বলে মনে হয়। এভাবে প্রায় এক মাস কেটে গেল, নেকলেসটা প্রায় পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেছে। স্বর্ণকার বলল কিছু পালিশ করার কাজ শেষ করে পরদিন সে নেকলেস রাজামশাইকে দেবে। সেদিন দুপুরবেলা রাজপ্রাসাদে যখন খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই ঘুমাচ্ছে, স্বর্ণকার তার ঘর থেকে বের হয়ে প্রহরীদের বলল, নেকলেসটা চকচকে করার জন্য দু'ঘণ্টা টক দইয়ে ভেজাতে হবে- তার এক কেজি দৈ দরকার। মহা মুশকিলে পড়ল প্রহরীরা। প্রাসাদে রান্নাবাড়া, খাওয়া-দাওয়া শেষ, এখন এই অসময়ে দৈ কোথায় পাওয়া যাবে!!! স্বর্ণকার বলল, দৈ না পাওয়া গেলে সে পরদিন নেকলেসটা রাজামশাইকে দিতে পারবে না। তাহলে উপায় কি!!! প্রহরীরা যখন আকাশ-পাতাল ভাবছে, তখন হঠাৎ শোনে রাস্তায় কে যেন 'দই চাই, দই' বলে হাঁকছে। প্রবলেম সলভড- প্রহরীরা তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে দেখে এক দইওয়ালী মাথায় দইয়ের ভান্ড নিয়ে চলেছে। প্রহরীরা তাকে ডেকে বলল,
- এক কেজি দৈ দাও।
- এক কেজি করে দেয়া যাবে না! এই দ্যাখো, আমার নিজের হাতে, ঘরে পাতা দই। আমি এটা ভেঙে দিতে পারবো না, নিলে পুরোটাই নিতে হবে।
প্রহরীরা দেখল, ভান্ডর মধ্যে সুন্দর জমাটবাঁধা দৈ।
- এত দৈ নেবার মতো পাত্র তো আমাদের নেই। এক কাজ কর, তুমি আমাদের সাথে ভেতরে চল। একজনের দৈ দরকার- সে তার দরকারমত নেবার পর তুমি বাকিটা নিয়ে চলে যেও, দাম কিন্তু পাবে পুরা দশ কেজির।
প্রহরীরা দইওয়ালীকে নিয়ে স্বর্ণকারের ঘরের সামনে এলো। স্বর্ণকারকে বলল,
- নাও, তোমার দৈ পাওয়া গেছে।
-যাক বাঁচা গেল! দই না পেলে আজ আমার কাজ শেষ হতো না।
দইওয়ালী, আমি দরকারমত দৈ ঢেলে নিয়ে বাকিটা ফেরত দিয়ে দিচ্ছি- রাজবাড়ীতে দই বেচতে এসে আজ তোমার বড় লাভ হলো !!!
স্বর্ণকার কিছুটা দৈ ঢেলে নিয়ে বাকি দৈ ভান্ডসহ দইওয়ালীকে ফেরত দিল। দইওয়ালী দৈয়ের দাম নিয়ে চলে গেল। স্বর্ণকার আবার দরজা বন্ধ করে কাজ করতে লাগলো। বিকালে এলেন রাজামশাই। স্বর্ণকার তখন দই থেকে নেকলেসটা তুলে বারবার সাদা পানিতে ধুয়ে, তেঁতুলের পানিতে ভিজিয়ে রাখলো। বলল, "এটা সারারাত ভিজবে, সকালবেলা এসে এটা মুছে পরিষ্কার করে রাজসভায় নিয়ে যাব, আজকের মত আমার কাজ শেষ।" রাজামশাই উঠলেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রহরীরা চাবি রাজামশাইকে দিল, রাজামশাই তার কোমরের ফিতায় চাবি বেঁধে ঘরে গেলেন। স্বর্ণকারও চলে গেল তার বাড়ি।
(৩)
সকাল হতেই রাজসভা লোকে লোকারণ্য। শহরের সমস্ত গণ্যমান্য লোকেরা তো এসেছেনই, প্রজাদের মধ্যে যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই এসে হাজির রাজসভায়- না জানি আজ ঘটে! স্বর্ণকার তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, রাজামশাই চাবি নিয়ে এসে ঘর খুলে দিলে সে তেঁতুল পানি থেকে নেকলেস তুলে মসলিনের গামছা দিয়ে মুছে রাজার হাতে দিল, তাই নিয়ে রাজা রাজসভায় এলেন, সঙ্গে স্বর্ণকারও এলো।
কষ্টি পাথর হাতে নিয়ে যাচাইকারী প্রস্তুত হয়ে বসেছিল। রাজা তার হাতে নেকলেস দিলেন। যাচাইকারী কষ্টিপাথর নিয়ে ঘষা দেয়, কি দেখে, আবার ঘষা দেয়, আবার দেখে- দেখতে দেখতে হয়রান হয়ে গেল। রাজামশাই জিজ্ঞেস করলেন, "কী ব্যাপার? কি দেখলে? কতখানি সোনা আছে এতে?"
যাচাইকারী বলল,"মহারাজ এতে কোন সোনা নেই, এটা পুরোপুরি পিতল দিয়ে তৈরি!!"
রাজার মুখে আর কোন কথা সরে না। কিছুক্ষণ পর সামলে নিয়ে স্বর্ণকারকে বললেন,
"তুমি পুরস্কার পাবে। এবার বল কি করে তুমি সবটুকু সোনা সরালে এই সাত স্তর নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে!!!"
স্বর্ণকার বলল, "মহারাজ!, এই নেকলেস বানাতে আসলে আমার ১৫ দিন দরকার হতো, কিন্তু আমি সময় নিলাম এক মাস। তার কারণ আমি দুটো নেকলেস বানাচ্ছিলাম, দিনের বেলা রাজপ্রাসাদে বসে সোনা দিয়ে যে নেকলেস বানাতাম, রাতের বেলা আমার বাসায় বসে ঠিক একই নকশায় একই আকারের আরেকটা নেকলেস বানাতাম পিতল দিয়ে। এভাবে প্রায় একমাস পরে আমার দুটো নেকলেস বানানো শেষ হল। তখন এই নেকলেস দুটো বদলাবদলি করা দরকার হল। সেজন্য আমি দইয়ের নাটক করলাম। আমি গতকাল এমন সময় দই চাইলাম, যখন জানি প্রাসাদের রান্না খাওয়া সব শেষ হয়ে গেছে, প্রাসাদে কোনো দই পাওয়া যাবে না!! আগে থেকেই আমার বউকে শেখানো ছিল সে যেন এই সময়ে এসে দই বিক্রি করতে আসে। তার দইয়ের ভান্ডে পেতলের নেকলেস রেখে সে জমাটবাঁধা দই বানায়- প্রহরীরা সেই দই ভাঙেনি। আমি দইয়ের ভেতর থেকে পেতলের নেকলেসটি বের করে নিয়ে সোনার নেকলেস ভান্ডে রেখে দেই, আমার স্ত্রী তা নিয়ে বাড়ি যায়। আমি পেতলের নেকলেসটি সকালবেলা ধুয়ে-মুছে এখানে নিয়ে এলাম।"
গল্প শুনে রাজসভার লোকজনের হাততালি দিয়ে স্বর্ণকারের বুদ্ধির তারিফ করতে লাগলো, কিন্তু রাজামশাই গেলেন মহা ক্ষেপে। বললেন, "আমার রাজ্যে বসে তুমি চুরি করো!!!!!!!!!
এদেশে তোমার কোন জায়গা হবে না। যাও, ভাগো আমার দেশ থেকে।"
(মূল গল্পে শেষটা অবশ্য অন্যরকম ছিল। কিন্তু আমার মনে হল, এভাবে শেষ করাটাই ভালো হতো, তাই আমি এভাবে শেষ করলাম।)