লিওনেল আন্দ্রেস মেসি এমন একটা নাম যারা ফুটবল খেলা দেখেন অথবা বোঝেন তারা সবাই এক নাম এ চিনবেন। যিনি মাত্র ২৫ বছর বয়সে নিজেকে এবং ফুটবল খেলা কে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যা হয়তো কেও কোনদিন কল্পনা ও করতে পারে নাই। তাঁর পায়ের জাদু তে মুগ্ধ হয় নাই এমন লোক খুজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। আর যারা তাঁকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবে আসলে তারা হিংসাতে বলবে। কারন সেই সব লোক এর পছন্দের খেলোয়াড় রা হয়তো সেই পর্যায়ে কোন দিন পৌছাতে পারবে না যে পর্যায়ে মেসি নিজে কে নিয়ে গেছেন এবং আরও উপরে যাবেন।
চলুন আজ দেখে নেই মেসি সম্পর্কে কিছু তথ্য
মেসি ১৯৮৭ সালের ২৪ শে জুন আর্জেন্টিনার ছোট্ট শহর রোজারিও তে খুবই দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। বাবা জর্জ হোরাসিও মেসি একজন স্টিল মিলের কর্মচারী, মা সেলিয়া মারিয়া ছিলেন একজন পার্ট টাইম পরিচ্ছন্নতা কর্মী। মেসির আছে বড় দুই ভাই রদ্রিগো এবং মাটিয়াস আর একটা আদরের বোন মারিয়া। মেসির বয়স যখন ৫ তখন থেকেই তাঁর বাবার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত দল গ্রান্দলি তে খেলা শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে নিওয়েলস ওল্ড বয়েস ক্লাবে খেলা শুরু করেন যেটি ছিল তাঁর শহর রোজারিওতেই ।
১১ বছর বয়সে মেসির শরীরে ধরা পড়ে এক কঠিন রোগ। "growth hormone deficiency" অর্থাৎ বৃদ্ধি সংক্রান্ত হরমোনের অভাব। এই রোগ এর জন্য মেসির দরকার ছিল ৯০০ ডলার যা তাঁর পরিবারের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। মেসির দুর্দান্ত প্রতিভা দেখে আর্জেন্টিনার ক্লাব রিভার প্লেট তাঁকে নেবার আগ্রহ দেখায়। তবে মাসিক ৯০০ ডলার এর খরচ বহন করা তাদের পক্ষেও বহন করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এত বড় একটা প্রতিভা কি কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে পারে ? না পারে না। মেসির মুখের হাসি হারিয়ে যেতে বসেছিল। সদা হাস্যময় মেসি মন খারাপ করে বসে থাকলেন। আর কি বা করার ছিল তাঁর। এমন সময় এগিয়ে এলেন কার্লেস রেক্সাচ যিনি কিনা তখন বার্সেলোনা দলের স্পোর্টিং ডিরেক্টর। মেসির প্রতিভার কথা শুনতে পেয়ে মেসি আর তার বাবাকে একটা ট্রায়ালের সুযোগ দিলেন, মেসি খেললো আর মূগ্ধ নয়নে দেখলেন কার্লেস রেক্সাচ। হাতের কাছে কোনো কাগজ না পেয়ে সেই মূহুর্তেই একটা ন্যাপকিনের উপর চুক্তি তৈরী করে মেসি কে বার্সেলোনার যুব দলে অর্ন্তভূক্ত করলেন রেক্সাচ। তার সব চিকিৎসার ব্যয় বার্সেলোনা ক্লাব দেবে বলে জানানো হলো। সবসময় মুখে লেগে থাকা হাসিটা আবার ফিরে এলো মেসির ঠোঁটে।
১৩ বছর বয়সে নিজের দেশ আর্জেন্টিনা ছেড়ে পাড়ি জমালেন স্পেনে। যোগ দিলেন বার্সেলোনার বিখ্যাত যুন প্রকল্প “লা মেসিয়া” তে।
এর পরের ইতিহাস তো সবার জানা
এবার আসুন জেনে নেই মেসির ক্যারিয়ার এর পরিসংখ্যান ও রেকর্ড
ক্লাব কেরিয়ারঃ
মেসি বার্সেলোনার জুনিয়র বি, ক্যাডেট বি, এবং এ দল এ খেলেছেন ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে ক্যাডেট বি তে থাকা কালীন ৩০ ম্যাচ এ ৩৭ গোল করেন। এর পর ২৯ নভেম্বর ২০০৩ এ বার্সেলোনা সি দলে সুযোগ পান। ভালো পারফরমেন্স এর জন্য খুব দ্রুত ৬ মার্চ ২০০৪ এ বার্সেলোনা বি দলে সুযোগ পান।
এই ভাবে শুরু করার পর এক বছরের ও কম সময় পর ২০০৪ সালের ১৬ অক্টোবর (মাত্র ১৭ বছর ১১৪ দিন বয়সে) তৎকালীন বার্সা ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড এর মাধ্যমে এস্পানিয়ল এর বিপক্ষে লা লিগা তে অভিষেক হয় এই ফুটবল যাদুকরের। এর পর মেসি যখন প্রথম তার লিগ গোল করেন (১৭ বছর ১০ মাস ৭ দিন) তখন হয়ে যান লা লিগার ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ গোল স্কোরার । পরে অবশ্য বোজান কিরকিচ মেসির পাস থেকেই গোল করে এই রেকর্ড নিজের করে নেন।
২০০৫-২০০৬ সেশন এ মেসি খুব অল্প সংখ্যক ম্যাচ খেলেন। এই সেশন এ মেসি ১৭ ম্যাচ এ ৬ গোল করেন।
২০০৬-২০০৭ সেশন এ মেসি প্রায় নিয়মিত ভাবে খেলা শুরু করেন সিনিয়র দলে। এর সাথে ২৬ ম্যাচ এ ১৪ গোল করেন। এই মৌসুম এ মেসি তার বিখ্যাত দুইটা গোল করেন যে দুইটার মতো গোল এক সময়ের সেরা খেলোয়াড় ম্যারাডোনা করে ছিলেন। আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমি কোন দুইটা গোলের কথা বলছি। জি হা গেটাফের সাথে একক প্রচেষ্টায় ৬ জন কে কাটিয়ে নিয়ে গোল এবং এস্পানিয়ল এর বিপক্ষে "হ্যান্ড অফ গড" ।
২০০৭-২০০৮ সেশনে মেসি প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি ওর এর জন্য মনোনয়ন পান। তবে দুর্ভাগ্য জনক ভাবে তিনি ৩য় হন। ২০০৭ এ ফিফা বেষ্ট প্লেয়ার অফ দা ওয়ার্ল্ড মনোনয়ন পান। কিন্তু সেখানেও ২য় স্থান লাভ করেন। এই একই বছরে তিনি বেষ্ট প্লে মেকার অফ দা ওয়ার্ল্ড মনোনয়ন পান। আবার ও দুর্ভাগ্য জনক ভাবে ৩য় স্থান লাভ করেন। এই সেশন এ মেসি ১৬ গোল এবং ১৩ অ্যাসিষ্ট করেন।
২০০৮-২০০৯ সেশন এ রোনাল্ডিনহোর বার্সা ছেড়ে যাবার পর মেসি পুরাপুরি ভাবে ১০ নং জার্সি পেয়ে যান। এই সেশন এ তিনি ৬৭৮ পয়েন্ট নিয়ে ফিফা বেষ্ট প্লেয়ার অফ দা ওয়ার্ল্ড এ আবার ও ২য় স্থান লাভ করেন একই সাথে বেষ্ট প্লে মেকার অফ দা ওয়ার্ল্ড এও ২য় স্থান লাভ করেন। এই সেশনে তিনি চ্যাম্পিয়নস লিগ এ ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে এক আসরে সবচেয়ে বেশি গোল দাতা (৯ গোল) হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই সেশনে বার্সা ৬-২ গোল এ রিয়াল কে পরাজিত করে যা ছিল ১৯৩০ সালের পর সবচেয়ে বড় জয় রিয়াল এর বিপক্ষে। মেসি ২ গোল করে এই জয়ে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন। এই সেশনে মেসির ৭০ মিনিট এ গোল এর জন্যই চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় করে। মেসি এই সেশনে ইউএফা ক্লাব ফরওয়ার্ড অফ দা ইয়ার এবং ইউএফা ক্লাব ফুটবলার অফ দা ইয়ার খেতাব জয় করেন। এই সেশনে মেসির দক্ষতায় কোন স্প্যানিশ ক্লাব প্রথম বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ, লা লিগা এবং কোপা দেল রে (ট্রেবল) জয় করে। ৩৮ গোল আর ১৮ অ্যাসিষ্ট করেন মেসি।
২০০৯-২০১০ সেশন ছিল মেসির ক্লাব ক্যারিয়ার এর একটি সাফল্য মণ্ডিত বছর। এই বছরে মেসির দক্ষতায় ইতিহাসের প্রথম ক্লাব হিসেবে বার্সেলোনা ৬ টা ট্রফি জিতে যা এক সেশনে কোন ক্লাব কোনদিন জিততে পারে নাই। মেসি এই বছর ব্যালন ডি ওর জয় করেন। তিনি রোনালদো কে স্মরণ কালের সবচেয়ে বড় ব্যবধান এ (মেসি-৪৭৩ রোনালদো- ২৩৩) হারান। একই বছরে তিনি প্রথম আর্জেন্টাইন হিসেবে ফিফা বেষ্ট প্লেয়ার অফ দা ইয়ার জয় করেন। ১০ জানুয়ারী ২০১০ তে সেশন এর প্রথম হ্যাট্রিক করেন টেনেরিফ এর বিপক্ষে। ১৭ জানুয়ারি ২০১০ মেসি ক্লাব এর পক্ষে ১০০ গোল করেন। বার্সেলোনা ক্লাব এর ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে পর পর ২ ম্যাচ এ হ্যাট্রিক করেন (ভ্যালেঞ্ছিয়া ও রিয়াল জারাগোজা এর বিরুদ্ধে)। ২৪শে মার্চ ২০১০ অসাসুনার বিরুদ্ধে খেলার মাধ্যমে বার্সার হয়ে ২০০ তম ম্যাচ খেলেন। ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল মেসির ক্যারিয়ার এর প্রথমবারের মতো আর্সেনাল এর বিপক্ষে ৪ গোল করেন। এই সেশনেই মেসি ব্রাজিল এর দুই কিংবদন্তী রোনালদো এবং রিভালদোর রেকর্ড ছাড়িয়ে যান। এই সেশনে মেসি ৪৭ গোল এবং ১১ অ্যাসিষ্ট করেন।
২০১০-২০১১ সেসন আবার ও মেসি ব্যালন ডি ওর জয় করেন। এবার তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তাঁরই বার্সা দলের জাভি এবং ইনিয়েস্তা। রিয়াল এর কাছে কোপা দেল রে হারার পর মেসি যেন আরও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেন। চ্যাম্পিয়নস লিগ এর সেমিফাইনালে তাঁর দুই গোলের জন্য রিয়াল কে হারায় এর পর ওয়েম্বলি তে সেই বিখ্যাত ম্যাচ। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কে হারিয়ে ৬ বছরের মধ্যে ৩য় বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় করে। মেসি ১২ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বচ্চ গোল দাতা নিস্তলরয় এর সমান গোল করেন। এই মৌসুম এও মেসি ও তাঁর দল বার্সেলোনা রেকর্ড ৫ টি শিরোপা জয় করে। এই মৌসুম এ মেসি ৫৩ গোল ও ২৪ অ্যাসিষ্ট করেন।
২০১১-২০১২ সেশন এ মেসি যেন আরও পরিনত। ক্লাব ক্যারিয়ার প্রায় সব রেকর্ড হাতের মুঠোয় পুরে ফেলেন। শুধু চ্যাম্পিয়নস লিগ ও লা লিগা বাদে ৪ টি শিরোপা জয় করেন। ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এক মৌসুমে ৭৩ গোল করে এক অনন্য রেকর্ড স্থাপন করেন। বার্সার ইতিহাসের সর্বচ্চ গোলদাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। লাতসিও কুবালা (১৯৪) ও সিজার রদ্রিগেজ (২৩২) কে পেছনে ফেলে মেসি হয়ে যান বার্সার ইতিহাসের সর্বচ্চ গোলদাতা । ইতিহাসের চতুর্থ খেলোয়াড় হিসেবে (ইয়হান ক্রুইফ, মিশেল প্লাতিনি ও মার্কও ফন বাস্তেন এর পর ) টানা তৃতীয়বার ব্যালন ডি ওর জয় করেন। ১১ এপ্রিল ২০১২ মেসি ৬০ গোল করে লা লিগার ইতিহাসে সেরা গোল স্কোরার হন। এই মৌসুমে মেসি বায়ার্ন লেভারকুজেন এর বিপক্ষে একাই ৫ গোল করে ইতিহাসের পাতায় নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে জান যা আজ পর্যন্ত কেও করতে পারে নি। ৫ মে ২০১২ তে এস্পানিওল এর বিরুদ্ধে হ্যাট্রিক করে ৭২ গোল করে ৭০ গোলের এক অনন্য রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেন।
পরবর্তী পর্ব আসছে খুব তাড়াতাড়ি । আগামী পর্বে আমরা দেখবো মেসির আরও কিছু সাফল্য গাথা এর সাথে তাঁর জীবন যাপন, সামাজিক কর্মকাণ্ড, এবং জাতীয় দলে মেসির পারফর্মেন্স ।।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ৮:৫২