somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তারানাথ তান্ত্রিকঃ বিভূতিভূষণের অমর সৃষ্টি

১৪ ই জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৪:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“চিরকাল এইসব রহস্য আছে নীরব
রুদ্ধ ওষ্ঠাধর
জন্মান্তরের নব প্রাতে, সে হয়তো আপনার
পেয়েছে উত্তর।“
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মানুষ চিরকালই রহস্যপ্রিয়। যা রহস্যময়, অতিপ্রাকৃত; যেঁ জগতের দেখা পাওয়া যায় না, তার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই মানুষের আকর্ষণ বেশি। অলৌকিকত্ব বা অতিপ্রাকৃত ঘটনা- তা যতই যুক্তিবাদীরা অস্বীকার করবার চেষ্টা করুক না কেন- আমাদের অনেকের সাথেই এমন অনেক ঘটনাই ঘটে যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। এগুলোই অতিপ্রাকৃত ও অলৌকিক ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যাতীত রহস্যর বেড়াজালে ঘেরা থাকে। সাহিত্যিক তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর উক্তি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য-



“অলৌকিক এবং অতিলৌকিক ঘটনার দিন শেষ হয়ে যায় নি, কেবল অনেক সময় আমরা তাদের অলৌকিক বলে চিনতে পারি না – এই যা।“

বৈজ্ঞানিক জে. বি. এস. হ্যালডেন [১৮৯২-১৯৬৪] যথার্থই বলেছেন –



“সত্য যে কল্পনার চেয়েও বিচিত্র শুধু তাই নয়, আমাদের কল্পনা যতদূর পৌছায় সত্য তার চেয়েও অদ্ভুত।“

মুলত এই অলৌকিকতা এবং অতিপ্রাকৃত ঘটনার প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ সবসময়েই ছিল। তাইতো এই সম্পর্কিত গল্প উপন্যাস আমার পড়ার তালিকায় সবসময়েই অগ্রাধিকার পায়। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এর অতিপ্রাকৃত উপন্যাসসমূহ- প্রেত, দানব; গল্পগ্রন্থ- পিশাচীনী, হুমায়ুন আহমেদ এর সকল ভৌতিক গল্প ও উপন্যাস, সেবা থেকে অনূদিত- অ্যামিটিভিল হরর, অশুভ সঙ্কেত, পিটার ব্লেটির- দ্যা এক্সরসিস্ট, স্টিভেন কিং এর গল্পসমগ্র অনেক আগেই শেষ করা।

এত অতিপ্রাকৃত উপন্যাস এর ভিড়ে বাংলা সাহিত্যর কিংবদন্তী লেখক বিভূতিভূষণের সৃষ্ট একটি চরিত্র আমার চোখের অন্তরালেই ছিল এতদিন। তিনি হলেন তারানাথ তান্ত্রিক। তারানাথ তান্ত্রিক- তিনি থাকেন কলকাতার মট লেন এ বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকের কলকাতায়। এই ভদ্রলোকের জীবন অনেক অতিপ্রাকৃত ঘটনায় পরিপূর্ণ। যিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন ভবঘুরের মত এই বিরাট ভারতবর্ষের বিভিন্ন শ্মশান এ, বিভিন্ন তন্ত্র সাধক এর সাথে এবং নিজে তন্ত্রসাধনা করে। এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার ঝুলিই তিনি খুলে দেন তার শ্রোতা- লেখক এবং তার বন্ধু কিশোরী সেন এর সামনে।

এই অসাধারণ চরিত্রটি নিয়ে বিভূতিভূষণ মাত্র দুটি গল্প লেখবার পরে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর- সুযোগ্য এবং একমাত্র পুত্র সুসাহিত্যিক তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই চরিত্রটি এগিয়ে নিয়ে যান- যা সঙ্কলিত হয়েছে তাঁর তারানাথ তান্ত্রিক গল্পগ্রন্থ এবং অলাতচক্র নামক উপন্যাসে।





তারানাথ তান্ত্রিক যাকে লেখক বর্ণনা করেছেন-

“বৃদ্ধের বয়স ষাট বাষট্টির বেশি হইবে না। রঙ টকটকে গৌরবর্ণ, এ বয়সেও গায়ের রঙের জৌলুশ আছে। মাথার চুল প্রায় সব উঠিয়া গিয়াছে। মুখের ভাবে ধূর্ততা ও বুদ্ধিমত্তা মেশানো, নিচের চোয়ালের গড়ন দৃঢ়তা ব্যাঞ্জক। চোখ দুটি বড় বড় উজ্জ্বল।“

আর তারানাথের মতে তিনি-

“একজন সাধারণ মানুষ। যাকে সাধক বলে আমি তা নই। কারন সত্যিকারের সাধনা করবার সুযোগও আমি কোনোদিন পাই নি; পেলেও করতাম কি না সন্দেহ। আসল ব্যাপারের চেয়ে এই পথে পথে বেড়িয়ে বেড়ানো, নানা বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সঙ্গে আলাপ হওয়া- জীবনের এই দিকটাই আমাকে বেশি মুগ্ধ করতো।“

আর এভাবেই প্রথম যৌবনে ভবঘুরের মত ঘুরতে ঘুরতে বীরভূমের এক শ্মশানে দেখা পান হাকিনিমন্ত্রে সিদ্ধ মাতু পাগলীর সাথে- যার কাছ থেকে তিনি পান ব্যাখ্যার অতীত কিছু ক্ষমতা। তারানাথের মুখেই মাতু পাগলী সম্পর্কে শোনা যাক-

“প্রথম যৌবনে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ি... বীরভূমের শ্মশানে মাতু পাগলী আমাকে সম্মোহিত করে নানা দৃশ্য দেখিয়েছিল। আমি যেন নদীর জলে নেমে গাছের শেকড়ে আটকে থাকা মৃতদেহ তুলে এনে পুজার উপকরন সংগ্রহ করে শবসাধনায় বসলাম... শক্তি আমাকে পাগলী দিয়েছিলো... রাখতে পারিনি। ঠিকই বলেছিল, আমার মনে অর্থের লালশা ছিল, তাতেই গেল।“

তারানাথের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার শ্রোতা দুজন। লেখক ও তার বন্ধু কিশোরী সেন। তারানাথের গল্প বলবার ক্ষমতা অসাধারণ। লেখকের মুখেই শোনা যাক-

“....তার গল্প বলার ক্ষমতাও ভারি সুন্দর। এ ক্ষমতা সবার থাকে না। কেউ কেউ বলার মত গল্পও বাচনভঙ্গির দোষে নষ্ট করে ফেলে। ... আর তারানাথ নিতান্ত তুচ্ছ ঘটনাও বলার গুনে চিত্তাকর্ষক করে তুলে। কত আশ্চর্য ঘটনা শুনেছি তার কাছে, সে সবের সঙ্গে আমাদের দাল-ভাত খাওয়া মদ্ধবিত্তের প্রাত্যহিক শান্ত জীবনধারার কোন সম্পর্ক নেই।“

তারানাথ তার শ্রোতাদের শোনান এই পরিচিত জগতের বাইরের এক জগতের কথা-

“আমাদের এই প্রাত্যহিক নিতান্ত পরিচিত জগতটার বাইরে এক আশ্চর্য দুনিয়ার কথা সে আমাদের শোনায়, যেখানে সম্ভাব্যতা এবং অসম্ভাব্যতার মাঝখানে সীমারেখাটা খুব অস্পষ্ট, দেখা যায় কি যায় না।“

তারানাথের প্রিয় সিগারেট ব্রান্ড “পাসিং শো”। যে কোন অলৌকিক ঘটনা তার একনিষ্ঠ শ্রোতা [লেখক এবং কিশোরী সেন] কাছে শুরু করবার আগে বেশ কয়েকবার আয়েশি ভঙ্গিতে ধোঁয়ার রিং ছেড়ে কথা শুরু করেন-

“...গল্প শুনতে যাবার সময় আমি আর কিশোরী মট লেনের মোড় থেকে দশ পয়সা দিয়ে এক প্যাকেট পাসিং শো কিনে নিয়ে যাই। প্রতিবারই তারানাথ সস্নেহে স্বচ্ছ মোড়কওয়ালা চিমনির মত টুপি পড়া ধূমপানরত সাহেবের কালচে লাল রঙের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে বলে- হ্যা,... এই হচ্ছে সিগারেট। নেশার আসল কথা হচ্ছে মৌজ, ছবির সাহেব কেমন মৌজ করে গোল গোল রিং ছাড়ছে দেখেছ ?”





তারানাথ তান্ত্রিক অতিপ্রাকৃতিক, আদিভৌতিক এবং অলৌকিক ঘরানার সাহিত্য বিভূতিভূষণের এক অমূল্য সংযোজন। বিভূতিভূষণ এই চরিত্রটি সৃষ্টি করেন আর তাঁর সুযোগ্য পুত্র তারাদাস এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এই চরিত্র মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত।

তারানাথের অভিজ্ঞতাগুলো এক অজানা অ অদেখা ভুবনের। পাঠকেরা হয়তো যুক্তির কষ্টিপাথরে বিচার করে ঘটনাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন-তাদের জন্যই হয়তো বিখ্যাত ইংরেজ কবি স্যামুয়েল কোলরিজ [১৭৭২-১৮৩৪] “সাস্পেনশন অফ ডিজবিলিফ” [Suspension of Disbelief] বলে এক সাহিত্যিক জাদুর কথা বলেছিলেন- যার মুল কথা হল উপভোগের জন্য অবিশ্বাসকে সাময়িক ভাবে মুলতবী রাখা।



তবে চলুন পাঠক, অবিশ্বাস ও যুক্তিকে মুলতবী রেখে ঘুরে আসি তারানাথের অদ্ভুত জগতে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৪:৩৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×