বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ২৬টি টেলিভিশন চ্যানেল অনএয়ারে আছে।এর মধ্যে প্রায় সবগুলো চ্যানেলেই সংবাদ প্রচার করে।৫৫ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট একটি দেশে এত গুলো টিভি চ্যানেল সত্যি অবাক করার বিষয়।এরমধ্যে আবার চ্যানেলগুলোর ঢাকা থেকে অনুষ্ঠান প্রচারের প্রবণতার ফলে সংবাদের কেন্দ্রবিন্দুও ঢাকাকেন্দ্রীক। ফলশ্রুতিতে ঢাকায় যেকোনো ঘটনা ঘটলেই টিভিচ্যানেলের সংবাদকর্মীরা ক্যামেরা নিয়ে যুদ্ধের মাঠে ঝাপিয়ে পড়ে।যার ফলে মাঝেই মাঝেই সংবাদকর্মীদের বিভিন্ন আচরণ অডিয়েন্সের কাছে খুব দৃষ্টিকটু লাগে।একজন সংবাদকর্মীর কাছে যেকোনো সংবাদ হচ্ছে প্রোডাক্ট। তাই সে অবশ্যই প্রত্যাশা করবে ভোক্তাদের কাছে তার প্রোডাক্ট সেল করতে।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একজন পাঁচতারকা হোটেলের ওয়েটার যদি ফুটপাতের হোটেল ছালাদিয়ার মেচিয়ার( তাদের পেশাকে ছোট করছি না , তুলনা করার জন্য শব্দটি ব্যবহার করছি) এর মত আচরণ করে তবে পাঁচতারকা হোটেলে আগত অতিথিরা বিরক্ত হয়। ঠিক তেমনি টিভিতে কর্মরত সংবাদকর্মীরা যখন গ্রামের হাটবাজারে ঔষধ বিক্রেতার মত আচরণ করে তখন তা অডিয়েন্সের মাঝে চরম বিরক্তির উদ্রেক করে।তাছাড়া টিভি সাংবাদিতার একটা দর্শন থাকা চাই। কারণ টিভি সকলের জন্য অবারিত একটি গণমাধ্যম। যা ছেলে বুড়ো, সবাই উপভোগ করে। তাই এ ধরনের একটি সর্বজনীন গণমাধ্যমে অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। যেকোনো অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রে তাদেরকে অবশ্যই বিভিন্ন বয়সের দর্শকদের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেওয়া উচিৎ
অথচ বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলিকে এই বিষয়ে সম্পুর্ণরুপে উদাসীন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রচারিত কিছু সংবাদ প্রচার টিভি মিডিয়ায় এথিকসের লংঘণের বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে । যেমন , মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডিতদের ফাঁসী কার্যকরের সংবাদ টিভি চ্যানেলগুলি যেভাবে ঘন্টার ঘন্টা ধরে প্রচার করছে তা কোনোভাবেই একটি সুস্থ গণমাধ্যমের দর্শন হতে পারে না।তারা কি একবারের জন্যেও কি ভেবে দেখে না ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে ফাঁসীর সংবাদ প্রচার শিশুর সুস্থ মনোবিকাশের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে একটি সুস্থ জাতি গঠন দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। আজকের ইউরোপ যে সারা বিশ্বে সভ্যসমাজের প্রতিনিধিত্ব করছে এ পর্যায়ে আসতে তাদের দীর্ঘ পথ পরিক্রম করতে হয়েছে। এর পিছনে সমাজের সকল দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানসমূহগুলো ভূমিকা রেখেছে। গণমাধ্যমগুলোও এর বাইরে ছিলো না। প্রতিক্রিয়াশীল গণমাধ্যম একটি সমাজকে ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়াশীলতার দিকে ধাবিত করে। অনেকে হয়ত ভাবতে পারেন আমি স্বাধীন সংবাদ প্রচারের বিরুদ্ধে।
বস্তুতঃপক্ষে আমি যেকোনো সংবাদ স্বাধীনভাবে প্রচারের পক্ষে কিন্তু আমার ব্যক্তিগত রিজার্ভেশন হচ্ছে , স্পর্শকাতর সংবাদ প্রচারের একটি মাত্রা থাকতে হবে। কিভাবে তা আমরা দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করব , তা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর , বিভিন্ন বয়সের দর্শকদের মনোবিকাশের উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে কিনা সে বিষয়টি অবশ্যই ভাবতে হবে।
এপ্রেক্ষিতে আর একটি উদাহরণ দিলে আরো পরিস্কার হবে। হত্যার অভিযোগে সম্প্রতি শাস্তিপ্রাপ্ত ঐশীর সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি কিভাবে টিভি চ্যানেল গুলি হুমরি খেয়ে পড়েছে। একটি টিনএজ মেয়ের সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে যে আরো সচেতন হওয়া উচিৎ ছিলো তা আমরা তাদের কাছ থেকে দেখেনি। বরং মাঝে মাঝে মনে হয়েছে ঐশীর শরীরের অংশ দেখানোতেই যেনো অধিক আগ্রহ। তাই বার বার তারা একই সংবাদ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখায়।অথচ যখন নাগরিক হিসেবে ঐশীর শিশু অধিকার পুলিশ বাহিনীর প্রভাবে কেড়ে নেয়া হলো তখন কিন্তু টিভি মাধ্যমগুলোকে জোরালো কোনো ভূমিকা রাখতে।
পূণশ্চঃ একটি সমাজ সামনে এগিয়ে যায় একটি দর্শনের মাধ্যমে , আর সমাজের সেই দর্শন বিকাশে প্রধান ভূমিকা রাখে গণমাধ্যম। তবে গণমাধ্যম তখনই সমাজের দর্শন বিকাশে ভূমিকা রাখবে যখন সে নিজে তার জন্য প্রযোজ্য দর্শন লালন করবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:০৭